এক টুকরো আলো পর্ব-২৫+২৬

0
494

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২৫
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

সকলে একসাথে বসে নাস্তা করছে। ফাবিহা ফিরোজ আলমের উদ্দেশ্যে বলল,“বাবা আমি পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে চাই।”

“অবশ্যই তুমি পড়াশোনা করবে।”

শাবাব খেয়ে চলেছে একমনে। ফাবিহা সৌজন্যে হেসে বলল,“ধন্যবাদ। আমি আজ একবার ক্লাসে যেতে চাচ্ছি।”

“শাবাব অফিস যাওয়ার সময় বউমা কে নিয়ে যেও।”

শাবাব ফাবিহার উদ্দেশ্যে বলল,“তৈরি হয়ে নিও তাড়াতাড়ি।”

ফাবিহা বলল,“আমি একা চলে যেতে পারবো।”

ফিরোজ আলম বললেন,“একা কেন যাবে? দুজন একসাথে চলে যাও। শাবাব তোমাকে নামিয়ে দিয়ে অফিস যাবে। তখন আর চিন্তা থাকবে না।”

দুজনের মাঝে কী চলছে ফিরোজ আলম জানেন না। তিনি শুধু চাইছেন তাদের মাঝে একটা বুঝাপড়া হোক। ফাবিহা আর কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নিলো।

শাবাব অপেক্ষা করছে গাড়ি নিয়ে। ফাবিহা বেরিয়ে আসছে। ড্রাইভিং সিট থেকে তাকিয়ে রইলো শাবাব। ফাবিহা কাছাকাছি আসতেই চোখ সরিয়ে নিলো। বিয়ের পর ফাবিহার জন্য কোনো শপিং করা হয়নি।
ফাবিহাকে ভার্সিটির সামনে নামিয়ে দিল। আসার পথে দুজনের মাঝে একদণ্ড কথা হয়নি। পেছনে না তাকিয়ে ভেতরে চলে গেল ফাবিহা। শাবাব যেতে নিয়েও কিছু একটা নজরে পড়ায় গাড়ি থেকে নেমে গেল। তাদের বিয়ের খবর এখনো গোপন রয়েছে। ফাবিহা হাঁটতে হাঁটতে সুমনের সামনে পড়লো। পাশ কাটিয়ে যেতে নিতেই সুমন পথ আগলে দাঁড়ালো। বিশ্রী ভঙ্গিতে হেসে বলল,“নাগরকে দেখি ভালোই পটিয়েছ। আমাকে এসে মা*র*ধ*র করে গিয়েছে।”

ফাবিহা কিছু না বুঝতে পেরে বলল,“মানে?”

সুমন খপ করে ফাবিহার হাত চেপে ধরে বলল,“তোমার নাগর কয়টা? আমি তো শাবাবের কথাই বলছি। ওর জ্বালা মিটিয়েছিস, এবার আমার জ্বালা মেটাবি।”

ফাবিহা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“হাত ছাড় বলছি।”

“না ছাড়লে কী করবি তুই?”

ফাবিহা থুতু ছুড়ে মা*র*লো সুমনের মুখে। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো সুমন। হাত দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে তাকালো। তার চোখ টকটকে লাল। হাত উঠানোর আগেই তার মুখে ঘু*ষি এসে পড়লো। দু-কদম পিছিয়ে গেল সে। শাবাব তার হাত থেকে ফাবিহার হাত ছাড়িয়ে নিলো। আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলল,“পরেরবার মাটিতে ফুঁতে ফেলবো। মাইন্ড ইট।”

সুমন বলল,“তুই তো এক মা*ল এতদিন ছেঁকে দেখিস না। এখনও খাস নাকি এই মা*ল?”

ফাবিহা রাগে শরীর কাঁপছে। শাবাব তার গতিবিধি লক্ষ করে শান্ত গলায় বলল,“ক্লাসে যাও তুমি। আমি দেখছি ওকে।”

ফাবিহা যাচ্ছে না। সে শাবাব, সুমন দুজনকেই সমান দোষী মনে করে। শাবাবের জন্যই তো সুমন তার পেছনে পড়েছে। শাবাব আবারও বলল,“যাও ফাবিহা।”

সুমন এই ফাঁকে শাবাবকে আক্রমণ করে বসলো। দুজনের মাঝে তুমুল মা*রা*মা*রি চলছে। ফাবিহা বুঝে উঠতে পারলো না কী করবে। কেউ কাউকে ছেড়ে দিচ্ছে না। এমন হলে খুনাখুনি হয়ে যাবে। শেষে ফাবিহা শাবাবকে টে*নে সরানোর চেষ্টা করলো। ক্ষ্যাপা ষাঁড়কে একা থামানোর সাধ্যি তার নেই। তবুও দুহাতে পেছন থেকে টে*নে ধরলো তাকে।
“ছাড়ো শাবাব।”

আপনা-আপনি সুমনের কাছ থেকে আলগা হয়ে এলো শাবাব। সুমন আবার তেড়ে আসলো। শাবাব এগিয়ে যেতে নিতেই ফাবিহা তাকে আবারও টে*নে ধরলো।
নিজের কোমরের কাছে ফাবিহার হাত দুটোর দিকে তাকাচ্ছে বারবার। রাগে ঘনঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল,“তুমি ক্লাসে যাও। আমি যাচ্ছি।”

ফাবিহা ক্লাসের দিকে এগিয়ে যেতেই শাবাব সুমনের উদ্দেশ্যে বলল,“ওর দিকে চোখ দিবি না। তোর যা ইচ্ছে তুই কর। শুধু ওদিকে চোখ দিলে ভালো হবে না।”

সুমনের হাসি দেখেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে সে শাবাবের কথায় কান দিচ্ছে না।

শাবাব ঠাণ্ডা মাথায় বলল,“তোর সাথে আমার এখন আর লেনাদেনা নেই। আমি তোর কোনো কাজে হাত দিচ্ছি না। তাহলে তুই কেন এখনো পুরনো শ*ত্রু*তা ধরে বসে আছিস? কী চাইছিস তুই?”

