#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৬
অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে বিকেল পাঁচটা বেজে যাবে। আদিরা সাড়ে চারটায় টিউশনের সময় এগিয়ে এনেছে যাতে জলদি পড়িয়ে মেসে ফিরতে পারে। আদিরা আশেপাশে কাউকে খুঁজছে যার কাছে নাচের সময় পড়া ড্রেসটা দিয়ে যেতে পারবে। খুঁজতে খুঁজতে সুমিকে পেয়ে গেলো। সুমির কাছে ড্রেসটা দিয়ে সে চারটার দিকে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে যায়। স্টুডেন্টের বাড়ি বেশি দূরে না। হেঁটে গেলে বিশ-পঁচিশ মিনিট লাগে। আগের দিন গলিতে গলিতে ঘুরার কারণে খুঁজতে বেগ পেতে হয়েছিল। আদিরা টিউশন করাতে গেলো।
….
মাহি চারুকলা ভবনের কাছে একটা পদ্ম জলাশয় আছে সেখানে বসে বসে ছোট ছোট ইটের কণা ছুড়ছে আনমনে। আজ তার রঙ তুলিও তার মন খারাপের সঙ্গী হচ্ছে না। হঠাৎ আচমকা তার পাশে কারও উপস্থিতির আভাস পেয়ে পাশ ফিরে তাকিয়ে আহনাফকে দেখলো সামনের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। মাহি নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। আবারও একই কাজ করতে নিলে আহনাফ মাহির হাত ধরে ফেলে বলে,
–এতো সুন্দর ফুটন্ত পদ্ম দেখেও তোমার মনের বিষন্নতা কাটে নি?
মাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–উহুম। মন আমার কথা কোনো কালেই শোনে না। তার যখন যা ইচ্ছে হয় সে তাই করে।
আহনাফ মাহিকে কিছু বলল না। ওদিকে মারসাদও একাকি থাকার জন্য কোথায় একটা গেলো আহনাফকে বলে নি। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। যেকোনো সময় কাঁদতে শুরু করবে। আহনাফ ও মাহি পাশাপাশি বসে আছে নিঃশব্দে। নীরবতায় আচ্ছন্ন তাদের মাঝে। কিয়ৎক্ষণ পর মাহি আনমনে বলে,
–তিন বছর আগে আপিলির আমাদের থেকে দূরে চলে যাওয়ার কী কোনো দরকার ছিল? আপিলি চলে গেলো সাথে করে দাভাইকে ঘর ছাড়া করে গেলো। আমার শান্তশিষ্ট দাভাই হয়ে গেলো রাগী ও বদমেজাজি। খুব কী দরকার ছিল?
আহনাফ জবাব দিলো না। সন্ধ্যা নেমে আসছে খুব দ্রুত। মূলত ভারী বর্ষণ হবার পূর্বাভাস হিসেবে সূর্য সময়ের আগেই লুকিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশের মেঘের আড়ালে। আহনাফ আকাশের অবস্থা দেখে মাহিকে বাড়ি ফিরতে তাগদা দিলে মাহি ড্রাইভারকে ফোন করে আসতে বলে।
_______
মারসাদ একটা সোনালু ফুল গাছের নিচে বসে আছে। বসে বসে ফোন টিপছে। সন্ধ্যার আজানের আরও আধ ঘণ্টা বাকি। রাস্তার পথচারি হাঁটার জায়গায় মারসাদ বসে আছে। সাথে একটা রিকশাওয়ালাকে দাঁড়া করিয়ে রেখেছে। সোনালু ফুল পুরো রাস্তায় চাদরের মতো ছড়িয়ে আছে। গতকাল রাতে বৃষ্টির দরুণ ফুলগুলো ভেজা অবস্থায় লেপ্টে আছে। আরেকটু দূরে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচেও ফুল ভেজা অবস্থায় চাদরের মতো বিছিয়ে আছে। কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে বসার মতো অবস্থায় নেই। ভিজে স্যাঁতসেঁতে তাই এখানে সোনালু ফুল গাছটার কাছে বসেছে। এই রাস্তায় বাস ও ট্রাক চলাচল করে না। প্রাইভেট কার ও রিকশা চলে। আশেপাশে বড়ো বড়ো দুই-একটা অট্টালিকা থাকলেও রাস্তাটা নিরব থাকে প্রায় সময়।
ঘরিতে সোয়া ছয়টা বাজার কিছুক্ষণ আগেই আদিরা হন্তদন্ত হয়ে একটা গলির থেকে বেরোলো। আজ তাকে স্টুডেন্টের মা জোর করে ছুটির পর চা নাস্তা খাইয়েছে। পড়ানোর সময় নাস্তা দেয় নি কারণ স্টুডেন্টের মা প্রকৃতির রূপ বিশ্লেষণ করে মেয়ের টিচারের সাথে একসাথে চা পান করার ইচ্ছে পোষণ করেছেন। আদিরা বারবার আকাশে জমা কালো মেঘের দিকে তাকাচ্ছে আবার হাতের বাটন মোবাইলে সময় দেখছে। তার অসাবধানতার কারণে একটা রিকশার সাথে লেগে যেতেও যায় নি। একদম নাক বরাবর রিকশাটা গেলো তার।
আশেপাশে কে আছে নাকি নেই তাতে তার বিন্দুমাত্র নজর নেই। সে তো বৃষ্টি ও সন্ধ্যার আগে মেসে ফিরতে পারলেই হলো। আদিরা মারসাদের পাশ দিয়ে যাওয়া ধরলে মারসাদ আদিরাকে ডেকে উঠে,
–ওহ মিস পার্পল কুইন! এতো তাড়া কিসের তোমার যে আশেপাশে নজর নেই?
আদিরা চমকে তাকালো। চেনা কন্ঠস্বর শুনে ঘুরে মারসাদকে দেখতে পেলো। মারসাদ বসা থেকে উঠে আদিরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো পকেটে ফোন ঢুকিয়ে। আদিরা অবাক কন্ঠে সুধায়,
–আপনি এখানে ভাইয়া?
মারসাদ রুষ্ঠ হলো। আদিরার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
–কেনো? জায়গাটা কী তোমার নামে রেজেস্ট্রি করা? না তো। তাহলে আমি এখানে আসতে পারবো না কেনো? আর মুখ দিয়ে তো ভাইয়া! ভাইয়া! বলে ফেনা তুলে ফেলছো। একটু তো দম নেও। চলো আমার সাথে।
আদিরা ভীত হলো। নাচ শেষ করার মাধ্যমে তো সে মারসাদের হাত থেকে রেহাই পেতে চেয়েছিল কিন্তু তা আর হচ্ছে কই? আদিরা আমতা আমতা করে বলে,
–ভাইয়া সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমাকে মেসে ফিরতে হবে।
মারসাদ কিছুটা সামনে এগিয়ে বলে,
–আমি কী বলেছি আমার সাথে ডেটে চলো?
আদিরা তাজ্জব বনে গেলো। আদিরার মনোভাবে,
“লোকটা বেশি অহেতুক কথা বলে। কখন কী বলে বোঝাই যায় না।”
মারসাদ ভ্রুঁ চুলকাতে চুলকাতে বলে,
–তোমাকে বুঝতেও হবে না। চলো আমার সাথে।
আদিরা বেঁকে বসলো। সে যাবে না। মারসাদের কথায় নাচ তো করলো। তারপরেও কেনো পিছু পরে রয়েছে! মারসাদ গলার স্বরে গম্ভীর্যতা এনে বলে,
–দেখো আদিরা, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তখন তোমারই বিপদ। আমি তোমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবো না। তোমাকে তোমার মেস অব্ধি পৌঁছে দিবো। দেখো রিকশাওয়ালা মামাকে সেই আধঘণ্টা ধরে দাঁড়া করিয়ে রেখেছি।
আদিরা গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে,
–আমি একা যেতে পারবো ভাইয়া। আপনাকে কস্ট করতে হবে না।
মারসাদ কপাল কুঁচকে বলে,
–তোমায় কে বলল আমি কস্ট করছি? আমি এখানে প্রায়ই একা একা বসে থাকতে আসি। আর এই রিকশা আমার জন্যই ঠিক করা। পথিমধ্যে তোমাকে দেখলাম তাই ভাবলাম এটা আমার দায়িত্ব তোমাকে সেফলি তোমার মেসে পৌঁছে দেই। চলো এবার। আমাকেও তো ফিরতে হবে। তোমার জন্য অযথা সময় নষ্ট করতে পারবো না।
আদিরা কী করবে বুঝতে পারছে না। একটা ছেলের সাথে একসাথে রিকশায় গেলে মানুষজন কতো রকম মন্তব্য করবে আর যদি রুমমেটদের কেউ দেখে ফেলে!
মারসাদ মনে হয় আদিরার ভাবনা বুঝলো। মারসাদ ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–তোমাকে কিছুটা দূরেই নাহয় নামিয়ে দিবো। আর এই রাস্তাটার সামনে একটা একদম নিরব গলি পরে। সেই গলিতে মাঝেমধ্যে কিছু ছেলেদের আড্ডা দিতে দেখা যায়। ওদের মনে কী আছে তা না তুমি জানো আর না আমি। এখন ভেবে দেখো।
আদিরা পরশুদিনের কথা চিন্তা করলো। সেদিন সে কয়েকটা ছেলেকে দেখেছিল। তবে তারা কিছু বলে নি বা করে নি। এমন সময় রিকশাওয়ালা বলে উঠে,
–আফামনি, ভাইজান ঠিকই কইছে। কিছু পোলাগো ওই মোরের দিকে দেহা যায়। আর আইজকা তো আন্ধার হইয়া আইছে। আপনার লাইগ্যাই ভালা হইবো ভাইজানের লগে গেলে। ভাইজানরে মুই চিনি। হে বহুত ভালা মানুষ। আপনে চলেন। ডরাইয়েন না।
আদিরা দ্বিমনা করতে করতেও রিকশায় উঠলো। মারসাদ বাঁকা হেসে নিজেও রিকশায় আদিরার পাশে উঠে বসলো। আদিরা কিনারার দিকে চেপে বসলো যা দেখে মারসাদ আলতো হাসলো। রিকশাওয়ালা প্যাডেল ঘুরিয়ে চালাতে শুরু করলো। দশ মিনিটের মধ্যে আদিরার মেস থেকে কিছুটা দূরে আদিরাকে নামিয়ে দিয়ে মারসাদ রিকশাতে করে চলে গেলো। মাগরিরের আজান হয়ে যাবে দুই মিনিটের মধ্যে। মারসাদ ভার্সিটির হলের কাছে মসজিদের দিকে রিকশাওয়ালাকে যেতে বললো।
চলবে ইন শা আল্লাহ্,
ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ।