এক পূর্ণিমা সন্ধ্যায় পর্ব-০৬

0
834

#এক_পূর্ণিমা_সন্ধ্যায়
#পর্ব_৬
#নিশাত_জাহান_নিশি

রাগে, দুঃখে, যাতনায় প্রতি মুহুর্তে অনলের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। ঐথির দিকে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। ঐথি পুরো বিষয়টাকে খুব মজার দৃষ্টিতে দেখছে। মিটিমিটি হেসে মিনিট খানেক বাদে কম্বলের তলায় মুখ লুকিয়ে নিচ্ছে!

ঐথির এহেন পাশবিক অত্যাচার সহ্য করেই রাতটা কোনো রকমে কাটিয়ে দিল অনল। প্রভাত ঘনিয়ে আসতেই নিদ্রায় কাতর দু’খানা রক্তিম চক্ষু নিয়ে ঐথির পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল অনল। মিহি চক্ষু জোড়ায় বদ্ধ ঘরে যদিও অনল ভোরের কিরণ অতোটা উজ্জ্বল ভাবে ফুটে উঠতে দেখে নি, তবে চতুর্পাশের হাঁকডাক শুনে বেশ আন্দাজ করতে পারছে ভোর হয়ে গেছে। ইতোমধ্যেই শীতের ভয়াবহ প্রকোপে বরফের আকার ধারণ করল অনলের সর্বাঙ্গ! হাত-পা যেন কিছুতেই চলছে না। রাতে বিরাজমান শীতের ভয়াল থাবা যেন অনলের গরম কাপড় হীন শরীরেই নিজেদের আবাসস্থল গড়ে নিয়েছে! বুকে দু’হাত গুঁজে কম্পায়মান শরীর নিয়ে অনল দরজার কাছাকাছি আসতেই আচম্বিতে কিছু একটা মনে করে পুনরায় পিছু ফিরে তাকাল। অমনি ঐথির ঘুমন্ত, মোহমায়ায় সিক্ত অতি আদুরে মুখ খানা প্রদর্শিত হলো! রাতের ন্যায় কম্বলটিকে এখনও ঐথি চতুর্পাশ থেকে সাপের মতো পেঁচিয়ে রেখেছে! দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির সাধ্যি হবে না, কম্বলের এই পেঁচ খুলে একই কম্বলের তলায় ঐথির পাশে সামান্যতম জায়গা করে নেওয়া! তন্দ্রায় গভীর ভাবে আচ্ছন্ন ঐথি। নাক দিয়ে কেবল ছোট ছোট নিশ্বাস নির্গত করছে। অনলের পলকহীন দৃষ্টি কেবল ঐথির ঘুমন্ত মুখশ্রীতেই আবদ্ধ। দিন-দুনিয়া যেন তার কিছু মুহূর্তের জন্য থমকে গেছে। উতলা, উদাসীন, উদগ্রীব চিত্তে কেবল সে ঐথিকেই এক মনে দেখে চলছে৷ কিছু সময় নিরলস দৃষ্টিতে ঐথিকে দেখে অনল আচমকাই স্মিত হেসে মাথা নুঁইয়ে মন্থর গলায় বলল,,

“অথচ এই মেয়েটিই এতটা সময় ধরে আমায় জ্বালাচ্ছিল! রাতের ঘুমটা পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছিল। এত জ্বালা সহ্য করার পরে ও আমি শুধু তাকে চেয়ে চেয়ে দেখছি৷ কোনো দ্বিধা ছাড়াই বারংবার তার প্রেমে পড়ছি।”

দরজার খিল খুলে প্রস্থান নিলো অনল। পাশের কামরার দরজা ঠেলে কামরায় প্রবেশ করতেই দেখল বিছানায় নাক টেনে আরামচে ঘুমুচ্ছে রুহাজ, নিয়াজ এবং আহির। মুহূর্তের মধ্যেই তিনজনকে টেনে টুনে বিছানা থেকে নামিয়ে অনল দাঁতে দাঁত চেঁপে বলল,,

“শালা, এবার উঠ তোরা। অনেক ঘুমিয়েছিস, এবার আমার ঘুমোনোর পালা!”