সুমন গাল চুলকে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,“মেয়েটার প্রতি তোর এত ইন্টারেস্ট কেন?”

“তুই ওর পিছু ছেড়ে দে।”

“ছাড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটা বড্ডো তেজী। আমার রাগ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই ওর তেজ কমানো ছাড়া আমি থামছি না।”

শাবাব শক্ত গলায় বলল,“ওর পরিচয় জানিস?”

সুমন বিদ্রুপ হেসে বলল,“তোর খেয়ে ছেড়ে দেওয়া মা*ল।”

কষিয়ে আরেকটা থা*প্প*ড় পড়লো সুমনের গালে। শাবাব হিমশীতল কণ্ঠে বলল,“ওর সাথে আমার কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু এখন ও আমার স্ত্রী। তাই যা করবি, ভেবেচিন্তে।”

শাবাব ঘড়ি দেখে গাড়িতে গিয়ে বসলো।
সুমন চমকে উঠলো। থা*প্প*ড়ে নয়, শাবাবের কথা শুনে।
শাবাব ড্রাইভ করতে করতে ভাবনায় ডুবে গেল। সুমনের ফাবিহাকে এভাবে উত্যক্ত করা তার ভালোলাগেনি। সে কিছুতেই এটা একসেপ্ট করতে পারছে না। সেও তো ফাবিহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বারবার তাকে উত্যক্ত করেছে। নিজের কাছে নিজেই ছোটো হয়ে এলো। সুমন আর নিজের মাঝে তফাত খুঁজে পেল না। অফিসের সামনে গাড়ি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে হেঁটে গেল ভেতরে।

★★

“আমাদের বাসায় নতুন সদস্য আসছে। এই খুশি তোমার উপভোগ করার কথা ছিল। কিন্তু অন্যকেউ তা উপভোগ করছে।”

ফাবিহা বলল,“এসব বাদ দে নিশি। যার ভাগ্যে যে লেখা আছে, সে শত বাঁধার পরও জীবনে আসবেই। আমি এখন আর আফসোস করি না। তবে নতুন সদস্য আসছে শুনে খুশি হলাম। আমি বিকেলে একফাঁকে এসে দেখে যাবো ভাবিকে।”

“সে তো তার বাবার বাসায়।”

“ওহ্। তুই গিয়েছিস দেখতে?”

“না।”

“নাম্বার দিতে পারবি? কথা বলবো।”

“আচ্ছা আমি পাঠাচ্ছি।”

ফাবিহা ভাবলো নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা কাউকে জানাবে না। কিছুদিন পর তো সে শাবাবের কাছ থেকে আলাদা হয়েই যাবে। তবুও অবুঝ মন উশখুশ করছে। জড়তা নিয়ে বলল,“আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে নিশি।”

নিশি বিস্মিত হয়ে মৃদু চিৎকার দিল।
“কীহ্? কী বলছো এসব? কবে, কখন? জানালেও না!”

ফাবিহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“জানানোর সুযোগ ছিল না। পরিস্থিতির কারণে জানাতে পারিনি। হুট করেই বিয়ে। তুই নাম্বার পাঠিয়ে দে।”

নিশি আফসোস করছে।
“ইশ্! নিজের ভাইয়ের বিয়েতেও আনন্দ করতে পারিনি। ভেবেছিলাম তোমার বিয়েতে চুটিয়ে মজা করবো!”

ফাবিহা তাচ্ছিল্য হাসলো। বিয়ে নিয়ে তো তারও কত স্বপ্ন ছিল। সবকিছু কি আর পূরণ হয়? বলল,“রাখছি। আমায় বাসায় যেতে হবে।”

নিশি মন খারাপ করে বলল,“ঠিক আছে। ভালো থেকো।”

নিশির কল কাটার পাঁচ মিনিটের মাথায় আবার কল এসে পড়লো ফাবিহার। রিসিভ করতেই শাবাব বলল,“কখন ছুটি হবে?”

“সেটা জেনে তুমি কী করবে?”

“তোমায় বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্যই জিজ্ঞেস করেছি।”

“আমি একাই যেতে পারি শাবাব। প্লিজ এসব অভিনয় করে ভালো সাজার চেষ্টা কোরো না। আমাদের পথ আলাদা।”

শাবাবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে কিছু না বলেই কল কেটে দিল। সুমন একা পেয়ে আবার কিছু না করে বসে। এই ভেবে পরক্ষণেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। ভার্সিটির কাছাকাছি যেতেই ফাবিহাকে রিকশায় দেখলো সে। শান্ত হয়ে পেছন পেছন গাড়ি নিয়ে আসলো। ফাবিহাকে বাসার সামনে নামতে দেখে দূর থেকে আবার ফিরে গেল। সে যা করেছে, এরপর চায় না তার জন্য ফাবিহার আর কোনো ক্ষ*তি হোক।
তুলি বসে বসে আচার খাচ্ছে। সুরাইয়া তাকে বকাবকি করছেন। রান্নাঘরে সব এলোমেলো পড়ে আছে।
“সব জমিদারের বেটি এসে আমার কাছে পড়ে। একজন গিয়ে উঠেছে ভার্সিটিতে, আরেকজন বসে বসে আচার খাচ্ছে। আমি হলাম দাসী।”

বকতে বকতে সবকাজ গুছিয়ে নিলেন। এসে তুলিকে চেঁচিয়ে বললেন,“জমিদারের বেটি, আচার খাওয়া হলে এবার ভাত গিলতে আসুন।”

তুলি বিরক্ত হয়ে বলল,“খালাম্মা আমি তো কইছি আচার খাইয়া সব কাম করুম। আপনে করতে গেলেন ক্যান?”

“আমার প্রেশার বাড়াবি না।”

ফাবিহা বাড়িতে ঢুকলো। সুরাইয়া তাকে দেখে বললেন,“তুলি সবাইকে তাড়াতাড়ি খেতে আসতে বল।”

ফাবিহা বলল,“আমার দেরি হবে আম্মা। গোসল করে তারপর খাবো। আপনারা খেয়ে নিন।”

সুরাইয়া থমথমে মুখে বসে রইলেন। ফাবিহা গোসল করে খেতে এসে দেখলো সুরাইয়া আর তুলি বসে আছে। সামনে খাবার। সে অবাক হয়ে বলল,“আপনারা খাননি এখনো?”

তুলি মুখ টিপে হাসলো। সে ভাবে তার খালাম্মার মাথায় গন্ডগোল আছে। নয়তো কে এমন করে? তার সাথে সবসময় ক্যাটক্যাট করে। আবার নিজে গিয়ে আগ বাড়িয়ে কাজ করে ফেলে। খাওয়ার সময় ডেকে ডেকে খাওয়ায়। এটা শুধু তার ক্ষেত্রে না। সবার ক্ষেত্রেই তিনি এমন। ফিরোজ আলমের সাথেও কিছু নিয়ে ঝগড়া হলে তাঁর যত্ন নিতে ভুলবেন না। তবে কথায় কথায় খোঁচা দেবেন। ফাবিহার দিকে প্লেট বাড়িয়ে দিল তুলি। ফাবিহা বসে পড়লো। আড়চোখে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। খাওয়া শেষ করে সে সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। সুরাইয়া তুলিকে খ্যাঁক করে উঠে বললেন,
“এ্যাই তুলি, কাজ পড়ে আছে চোখে দেখিস না?”

তুলি পা টিপে টিপে ফাবিহার সাথে কাজে হাত লাগালো। ফাবিহা বলল,“এটুকু আমি করতে পারবো। তুমি যাও।”

শাবাব বাড়ি ফিরলেও কথা বললো না ফাবিহার সাথে। ফাবিহাও বললো না। হুরাইনের নম্বরে কল দিল।

“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কে বলছেন?”

“আমি ফাবিহা। নিশির খালাতো বোন।”

হুরাইন চিনতে পেরে উচ্ছ্বাসিত গলায় বলল,“কেমন আছেন আপু?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন? বাবু কেমন আছে?”

হুরাইনের মৃদু হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
“আলহামদুলিল্লাহ আমরা ভালো আছি। আপনার সাথে দেখা করার ইচ্ছে হচ্ছে। বিয়ের পরদিন যে দেখা দিয়ে চলে গেলেন আর এলেন না। আমাদের বাড়িতে আসুন।”

ফাবিহা হেসে বলল,“আমি এখন শশুর বাড়িতে ভাবি।”

“আপনার বিয়ে হয়ে গিয়েছে? আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে আপনার স্বামীকে নিয়ে আসুন।”

শাবাব তীক্ষ্ণ চোখে কখন থেকে তাকিয়ে আছে। ফাবিহা কার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে?

স্বামীর কথা বলায় ফাবিহা চুপ করে গেল। কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে বলল,“নিজের যত্ন নিচ্ছেন তো ভাবি?”

“সবাই যত্ন নিচ্ছে।”

“অন্যদিন কথা হবে।”

“ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ।”

“আল্লাহ হাফেজ।”
কল কাটতে গিয়েও ফাবিহা জিজ্ঞেস করলো,“আচ্ছা ভাবি, কী করলে সুখী হওয়া যায়?”

হুরাইন কিছু বুঝলো কি না সেটা আন্দাজ করা গেল না। কেবল বলল,“বেশি বেশি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত আর আল্লাহর কাছে সবকিছু চাইবেন আপু।”

ফাবিহা অস্থির গলায় বলল,“যদি কখনো মনে হয় আমি নিজের জীবন নিয়ে সুখী না তাহলে?”

হুরাইন ধরেই নিলো ফাবিহা হয়তো এখনো তাসিনের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবে। সে মুচকি হেসে বলল,“আল্লাহ যাঁকে যাঁর জন্য সৃষ্টি করেছেন, তাঁর সাথেই তাঁর জীবন জুড়বে। তিনি যা করেন, মানুষের ভালোর জন্যই করেন। তাই ধৈর্য ধারণ করা উচিত।”

ফাবিহা বলল,“পরে আবার বিরক্ত করবো আপনাকে।”

“যখন-তখন স্মরণ করতে পারেন। আমি বরং খুশি হবো।”

কথা শেষ করে ঘরে ঢুকলো ফাবিহা। শাবাব ফোনে মনোযোগ দিয়েছে। যেন সে এতক্ষণ ফাবিহার দিকে তাকায়ওনি। ফাবিহাও নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। নিরবতা ভেঙে শাবাব বলল,“কাল তোমার জন্য শপিং করে নিও। এখানে ওয়ালেট রাখা আছে।”

ফাবিহা শান্ত গলায় বলল,“আমার জামাকাপড় আছে।”

“সেটা থাকতেই পারে। বিয়েটা যেভাবেই হোক, তোমাকে কিছু দেওয়া হয়নি।”

“আমি তোমার কাছ থেকে কিছু আশাও করি না।”

শাবাব তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,“সরি!”

চোখ উলটে তাকালো ফাবিহা। জিজ্ঞেস করলো, “কীসের জন্য?”

“তোমার সাথে যা যা হয়েছে সবকিছুর জন্য সরি!”

ফাবিহা ঠাণ্ডা গলায় বলল,“সরি বললেই কি সব সমাধান হয়ে যাবে? সব আগের মত হয়ে যাবে?”

“আমি জানি কিছুই ঠিক হবে না। তুমি আমার জেদ ছিলে। সেজন্য আমি যেকোনো ভাবে তোমাকে নত করতে চেয়েছিলাম। আমি ক্ষমা চাইছি।”

“ক্ষমা মন থেকে আসে শাবাব। আমি চাইলেই নিজের সাথে করা তোমার নীচ কাজগুলো ভুলতে পারছি না। তুমি কী কী করেছো আমার সাথে। আমি সবকিছু ভুলে গিয়ে নিজের মত করে আবার সবটা শুরু করতে চেয়েছি। ফুফুর বাড়ি থেকে আসার পর তুমি আবারও সবটা তচনচ করে দিলে। তোমার কাছে যেটা বিয়ে মনে হয়, সেটা আমার কাছে বিয়ে নয়। আমার মনে হয় নিজের ইজ্জত বেচে দেওয়া হয়েছে। সেদিন তুমি যা করলে, মানুষ যা যা ব্যবহার করলো তাতে আমার ওটাকে আর বিয়ে মনে হয়নি। তোমার কারণে সুমন আমার পেছনে পড়েছে। আমাকে ‘মা*ল’ সম্বোধন করছে। তোমার খেয়ে ছেড়ে দেওয়া মা*ল। যাকে তুমি এখনো ছেঁকে দেখো। এতকিছুর মূল্য কীভাবে চোকাবে শাবাব? একটা সরি দিয়ে?”

ফাবিহার গলা শান্ত হলেও সুরে তাচ্ছিল্য। শাবাব দৃষ্টি নিচু করে রেখেছে। নিস্তেজ গলায় বলল,“তুমি কী চাও?”

“তুমি ভালো করেই জানো।”

“ঠিক আছে। তুমি কালই চলে যেতে পারো।”

শাবাবের কথা বিশ্বাস হচ্ছে না ফাবিহার। সন্দিহান গলায় বলল,“তুমি আমার সাথে মজা নিচ্ছো? আমি তোমায় চিনি শাবাব। তুমি এক মুখে দুই কথা বলো।”

শাবাব বলল,“আমি কসম করেছিলাম তোমার জীবন জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়বো। আমি সেটা করেছি। এবারও চাই তুমি আগের মত নিজের জীবন নিয়ে খুশি থাকো।”

ফাবিহার বুক থেকে ভারী পাথরটা নেমে গেল। উৎফুল্ল চোখে চেয়ে বলল,“আমাদের তো কাগজে-কলমে বিয়ে হয়নি। তাহলে মুখেই ডিভোর্স দিয়ে দাও।”

শাবাব থমকে গেল। ফাবিহাকে বিয়ে করার কথা সে কখনো কল্পনা করেনি। হঠাৎ করে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দুজনের জীবন জুড়ে গেল। দুজনের কেউই কাউকে চায়নি। তবুও শাবাব যেন বাঁধা পাচ্ছে। সে মলিন হেসে বলল,“যেখানে মন থেকে কেউ কবুলই বলিনি সেখানে ডিভোর্স আবার কী?”

ফাবিহা বলল,“আমি কৃতজ্ঞ থাকবো তোমার কাছে। আশা করছি তুমি আর আমার সামনে আসবে না।”

“আসবো না।”

রাতে ফাবিহার ভালো ঘুম হলো। সকালে সে সব গুছিয়ে নিচে নামলো। সুরাইয়া আর ফিরোজ আলম দুজনে একসাথে জিজ্ঞেস করলেন,“তোমরা কোথাও যাচ্ছো?”

শাবাব বলল,“ফাবিহা চলে যাচ্ছে ওর বাড়ি। আমরা একসাথে সংসার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

ফিরোজ আলম, সুরাইয়া, তুলি তিনজনই বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন।

#চলবে……

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২৬
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

সুরাইয়া আতঙ্কিত স্বরে বললেন,“কী বলছো তোমরা? দুজনে বিয়ে করেছো না? তাহলে এসব কী বলো?”

শাবাব বলল,“শান্ত হও মা। বিয়েটা আমাদের ইচ্ছেতে হয়নি। সংসার করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।”

ফিরোজ আলম গরম হয়ে গেলেন।
“সব তোমাদের মর্জিমাফিক হবে? প্রথম থেকে যেভাবে আমাদের নাচিয়ে এসেছো, আমরাও সেভাবেই নেচে এসেছি।”
অতঃপর শুধু শাবাবের উদ্দেশ্যে বললেন,“তুই বিয়ে যেহেতু করবি না, তাহলে এত কাহিনী কেন করলি? বিয়ের উদ্দেশ্য না থাকলে একটা মেয়ের পেছনে এভাবে পড়ে থাকার কারণ কী?”

শাবাব চুপ করে রইল। এর যথাযোগ্য জবাব তার কাছে নেই।
“চুপ করে থাকবি না। আমার কথার জবাব দে।”

শাবাব শক্ত মুখে বলল,“কারো ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সংসার সম্ভব নয় বাবা। আমরা কেউই আর সংসার করতে চাই না।”

ফাবিহা বলল,“আমি এই বিয়েতে খুশি নই। বাবার জোরাজোরিতে এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি।”

সুরাইয়া একবার ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন তো একবার ফাবিহার দিকে। শাবাবের মুখ দেখে তিনি আন্দাজ করে নিলেন শাবাব যা বলছে মিথ্যা বলছে। এভাবে সংসার ভেঙে দেওয়াতে তার মত নেই। সে হয়তো জোরপূর্বক এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি এবার পুরোপুরি নরম খোলসে বেরিয়ে এলেন। ফাবিহাকে ধরে বললেন,“এসব বলে না মা। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ভাবছো সংসার ভেঙে এখান থেকে চলে গেলে তোমার জীবন আরো সহজ হবে। এসব ভুলেও চিন্তা কোরো না। জীবন আরো কঠিন হয়ে যাবে। এভাবে নিজেদের জীবন নষ্ট কোরো না।”

ফাবিহা সুরাইয়ার হাতে হাত রেখে নরম স্বরে বলল,“দেখুন আম্মা, আপনাদের কারো উপর আমার রাগ নেই। আমার পক্ষে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে সংসার করা সম্ভব নয়।”

সকলেই অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো। অতঃপর নিরবতা ভাঙলেন ফিরোজ আলম। ফাবিহার উদ্দেশ্যে বললেন,“আমরা তোমায় আটকাবো না। তবে তোমাকে একা তো ছাড়া যায় না। তোমার বাবা-মাকে খবর দিচ্ছি।”

ফাবিহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। ফিরোজ আলম ফোন বের করে কল দিলেন আতাউর রহমানের নম্বরে।

আতাউর রহমান স্ত্রী নিয়ে চলে এলেন। দুই পরিবারের উপস্থিতিতে শাবাব আর ফাবিহাকে আরেকবার ভাবতে বলা হলো। তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল। ফাবিহার মা মেয়ের পক্ষে। তিনি মেয়েকে বল দিয়ে বললেন,“মা তোর পাশে সবসময় আছি।”

সকালের নাস্তা আর কারো হলো না। পরিস্থিতিই এমন ছিলো যে, গলা দিয়ে খাবার নামানোর চিন্তা কারো মাথায় ছিলো না। শেষ পর্যন্ত ফাবিহা আর শাবাবের সিদ্ধান্তেই সবাইকে হার মানতে হলো। ফাবিহার বাবা-মা তাঁদের সাথে মেয়েকে নিয়ে যাবেন। ফাবিহা জেঠী শাশুড়ির দেওয়া গলার হার আর টাকা শাশুড়ির হাতে দিয়ে বলল,“এগুলো যার প্রাপ্য, তাকেই দেবেন। আসি আম্মা।”

সুরাইয়া বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এরপর ফিরোজ আলমের কাছ থেকে বিদায় নিলো ফাবিহা। শাবাবের দিকে আর ফিরে তাকালো না। বাবা-মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে এলো। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো তিনটি মানুষ।
দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যেতেই ফিরোজ আলম শাবাবের দিকে তাকালেন। রাগে, কষ্টে, অপমানে বললেন,“সারাজীবন তুই আমাকে ছোটোই করে এসেছিস। কোনোদিন আমার মুখ উজ্জ্বল করতে পারিসনি। না আদব-কায়দায় আর না পড়াশোনায়। কোনোদিন একবিন্দু শান্তি দিসনি আমায়। ভুল করেছি তোকে বাঁচিয়ে রেখে। ছোটো বেলায় লবণ খাইয়ে মে*রে ফেললেই ভালো হতো। তুই ম*র*তে পারিস না?”

শাবাব অসহায়বোধ করলো। সুরাইয়ার বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠলো। তিনি বিচলিত কণ্ঠে বললেন,“কী বলছো এসব?”

ফিরোজ আলম রাগের মাথায় আবারো বললেন,“তোমার ছেলেকে যেহেতু সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে শিখে গিয়েছে, তাহলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের রুটিরুজি নিজেকে জোগাড় করতে বলে দিও। তার দায়িত্ব নেওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।”

স্থান ত্যাগ করলেন তিনি। শাবাব ভেবে দেখলো তার কৃতকর্মের ফল সে একা নয়, বরং আশেপাশের সব মানুষকে ভোগ করতে হচ্ছে। নিজের জন্য আরো একটি সিদ্ধান্ত নিলো। বাবা-মাকেও এবার একটু শান্তি দেওয়া প্রয়োজন। ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। নিস্তেজ পায়ে হেঁটে এলো নিজের ঘরে। সুরাইয়া সবসময় ছেলের অন্যায়কে অন্যায় মনে করেননি। আজ আর স্বামীর বিরুদ্ধে ছেলের জন্য প্রতিবাদ করতে পারেননি। তিনিও চুপ ছিলেন। কিন্তু শাবাবের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবগত হলে বোধহয় আরো একটা চমক পেতেন।

দুপুরে সবাইকে খেতে ডাকলো তুলি। আশ্চর্যজনকভাবে সবাই এসে চুপচাপ খেয়েও নিলো। কাউকে দ্বিতীয়বার খাবারের জন্য ডাকতে হয়নি। কিন্তু কারো মুখে কথা ছিল না।

ফাবিহা নিজেকে মুক্ত পাখি ভেবে প্রাণ খুলে হাসলো। অনেকদিন পর নিজের বাড়ির ছাদে এলো। পাশের বিল্ডিং এর এক আন্টি জিজ্ঞেস করলেন,“আরে ফাবিহা যে! কেমন আছো? কবে এসেছো শশুর বাড়ি থেকে?”

ফাবিহা হাসিমুখে বলল,“আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি আন্টি। এসেছি আজই।”

“এবার এত তাড়াতাড়ি আসতে দিল? দুই-তিন দিনই তো হলো।”

ফাবিহা হেসে হেসেই জবাব দিল,“আসতে কেন দেবে না? আমি আসতে চাইলে আমাকে আটকে রাখার সাধ্যি কার?”

“যাই বলো, ভালো শশুর বাড়ি পেয়েছো তবে। আমার মেয়েটাকে তো বছরেও আসতে দেয় না।”

ফাবিহা কথা বললো না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন,“জামাইকে একবারও দেখলাম না। কখন আসে কখন যায়?”

ফাবিহা মনে মনে বলল,“আর কখনো দেখবেন না।”
মুখে বলল,“দেখেছেন হয়তো চিনতে পারেননি।”

“হবে হয়তো।”

ফাবিহা নিচে নেমে এলো। ফোন থেকে নিজের হাতের ছবিটা ডিলিট করে দিল। এটার আর প্রয়োজন নেই। ভেবেছিল শাবাবের বিরুদ্ধে এমন ছোটোখাটো কিছু প্রমাণ রেখে দেবে। যাতে পরবর্তীতে তাকে কেউ সংসার করার জন্য জোরজবরদস্তি করতে না পারে। এখন শাবাব নিজেই যেহেতু তার সিদ্ধান্তে একমত হয়েছে, তাই তার বিরুদ্ধে যাওয়ার আর প্রয়োজন পড়ছে না। আর একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সুমনের। মনে হচ্ছে না সে সোজা হবে। চুপ থাকলে বরং তার সাহস আরো বেড়ে যায়।

★★★

তাসিন এশার নামাজ পড়ে মসজিদে বসে রইলো। মোনাজাতে আজকাল সকলের সাথে তার অনাগত সন্তানও ঠাঁই পাচ্ছে। সে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারছে পরিবর্তন যেকোনো বয়সে হওয়া যায়। চেষ্টা থাকলে কোনোকিছুই অসম্ভব নয়। দ্বীনের পথে চলতে গিয়ে অনেকের সাথেই দূরত্ব বেড়েছে। এতে এখন আর আফসোস হয় না। মসজিদ থেকে বেরিয়ে বাড়ি গেল। রাতে খেতে বসেই সাজেদা বললেন,“বউকে আর কতদিন বাপের বাড়ি তুলে রাখবি? এবার বাড়ি নিয়ে আয়।”

তাসিনের বাবা চোখ কপালে তুলে বললেন,“তুমি না শান্তিতে আছো? বউমা বাড়ি থাকলেই তো তোমাকে বিরক্ত করে।”

সাজেদা চোখ পাকিয়ে তাকালেন।
“তাই বলে কি স্বামীর বাড়ি আসা লাগবে না? সারাজীবন বাপের বাড়িতেই থাকবে?”

তাসিন খানিক মুচকি হাসলো বাবা-মায়ের ঝগড়া শুনে। তবে মনে মনে দুঃখ প্রকাশ করলো বেশি। শশুরের দেওয়া শর্ত সম্পর্কে বাবা অবগত হলেও মা কিছুই জানেন না। তাই চাইলেও যে এখন হুরাইনকে নিয়ে আসা যাবে না সেটা মা বুঝবেন না। তাসিন বাবার দিকে তাকাতেই তিনি সাজেদার উদ্দেশ্যে বললেন,“বউমা ওখানে থেকে আরেকটু শক্ত হয়ে আসুক।”

সাজেদা তেতে উঠলেন।
“আমি কি তার দেখাশোনা করতে পারবো না? তোমরা ভাবো আমি সারাদিন ওকে কাজ করাবো? নবদের ছেলেমেয়ের জন্য যদি আমি সব কাজ করতে পারি, তাহলে নিজের নাতি-নাতনির জন্য পারবো না?”

তাসিনের বাবা বললেন,“তুমি বুঝতে পারছো না। আমি ওটা বুঝাতে চাইনি। আমি বলতে চেয়েছি তুমি সংসারের কাজে মন দিলে বউমার খেয়াল রাখবে কীভাবে? ওখানে তো তার মা আছে, ভাবি আছে। বোনেরাও আসা-যাওয়া করে।”

সাজেদা কথা বললেন না আর। মেজাজ এখন খুব খা*রা*প আছে। নিশি চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল। তাসিনও খেয়ে ধীরেসুস্থে ঘরে এলো।
স্ত্রীকে এখনো থমথমে দেখে তাসিনের বাবা সাজেদার মুখোমুখি হয়ে বললেন,“আজ আমাকে কিছু সত্যি কথা বলবে সাজেদা?”

সাজেদা বেগম চমকালেন। কী সত্যির কথা জানতে চাইছেন? তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন স্বামীর কাছ থেকে কী লুকিয়েছিলেন!
“কী হলো? বলে।”

“বলো কী সত্যি জানতে চাও?”

“তুমি কি সত্যিই বউমাকে পছন্দ করো না? একেবারে মন থেকে বলবে। ফাবিহার সাথে এমন একটা কাণ্ড না ঘটলে কি তুমি সত্যিই হুরাইনের মত বউ পেয়ে খুশি হতে না?”

সাজেদা হাত ছাড়িয়ে নিলেন।
“এটা তোমার প্রশ্ন? যা হওয়ার হয়েছে, বাদ দাও।”

“তোমাকে আজ বলতেই হবে।”

সাজেদা আজ মনের রাগ ইচ্ছেমতো মিটিয়ে বলতে শুরু করলেন,“আমি কত বড়ো মুখ করে বোনের মেয়েকে চাইলাম। তাদের কাছে আমাকে ছোটো বানিয়ে দিল তোমার ছেলে। সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আমার উপর থেকে। শুধু কি আমি ছোটো হলাম? মেয়েটার মনের অবস্থা কীরকম হয়েছিল? তোমার পুত্রবধূ এসে একেবারে সিংহাসন গেঁড়ে বসেছেন। সবটার মূলে রয়েছে সে। তাই তাকে আমি মন থেকে মানতে পারছি না।”

তাসিনের বাবা বললেন,“সত্যিই কি মন থেকে মানতে পারছো না? তাহলে তাকে বারবার কেন নিয়ে আসতে বলছো? আর যা কিছু হয়েছে তাতে তো তার কোনো হাত নেই। সব দোষ তোমার ছেলের। অথচ ছেলের সাথে দিব্যি কথা বলে যাচ্ছো। তাহলে পরের মেয়ে কী দোষ করলো?”

সাজেদা মুখ ঘুরিয়ে বললেন,“তাকে এই বাড়িতে আনতে বলছি আমার নাতি-নাতনির কথা ভেবে। আমি তো দাদি।”

তাসিনের বাবা আলগোছে হাসলেন। বললেন,“আমি কিছু বলবো না সাজেদা। তুমি একবার নিজের পরিষ্কার মনকে জিজ্ঞেস করে সব প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে নিও।”

তাসিন শশুর বাড়ি এলো। জনাব আজাদ সরু চোখে তাকিয়ে আছেন। নিজের সন্তানের কথা বলে ঘনঘন আসা-যাওয়ার রাস্তা তৈরি করে নিয়েছে। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন,“আপনি কিন্তু শর্ত ভঙ্গ করছেন।”

তাসিন ভদ্রতা করে হাসলো। নরম সুরে বলল,“শর্ত ছিল আপনার মেয়ে আমার সাথে যাবে না। কিন্তু আমার আসা বারণ ছিল না। যদি বারণ ছিল ধরেও নিই তাহলেও আরেকটা পথ খোলা আছে আমার।”

“ওটাই তো সব সমস্যা।”

তাসিন বলল,“আল্লাহ চান আমি এখানে আসি, সেজন্যই আমার জন্য পথ খুলে দিয়েছেন।”

জনাব আজাদ আর কথা খুঁজে পেলেন না। তাসিন ভেতরে গেল। হুরাইন হাঁটাহাঁটি করছে। দুই ঠোঁট গোল করে কী কী পড়ছে। রাগ হলো তার। এতটা পাষাণ কীভাবে একটা কোমলমতি মেয়ে হতে পারে? স্বামীর জন্য মনে একটু দয়ামায়া নেই। তাসিন পেছন থেকে গলা ঝাড়লো। হুরাইন পিছু ফিরে তাকালো। তাসিনকে দেখে উপরে বেশ বিরক্ত হওয়ার ভান ধরলো।
“আপনি কেন এসেছেন? মাঝে একদিন না যেতেই আবার উপস্থিত?”

“আমি নিশ্চয়ই তোমাকে দেখতে আসিনি।”

মুখ বাঁকালো হুরাইন। তাসিন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,“আমার বাবু কী খেয়েছে?”

হুরাইন চোখ সরু করে তাকালো। বলল,“আমি কী খেয়েছি সেটা জিজ্ঞেস করলেই পারেন।”

“তুমি কী খেয়েছো সেটা আমার জনয়ার প্রয়োজন নেই। তোমার বাবা আছেন সেটা জানার জন্য। আমি আমার সন্তানেরটা জানতে চাইছি।”

মনে মনে হাসলো হুরাইন। মুখে বলল,“তাহলে আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ কী? নিজেই জিজ্ঞেস করে নিন নিজের বাচ্চাকে।”

“সে কথা বলতে জানলে নিশ্চয়ই তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম না!”

তাসিন চোখ ঘুরিয়ে হুরাইনের চুলের দিকে তাকালো। বলল,“তুমি কি চুলে তেল দাও না? আমার বাচ্চার চুল পাতলা হলে তোমার দোষ। আমি তখন তোমাকে ধরবো। তেল কোথায়?”

তেল খুঁজতে লাগলো তাসিন। হুরাইন বলল,“চুল পাতলা হলে নাহয় আমার দোষ। কিন্তু বেদ্বীন তৈরি হলে কার দোষ?”

তাসিন এখন আর রাগ করে না। তেল খুঁজে পেয়ে হুরাইনের পেছনে গিয়ে বসলো। হাতে তেল নিতে নিতে বলল,“তাকে এবং তার বাবাকে দ্বীনি পথে পরিচালনা করার দায়িত্ব তার মায়ের। ছাত্র শিখতে না পারলে অবশ্যই তাকে শাসন করার অধিকার শিক্ষকের রয়েছে।”

আজ ছুটির দিন হওয়ায় তাসিন এখানে রইলো। শশুরের সাথে জামাআত ধরার জন্য বের হলো। জনাব আজাদ লক্ষ করছেন তাসিনকে। জুমার নামাজ শেষে আজ মসজিদ জিলাপি দেওয়া হলো। হুরাইন জিলাপি পছন্দ করে। সে হাতে করে নিয়ে এলো হুরাইনের জন্য। জনাব আজাদ একটা নাতির হাতে দিলেন, আরেকটি হুরাইনের হাতে। হুরাইন হাসলো। স্বামী – বাবা দুজনের মাঝে চলা নিরব যুদ্ধ সম্পর্কে সে অবগত। পেটে হাত রেখে বলল,“তুমি বলো তো, তোমার বাবার শাস্তিটা কি এবার একটু কম করা উচিত?”

দুপুরে খাওয়ার পর হুরাইন আর জনাব আজাদ কথা বলতে বসলেন। দুজনের চেহারাই বেশ ভাবুক বানিয়ে রেখেছে। হুরাইন বলল,“আমার মনে হয় এবার আমার ফিরে যাওয়া উচিত আব্বু। কারণ ওনার কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে সেটা আমি দূরে থাকার কারণে দেখতে পাচ্ছি না।”

জনাব আজাদ তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললেন,“বাহ্যিক যেটুকু আমি নজর রাখতে পেরেছি, তাতে আলহামদুলিল্লাহ অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে।”

“তাছাড়া আমার শাশুড়ি, ননদ ওনারা কিন্তু আমি দূরে থাকায় দ্বীন থেকে আরো দূরে সরে যাচ্ছেন। আমার যাওয়া উচিত।”

“ঠিক আছে। আপনি যাবেন আম্মু। আগে দেখুন জামাই নিজ থেকে আপনাকে যেতে বলে কি না?”

হুরাইন হাসলো কেবল। বাবা না জানলেও সে তো জানে তাসিনের এখানে বারবার আসার উদ্দেশ্য কী। সে কী চায়।

★★★

শাবাব কিছু জামাকাপড় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে মাকে ফোন করে বলল,“আমাকে ক্ষমা করে দিও মা। আমি আর তোমাদের অসম্মানের কারণ হতে চাই না। আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি।”

সুরাইয়ার হাউমাউ কান্নার আওয়াজ শুনে ফোন কেটে দিল শাবাব। মায়ের জন্য তার মনটা কেমন করছে। চোখে পানি এসে ভীড় জমাতে চাইছে।
সাথে কিছু টাকা ছিলো। সেগুলো দিয়ে অনায়াসে দিন পনেরো কেটে গেল। যখন পকেট শূন্য হলো তখন উপলব্ধি হলো বাবা কী জিনিসের নাম। মানুষ সবসময় মায়ের অবদানের কথাই বলে বেড়ায়। বাবা বাইরে থাকেন। লালনপালন, খাওয়ানো, ময়লা পরিষ্কার করা সব করেন মা। অথচ আরেকটু গভীরে গিয়ে ভাবলে উপলব্ধি করা যায় লালন-পালন, আরাম-আয়েশের জীবনের জন্য গাধারখাটুনি করতেই তো বাবা বাইরে থাকেন। খাঁ খাঁ রোদে ঘামে জবজবে শরীর নিয়ে যখন একজন রিকশাচালক বাবার দিকে তাকানো যায়, তখন বুঝা যায় বাবার গুরুত্ব কতটুকু।

কয়েকজন বন্ধুর কাছ থেকে ধারে টাকা নিলো। যে ছেলে বাবার টাকার দাপুটে বন্ধুদের নিয়ে টাকা ছিটিয়েছে, সেই ছেলেই বাবার ছায়া থেকে বেরিয়ে টাকা ধার করে চলছে। যতগুলো দিন পেরুচ্ছে ততই জীবনটা কঠিন ও দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে আজকাল সম্মানটাও পাচ্ছে না। পাবে কী করে? যেখানে কোনো মুরব্বি দেখলে সম্মান দিয়ে কথা বলাটা অতি অপ্রয়োজনীয় মনে করতো সে, সেখানে সে কীভাবে সম্মান পাবে? সময়ের তীরটা ঘুরতে ঘুরতে একদিন নিজের দিকেই তাক হয়।
বন্ধুদের ধার করা টাকাও ফুরিয়ে এলো। এখন হাত শক্ত করে খরচ করে। একবেলা খেলে আরেকবেলা না খেয়ে থাকে। তিনবেলা খেলেই যে টাকা ফুরিয়ে যাবে। পড়াশোনায় কোনোদিন ভালো করেনি। চাকরির বাজারে তার কদর নেই। যেসব কাজ হাতের কাছে পাচ্ছে তাতে তার প্রেস্টিজে লাগছে। তারউপর বেতন সামান্য।

মসজিদে আজান হয়েছে। পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো শাবাব। অনেকেই ঢুকছেন মসজিদে। শাবাব তাকিয়ে রইলো। কবে সে মসজিদে গিয়েছে, কবে এক ওয়াক্ত নামাজ পড়েছে সে মনে করতে পারছে না। খুব ছোটোবেলায় বাবার হাত ধরে সেই যে মসজিদে আসা হলো। এরপর আর আসা হলো না। অনেক ভেবেচিন্তে মসজিদের দিকে পা বাড়ালো সে। অন্যদের দেখাদেখি ওজু করলো। কিন্তু ওজুর পূর্বে, ভেতরে কী পড়তে হয় সে জানে না। বিসমিল্লাহ পড়ে ওজু শেষ করে মসজিদে পা রাখলো। শরীর কেমন কাঁটা দিয়ে উঠলো। নামাজ পড়ে মলিন মুখে বসে রইলো। সকলে বেরিয়ে গেলেন। তখনও দুজন হুজুর ভেতরে বসা ছিলেন। তারাও বেরিয়ে গেলেন। শাবাব বসে রইলো। ঘন্টাখানেক পর সেই হুজুরের মধ্যে একজন ভেতরে এসে শাবাবকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে ডাকলেন।
“বাবা, আপনি বাড়ি যাবেন না?”

“হুঁ?”
শাবাব অন্যমনস্ক ছিলো। তিনি বললেন,“অনেকক্ষণ যাবত বসে আছেন দেখছি। বাড়ি যাবেন না?”

শাবাব নিস্তেজ গলায় বলল,“বাড়ি তো নেই।”

“বাড়ি থেকে রাগ করে এসেছেন? রাগ না করে ফিরে যান বাবা।”

“কীভাবে ফিরবো? আমি আমার আশেপাশের সব মানুষকেই অশান্তিতে রাখি। আজ আমার নিজের জীবনেই শান্তি নেই।”

“কী হয়েছে। খুলে বলুন।”

শাবাব নিজের সমস্ত কৃতকর্মের কথা বললো। কীভাবে সে মানুষকে অসম্মান করে এসেছে, মেয়েদের পেছনে ছুটেছে, বাবা-মায়ের সাথে অন্যায় করেছে। শেষমেশ স্ত্রীর সাথে বিয়ের আগেও ও পরে কী করেছো সব বললো।

সে ভেতর থেকে খুবই ভেঙে পড়লো। বলল,“আমি কীভাবে ক্ষমা পাবো?”

হুজুর বললেন,“ক্ষমা করলেও মন থেকে একবার যে অভিশাপ লেগেছে সেটা তো ফেরানো সম্ভব নয়। বুলেট একবার ছুঁড়লে সেটা যেমন ফেরানো যায় না, তেমনি গুরুজন, বাবা-মায়ের মনে কষ্ট এসে গেলে না চাইতেও যে অভিশাপটা পড়ে তা ফেরানো সম্ভব নয়। আপনি বরং বাড়ি ফিরে যান। বাবা-মা মুখে কিছু বললেও আবার বুকে টেনে নেবেন।”

হুজুর চলে গেলেন। শাবাব বেরিয়ে এলো মসজিদ থেকে। মা-বাবা দুজনের কথাই খুব মনে পড়ছে। ফাবিহার বিষয়টি তাকে যতটা না পোড়ায়, তারচেয়ে বাবা-মায়ের সাথে করা অন্যায়, তাদের কাছ থেকে দূরে থাকাটা তাকে পোড়ায়।

ফাবিহা প্রথম কিছুদিন শান্তিতে চলাফেরা করলেও এখন সকলেই ওর স্বামীর কথা, শশুর বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে। ফাবিহা বলেও দিয়েছে সে একেবারে চলে এসেছে। সেই থেকেই তার জীবনে নেমে এসেছে বাঁকা চোখের চাহনি। প্রথম থেকেই অপয়া, অলক্ষ্মী ট্যাগ ছিল। এখন সকলের চোখে সে খুবই ছোটো একটা প্রাণী। ফাবিহা নিজেকে প্রশ্ন করে “জীবনে সুখ কোথায়? কোথায় গেলে একটা সুস্থ জীবন পাওয়া যাবে?”

#চলবে…….

রি-চেইক করা হয়নি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে