#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
“১২”
__________________________________
জাইফ চোখ মুখ লাল করে খুবই যত্ন করে যীনাতের পায়ে বরফ ডলে দিচ্ছে আর যীনাত কিছুক্ষণ পর পর ব্যথায় ভ্রু কুচকাচ্ছে। নিচে থেকে চিৎকার-চেঁচােমেচির শব্দ কানে ভেসে আসছে যীনাতের। যীনাতের এগুলো সহ্য না হওয়ায় জাইফকে বলে,”শুনুন!”
জাইফের কোনো উত্তর নেই। যীনাত বুঝতে পারে জাইফ তার উপর রেগে আছে তবুও বলে,”দেখুন শুধু শুধু চেঁচামেঁচির কোনো মানে হয়না আপনি ওদের বলুন যেনো দাদীর সাথে কোনোরকম তর্ক না করে।”
– জাস্ট শাট আপ যীনাত! এতো সহজ সরল হওয়াও ভালো না। তুমি ভাবতে পারতাসো আজ সিঁড়ি থেকে পরে গেলে তোমার অবস্থা কি হতো? তবুও বলছো ঠাম্মিকে কিছু বলতে না? আমাকে তো তখন কিছু বলতে দিলা না এখন ওরা বলছে বলুক না!!
– আমি জানি আপনি আমার উপর রেগে আছেন। কিন্তু কেন ঠাম্মির দিকটা বুঝে উঠতে পারছেন না? আমি যতোটুকু বুঝেছি ঠাম্মি তার স্বামী এবং সন্তানের শোকে এমন হয়ে গেছে। পারলে দাদু বা আঙ্কেল কে জিজ্ঞেস করুন! তার সাথে মিশুন, মন খুলে কথা বলুন ঘুরাঘুরির মাঝে রাখুন দেখবেন সব ইন শা আল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে। আর দাদুর থেকে যতোটুকু শুনেছি আর বুঝেছি আপনি অনেক ঠান্ডা স্বভাবের এবং চিন্তা-চেতনাও আছে। তাই রাগের মাথায় কিছু করবেন না সেটা আপনার প্রতি আমার বিশ্বাস।
যীনাতের মুখে “বিশ্বাস” শব্দ টা শুনে জাইফ যেনো বরফের মতো গলে গেলো। সত্যিই কি যীনাত তাকে বিশ্বাস করে?
– তুমি আমাকে সত্যি-ই বিশ্বাস করো?
যীনাত মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো। জাইফ একটা টেডি স্মাইল দেয়। তারপর যীনাতের পায়ে বরফ ডলে বরফের ব্যাগ টা নিয়ে জাইফ নিচে থেকে আসে যীনাতের জন্য খাবার নিতে। নিচে এসে দেখে দেবনাথ দেব আর রিকেশ কমলা দেবীর সাথে কথা কাটাকাটি করছে আর আনুস্কা সাইডে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। সে দেবনাথ দেবের জন্য চুপ করে আছে। যতোই হোক হবু দাদাশশুড় বলে কথা তার সামনে তার বোনকে কিছু বলা নিশ্চয়ই ভালো দেখাবে না। নইলে আনুস্কা চুপ থাকার মানুষ না। জাইফকে দেখতেই দেবনাথ দেব বলে,”তোমাকে আগেই বলেছিলাম কমলাকে এখানে এনো না।”
জাইফ কারো সাথে কোনোরকম কথা না বলে কিচেনের দিকে চলে গেলো। গিয়ে দেখে তার মা মল্লিকা দেবী মুখ গোমড়া করে রান্না করছে আর পাশে মিনি তাকে সাহায্য করছে। জাইফ বরফের ব্যাগ টা রেখে মল্লিকা দেবীকে বলে,”মা প্লেটে খাবার সাজিয়ে দাও তো!”
– কেন?(অবাক হয়ে)
– যীনাতের জন্য। পায়ে ব্যথার জন্য আগেই খাওয়া উচিত। খাওয়ার পর কিছু মেডিসিন নিতে হবে তাহলে পায়ের ব্যথাটা মোটামুটি কমবে।
– ওহ হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস! মিনি খাবার রেডি কর।
মিনি মাথা নাড়িয়ে খাবার বাড়তে শুরু করে একটা প্লেটে। মল্লিকা দেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”মেয়েটা মাত্রই স্বাভাবিক হলো আর এমন সময়ই এই বিপদ চলে আসে। পিসির আর বুঝ হলো না”
– হবে বলেও মনে হয়না। সে যাইহোক তোমাদের আর ওনাকে চিন্তা করা লাগবে না আমি আছি তার চিন্তা করার জন্য।
বলেই খাবারটা নিয়ে যীনাতের রুমে চলে গেলো। এখন জাইফের মাথায় কি চলছে সেটা একমাত্র জাইফই ভালো জানে। জাইফ দেবনাথ দেব আর রিকেশকে চেচামেচি করতে নিষেধ করে উপরে চলে গেলো। কমলা দেবী এখনো রাগে ফুসছে তার আধিপত্য কি আর হবে না?
জাইফের হাতে খাবার দেখে যীনাত জিজ্ঞেস করে,”খাবার কার জন্য?”
– এখানে তোমাকে ছাড়া তো আর কাউকে আমি দেখছি না।
যীনাত হাসলো তারপর বলে,”এই অসময়ে খাবার কেন?”
– অসময়ে পায়ের বেহাল অবস্থা করেছেন তাই অসময়টা ঠিকসময় আপাতত বলা যায়।
যীনাত মুখ গোমড়া করে বলে,”খোটা দিচ্ছেন আমায়?”
জাইফ নিঃশব্দে হেসে বলে,”খোটা কেন দিতে যাবো? যাইহোক হা করুন আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
যীনাত অয়াবক হয়ে বলে,”আপনি খাইয়ে দিবেন মানে কি? আমার হাত আছে আমি-ই খেতে পারবো।”
– উহু আমি খাইয়ে দিবো।
বলেই এক লোকমা জোর করে যীনাতের মুখে পুরে দিলো। যীনাত চাবাতে চাবাতে বলে,”আমার পায়ে চট লেগেছে হাতে না তাহলে এগুলোর মানে কি?”
– “মানে” শব্দ টা সবজায়গায় খাটে না বুঝলে। আর আমি কোনো পরপুরুষ না যে তোমাকে খাইয়ে দিতে পারবো না। আমি তোমার হাসবেন্ড তাও ইসলামিক রীতিতেই।
বলেই আরেক লোকমা মুখে পুরে। যীনাত ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে বলে,”উহ! আসছে আমার হাসবেন্ড জীবনে একসাথে নামাজ পড়লো না আবার অধিকার দেখাতে আসে!”
– শিখিয়ে দাও ঠিকই পড়বো একসাথে!
যীনাত চোখদুটো বড় বড় করে বলে,”মানেহ? আপনি তো অন্য ধর্মা…”
– তুমি আসলেই বোকা। এতো হাদিস জানো এইটা জানো না যে কোনো অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করা জায়েজ না? তাইতো আমি গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছি আর তার এক সপ্তাহ পরেই তোমায় বিয়ে করেছি!!
যীনাত চোখ বড় বড় করে জাইফের দিকে তাকায়। কি বলছে সে এসব?
– শুধুমাত্র আমাকে বিয়ে করার জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছেন?
– বলা যায় তাই! দাদুও অমত করেনি বরং জোর করেছে। আমি বুঝিনি কেন তবে সে বললো সঠিক সময়ে জানতে পারবো কিন্তু সেই সময় কবে আসবে তা আমি জানিনা!!
যীনাত অবাক হয়ে জাইফের দিকে তাকায় আর ভাবে জাইফের সাথে তার অতীতের কোনো সম্পর্ক নেই তো অথবা তার জীবনের সাথে? নাহলে ঘুরে-ফিরে এতো বাধা বিপত্তির পরেও কি করে সেই জাইফের সাথেই তার বিয়ে হলো? বিষয়টা অনেক ভাবাচ্ছে যীনাতকে! আচ্ছা দাদু কি তাকে সত্যি টা বলতে পারবে? হ্যাঁ এখন তার দাদুই একমাত্র ভরসা।
– কোথায় হারিয়ে গেলে? খাও জলদি মেডিসিন তো নিতে হবে নাকি?
যীনাতের ধ্যান ভাঙতেই সে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। খাওয়া শেষে মেডিসিন খাইয়ে জাইফ চলে যেতে নিলে যীনাত আটকিয়ে বলে,”আজ আমার সাথে নামাজ পড়বেন?”
জাইফ পিছে ফিরে বলে,”তোমার না পায়ে ব্যথা?”
– ও কিছু হবে না। আপনি যোহরের আযানের সময় পুরোপুরি পরিপাটি হয়ে আমার রুমে চলে আসবেন একসাথে নামাজ আদায় করবো।
জাইফ যেনো খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। তারপর নিজের সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো। যীনাত খুব খুশি হয় এই ভেবে নিজের স্বামী অন্য ধর্মের নয় আর জাইফের প্রতি তার আরও হাজারগুণ ভালোলাগা কাজ করছে। সত্যি-ই জাইফ অনেক দায়িত্ববান এবং সুশীল একজন যুবক। আল্লাহ-র দরবারে সে আরও গভীরভাবে শুকুরিয়া আদায় করার জন্য একসাথে নামাজে দাঁড়াবে এবং দুজনের আগমন বিপদ হতে রক্ষা পেতে সাহায্য চাইবে।
যোহরের সময় জাইফ পুরো পরিপাটি হয়ে যীনাতের রুমে প্রবেশ করে এবং দরজা লক করে দেয় যাতে কেউ যীনাতের ঘরে খোঁজ করতে আসলে তাকে নামাজরত অবস্থায় না দেখতে পায়।সেইসময় যীনাত খুড়িয়ে খুড়িয়ে ওযু করে ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছিলো। জাইফকে দেখে একদম হা হয়ে যায়। সাদা পাঞ্জাবি আর টুপিতে জাইফকে কোনো রাজপুত্রের থেকে কম সুন্দর লাগছে না। একটা ছেলে কি করে এতোটা সুন্দর হতে পারে তা যীনাতের অজানা। জাইফ যীনাতের হাত ধরে নিয়ে বিছানায় বসালো। যীনাত ভালো করে ওড়না মাথায় পেচিয়ে নেয়। জাইফ কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে বলে,”নামাজ পড়তে পারবে তো ঠিকমতো?”
যীনাত মুচকি হাসি দিয়ে মাথা নাড়ায় যে সে পারবে! যীনাতের মুচকি হাসিটা যেনো জাইফের কলিজা ঠান্ডা করে দেয়। যীনাত জাইফের সাহায্যে জায়নামাজ টা বিছিয়ে নেয় কিন্তু এক জায়নামাজে কি করে দুইজন নামাজ আদায় করবে? পরে উপায় না পেয়ে জাইফকে জায়নামাজ দিয়ে ওড়না দিয়ে নামাজে দাঁড়ালো যীনাত এবং জাইফকে অক্ষরে অক্ষরে শিখিয়ে দিলো কিভাবে কি করতে হবে। জাইফও যেনো খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে শিখে ফেলে। যীনাত অবাক না হয়ে পারলো না যেনো জাইফ আগেও নামাজ আদায় করেছে! সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে একসাথে নামাজ আদায় করে। যীনাত এবং জাইফ উভয়ের মনেই যেনো এক অজানা ভালোলাগা কাজ করছে কিন্তু কেউ-ই প্রকাশ করে না।
★
জাইফ কারো সাথে কথা বলতে বলতে কমলা দেবীর রুমে গেলো। তখন কমলা দেবী পান মুখে পুরে নিচ্ছিলো। জাইফ কিছু না বলেই কমলা দেবীর কানে ফোন দিয়ে বলে,”কথা বলো!”
কমলা দেবী কানে ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে কিছু কথা বললো যার কারণে কমলা দেবীর হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো। পড়ে যাওয়ার আগে জাইফ খপ করে ফোন টা ধরে ফেলে। কমলা দেবীর এতোদিকে হুস নেই সে এক দিকে তাকিয়েই কেঁদে চলেছে। জাইফের খারাপ লাগলেও কিছু বলেনা চুপ থাকে কিন্তু তবুও নিজেকে শক্ত করে বএল,”আশা করছি এবার থেকে এমন কিছু করবা না যেটা অন্যের মনে আঘাত হানে!”
বলেই জাইফ চলে গেলো।
সেদিনের পর থেকে কমলা দেবী চুপ করে থাকে কারো সাথে আগের মতো অন্যায় আবদার করে না তবে সকলেই তাকে সময় দেয় তার সাথে সুখ অসুখ শেয়ার করে। এমনকি একেকজন একেকবার তাকে ঘুরতেও নিয়ে যায়। কমলা দেবী কোনো কারণে কষ্টে ভুগলেও সবার এতোটা মিশামিশিতে সে প্রাণখুলে হাসে মিশে তবে আগের মতো অন্যায় কিছু করে না। সে এখন নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। তার এতোদিনের ভালোমানুষী কোনো এক জায়গায় হয়তো হারিয়ে ফেলেছিলো নিজের অজান্তে কিন্তু সে তা ফিরে পেয়েছে। এমনকি যীনাতের কাছেও সে ক্ষমা চেয়েছে! দেব পরিবারে যেনো খুশির আমেজ! এই খুশিতে আরও এক খুশি নিয়ে আসলো সেটা হলো রিকেশের বিয়ে! রিকেশের বিয়ের কিছুদিন আগে কমলা দেবী আড়ালে জাইফকে বলে,”এইবারও কি আইবো না আর উপ্রে রাগ কইরা? আই তো ভালা হইয়া গেসি!”
জাইফ উত্তরে শুধু মুচকি হাসি দেয় এবং বলে,”আসবে গো ঠাম্মি সাথে তোমার জন্য আরেকটা সারপ্রাইজও আছে।!”
“সারপ্রাইজ” শুনে কমলা দেবীর মুখ খুশিতে চিকচিক করে উঠে। জাইফ নিঃশব্দে হাসলো।
———————————–
চলবে!!!
(তোহ? গঠনমূলক মন্তব্য পাবো কি?)