কম্বল পেঁচিয়ে শুয়ে পড়ল অনল! নিয়াজ, আহির এবং রুহাজ তিনজন তিন দিকে ছিটকে পড়েছে! ঘটনার আকস্মিকতায় তারা তিনজনই বেকুব চাহনিতে অনলকে দেখছে। তিনজনেরই আঁখিদ্বয় রক্ত জবার মতো লাল হয়ে আছে৷ ঘুম পরিপূর্ণ হওয়ার পূর্বেই অনলের এই আকস্মিক আক্রমন তাদের তিনজনেরই অপ্রত্যাশিত ছিল! সম্বিত ফিরে পেতেই তিনজন রাগী ভঙ্গিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। কোনো দিকেই কালক্ষেপণ না করে তারা তিনজন কম্বল পেঁচিয়ে শুয়ে থাকা অনলকে চারপাশ থেকে চেঁপে ধরল! যত রাজ্যের গাল মন্দ আছে সব তারা একেক করে অনলকে শুনিয়ে দিলো। ঘুমে জর্জরিত আঁখিযুগল বুজে অনল বিরক্তিকর গলায় বলল,,

“প্লিজ, থাম তোরা! সারা রাত ঘুমোই নি আমি। ঐথির চক্করে পড়ে রাতের ঘুম নিপাতে গেছে আমার।”

সঙ্গে সঙ্গেই নিয়াজ, আহির এবং রুহাজ মিলে ক্রুর হাসিতে মত্ত হয়ে উঠল! তিনজন তিনজনের দিকে চেয়ে নেগেটিভ দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে! ইশারায় যুক্তি মত করে তিনজন বেশ আগ্রহ নিয়ে অনলের পাশে গাদাগাদি করে শুয়ে পড়ল। গলা খাঁকিয়ে একজন আরেক জনকে চোখ মেরে সমস্বরে বলে উঠল,,

“কি করেছে রে ঐথি? মানে বিয়ের আগেই সব হয়ে গেছে?”

অনল গর্জে উঠল! তাৎক্ষণিক শোয়া থেকে উঠে তিনজনকেই ঢিলেঢালা ভাবে বালিশের সাথে চেঁপে ধরে ব্যগ্র গলায় বলল,,

“হ্যাঁ, হয়ে গেছে! বিয়ের আগেই সব হয়ে গেছে!”

“সত্যিই সব হয়ে গেছে?”

শরীরের সমস্ত শক্তি কাজে লাগিয়ে অনল এবার খুব জোরেই তাদের তিনজনকে বালিশের সাথে চেঁপে ধরল! অনলের শক্তির সাথে কিছুতেই যেন তারা তিনজন পেরে উঠছে না। দু’বাহু দ্বারা তিনজনকেই সমভাবে চেঁপে ধরে আছে অনল। বিক্ষুব্ধ হয়ে বাজখাঁই গলায় অনল তাদের তিনজনকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“এবার বল? বিয়ের আগে আসলেই সব হয়ে গেছে?”

তিনজনই অস্ফুটে গলায় আর্তনাদ করে বলল,,

“না, হয় নি! কিছুই হয় নি। এবার প্লিজ ছাড় আমাদের!”

হাঁফিয়ে উঠল অনল! তিনজনকে ছেড়ে মুহূর্তের মধ্যেই গাঁয়ের শার্টটি খুলে নিলো। উন্মুক্ত শরীরে গাঁয়ে কম্বল পেঁচিয়ে উবুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মন্থর গলায় আহত তিনজনকে বলল,,

“একদম ডাকবি না আমায়! ঘুম ফুরালে আমি নিজেই উঠে যাব!”

ডরে, ভয়ে তিনজন হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানাল। অনলের পাশ থেকে উঠে তিনজনই ওয়াশরুমে সিরিয়াল লাগাল! সিরিয়ালে ও তিনজন মারামারি লেগে গেল! কে আগে ফ্রেশ হবে এসব নিয়েই তাদের মধ্যে তুমুলে বাক-বিতন্ডা চলছে।

,
,

দুপুর বারোটা৷ ঘুম থেকে উঠে মাত্র ফ্রেশ হলো ঐথি। পেটে সাংঘাতিক ক্ষুধামন্দা কাজ করতেই ঐথি নাক, মুখ কুঁচকে কামরা থেকে বেরিয়ে এলো। অমনি নিয়াজ, আহির এবং রুহাজের মুখোমুখি হয়ে গেল! ঐথিকে দেখা মাত্রই তিনজন শুকনো ঢোক গিলে ঠিক চার হাত দূরত্বে গিয়ে দাঁড়াল! ঐথির হুটহাট চিৎকার করে বসা, গাঁয়ে হাত তুলা এই দুটি ব্যাপারেই তারা তিনজন ভীতসন্ত্রস্ত! তাদের তিনজনের ভয়াতুর ভাবভঙ্গি দেখে ঐথি ভ্রু যুগল উঁচিয়ে নিলো! বুকে হাত দু’হাতে গুঁজে দূরত্ব খানিকটা হ্রাস করে তিনজনের মুখোমুখি দাঁড়াল! অমনি তিনজন পিছু হটতে আরম্ভ করল। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে ঐথি ও দু’এক কদম সামনে বাড়িয়ে হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠল,,

“কি হচ্ছেটা কি? আপনারা এভাবে পিছিয়ে যাচ্ছেন কেন?”

ঠিক এই দুর্যোগটির আভাসই পাচ্ছিল তিনজন! সাংঘাতিক ভয়ে কেঁপে উঠে নিয়াজ হঠাৎ মুখ ফসকে বলে উঠল,,

“অনল বলেছে! অনল বলেছে, তোমার থেকে যথেষ্ট দূরে থাকতে। তুমি হলে হিংস্র! হিংস্র মানবী!”

চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ঐথির। অকপট গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“অনল বলেছে এসব?”

নিয়াজের সাথে বাকি দুজনও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল! গজগজ করে উঠল ঐথি! তিনজনের দিকে পুনরায় তেড়ে এসে বলল,,

“আপনাদেরও কি তাই মনে হয়? আমি হিংস্র? হিংস্র মানবী!”

আত্নরক্ষার জন্য তিনজনই কম্পিত গলায় বলল,,

“ককই, নানানা তো! আমাদের তো ককখনও এমন কিছু মনে হয় নি!”

“তাহলে আপনার বন্ধুর এমন মনে হওয়ার কারণ কি? কি করেছি আমি?”

আহির হঠাৎ অস্থিরতা ভুলে মেয়েদের মতো ইনিয়ে বিনিয়ে লজ্জা মাখা গলায় বলল,,

“কাল রাতে নাকি তুমি তাকে ঘুমুতে দাও নি! আই মিন, খুব জ্বালিয়েছ!”

ঐথি থমকালো! আকাশসম রাগটাকে কিঞ্চিৎ আয়ত্তে এনে জোরপূর্বক হেসে বলল,,

“ওহ্ হ্যাঁ! কাল রাতে তো আপনার বন্ধুর সাথে আমার বাসর ছিল! আমরা সারা রাত জেগে বাসর করেছি! আপনার বন্ধুকে জ্বালিয়েছি!”

আহির, নিয়াজ এবং রুহাজ চমকে উঠল! অবিশ্বাস্যভাবে তিনজনই মুখটাকে হা করে বলল,,

“সত্যি?”

চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ঐথির! অস্থির দৃষ্টিতে আশেপাশে কিছু একটা খুঁজতে লাগল! দরজার বাইরে পড়ে থাকা ছোট একটা কাঠের গুঁড়ি দেখা মাত্রই ঐথি দৌঁড়ে গেল গুঁড়িটির কাছে। রাগে গজগজ করে গুঁড়িটি হাতে নেওয়া মাত্রই রুহাজ উচ্চ শব্দে চেঁচিয়ে বলল,,

“পালা রে! সংঘাত থেকে বাঁচতে হলে এখনই পালা।!

তিনজনই জান নিয়ে ছুট দিল লজের বাইরে! কাঠের গুঁড়িটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ঐথি! অত্যধিক রাগে ফোঁস ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস নির্গত করে বলল,,

“অনলের বাচ্চা! আজ তোকে আমি কাচ্চা চিবিয়ে খাব! যা নয় তা বলে বেড়াচ্ছে আমার নামে!”

তেজস্বিনী রূপ নিয়ে ঐথি অনলের কামরায় প্রবেশ করল। সমস্ত খাট দখল করে অনল কম্বল পেঁচিয়ে আরামচে নাক টেনে ঘুমুচ্ছে! অনলের এই সুখের নিদ্রা যেন কিছুতেই ঐথির সহ্য হচ্ছে না। গাঁ জ্বালা পোঁড়া করছে। তৎক্ষনাৎ কাঠের গুঁড়িটা হাত থেকে ছুড়ে ফেলে ঐথি ধপাধপ পা ফেলে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। মগ ভর্তি ঠান্ডা পানি এনে অনলের খাটের পাশে দাঁড়াল! ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক হাসি ফুটিয়ে ঐথি অনলের ঘুমন্ত মুখে বরফগলা জল ছিটকাতে আরম্ভ করল! প্রথমদিকে অনল ঠান্ডা জলের আভাস টের না পেলেও পরক্ষণে শীতে কেঁপে সাইক্লোনের বেগে হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল! অস্থির এবং আতঙ্কিত আঁখি পল্লবে অনল ঐথির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই ঐথি উত্তেজিত গলায় শুধিয়ে বলল,,

“আমি হিংস্র মানবী না? আমি হিংস্র মানবী?”

মুহূর্তের মধ্যেই অনলের মাথায় ক্রোধ চেপে বসল। তটস্থ গলায় কিছু বলার পূর্বেই ঐথি পুনরায় বলল,,

“এবার প্রমাণ দিয়েই দিলাম, আমি কতটা হিংস্র!”

একে তো অনলের ঘুম পরিপূর্ণ হয় নি। দ্বিতীয়ত, ঐথির পানি ছিটকানো। তৃতীয়ত, অকারনেই এহেন হুমকি, ধামকি! সব মিলিয়ে তুখার রেগে উঠল অনল। গাঁ থেকে কম্বলটা ছুড়ে ফেলে সটান হয়ে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত চেপে ঐথির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“তো বলো? কি বলছিলে? তুমি হিংস্র? হিংস্রতার প্রমাণ দিয়েছ?”

এই পর্যায়ে এসে ঐথি খানিক বিচলিত হয়ে উঠল! অনলের রাগান্বিত চক্ষু জোড়া থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলল,,

“হ্যাঁ দিয়েছি! প্রয়োজনে আরও দিব!”

আগ, পাছ না ভেবেই মুহূর্ত কয়েকের মধ্যেই অনল ঐথির থুতনী চেপে ধরল! কর্কশ গলায় বলল,,

“এবার বলো? কে বেশি হিংস্র?”

ঐথি মৃদু আর্তনাদ করে বলল,,

“আআআহ্! আমার কি দোষ? তুমিই তো সবাইকে বলছিলে আমি হিংস্র! সারা রাত তোমাকে ঘুমুতে দেই নি!”

কপাল কুঁচকে এলো অনলের। বিস্ময়াত্নক গলায় বলল,,

“আমি? আমি বলেছি তুমি হিংস্র? কার কাছে আমি এসব বলেছি?”

অনলের হাতের বাঁধনটা অল্প ঢিলে হয়ে আসতেই ঐথি সুযোগ বুঝে অনলের ব্যান্ডেজ করা কপালের কাটা অংশটায় আংগুলের সমস্ত শক্তি দ্বারা চাপ বসিয়ে দৌঁড়ে কামরা থেকে প্রস্থান নিয়ে বলল,,

“হিংস্রতায় তুমি কখনও আমার সাথে পেরে উঠবে না অনল! এক্ষেত্রে আমিই সেরা!”

#চলবে…?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে