ওয়ারদূন আসরার পর্ব-১১

0
1167

#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
“১১”
__________________________________
– আচ্ছা দাদু আপনার সাথে দাদীকে তো দেখি না সে কোথায়?

দেবনাথ দেব শুকনো একটা হাসি দিয়ে বলে,”উর্মিলা আরও ৭ বছর আগে মারা গেছে।”

দেবনাথ দেবের কথা শুনে মুহূর্তেই যীনাতের মন খারাপ করে ফেলে। দেবনাথ দেব মুচকি হেসে বলে,”আমার জীবনের কাহীনি শুনবে?”

যীনাত কাধ থেকে মাথা উঠিয়ে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলে,”হ্যাঁ শুনবো বলুন!”

দেবনাথ দেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলা শুরু করে,”যখন ভার্সিটি লাইফে ছিলাম তখন এক মুসলিম মেয়েকে বেশ মনে ধরেছিলো। কিন্তু মেয়েটা ছিলো এতিম। তার ভাইকে নিয়েই ছিলো তার পরিবার। খুবই কষ্টে অর্থ উপার্জন করে কোনোরকমে সংসার চালাতো। মেয়েটার করুণ অবস্থা দেখে সকলেরই কমবেশী নিজেদের অজান্তেই চোখে জল চলে আসতো। আমার বেলাতেও ব্যাতিক্রম হয়নি। আমি মেয়েটাকে ভালোবাসতাম এবং তখন তাকে চাইছিলাম নিজের করে নিতে তাকে ওভাবে আর কষ্টে দেখতে পারতাম না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম মেয়েটিকে বিয়ে করবো। কিন্তু তার আগেই আমার পরিবার জেনে যায় আমি এক মুসলিম মেয়েকে পছন্দ করি। সেদিন বাবা-মা তাদের দিব্বি কেটে বলেছিলো যেনো আমি আমার মরণের আগ পর্যন্ত অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ না করি। তাই হলো আমি আর মেয়েটার মুখোমুখি হলাম না। কিছুদিনের মাঝেই খুবই ঘরোয়াভাবে উর্মিলার সাথে আমার বিয়ে সম্পূর্ণ হয়।”

– তারপর? ওই মেয়েটা?

– আমার বিয়ের তিন বছর পরে মেয়েটাকে কারা যেনো র‍্যাপ করে ডোবায় ফেলে দেয়। আর তার ভাই বোনের এমন মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

বলেই থামলেন দেবনাথ দেব। যীনাতের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। ইশশশ মেয়েটা কতোই না কষ্ট করেছে জীবনে তবুও ভাগ্যের কেমন লীলাখেলা। সবটাই যে আল্লাহ-র কাছে! তার হাতেই সব।

যীনাত অনেকক্ষণ ধরেই জাইফকে আশেপাশে দেখছে না কিন্তু কেন কোথায় সে তা জানেনা। জাইফের কি একবারও তার কথা মনে পড়ছে না? একবারও কি মনে পড়ে না যীনাতের সাথে তার একবার হলেও দেখা করা উচিত? একরাশ অভিমান ভর করলো যীনাতের মনে জাইফের জন্য। দেবনাথ দেব কে কিছুটা ইতস্ততবোধ থেকে বলে,”আচ্ছা দাদু ‘উনি’ কোথায়?”

দেবনাথ দেব প্রথমে বুঝতে পারেনা এই ‘উনি’ টার মানে। পরে বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বলে,”রিকেশের সাথে কমলার কাছে গেছে কমলাকে নিয়ে আসতে!”

কমলা দেবী আসবে শুনে যীনাতের খুশি দেখে কে।

– দেখো ঠাম্মি তোমাকে ওই বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি ঠিকি কিন্তু একদম ভদ্রভাবে থাকবা।(জাইফ)

– ওই ছ্যাড়া তুই আর ছোড হইয়াও আরে শিখাস আই কোনহানে কিরাম ব্যবহার করুম!

– হ্যাঁ শেখাবো দরকার হলে তাও করবো। তবে যা বলছি তা অক্ষরে অক্ষরে শুনো নইলে চান্দু তোমার কপালে ঠ্যালাঠ্যালি লাগবে।(জাইফ)

– ও ঠাকুর গো কি দিন দেহাইলা এমন কচি পোলায় কিনা আরে ধমকায়। দড়ি ফেলাও আই উইঠা যাই গোওওও।

– দেখো ঠাম্মি তোমার এইসব ন্যাকামি আমার সামনে করবা না। এতোই উপরে যাওয়ার সখ হলে আমাকে বলো আমি তোমাকে উপরে পাঠানোর ব্যবস্থা করি কি বলো?(জাইফ)

– মানেহ? ও সোয়ামি তুমি এইডা কইলা কিতা তুমি আরে উপরে পাঠাইবা?(অবাক হয়ে)

– দরকার হলে তাই।

বলেই জাইফ প্যাকেটের থেকে ইনজেকশন টা বের করলো। ইনজেকশন দেখে কমলা দেবীর যায় যায় অবস্থা। এসির মাঝেও তিনি গড়গড় করে ঘেমেই চলেছে। কমলা দেবীকে ঘামতে দেখে রিকেশ হেসে বলে,”বুঝলি ভাই আমাদের ঠাম্মির ঘামানোর রোগ হইসে তারে ইমিডিয়েটলি চেকআপ করাতে হবে!”

– চেকাপ করানোর কি আছে আমার হাতের এই মেডিসিন দিয়েই ঠাম্মির সব ভিমরতি ছাড়াবো কি বলো কমলা রানী?

– এএএএইই নানানানানানা আরে এইডি দেওন লাগতো না আই সব কথা হুনুম!!

– এইতো বুড়ী আসছে লাইনে।

বলেই রিকেশ হেহে করে হেসে দিলো। তারপর দুই ভাই মিলে কমলা দেবীকে বাড়িতে নিয়ে আসে। কমলা দেবীকে আসতে দেখে মল্লিকা দেবী তার সেবা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিচে চেঁচামেচির শব্দ শুনে যীনাত নিজের ওড়না ঠিক করতে করতে রুম থেকে বের হতে নিলো ওমনি জাইফের সাথে বড়সড় ধাক্কা খায়। তাল সামলাতে না পেরে যীনাত পড়ে যেতে নেয় তার আগেই জাইফ যীনাতের কোমড় ধরে তাকে পরে যাওয়ার হাত থেকে বাচায়। যীনাত ভয়ে ততোক্ষণে চোখ মুখ খিচে ছিলো। জাইফ মুগ্ধ নয়নে যীনাতের ভীতু ফেস টা দেখছে। যীনাত পড়লো না ভেবে পিটপিট করে তাকালো এবং দেখলো জাইফ তাকে ধরে আছে। যীনাত সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ায় এবং নিজেকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করছে। জাইফ যীনাতের দিকে তাকিয়ে দেখে যীনাত কেমন যেনো লাল হয়ে আছে। কিন্তু কেন? এভাবে হঠাৎ লাল….এক মিনিট যীনাত কি লজ্জা পেয়েছে? ভেবেই মুচকি হাসে জাইফ তারপর গলা পরিষ্কার করে বলে,”দেশেশুনে চলাফেরা করো নইলে এখন পরে কোমড় তো ভাঙতে।”

যীনাত প্রচুর লজ্জায় বলে,”পরে থেকে খেয়াল রাখবো।”

জাইফ মুচকি হাসলো তারপর বলে,”কোথায় যাওয়া হচ্ছিলো?”

– নিচে সোড়গোল শুনলাম তাই….

– এখন যাওয়ার প্রয়োজন নেই তুমি ঘরেই থাকো।

– হুম।

জাইফ চলে গেলো নিজের রুমে। যীনাত থামায় নি কি-ই বা বলে থামাবে?

আনুস্কা রিকেশের সাথে নিকেশ ম্যানশনে আসলো। আনুস্কা প্রথমে সকলকে সালাম করে। কমলা দেবীকে প্রনাম করতে গেলেই সে কিছুটা পিছে ফিরে যায়। এতে আনুস্কা নিঃশব্দে হাসলো কারণ সে ভালো করেই জানে কমলা দেবী কিরকম। নিকেশ, দেবনাথ দেব আনুস্কার সাথে দেখা করেই যে যার কাজে চলে যায়। আনুস্কা সেই ফাকে বলে,”ঠাম্মি গুরুজনদের পা ছুয়ে প্রনাম করতে হয় জানেনা না?”

কমলা দেবী তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলে,”ওই ছ্যাড়ি আরে এইডি কস ক্যান? তোর কাছে কি আই কৈফিয়ত চাইসি চেন্না মাইয়া!”

– আমি চেন্না হইলে আন্নেও চুন্না বুড়ি!

– কি কইলি তুই আরে? তোরে তো আই বেগুন দিয়া ধুমু।

– তুমি আমারে বেগুন দিয়া ধুইলে আমি তোমারে বেগুনের সাথে ভাজমু!

– আচ্ছা বেয়াদব মাইয়া তো তুই! ওই রিকু এই বেয়াদবটারে তুই বিয়া করিস না মারা পড়বি!

– ওই বুড়ী তুমি এখন আমার বরের দিকে নজর দিসো ক্যান? আমি বিয়া করমুই এই বাড়ির বড় বউ আমি হমুই হইয়াই তোমারে জম্মের শিক্ষা দিমু!! তোমার মতো ত্যাড়া রে সোজা করার ল্যাইগা আমি একাই যথেষ্ট।

রিকেশ হা করে আনুস্কার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে তো দেখছি কমলা দেবীর থেকেও ড্যাঞ্জারাস!! যাক কমলা দেবীর অন্যায় আবদার তাহলে আনুস্কাই কমাতে পারে!

– ওই ছ্যাড়ি কি কইলি তুই? আই ত্যাড়া? তুই ত্যাড়া তোর চৌদ্দগেরাম ত্যাড়া ফইন্নি। রাস্তার মাইয়া হইয়া আরে ধমকাস এত্তো বড় সাহস!!

– সাহসের দেখলা কি তুমি বুড়ী। বিয়ে হয়ে আসতে দাও তারপর দেখো ঠ্যালার নাম বাবাজী কারে কয়।

বলেই আনুস্কা রিকেশের কাছে এবং বলে যেনো রিকেশের রুম দেখায়। রিকেশও বাধ্য হয়ে নিজের রুমে আনুস্কাকে নিয়ে গেলো। আর কমলা দেবী এদিকে রাগে ফুসতে লাগে। যেভাবেই হোক আজ আনুস্কাকে সে শাস্তি দিয়েই ছাড়বে। এমন শাস্তি দিবে যে আনুস্কা দ্বিতীয়বার আর এই মুখো হবে না। এমন কিছু শয়তানি বুদ্ধি কমলা দেবী ভাবতে থাকে। যেহেতু জাইফ এখন নিজের রুমে সেহেতু কমলা দেবীকে কেউ কিছু বলতে পারবে না। কমলা দেবীর হঠাৎ নিজের পায়ে দেয়ার সরিষার তেলটার কথা মনে পড়ে। কাউকে কিছু না বলে তিনি হেটে হেটে নিজের রুমে যায় এবং তেলের বোতল টা নিয়ে আসে। তেলের বোতলের মুখ খুলে সিঁড়ির দিকে যায় এবং এক সিঁড়িতে তেল ঢেলে দেয় যেনো আনুস্কা পরে নিজের কোমড় ভাঙে।

খুবই গোপনে সব কাজ সেরে মিনিকে ডাকে যেনো তার পায়ে তেল মালিশ করে দেয়। মিনিও কমলা দেবীর কাছে বাধ্য হয়ে তেল মালিশ করা শুরু করে। কমলা দেবী কিছুক্ষণ পর পর হাসছে যা মিনির চোখ এড়ালো না। দুর্ভাগ্যবশত সেই তেলের সিড়িতে যীনাত পা পিছলিয়ে পড়ে যায়। ভাগ্য ভালো সিড়ি থেকে পড়ে যায়নি তার আগেই রেলিং ধরে নিজেকে সংগত করেছে যীনাত। তবে পায়ে ভিষণভাবে চোট পেয়েছে যীনাত। কমলা দেবী সিড়ির দিকে তাকিয়ে বেক্কল বনে গেলো। তার বাধা ফাদে দেখছি যীনাত এসে সব লন্ডভন্ড করে ছাড়লো! তবুও কমলা দেবী হাসলো এই ভেবে যীনাতের উপরও শোধ নিতে পেরেছে। মিনি যীনাতের অবস্থা দেখে যেই যেতে নিবে তার আগেই বলে,”ওই ছ্যাড়ি যাস কই? আগে আর পায়ে তেল মালিশ কর তারপরে যা মন চায় করিস!”

– কিন্তু দিদিমনি?

– হেরে দেহার ল্যাইগা মানুষ আছে তুই কাম কর!

কোনো “ধরাম” শব্দ শুনে সবাই সিঁড়ির দিকে আসে। জাইফও রুম থেকে বেরিয়ে আসে কিসের শব্দ তা দেখার জন্য। এসে যা দেখে তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। জাইফ একপ্রকার ছুটে যায় যীনাতের কাছে পিছে রিকেশ আর আনুস্কাও। যেই তেলের সিঁড়িতে পা দিবে তার আগেই যীনাত জাইফকে থামিয়ে দেয় এবং বলে,”এখানে তেল আছে সাবধানে নামুন!”

———————————

চলবে!!!

(গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে