এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-৩+৪

0
1237

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ৩+৪
সামান্য লজ্জা বোধ নেই অর্কর, এতো বড় ঘটনা ঘটানোর পরেও বিন্দুমাত্র লজ্জিত নয় ও, মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছিলো অদিতির। কাল রাতে কতো বার ফোন করেছে ও অর্ক কে, মেয়েটার কথাগুলো শোনার পর থেকেই অর্কর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে ও, একবারের জন্যেও ফোন ধরেনি ও, নিশ্চয়ই নিজের সুবিধার জন্যেই ইচ্ছা করেই সাইলেন্ট করে রেখে দিয়েছিলো। আর বলে কিনা, ও ফোন খুঁজে পাচ্ছিলো না, ওই টুকু ফ্ল্যাটের মধ্যে ফোন হারিয়ে গেলো, আবার সকালেই পেয়েও গেলো সেটা!

নিজেকে বেশি চালাক ভাবে ও, অদিতি কি বোকা নাকি! যা বোঝাবে তাই বুঝবে ও! আর কিচ্ছু জানতেই চায়না ও মেয়েটার সম্বন্ধে, যা বোঝার ও সবটাই বুঝে গিয়েছে। যাতে অদিতি কাল রাতে যোগাযোগ করতে না পারে সেইজন্যেই এই প্ল্যান, অর্ক কে যতটা সহজ সরল ও ভাবতো ততটা নয় ও, এখন ও সেটা বেশ টের পাচ্ছে।

এতো চিৎকার করছিস কেনো? নিজের শরীর খারাপ হয়ে যাবে তো! বাচ্চা টার কথাটাও একটু ভাব,

শাশুড়ির গলার আওয়াজে নিজেকে সামলালো দিতি, ও কি খুব জোরে চিৎকার করে ফেলেছে! উনি কি কিছু শুনতে পেলেন!

ফোন ধরেনি নাকি? দাঁড়া, আজ আমিও বলবো ওকে, খুব খারাপ অভ্যাস,

শাশুড়ির কথায় একটু হাসলো দিতি, নিজের ভেতরের চলা তোলপাড় টা কে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। মা যদি বুঝতে পারে, তাহলে এতো সহজে ছেলে কে ছেড়ে দেবে না, সেটা দিতি ভালো করেই জানে। কিন্তু এটা একান্তই ওদের দুজনের সমস্যা, কোনো প্রমাণ ছাড়া অর্কর সম্বন্ধে অভিযোগ আনা যে হাস্যকর, এটা ও ভালোই জানে, তাই এই মুহূর্তে অন্য কারোর এই ব্যাপারে ঢুকে পড়া ও চাইছে না। যা করার ও নিজেই করতে পারে, এত দুর্বল ও নয়!

ঘন্টা খানেক ফোন বন্ধ করে রাখার পর থেকেই মন টা খারাপ লাগতে শুরু করেছে। যতই হোক, অদিতির শরীর খারাপ, এই অবস্থায় হয়ত একটু বেশি রাগ দেখিয়ে ফেলেছে, তাই বলে ওর তো নিজের মাথা টা ঠান্ডা রাখা উচিত। কিছুক্ষন ভাবার পরে রাগ টাও কমে আসছে আস্তে আস্তে, ফোন টা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে অন্ করে রাখলো অর্ক। ও নিজে থেকে কিছুতেই করবে না আর, কিন্তু দিতি করলে অন্তত ধরতে পারে যাতে।

নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছে ওর, এতো ভুলো মন যে ওর কি করে হলো! রান্না ঘরে গ্যাসের ওভেনের তলায় কি করে ফোন টা রেখে এলো ও, কিছুতেই মনে করতে পারছিলো না। সোফার ওপর থেকে ওটা তো আর পায়ে হেঁটে ওখানে যায় নি, নিশ্চয়ই ওই রেখেছে, অন্যমনস্ক হয়ে কখনো। তাও তো খুঁজে পেতোনা, যদি না সকালে চা করতে গিয়ে গ্যাসের ওপর দুধ পড়তো, আর সেই দুধ মুছতে গিয়ে ওভেন সরাতে হতো!

দাদা চা, বৌদির শরীর কেমন আছে?

চায়ের ট্রে টা টেবিলে রেখে প্রশ্ন করলো রান্নার দিদি, একটু হাসলো অর্ক।

হ্যাঁ, ভালো আছে। আচ্ছা দিদি, কাল তুমি রাতে রান্না করে গ্যাস মুছে ছিলে?

অর্কর প্রশ্নে একটু অবাক হলো সরমা, এ আবার কি প্রশ্ন! দাদা এতো সংসারী কবে থেকে হলো আবার! সরমা কে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে অস্বস্তিতে পড়লো অর্ক, প্রশ্ন টা একটু অদ্ভুত হয়ে গেছে, নিজেই বুঝতে পারছে সেটা।

আসলে আমার মোবাইল টা কাল থেকে পাচ্ছিলাম না, আজ সকালে ওটা গ্যাসের তলায় পেলাম, তাই জানতে চাইছিলাম,

নিজের থেকেই বললো ও, সরমা একটু স্বস্তির শ্বাস ফেললো। বৌদি বোধহয় ওখান থেকেই নজর রাখছে এতক্ষন ওটাই ভাবছিলো মনে মনে, তাড়াতাড়ি বললো,

না দাদা, মুছেছিলাম তো, তখন তো তোমার মোবাইল ছিলো না ওখানে,

সরমা ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেলো। ও চলে যাবার পর থেকেই অস্বস্তি হচ্ছে, যদ্দূর মনে পড়ছে ও তো রাতে রান্না ঘরে যায়নি আর, একদম তো সকালে চা করতে গেলো। সরমা তো রাতের খাবার ডাইনিং টেবিলের ওপরে রেখে যায়, রান্না ঘরে যাবার তো প্রয়োজন পড়েনি আর। মোবাইল টা ওখানে গেলো কিভাবে, কিছুতেই মনে করতে পারছে না।

দরজা টা বন্ধ করে দাও দাদা,

সরমা র ডাকে হুঁশ ফিরলো অর্কর, দরজা বন্ধ করতে পেছন পেছন এলো ও,

আমি যাবার পরে কেউ এসেছিলো দাদা কাল? অনেকগুলো কফির কাপ দেখলাম সকালে বাসন মাজতে গিয়ে, ওই কফি করতে গিয়েই বোধ হয় মোবাইল রেখে এসেছিলে,

বলতে বলতেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো সরমা, ওর এখন দাঁড়িয়ে দাদার মোবাইল হারানোর রহস্যভেদ করার সময় নেই। আরও চারটে বাড়ির কাজ পড়ে আছে এখনো, নেহাত বৌদি নেই তাই এ বাড়িতে এখন একটু বেশি সময় দিতে হচ্ছে। নাহলে এতক্ষনে আরও দু বাড়ি সেরে ফেলতো ও!

কফি করতে গিয়ে! একটু অন্যমনস্ক হয়েই দরজা বন্ধ করে ঘরের সোফায় এসে বসলো অর্ক। কাল ওর বেশ কয়েকজন ছাত্র ছাত্রী এসেছিলো, তারাই কফি করেছিলো। ও ও অবশ্য বার দুয়েক গিয়েছিলো বিভিন্ন জিনিস দেখিয়ে দিতে, তাহলে তখনই ফেলে এসেছিলো নিশ্চয়ই।

যুৎসই একটা কারণ খুঁজে বার করতে পেরে মনের অস্বস্তিটা দূর হয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ, কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে, আর বসে না থেকে উঠে পড়লো অর্ক। দিতির সঙ্গে কথা এখন আর বলবে না বলেই ঠিক করে নিলো ও। এখন ওর মাথা গরম হয়ে আছে, কলেজ থেকে ফিরতে ফিরতে ঠান্ডা হয়ে যাবে, সন্ধ্যেবেলায় নিশ্চিন্তে বসেই কথা বলবে একদম।

সন্ধ্যে বেলা অর্কর সঙ্গে রাগারাগি করার পর থেকেই শরীর টা সত্যিই খুব খারাপ লাগছে, বিছানায় চুপ করে শুয়ে ছিলো দিতি। নাহ! অর্কর জন্যে নিজের বাচ্চার ও ক্ষতি করতে পারবে না, জাহান্নামে যাক অর্ক, ও আর কিছুতেই মনের মধ্যে অশান্তি আনতে দেবে না।

ডাক্তার ওকে বার বার বলে দিয়েছেন চিন্তা না করতে, নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো দিতি, মনের মধ্যে জমা হয়ে থাকা দুশ্চিন্তা গুলো সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগলো। আগামী কয়েক মাস ও শুধু নিজের বাচ্চার কথাই ভাববে, অর্কর ব্যাপারে ডিসিশন নেওয়ার জন্যে সারাজীবন পড়ে রয়েছে। কিন্তু বাচ্চা র কোনো ক্ষতি হয়ে গেলে ও নিজেকেই ক্ষমা করতে পারবে না।

কাল সারা সন্ধ্যে কোথায় ছিলো অর্ক, ও জানতেই পারলো না একদম। বাড়িতে ছিলো বললেই ও বিশ্বাস করবে কেনো? কোনো প্রমাণ আছে ওর কাছে? বাড়িতে থাকলেও যে একাই ছিলো এটা কি করে বুঝবে ও, না চিন্তা করতে চাইলেও শুধুই প্রশ্নগুলো ঘুরে ফিরে আসছে!

ফোন না ধরার মতো কি এমন পরিস্থিতি হয়ে ছিলো, সেটা না জানা পর্যন্ত শান্তি নেই। কিন্তু অর্কর বলা কথা বিশ্বাস করা ছাড়া আর কিই বা করার আছে ওর। ইসস, কেনো যে ও বিশ্রাম নেবার জন্যে এখানে আসতে গেলো, এখন নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছে!

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই চমক খেলে গেলো ওর মাথার মধ্যে, এতো কিছু ও ভাবছে কেনো? এই প্রশ্নের উত্তর তো ও এক্ষুনি পেতেই পারে, রান্নার দিদি কে ফোন করলেই তো জানা যাবে অর্ক কাল সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে ছিলো কিনা! দিদি তো রান্না করতে এসেছিলো কাল রাতে! মাথা টা ঠান্ডা করে সবটা ভেবে নিয়ে, ফোন টা হাতে তুলে নিলো ও, খুব কায়দা করে কথাটা জানতে হবে! দিদি কে ওর জিজ্ঞেস করার আসল কারণ কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না, তাহলেই এক্ষুনি পাঁচ বাড়ি গল্প করে বেড়াবে!

লাস্ট ক্লাস টা শেষ হলো চারটে নাগাদ, ক্লাস শেষ করে ও আর অরিন্দম কলেজ থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে সমর দা ডাকলেন। অর্কর সঙ্গে অরিন্দমের চোখাচোখি হলো, দুজনের কেউই বিশেষ পছন্দ করেনা সমরদা কে, কিন্তু সিনিয়র প্রফেসরের ডাক উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। ভদ্রলোক ওদের থেকে অনেকটাই সিনিয়র, কিন্তু কথা বার্তা সিনিয়র সুলভ নয়। সব ব্যাপারেই আগ বাড়িয়ে কমেন্ট করা ওনার স্বভাব, কলেজে নিজের ছাত্র ছাত্রীদের সম্পর্কেও উনি যে সব মন্তব্য করেন তা একদমই শিক্ষক সুলভ আচরণ নয়।

অর্ক চুপ করে থাকলো, অরিন্দম ঘাড় ঘুরিয়ে হাত নাড়লো, মুখে জোর করে একটু হাসি টেনে এনে বললো,

আরে! দাদা যে! ক্লাস শেষ হয়ে গেলো নাকি? মেট্রো ধরবেন তো? চলুন তাহলে,

সমর দাস পা চালিয়ে এগিয়ে এলো, অর্কর দিকে তাকিয়ে ভ্রু ভঙ্গি করে বললো,

মেট্রো ছাড়া আর কোথায় যাবো বলো! কিন্তু অর্ক বাবুর তো আমার কোম্পানি পছন্দ নয় বলেই মনে হচ্ছে! তোমরা বরং এগিয়েই যাও!

অর্ক তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লো,

আরে, না না! সেরকম কিছু নয়, চলুন চলুন একসাথেই যাই!

তিনজনে একসঙ্গে এসে মেট্রো স্টেশনে ঢুকলো। অরিন্দম অবিবাহিত, অর্কর বউ বাড়িতে নেই, তাই আজ কলেজ ফেরত দুজনে অরিন্দমের বাড়ি গিয়ে একটু আড্ডা মারার প্ল্যান হচ্ছিলো, কিন্তু এখন সমর দাসের উপস্থিতি তে সে প্ল্যান দুজনেই চোখের ইশারায় চেঞ্জ করে ফেললো।

ওরা যেখানে এসে দাঁড়ালো, তার পাশেই ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ছাত্রীরা জটলা করে দাঁড়িয়ে ছিলো, অরিন্দম ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো একটু। প্রত্যুত্তরে ওদের মুখেও হাসি ছড়িয়ে পড়লো, দু একটা টুকটাক কথাবার্তার পর সম্ভবত স্যরদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেই ওরা একটু পেছন দিকে এগিয়ে গেলো। যেতে যেতেই ওদের মধ্যে একজন অর্কর দিকে তাকালো,

স্যার, কাল আপনার বাড়িতে আমার সানগ্লাসটা ফেলে এসেছি,

অর্ক একটু চিন্তা করে বললো,

তাই নাকি! খেয়াল করিনি তো! আচ্ছা, খুঁজে পেলে কাল কলেজে নিয়ে আসবো,

ছেলে মেয়ের দল টা চলে যাবার পরে সমর দা ওর দিকেই ফিরলেন,

ওর নাম অনির্বাণ না? কাল তোমার বাড়ি গিয়েছিলো কি করতে?

অর্ক সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো,

হ্যাঁ, ওদের কিছু প্রবলেম ছিলো, তাই!

সমর দাসের মুখটা একটু গম্ভীর হলো। তাঁর মতো সিনিয়র প্রফেসর থাকতে এই অল্পবয়সী ছেলেদুটির স্টুডেন্ট মহলে এই জনপ্রিয়তা তাঁর একটুও পছন্দ নয়। কিন্তু কিছু করার নেই, চেষ্টা যে তিনি করেন নি তাতো নয়, কিন্তু এদের কে কিছুতেই কোণঠাসা করে উঠতে পারছেন না! এর মধ্যেই মেট্রো এসে গেলো, দুটো স্টেশন পরে অরিন্দম নেমে যেতেই অর্কর দিকে তাকালো সমর দাস,

দেখলে অরিন্দম কে! কি রকম যেচে যেচে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলছিলো! ছেলেটার একটা কিছু ব্যবস্থা কর ভাই, কলেজের মেয়েরা যে সব বিরক্ত হয়ে পড়ছে! এইচ ও ডি সেদিন বলছিলেন, অনেক কমপ্লেন আসছে কিন্তু!

অর্ক ভ্রু কুঁচকে তাকাল, অরিন্দম যথেষ্টই ভদ্র ছেলে, ওর নামে কমপ্লেন আসছে, এটা বিশ্বাস করা মুশকিল! এইচ ও ডি র নাম করে বলে দিলেই সব বিষয় আসলে খুব গুরুত্ব পেয়ে যায়! অর্ক খুব ভালো করেই জানে ওদের এইচ ও ডি একদম অন্য রকমের মানুষ, তাঁর কিছু বলার থাকলে সরাসরি অরিন্দম কেই বলতেন, এতো কথা ছড়াতেন না। সমর দার এইসব কথার জন্যেই সবাই ওনাকে এড়িয়ে চলে। ভদ্রলোকের যথেষ্টই বয়স হয়েছে, সব বয়সে সব কথা যে শোভা পায়না সেটা উনি বোঝেন না, অর্ক চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলো।

অর্ক কে চুপ করে থাকতে দেখে বোধহয় কিছু বুঝতে পারলেন ভদ্রলোক, আর এই প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে যেতে চাইলেন না। অর্কর স্টেশন এসে গেলো, একটা ছোট্ট আসছি বলেই মুখটা ইচ্ছাকৃতভাবেই গম্ভীর রেখে নেমে গেলো অর্ক।

স্যারদের কে দেখেই স্টুডেন্টদের দলটা মেট্রোর পেছনের দিকের একটা কামরায় উঠলো। সেটা অর্ক বা অরিন্দমের জন্যে নয়, তার একটাই কারণ সিনিয়র প্রফেসর সমর দাস।

এই সমর স্যার না! কি রকম চোখ ঘুরিয়ে দেখছিলো দেখলি!!

তিয়াসার কথা শেষ হবার আগেই অনির্বাণ খেই ধরে নিলো,

আরে ভাই! আমি বুঝবো কি করে, যে অর্ক স্যারের বাড়ি গেছি শুনেই ওর মুখটা ওই রকম হয়ে যাবে!

কৌশিক হেসে উঠলো, মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললো,

হেব্বি জেলাস ভাই! ক্লাসে এসেও খালি মেয়েদের দিকেই তাকিয়ে পড়ায়! আমরাও যে বসে আছি সেটা ওকে দেখলে মনে হয় না!

এই কথাটায় মেয়েরা কেও এগ্রি করলো না, রিয়া আর তিয়াসা দুজনেই প্রতিবাদ জানালো। তর্ক জমে ওঠার আগেই রিয়ার স্টেশন এসে গেলো, ও আর কৌশিক দুজনেই নেমে পড়লো। দুজন কে একসঙ্গে নামতে দেখে অনির্বাণের ঠোঁটে মুচকি হাসি খেলে গেলো।

আমি জানি তুই কেনো হাসলি! কিন্তু রিয়া কে পটানো একটু চাপের আছে! কোথায় কৌশিক আর কোথায় রিয়া!

তিয়াসা অনির্বাণের প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো যাতে দীপ আর শ্রেয়া শুনতে না পায়। ওদের সঙ্গে কৌশিকের বন্ধুত্বটা একটু বেশি।

কেনো রিয়া এমন কি? কোনো রকমে তো অনার্সটা পেয়েছে!

ততোধিক নিচু গলায় অনির্বাণ উত্তর দিলো, তিয়াসা মাথা নাড়লো,

ধ্যাত! পড়াশুনার কথা কে বলছে! আমি তো ওর বাবার টাকার কথা বলছি, বড়লোক বাপের মেয়ে ভাই! ওরকম দশটা কৌশিক কে কিনতে পারে!!

শেষের কথাগুলো বোধহয় একটু জোরেই হয়ে গিয়েছিলো, দীপ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, অনির্বাণ ম্যানেজ করার চেষ্টা করলো,

ওই টাকাটাই আছে শুধু! কৌশিক বরং ওর থেকে ভালো কিছু ডিজার্ভ করে!

দীপের স্টেশন এসে গিয়েছিলো, গেটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে পেছন ফিরে আস্তে করে বললো

বাপ যদি এতোই বড়লোক, তাহলে মেট্রোয় যায় কেনো?

সে তো অনির্বাণও যায়! ওর বাবা তো বিশাল বিজনেসম্যান!

শ্রেয়া মুচকি হেসে বললো, দীপ হাত তুললো,

আরে! সেতো ভাই তিয়াসার জন্যে! আমার, তোর জন্যে নাকি! নামবি নাকি আমার সঙ্গে?

না রে, কাল অনির্বাণের বাড়িতে আড্ডা দিয়ে অর্ক স্যারের বাড়ি হয়ে ফিরতে অনেক রাত হয়েছিলো। আজও হলে মা ক্ষেপে যাবে!

তড়িঘড়ি জবাব দিলো শ্রেয়া, দীপের কথাটার উত্তর বাকি দুজনের কাছে ছিলো না, তিয়াসা আর অনির্বাণ শুকনো মুখে হাতটা তুললো শুধু,

বাই!

সরমা কোনো রকমে চার বাড়ি কাজ শেষ করে দৌড়ে এসে চারটে পাঁচের ক্যানিং লোকালে পা দিয়েছিলো, হটাৎ করেই ফোন বেজে উঠলো। গুছিয়ে বসে ফোন ধরে হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গেই অদিতির গলা ভেসে এলো, সরমা একটু বিরক্ত হলো, তাও গলায় মধু ঢেলে বললো

দাদার রাতের রান্না করে এসেছি বৌদি, তুমি নিশ্চিন্তে কদিন থাকো দেখি!!

দিতি লজ্জা পাচ্ছিলো, কিভাবে আসল কথাটা জানতে চাইবে ভাবতে ভাবতে একটু ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলো,

হ্যাঁ, সে তো জানি, দাদা বলেছে আমাকে। কাল রাতে কি রান্না করেছিলে? দাদা বাড়িতে ছিলো তো তখন? জিজ্ঞেস করে নিয়ে করেছিলে তো?

এতো প্রশ্নে সরমা বোধহয় বিরক্ত হলো, তার আড্ডার দেরি হয়ে যাচ্ছিলো, একটু বিরক্ত গলায় বললো,

হ্যাঁ গো জিজ্ঞেস করেই করেছি, দাদা বাড়িতেই ছিলো। এতো কফির কাপ জমেছে, সকালে বাসন মাজতে গিয়ে দেখলাম,

সরমা ফোন রেখে দিল, কথা বলে ফোন টা নামিয়ে রাখার পর থেকেই খুব মন খারাপ হয়ে গেলো অদিতির, না করলেই ভালো হতো ফোন, কেনো যে করতে গেলো! ওর কথা থেকেই পরিষ্কার কেউ কাল সন্ধ্যেবেলা, অর্কর সঙ্গে ছিলো ফ্ল্যাটে, কফিও করেছিলো তার জন্যে অর্ক। অর্ক যে কফি করতে পারে, তাই তো ও জানতো না এতদিন! আজ পর্যন্ত তো ওকে কোনোদিনও খাওয়ায় নি করে! অর্ক কে চা করতেই ও দেখেছে শুধু, কে এমন স্পেশাল গেস্ট এলো যার জন্যে কফি করলো অর্ক! তাও অনেকগুলো কাপ! সে কি অনেকক্ষণ ছিলো ওখানে! না হলে এতো কফির কাপ হয় কি করে!!

কিন্তু ও তো আর অর্কর সঙ্গে কোনোদিনও কথা বলবে না ঠিক করেই নিয়েছে, তাই এইসব প্রশ্নের উত্তর ও আর জানতে চাইবে না কখনও। কেউ যে এসেছিলো ওর ফ্ল্যাটে সেটুকুও তো ওকে জানায়নি অর্ক, ফ্ল্যাটটা তো ওরও নাকি! মাত্র দুদিন হলো ও এসেছে,এর মধ্যেই কে ফ্ল্যাটে এলো, গেলো, সেগুলো আর জানানোর প্রয়োজন ওকে মনে করছে না যখন তখন ও নিজে থেকে কিছু জানতে চাইবে না। কিন্তু এটা তো ও বুঝতেই পারছে নিশ্চয়ই কোনো মেয়েই হবে, সম্ভবত সেই মেয়েটাই, যে ওকে ফোন করেছিলো, নিজের দোষ লুকিয়ে রাখার জন্যই এখন এ বিষয়ে আর কোনো কথাই ওকে অর্ক বলতে চাইছে না।

তার মানে মেয়েটা যেই হোক না কেনো মিথ্যে কথা বলেনি একটুও। কিন্তু মেয়েটা কে এবার ও কোথায় পাবে! আর তো একবারও ফোন করলো না ওকে। কেনো যে তখন ও ফোন টা কেটে দিয়েছিলো, তাই এখন সব জেনেও ওকে চুপ করে থাকতে হচ্ছে। অর্কর মুখোশ টা ও কারোর কাছেই খুলতে পারবে না কোনো দিনও, ওর কাছে এই মুহূর্তে কোনো প্রমাণ নেই।
ক্রমশ

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ৪
মেট্রোর গেট দিয়ে বেরোতে বেরোতেই রিয়া কৌশিকের দিকে তাকালো,

চল, চলি এবার, টা টা!

কৌশিক চুপ করে থাকলো, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রিয়া একদম ইনোসেন্ট ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো,

আচ্ছা, তুই হটাৎ এখানে নেমে পড়লি কেনো বলতো? তোর টালিগঞ্জ নামলে সুবিধা হয় না?

মুহূর্তে কৌশিকের মুখ গম্ভীর হলো, ওর এখানে নেমে পড়ার কারণ রিয়ার অজানা নয়, তাও জেনেশুনেই কথাগুলো বলছে!

তুই জানিস না আমি কেনো নেমেছি?

কৌশিকের গলার স্বরে অপমানের সুর। রিয়া একটু চুপ করে থাকলো, তারপরে আস্তে আস্তে বললো,

তুই তো জানিস আমার বাবার কথা, বাবা এসব মেনে নেবে না একটুও!

এই কথাগুলো গত তিন বছর ধরে শুনছি, আর নতুন করে শোনার নেই! এই বছরটা আমাদের একসঙ্গে কাটানো শেষ বছর, এখনও তুই মনস্থির করতে পারলি না? তোর বাবার কথা ছাড়, তুই নিজের কথা বল? তুই কি ভাবছিস?

বিশ্বাস কর, আমার ভাবাভাবির কিছু নেই। আমার বাবা একটা হাই ফাই স্টাটাস মেনটেইন করে চলে, তোর মতো মধ্যবিত্ত ছেলের সঙ্গে বিয়ে কিছুতেই মেনে নেবে না।

তারমানে তোর বাবার ইচ্ছেই তোরও কথা, তাই তো?

একটু ভাঙা গলায় বললো কৌশিক, রিয়া মাথা নাড়লো,

প্লিজ! আমি বন্ধু হিসেবে তোকে হারাতে চাই না!

কৌশিক চুপ করে থাকলো, তারপর বললো,

ঠিক আছে, চল তোকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি অন্তত। আজ পর্যন্ত নিজের বাড়িতে যেতেও তো বলিসনি কোনোদিনও!

তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লো রিয়া,

প্লিজ যাসনা! আমাদের গেটে সিসিটিভি লাগানো আছে, বাবা দেখতে পেলে রাগ করবে!

শ্রেয়া মেট্রোর গেট দিয়ে বেরোতে বেরোতে দীপ কে ফোন করলো,

যা দিলি না নামার আগে! দুজনের মুখ তো শুকিয়ে গেছে একদম!!

দীপ মুচকি হাসলো ফোনের মধ্যেই,

তুই নেমে পড়েছিস?

না নেমেই ওদের পাশে দাঁড়িয়ে তোকে ফোন করছি নাকি? এইটুকু সেন্স নেই তোর?

খিঁচিয়ে উঠলো শ্রেয়া, দীপ তাড়াতাড়ি বললো,

আরে হ্যাঁ! বুঝেছি সেটা, তাও কনফার্ম হয়ে নিলাম। হটাৎ করে সব ছেড়ে কৌশিকের পেছনে পড়ে গিয়েছে তিয়াসা টা!! আর নিজের বেলায়? একদিনও তো অনির্বাণ কে গাড়ি আনতে দেয় না, আগেই বলে রাখে মেট্রোয় ফেরার জন্য।

হ্যাঁ, তো! সেই কবে থেকে শান্তিনিকেতন যাওয়ার প্ল্যান হচ্ছে ওর গাড়ি নিয়ে তা আর হোলো কই? বললেই আগে তো তিয়াসাই ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্রেনে যাওয়ার জন্যে! অনির্বাণ কে কথাই বলতে দেয় না একটাও!

আরে গাড়িতে গেলে তো লস! ড্রাইভারের সামনে তো আর প্রেম করতে পারবে না, তাহলেই গিয়ে অনির্বাণের বাবার কানে তুলে দেবে সব। সেই জন্যেই তিয়াসার ট্রেনে যাওয়ার ইচ্ছে,

শ্রেয়ার কথা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বললো দীপ।

তবে রিয়াটাও কম যায় না ভাই! এতো পয়সা, সারাক্ষন খালি বড়লোকি কথা বার্তা, এই আছে, ওই আছের গল্প! কিন্তু দ্যাখ গাড়ি নিয়ে কোথাও যাওয়ার কথা বললেই ভাই বাবার গল্প শোনায়। ওর বাবা নাকি তাহলে ও বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছে সেটা জেনে যাবে!

শ্রেয়ার কথায় মাথা নাড়লো দীপ,

হ্যাঁ রে, ঠিকই বলেছিস! ওই শান্তিনিকেতন যাওয়ার কথাতেও এটাই বলেছিলো। ট্রেনে গেলে তবেই যেতে পারবে ও, ওর মা নাকি বাবা কে মাসীর বাড়ি যাচ্ছে বলে ম্যানেজ করে ফেলবে!!

শ্রেয়াও নেমে যাওয়ার দুটো স্টেশন পরেই তিয়াসা আর অনির্বাণ নেমে পড়লো, ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতেই তিয়াসা অনির্বাণ কে বললো,

দীপটা কিরকম বললো দেখলি? রিয়ার মেট্রোয় চড়ার সঙ্গে তোর কারণটাও একসাথে করে ফেললো। আসলে কৌশিক সংক্রান্ত কোনো কিছু বললেই ওর রাগ হয়ে যায়। আর শ্রেয়া? কিরকম ইনোসেন্ট ভাবে বললো, “সে তো অনির্বাণ ও যায়”। ন্যাকা!! যেনো কিছুই জানে না!! যতো ইনোসেন্ট মুখ করে থাকে না ও, ততোটা নয় কিন্তু। অর্ক আর অরিন্দম স্যারের দিকে কি রকম তাকিয়ে ছিলো দেখলি? নেহাত আমরা পেছনে সরে এলাম, না হলে ওর কিন্তু ওদের সাথেই ওঠার ইচ্ছে ছিলো!

অনির্বাণ কথাটা কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলো,

ছাড় তো!! বললে কি এসে যায়? আর মিথ্যে তো বলে নি কিছু, আমি তো সত্যিই তোর জন্যেই মেট্রোয় আসি!

তিয়াসা মুখ নিচু রেখে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলো, কোনো উত্তর না পেয়ে কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পরে অনির্বাণ বললো,

কি হলো? এটা শুনেও কিছু বললি না তো?

তিয়াসা মাথা নাড়লো,

এই মুহূর্তে ভাবিনি কিছু!! সময় লাগবে, আপাতত ফাইনাল এক্সামের আগে এসব নিয়ে ভাবতে চাই না, একটু সময় দে!!

কয়েক মিনিট তিয়াসার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে অনির্বাণ বললো,

দিলাম!

বাড়িতে ফিরে থেকেই সোফায় শুয়ে শুয়ে টিভির রিমোট বিভিন্ন চ্যানেলে ঘুরিয়ে যাচ্ছিলো অর্ক, অদিতি কে বাড়িতে দিয়ে আসার পর থেকেই সন্ধ্যে বেলাটা কাটতেই চায়না আর। কলেজ আর বাড়ি ছাড়া তো জীবনে কিছুই করেনি ও। কাল তাও স্টুডেন্টরা এসেছিলো ওর কাছে কিছু নোটস এর জন্যে, সন্ধ্যে বেলা ঘন্টা খানেক ভালোই কেটে ছিলো। ও নিজে কোনো স্টুডেন্টকে বাড়িতে আসতে বলে না সাধারণত, কিন্তু এই মেয়েটা বেশ কিছুদিন যাবত ওর কাছে নোটস গুলো চাইছিলো। দিচ্ছি, দেবো করে দেওয়া হয়ে উঠছিলো না।

অদিতির শরীরটা ভালো ছিলো না বেশ কিছুদিন ধরে, ওকে নিয়ে বার বার ডাক্তারের কাছে ছোটা দৌড়া করতে করতে ও ভুলেই যাচ্ছিলো নোটস এর কথা। তারপর মা ফোন করে ওকে ওখানে রেখে আসতে বললো, কিছুদিন বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে। দিতির খুব একটা আপত্তি ছিলো না, ওর সত্যি এখানে রেস্ট হচ্ছিলো না। বাড়ি থেকে ফিরে কাল কলেজে ঢুকতেই তিয়াসার মুখোমুখি হলো ও।

স্যার, নোটসগুলো? আজ পাবো কি? রিয়া বলছিলো ও আপনাকে বলে রেখেছে কদিন আগেই, আপনি আজ নিয়ে আসবেন বলেছেন!

তিয়াসার প্রশ্নে একদম লজ্জায় পড়েছিলো ও, এতো ভুল হয়ে যায় ওর!

সরি, একদম ভুলেই গেছি। কাল এনে দেবো, আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম কদিন,

লজ্জা ঢাকতে একটু বেশি গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলো ও।

স্যার, সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা, কাল মানে আরও দেরি হয়ে যাবে। আমরা একটু আপনার বাড়িতে গিয়ে যদি নিয়ে আসি, প্লিজ স্যার,

তিয়াসা কিছু বলার আগেই পেছন থেকে রিয়া এগিয়ে এসেছিলো। অর্ক একটু থতমত খেয়েছিলো, অদিতি বাড়িতে নেই, ওদের বাড়িতে আসতে বলা ঠিক হবে কি! ওকেই তো চা করার ঝামেলা পোহাতে হবে আবার!

স্যার, আমরা ঢুকবো না আপনার বাড়িতে, দরজা থেকেই চলে আসবো নোটস নিয়ে, প্লিজ স্যার, আমাদের খুব দেরি হয়ে যাবে কাল পেলে,

অর্ক কে চুপ করে থাকতে দেখেই বোধহয় কিছু একটা আন্দাজ করে বলেছিলো রিয়া, এরপরে আর কিই বা বলা যায়, অগত্যা এসো বলে দিয়েছিলো অর্ক।

সন্ধ্যেবেলায় সোফায় বসে মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতেই দরজায় বেলের আওয়াজ হয়েছিলো, সোফার ওপর মোবাইলটা রেখে দরজা খুলে দেখলো স্টুডেন্টরা এসেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই ওরা নোটসটা চাইলো যখন, তখন মনে পড়লো ও যথারীতি ওটা বার করে রাখতেই ভুলে গেছে। ওদের দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ওটা খুঁজতে যাওয়া খারাপ দেখায়, তাই ওদের ঘরে ঢুকে সোফায় বসতে বলেছিলো ও।

চা খাবে? উল্টোদিকের সোফায় বসতে বসতে ওদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলো অর্ক, বাড়িতে এসেছে যখন, তখন এটুকু সভ্যতা তো করতেই হতো।

হ্যাঁ, বলেই নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে ছিলো রিয়া,

স্যার, আপনি বরং নোটস গুলো খুঁজুন ততক্ষন, আমি করছি, ম্যাডাম নেই, আপনাকে করতে হবে না।

একটু অবাকই হয়েছিলো অর্ক, দিতি নেই ওরা সেটা কিভাবে জানলো!

তোমরা জানলে কি ভাবে ম্যাডাম নেই?

স্যার, আপনি বাড়ি গিয়েছিলেন তো? ম্যাডাম কে রেখে এসেছেন, জানি সেটা। কফি করবো স্যার? এখানে আছে দেখতে পাচ্ছি কফি,

কথাগুলো বলতে বলতেই রান্না ঘরে ঢুকে গিয়েছিলো রিয়া, ও আর কথা বাড়াতে চায়নি,

করো তোমার যা ইচ্ছে, বন্ধুরা যা খেতে চায়!

বলেই নিজের স্টাডি তে ঢুকে গিয়েছিলো নোটস গুলো খোঁজার জন্যে। বেশ কিছুক্ষন লেগে ছিলো ওগুলো খুঁজতে, দিতি যে সব কোথায় গুছিয়ে রাখে! প্রয়োজনের সময় ও কিছুতেই খুঁজে পায়না, কতবার ওকে এখানে হাত দিয়ে বারণ করেছে। বেশি গোছানো থাকলে যে জিনিস খুঁজে পাওয়া যায়না এই থিওরি টা অদিতি কিছুতেই বিশ্বাস করে না। কিন্তু অর্কর গোছানো জিনিস থেকে কিছু খুঁজে বার করতেই বেশি সময় লাগে সব সময়।

নোটস গুলো নিয়ে বাইরে এসে দেখলো রিয়া কফি নিয়ে এসে সোফায় বসে আছে, সামনের টেবিলে ট্রে তে কফি রাখা। সবাই ইতিমধ্যেই চুমুক দিয়ে ফেলেছে নিজের নিজের কাপে। ও ও একটা কাপ হতে তুলে নিয়ে ছিলো, খুব একটা খারাপ বানায়নি কফিটা, চুমুক দিয়েই বুঝেছিলো অর্ক।

বিস্কুট নাওনি কেন তোমরা? রান্নাঘরে ছিলো তো,

বলে সোফা ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিলো অর্ক, তার আগেই উঠে পড়েছিলো শ্রেয়া,

আপনি বসুন স্যার, আমি নিয়ে আসছি খুঁজে,

কফি খেয়ে আরো ঘণ্টা খানেক কথা বলে বেরিয়ে গিয়েছিলো ওরা, যাবার আগে অবশ্য সবার কাপগুলো ট্রেতে করে রান্নাঘরে রেখে এসেছিলো তিয়াসা। ও ও তারপর সোজা এসে খেতে বসে গিয়েছিলো টেবিলে। অনেকক্ষণ আগে দিদি রান্না করে যায়, দিতি থাকলে ওগুলো পরে আবার গরম করে, কিন্তু ওর সেটা ইচ্ছে করে না। তাই খুব বেশি ঠান্ডা হয়ে যাবার আগেই খেয়ে নেয় অর্ক।

ধুৎ, আর টিভি দেখতে ভালো লাগছিলো না, কাঁহাতক আর একই খবর বিভিন্ন চ্যানেলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখা যায়! টিভি টা বন্ধ করে উঠে ঘরে ঢুকে পড়লো ও, এতক্ষনে সব রাগ চলে গেছে,নিজেরই। একটু ফোন করতে ইচ্ছে করছে দিতি কে, ও থাকলে সন্ধ্যে বেলা স্টাডি তে থাকলে বিরক্ত হয়, আর এখন ওর নিজেরই কিছু পড়তে ইচ্ছে করছে না।

অন্য সময় এই নিয়েই অদিতির সঙ্গে ওর গন্ডগোল হয়, কলেজ থেকে ফিরেই স্টাডিতে ঢুকে যাওয়া ওর একটুও পছন্দ নয়। দিতি কে বাড়ি তে রেখে এসে যে বই গুলো ও নিশ্চিন্তে পড়বে বলে আলাদা করে রেখেছিলো, সেগুলো ওই ভাবেই পড়ে আছে!! খুলেও দেখতে ইচ্ছে করছে না এখন!! অথচ তখন কতো কিছু ভেবেছিলো, দিতি না থাকাকালীন কতো কিছু করার প্ল্যান ছিলো ওর। সেসব তো কিছুই হয়নি এই তিন দিনে উল্টে এ সপ্তাহেই আবার বাড়ি যাবার প্ল্যান করতে লাগলো অর্ক!!

কাল রবিবার, কলেজ নেই, সারাদিন যে কিভাবে কাটবে, ভাবতেই বিরক্ত লাগছে অর্কর। অদিতি থাকলে এই ছুটির দিনটাই একদম অন্য রকম হতো, রবিবারগুলোর জন্যে দুজনেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতো। দিতি নেই, এটা মনে হতেই মনে হলো সকালের পরে ওর সঙ্গে একবারও কথা বলতে পারেনি ও। সেই যে রাগ করে ফোন বন্ধ করে রেখেছিলো, তারপর অন করার পরেও দিতি নিজে থেকে করে নি আর।

কিন্তু ওর নিজের তো কিছু দায়িত্ব আছে, এই শরীরের অবস্থায় ও নিজে দিতি কে টেনশনে রাখতে পারেনা। অর্ক ঠিক আছে কিনা এটুকু জানতে তো অদিতি চাইবে নিশ্চয়ই, তাই মায়ের মোবাইলে ফোন করে দিয়েছিলো ও, কিন্তু দিতি র সঙ্গে কথা বলতে চায় নি।

কথা বললে ওর মোবাইলেই বলবে, মায়ের মোবাইলে ফোন করে ওকে ডাকবে না। তাই সকাল থেকে কথাই হয়নি আর। এতক্ষনে মাথা নিশ্চয়ই ঠান্ডা হয়ে গেছে, ফোন তুলে ডায়াল করলো অর্ক, অদিতির ফোন বন্ধ! এতো রাগ, সামান্য কারণে! পাগলামির একটা সীমা থাকে সব সময়, দিতি যেনো ভীষণ জেদি। কোনো বিষয় একবার মাথায় ঢুকে গেলে আর কিছুতেই বার করা যায় না। সাধারণ বিষয়গুলোকে অসাধারণ করে তুলতে ওর জুড়ি মেলা ভার।

এই সব টুকটাক মান অভিমান গুলো কে বাদ দিলে অদিতি মেয়ে হিসাবে খুবই ভালো। প্রথম বার কথা বলেই এতটাই ইমপ্রেস হয়েছিলো অর্ক, যে ওখানে বসেই বিয়ের ডিসিশন নিয়ে ফেলেছিলো সঙ্গে সঙ্গেই। বাবা মায়ের ও বেশ পছন্দ হয়েছিলো, মায়ের আবার ওর মা নেই শোনার পর থেকেই একটা মায়া পড়ে গিয়েছিলো, তাই দুই বাড়ি থেকেই বিয়ের দিন ঠিক করতে একটুও দেরি হয় নি।

এমনিতে যথেষ্ট সংসারী দিতি, কিন্তু সামান্য কথায় বড্ড বেশি রিয়াকশন দেখিয়ে ফেলে সব সময়। কাল যেমন ফোন না করার জন্যে ডিভোর্সের প্রসঙ্গও তুলে ফেললো, ও যে কখন, কোন সময় দিতির কাছে ডিভোর্সের কথা বলেছিলো ও সেটা একটুও মনে করতে পারছে না। ও তো চায় নি কখনো ডিভোর্স, তাহলে সেটা না দেওয়ার প্রশ্ন আসছে কেনো! ও নিজে যে একটা পাগল, আর ওকেও যে খুব শীঘ্রই পাগল করে ছাড়বে সেটা এখুনি বুঝতে পারছে অর্ক।
চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে