এক টুকরো আলো পর্ব-০৩

0
506

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_০৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

চারিদিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে। জায়নামাজ গুছিয়ে উঠানে হাঁটতে বের হলো হুরাইন। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে রান্নাঘরে ঢুকলো। সবার জন্য চা করে বের হতেই ভাবির সাথে দেখা হলো। মিষ্টি হেসে ভাবির দিকে এক কাপ চা বাড়িয়ে ধরলো।
ভাবি খুশি হয়ে হাস্যজ্জ্বল চেহারায় হাত বাড়িয়ে চা নিলো। দুষ্টুমি করে বলল,“এমন ননদিনীর বিয়ে হয়ে গেলে আমার খুব আফসোস হবে। প্রতিদিন আরাম করে চা খাওয়াটা মিস হয়ে যাবে যে!”

চোখ পাকিয়ে তাকালো হুরাইন। গালে লজ্জার আভা স্পষ্ট ফোটে উঠেছে। বলল,“আমার এখনো পড়া শেষ হয়নি।”

“ওই তো আর মাত্র একটা বছর। তারপর তো।”
ঠোঁট টিপে হাসছে ভাবি।

“এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে ভাবি।”
লজ্জা পেয়ে রাগ দেখালো হুরাইন।
ভাবি আরেকটু রাগানোর জন্য বলল,“তোমার ভাইয়ার সাথে কথা বলবো?”

“ভাবি।”

দ্রুত পা চালিয়ে চায়ের ট্রে হাতে চলে গেল হুরাইন। বাড়ির সকলের হাতে এক কাপ করে চা দিয়ে শেষে বাবা-মায়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজায় নক করতেই বাবা বললেন,“আসুন মা।”

জনাব আজাদ জানেন বাইরে হুরাইন দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন সকালে এই সময়টাতে চা নিয়ে এসে দাঁড়ায়। ভেতরে ঢুকে বাবা-মা দুজনকে চা দিয়ে নিজের জন্য এক কাপ নিয়ে বসলো। বাবা জিজ্ঞেস করলেন,“পড়াশোনা কেমন চলে? মাদ্রাসায় কোন সমস্যা হয়?”

“না আব্বু, সব ঠিকঠাক। পড়াশোনাও ভালো চলছে আলহামদুলিল্লাহ।”

চা শেষ করতে করতে বাবা-মায়ের সাথে টুকটাক কথা বলে বেরিয়ে এলো হুরাইন।

মাদ্রাসার জন্য তৈরি হয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। বান্ধবীদের জন্য অপেক্ষা করছে। তিনজনই চললো সামনের মোড়ে৷ সেখানে সবসময় সিএনজি পাওয়া যায়। একটা সিএনজি ঠিক করে বাজারের উপর এসে নামলো তারা। এখান থেকে মাদ্রাসা একটু ভেতরে। ওটুকু পথ হেঁটেই যেতে হয়। হুরাইন চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে।
চা দোকানের ভেতর থেকে একজোড়া দৃষ্টি তার উপর পড়ে আছে। আধাঘন্টা পূর্বে এখানে এসে বসেছে তাসিন। একটা কালো বোরকা পরা ছাত্রীকে যেতে দেখলেই বুক ধ্বক করে উঠতো। এই বুঝি হুরাইন চলে যাচ্ছে। কিন্তু না,কাছাকাছি এগিয়ে এলে ভুল প্রমাণিত হয়। এবার আর ভুল হলো না। হুরাইন সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একবারও আশেপাশে তাকাচ্ছে না। তাসিন নিমেষহীন তাকিয়ে রইলো। একটিবার তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারতো মেয়েটা। দৃষ্টি সীমানা পেরিয়ে যেতেই বেরিয়ে পড়লো তাসিন। আজ তাড়াতাড়ি অফিসের জন্য বের হতে দেখে মা নানা রকম প্রশ্ন করছিলেন। এখন থেকে এই সময়েই বের হতে হবে বলে এসেছে তাসিন। এখান থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে গাড়ি ধরলো।

আজও একটা লাভ লেটার পেয়েছে ফাবিহা। কাগজের ভাঁজ খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে লাভ লেটারটি পড়লো সে। বাংলা ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী কিনা। বেশ কয়েকটি বানান মার্ক করে সামনের ছেলেটিকে বলল,“তোমার ভাইকে বলে দিও বাংলা বানানটা শিখে নিতে।”

ছেলেটি মাথা নিচু করে রইলো। ফাবিহা প্রস্থান করতেই বিড়বিড় করে বলল,“ভাই কীভাবে এই নাক উঁচু মেয়েটিকে পছন্দ করেছে?”

শাবাবের সাথে দেখা হয়ে গেল ফাবিহার। শাবাব বলল,“চিঠির জবাব?”

ফাবিহা সংকোচহীন গলায় বলল,“আপনার চামচার কাছে জবাব দিয়ে এসেছি।”

দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে এলো শাবাবের। ধমকে উঠলো ফাবিহাকে।
“শাটআপ। ও আমার চামচা নয়। ছোটো ভাইয়ের মতো।”

ফাবিহা বিদ্রুপ করে হাসলো। দাঁড়ানোর প্রয়োজন মনে করলো না। ঝট করে হাত চেপে ধরলো শাবাব। চোখ জ্বলে উঠলো ফাবিহার। মাথা গরম হয়ে গেল তার। শাবাবের গালে চড় বসিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করলো,“অ*স*ভ্য। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বে*হা*য়া*প*না করা হচ্ছে। ”

শাবাবের চোখে জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ। অপ*মানে র*ক্ত টগবগ করে উঠলো। গালে হাত বুলিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে শাসিয়ে উঠলো ফাবিহাকে।
“আমি তোমাকে দেখে নেব। নিজের পায়ে কুড়াল মে*রে*ছো।”

ফাবিহা কোন কিছুর পরোয়া না করে বেরিয়ে গেল গেট দিয়ে। বলতে হয় মেয়েটার সাহস আছে৷ কেবল তাসিনকে দেখলেই তাকে লজ্জারা ঘিরে ধরে। প্রচন্ড নির্লজ্জ মেয়েরাও যাকে ভালোবাসে, তার চোখে দৃষ্টি মেলাতে গিয়ে লজ্জা পায়। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। এটাই হয়তো ভালোবাসার ক্ষমতা।

তাসিন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলো। ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে এসেই দেখলো মা খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। একটা চেয়ার টে*নে বসে পড়লো তাসিন। কয়েক লোকমা খাওয়ার পরই মা বললেন,“ফাবিহাকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আয়।”

তাসিনের পরিবারে একেবারে খোলা মনের। আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে অভ্যস্ত। ছেলে তার হবু বউ নিয়ে ঘুরতে যাবে, এগুলো স্বাভাবিক বলেই গণ্য হয়। তাসিন খাওয়া শেষ করলো চুপচাপ। শেষে টিস্যু দিয়ে হাত মুছে মায়ের দিকে না তাকিয়েই বলল,“আপাতত বিয়ের ব্যাপারটা বন্ধ রাখ মা। এখনই বিয়ের ব্যাপারে ভাবছি না আমি।”

মা বললেন,“আশ্চর্য! এখন বিয়ে করবি না কখন করবি? বুড়ো হলে? চাকরি করছিস। একটা হ্যান্ডসাম স্যালারি পাচ্ছিস। তাহলে বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়?”

“আমার কিছু ব্যক্তিগত মতামত নিশ্চিয়ই থাকতে পারে।”

মা শান্ত হলেন। বললেন,“সেটা কেন থাকবে না। আচ্ছা এখন বিয়ে না করলি। সেটা তোরা দুজনে কথা বলে নিস নিজেদের মধ্যে। যখন ইচ্ছে হবে তখন দু’জন আমাদের জানিয়ে দিবি।”

তাসিন কথা বাড়ালো না। কারণ তার মন এখনো দ্বিধাদ্বন্দে আছে। নিজের কাছে নিজেকে ক্লিয়ার করাটা জরুরি।

★★

আজ দুই বান্ধবীর একজনও মাদ্রাসায় যাবে না। একাই যেতে হচ্ছে হুরাইনকে। না গেলেও শাস্তি পেতে হবে। একা যেতে কেমন অস্বস্তি লাগে। সাথে বান্ধবীরা থাকলে যেমন একটা বল পাওয়া যায়, একা হলে সেটা পাওয়া যায় না। একা গিয়ে একা একাই ফিরছে সে। সিএনজি থেকে নেমে কিছুটা ভেতরের দিকে তাদের বাড়ি। হাঁটতে গিয়ে সামনে দুটো কুকুর দেখলো। তার দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করছে৷ ভয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ভেতরে আল্লাহর নাম জপছে হুরাইন। সামনে পা চলছে না। চোখ বুঁজে এক পা বাড়াতে গিয়ে টের পেল কুকুর দুটো তার দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের আওয়াজ বেড়ে গিয়েছে। এক পা দু-পা করে রাস্তার পাশে গিয়ে একটি পুকুরের কিনারায় চলে গেল। কুকুর দুটো ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে। বুকের ভেতর ত্রাস চলছে। আল্লাহ আল্লাহ করে প্রস্তুতি নিচ্ছে হুরাইন। কুকুরের কামড় নিশ্চিত মনে করে চোখ বন্ধ করতেই মানুষের স্বর শুনতে পেল। সাহস পেয়ে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো একজন যুবক কুকুর দুটোকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। তার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। ঝট করে মাথা নিচু করে নিলো হুরাইন। পাশ কাটিয়ে চলে গেল সে। তাসিন কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। হুরাইনের এই তাকানোটা তার ভেতরে ঝড় তুলে দিলো। অথচ সে নিকাবের উপরের পাতলা আবারণের জন্য ঠিকঠাক মেয়েটির চোখের সৌন্দর্যও দেখতে পেল না। তবুও তার চোখে প্রশান্তি ঢেউ খেলছে।

মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো তাসিন। যাই হয়ে যাক না কেন, সে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। বাসায় জানিয়ে দেবে হুরাইনের কথা। শুধু শুধু ফাবিহাকে আশা দেখিয়ে লাভ নেই। মেয়েটার দোষ নেই। দোষটা তার। হুরাইনকে নিজের কৌতুহল ভেবে সে মাকে বিয়েতে হ্যাঁ বলেছে। ভেবেছিল বিয়েটা হয়ে গেল হয়তো তার কৌতুহল মিটে যাবে। এখন কৌতুহল মিটে নি। বরং বেড়ে গেল। তাসিন গভীর স্বরে বলল,“মৃ*ত্যু*র আগ পর্যন্ত তোমাকে জানতে চাওয়ার তৃষ্ণা বেড়ে গেল হুরাইন। কিন্তু তার জন্য যে তোমাকে নিজের জন্য হালাল করা জরুরি।”

ফাবিহা সেজেগুজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসলো। মনে প্রজাপতি ডানা মেলেছে। আজ দেখতে পাবে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে। বিয়ের কথা ওঠার পর থেকে তাসিন কেমন পর পর আচরণ করছে। নাকি অস্বস্তিতে কথা বলতে চাইছে না! সে না-হয় তাসিনকে পছন্দ করতো বলে বিয়ের কথা ওঠায় মনে মনে আরো লাড্ডু ফুটেছে। নিজের মনে সবটা ভাবছে ফাবিহা। মায়ের সাথে বের হলো সে। খালার বাড়ি এসে বাধ্য মেয়ের মতো খালার হাতে হাতে কাজ গুছিয়ে দিচ্ছে। তাসিনের মা যতই না করছেন, ফাবিহা শুনছে না। মনে মনে বেশ সন্তুষ্ট তিনি। ছেলে বউ হিসেবে ফাবিহা সোনার হরিণ। সংসারী মেয়ে। তাসিনের বোন নিশি সোফার উপর পা তুলে বসে মিটিমিটি হাসছে। ফাবিহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নিশি হাসতে হাসতে বলল,“তোমাকে বউ বউ লাগছে। ভাবি ডাকতে ইচ্ছে করছে।”

ফাবিহা আশেপাশে তাকালো। তাসিনকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ঠোঁট টিপে হেসে ফিসফিস করে বলল,“তোর ভাবি ডাক শোনার জন্য আমি মুখিয়ে আছি। যত ইচ্ছে ডাক। তবে অন্যদের সামনে ডাকবি না। আমি কিন্তু লজ্জা পাব।”

নিশি হাসি আটকানোর চেষ্টা করে বলল,“তুমি আবার লজ্জাও পাও।”

“একদম ভাবির সাথে মশকরা করবি না। তোর ভাইকে বলে একদম হাত খরচা বন্ধ করে দেব।”

“বউ না হতেই কেমন বাঙালি ভাবিদের মতো আমার পেছনে লেগে যাচ্ছো। বলি আমিও কিন্তু ভালো ননদিনী নই। একেবারে যখন কা*ল*না*গি*নী*র মতো ছোবল দেব, তখন হাড়ে হাড়ে টের পাবে।”

“আমি অবশ্যই বাঙালি বউ, তাহলে বাঙালি ভাবি হবো না তো কী হবো?”
দুজনের হাসি-তামাশার মাঝে তাসিন এসে দাঁড়ালো। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিতেই লজ্জায় মিইয়ে গেল ফাবিহা।
“আমার ঘরে আয় ফাবিহা।”

বলেই গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল তাসিন। ফাবিহা কী করবে বুঝতে পারছে না। তার হাত-পা কেমন কাঁপছে। আগে আর এখনকার সম্পর্ক এক নয়। পুরোনো সম্পর্ক হলে তাসিন বলার পরপরই ফাবিহা তার ঘরে গিয়ে উঠতো। এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নখ কামড়াচ্ছে। নিশি রগড় করে বলল,“যাও যাও। ভাই তোমাকে প্রেম করার জন্য ডাকছে।”

ধ্যাৎ বলেই লজ্জা পেয়ে সরে গেল ফাবিহা। ধীর পায়ে এগোতে থাকলো তাসিনের ঘরের দিকে। ভেতরে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে? সুখ নাকি এক আকাশ সমান বিষাদ? ফাবিহা সুখ ভেবে পা বাড়িয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালো। টোকা দিতেই গম্ভীর স্বর ভেসে এলো।
“আয়।”

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে