#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪
অডিটোরিয়ামের ভেতর ঢুকবে কি ঢুকবে না, তাই ভাবছে আদিরা। অস্বস্থি ও ভয় হচ্ছে তার। নাচের সময় মারসাদের করা বাধ্যগত স্পর্শগুলোও তার স্নায়ুতন্ত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এখনও ভাবলে তার শুভ্র কায়া কেঁপে উঠে। প্রায় পাঁচ মিনিট হলো আদিরা অডিটোরিয়ামের বাহিরে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকিঝুঁকি করছে। হঠাৎ একজোড়া হাত তার কাঁধ স্পর্শ করে বার দুয়েক ডাক দিলো। আদিরা হকচকিয়ে গিয়ে পেছোনে ফিরে ভূ’ত দেখার মতো চমকে গেলো। পেছোনে মারসাদ হাস্যজ্বল অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। মারসাদ নিজেও অডিটোরিয়ামের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে নিয়ে বলল,
–আমাকে দেখা যাচ্ছে না কেনো? কতো চেষ্টা করছো দেখতে যে আমার মতো ব’দ লোকটা ভেতরে আছে কী-না? কিন্তু আফসোস! ব’দ লোকটা একটু চোখ-মুখ ধুতে গিয়েছিল। কী করবে এখন?
আদিরা বোকার মতো তাকিয়ে আছে। লোকটা নিজের মতো করে প্রলাপ বকে যাচ্ছে। ওর মনের কথাগুলোও বলে দিচ্ছে। আদিরা মনে মনে ভাবে,
“সে জানলো কী করে যে আমি কী করছিলাম?”
মারসাদ হাই তুলতে তুলতে বলে,
–তুমি বড্ড জোরে জোরে চিন্তা করো মিস পার্পল কুইন। উপস রেড কুইন! অসাধারণ কিছু চিন্তা করোই না যা আমি ধরতে পারবো না। যাইহোক। চলো। প্রতিটা স্টেপ কয়েকবার করে মেমোরাইজ করবে। তোমার মার্কশিট দেখলাম। কোয়াইট ব্রিলিয়ান্ট তুমি। ডান্স স্টেপ গুলো তো আর অতো কঠিন না তোমার ফেভারিট সাবজেক্ট বায়োলজির ঘাসফড়িং, রুইমাছ ও শ্বশনের চাপ্টারের মতো। আয়ত্তে চলে আসবে। লেটস গো।
আদিরা মারসাদের দেওয়া অদ্ভুত উদাহারণটা ঠিক মেলাতে পারলো না। সে তাও কিছু বলল না। মারসাদ অডিটোরিয়ামের ভেতরে ঢুকে পিছু পিছু আদিরাও ঢুকে। মৌমিরা নাচের স্টেপ আবারও দুয়েকবার দেখিয়ে দিয়ে ওরা প্র্যাকটিস করে।
________
ঝড়ো হাওয়ায় দুলছে প্রকৃতি। সন্ধ্যা নামতেই ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টির ছাঁট। আদিরা মেসের জানালার গ্রিল ধরে একটা কপাট খোলা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। বিদ্যুৎ তো সেই কখন চলে গেছে। অন্ধকারে সে বৃষ্টি দেখছে। খুব করে মন চাচ্ছে বাহিরে গিয়ে এই বর্ষণে নিজেকে বিলীন করতে। আদিরার গ্রামের কথা মনে পরছে। জৈষ্ঠ মাসের শুরু। এখন ঝড়বৃষ্টিতে ঘরের চালে টুপটুপ করে কাঁচা-পাকা আমি পরতো বৃষ্টির সাথে সাথে। টিনের চালে বৃষ্টির অনবরত টুপটুপ করে পরা এক ছন্দ তৈরি করে সাথে হঠাৎ হঠাৎ আম পরলে সেই ছন্দে ভিন্নতা আনতো। আদিরা ও তার ভাই ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটে বাড়ির পেছোনের আম গাছ দুটোর কাছে চলে যেতো। উঠোনে পানি জমে ছলাৎছলাৎ দৃশ্য। দুই ভাই-বোনের দুষ্টুমি আর মায়ের বারণ করা চিৎকার চেঁচামেচি খুব খুব মিস করছে সে।
আদিরার এক রুমমেটের চিৎকার তার কানে আসলো,
–এই মেয়ে জানালা বন্ধ করো। কতক্ষণ ধরে বলছি সে তো শুনছেই না। বৃষ্টির পানিতে পুরো রুম ভিজে যাচ্ছে আর সে জানালা দিয়ে বৃষ্টিবিলাশ করছে। এই মেয়ে দেখতে পারছো না? এটা পশ্চিমা বৃষ্টি আর জানালাটাও পশ্চিম দিকে। বন্ধ করো এখুনি।
আদিরা মলিন হেসে জানালার কপাট লাগিয়ে দিলো। নিজের জন্য বরাদ্ধ করা খাটে বসে। প্রকৃতির রুদ্ররূপ এখন বন্ধ জানালা দিয়ে অবলোকন করছে আদিরা। আদিরা মনে মনে আওড়ায়,
“এই শহর যান্ত্রিক। প্রকৃতির হাসি কান্না কিছুই তাদের হৃদয় ছোঁয় না। প্রেম তো হারিয়েই গেছে। ব্যাস্ত যার যার জীবন নিয়ে। এই শহর কী আমায় আপনা করবে?”
_________
ভার্সিটিতে স্টেজ সাঁজানো হচ্ছে। গতকালের বৃষ্টিতে মাটি কিছুটা কর্দমাক্ত। এখন হালকা বালি দিয়ে দিয়ে কাঁদামাটি শুকানোর চেষ্টা চলছে। আদিরা গেট দিয়ে ঢোকার পর কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে শয়ে শয়ে ভেজা কৃষ্ণচূড়া বৃষ্টিতে সিক্ত রাস্তায় বিছিয়ে থাকতে দেখেছে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে একটা কৃষ্ণচূড়া ফুল তুলে নিয়েছিল এখন গেছে বড়ো কড়ই গাছটার কাছে। কড়ই গাছটার নিচে চাদরের মতো ভেজা ফুল ছড়িয়ে আছে। আস্ত ফুল পাওয়াই মুশকিল। কড়ই গাছটার কাছে মাটিও কর্দমাক্ত। পা টিপে টিপে গিয়ে দুই-তিনটা ফুল তুলে নিলো আদিরা। এখন ব্যাগ থেকে সুতা বের করে বেঁধে নিলো। আদিরা বাম পাশে তাকাতেই দেখলো একটা মেয়ে কাঠের তৈরি ছবি আঁকতে সাহায্য করে এমন কিছুতে কাগজ সেঁটে কিছু আঁকছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আদিরার কৌতুহল হলো। সে একটু এগিয়ে গিয়ে মাহিকে দেখতে পেলো। আদিরা মাহির পেছোনে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছে মাহি কী আঁকছে।
আচমকা মাহি ক্যানভাসে রঙ তুলির সামাঞ্জস্য করতে করতে বলে উঠলো,
–কী দেখছিস আদু?
অবাক হয় আদিরা। তারপর বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–তুমি বুঝলে কি করে?
মাহি মুচকি হাসে। ধ্যান তার চিত্র আঁকাতে। হেয়ালি করে বলে,
–কড়ই ফুলের সমারোহে এক পার্পল ফেইরি! সুন্দর না?
আদিরা ক্যানভাসে চিত্রটা দেখে অবাক হয়ে যায়। তারপর বলে,
–তুমি এতো সুন্দর করে কী করে আঁকলে? চিত্রটা অসম্ভব সুন্দর।
মাহি আঁকতে আঁকতে বলে,
–তুমি আমার ক্যানভাসে এসে এর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছো। আমি তো সিক্ত কড়ই গাছটার নিচে ফুলের সমারোহ চিত্রে ফুটিয়ে তুলছিলাম মাত্র। তখনি এক বেগুনী পরীর আবির্ভাব। এই যান্ত্রিক শহরে গোলাপ, বেলির মতো কিছুটা কৃষ্ণচূড়াকেও প্রাধান্য দেওয়া হয় কিন্তু কড়ই ফুলের সৌন্দর্য সবাই বুঝতে পারে না। কড়ই ফুলও যে মুগ্ধতা ছড়াতে পারে তা সবাই বুঝে না। অবশ্য গোলাপ ছাড়া অন্য ফুলের প্রাধান্যও কম দেখা যায়।
আদিরা চিত্রর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহি আদিরার মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে বলে,
–আমি তো চিত্রটা দেখে দেখে আঁকলাম। তবে দাভাই এটা না দেখেও শুধু ফিল করে আঁকতে পারবে। চেহারা আঁকতে ছবি দেখতে হয় কিন্তু প্রকৃতি আঁকতেও আমার সেটাকে সামনে রেখে আঁকতে হয় নয়তো খুঁতখুঁত লাগে। দাভাই এটা আঁকলে কল্পনা করে বা মাত্র এক-দুইবার দেখে এঁকে ফেলতে পারতো।
আদিরা উচ্ছাসিত হয়ে বলে,
–তুমিও দারুন আঁকো। চিত্রটা দেখে আমি অনেক অবাক হয়ে গিয়েছি। এতো সুন্দর হচ্ছে বলার মতো না। তোমরা কী ছবি আঁকা শিখেছো?
মাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–নাহ! আমি দাভাইকে দেখে শিখেছি। আমার বাবাও খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। কিন্তু তার রঙ হারিয়ে গেছে। তার ক্যানভাস শূণ্য থাকে এখন। দাভাই ছোট বেলায় অনেক আঁকতো। আর বড় হয়েও তার আঁকা অনেক চিত্র দেখেছি। দাভাই এখন ছবি আঁকে খুব কম। সে নিরালায় ছবি আঁকে। যাইহোক। আমার আর একটু বাকি আছে। ফুলগুলোতে আরেকটু রঙ দিবো।
আদিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাকিটুকু আঁকা দেখে। ছবি আঁকা হলে মাহি ও আদিরা ডিপার্টমেন্টের একটা রুমে ছবিটা শুকাতে রেখে আসে। তারপর ওরা স্টেজ যেখানে সাঁজাচ্ছে সেখানে যায়। ওরা ঘুরে ঘুরে দেখছিল তখনি সেখানে মৌমি এসে হড়বড়িয়ে বলে,
–তোমাকে আমি কতো খুঁজলাম জুলোজি ডিপার্টমেন্টে আদিরা! কই ছিলে? জলদি চলো। তোমাকে লাস্ট টাইম প্র্যাকটিস করতে হবে তো। কোনো ব্লান্ডার করা যাবে না।
মাহি মৌমিকে হুট করে জড়িয়ে ধরে বলে,
–আপিইইই! ইশ তোমাকে ব্লু শাড়িতে কী সুন্দর লাগছে গো। আমিই তো ক্রাশ খেয়ে গেলাম তাহলে জিজু কী পরিমান ফিদা হবে ভাবতো?
মৌমি মাহিকে জড়িয়ে বলে,
–থাংকু মাহি বাচ্চাটা। তোমাকে তো পুতুলের মতো লাগছে। শাড়ি পড়লে না কেনো?
মাহি মুখ লটকিয়ে বলে,
–শাড়ি! কে পড়িয়ে দিবে বলোতো? আমার মা! বাদ দেও। আদু কী ডান্স করবে নাকি?
মৌমি হাস্যজ্বল প্রতিউত্তর করে,
–হ্যাঁ। তোমার ভাইয়ের সাথে।
মাহি উচ্ছাসিত হয়ে বলে,
–ওয়াও গ্রেট।
আদিরা তো হতভম্ব।
চলবে ইন শা আল্লাহ্,