একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-২৬+২৭

0
483

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৬
কড়ি আজ যে শাড়িটা পরেছে সেটি ওর মায়ের। বার্গান্ডি রঙের জামদানি। কড়ির কানে, গলায় মুক্তোর দুল আর মালা। রামিম বলতো এই শাড়িটায় কড়িকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায়। এত সুন্দর দেখায় যে বিয়ে করে ফেলতে ইচ্ছে হয়। এ কারণেই শাড়িটা আজ পরা। গতরাতে কড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল। রিমা দরজা ধাক্কে তুলে বলল, “আজ তোর সাথে থাকি।”
ঘুমে আড়ষ্ট কড়ি বলল, “থাকলে থাকো, আমার যেমন দাদীর ঘর, তোমারও দাদীর ঘর। তোমার আবার একইসাথে দাদী শাশুড়িও।”
রিমা হেসে দরজা আটকাল। কড়ির পাশে কনুইয়ে ভর দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে বলল, “অ্যাই শোন না, তোর সাথে কথা আছে।”
“কি বলবে?”
রিমা নিজের গলার চেইনটা আঙুল দিয়ে খুটতে খুটতে বলল, “তোর কোনো পছন্দ টছন্দ আছে?
কড়ি দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, “উহুঁ।”
“তাহলে আমরা তোর জন্য বিয়ে দেখি?” খুশিতে রিমার চোখ চকচক করে উঠল।
কড়ি বলল, “এখনি বিয়ে দিয়ে দিবে?”
“সমস্যা কি? তোর কি কেউ আছে?”
“না, তা নেই।”
“তাহলে আর বাধা দিস না।”
কড়ি চুপ করে রইল। রিমা বলল, “নাসিমা ফুপুকে চিনিস?”
“হ্যাঁ।”
“নাসিমা ফুপুর ভাসুরের ছেলের জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছে। ফুপুই চাচ্চুর কাছে প্রস্তাব দিলেন। চাচ্চুর কাছে মন্দ মনে হয়নি। চেনাজানার মাঝে হলেই ত ভালো। তাই আমাকে পাঠালেন তোর দ্বিতীয় কোনো মত আছে কিনা জেনে নিতে।”
“ওহ্।”
“ছেলে পুলিশ অফিসার। খুব অনেস্ট নাকি। কাল বৌভাতের অনুষ্ঠানে তো আসবেই। তখন দেখতে পারবি। কথা বলতে চাইলে সে ব্যবস্থাও করে দিতে পারব।”
“কথা বলতে হবে না। বাবা যা বলবেন তাই।”
“কী সোনালক্ষী বোন আমার!” রিমা কড়িকে আদর করে দিলো।
কড়ি মনে মনে তীব্র অপরাধবোধে মরে গিয়ে বলল, “স্বর্ণ পুড়ে যেমন খাঁটি হয় তোমার বোনও পুড়েই সোনালক্ষী বোন হয়েছে। নয়তো সে তোমাদের মুখে চুনকালি মাখবার সব ব্যবস্থাই সুন্দরমত করে ফেলেছিল।”
রিমা বলল, “কি ভাবছিস?”
“কই ভাবছি?”
“কাল কিন্তু সুন্দর করে সাজিস।”
এজন্যই কড়ি আজ এত সুন্দর করে সেজেছে। রামিম যে শাড়িতে তাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করত সেটা পরেই সে পাত্রপক্ষের সামনে যাবে। নিজের পরিবারের পছন্দে বিয়ে করে পরিবারকে খুশি করবে। এতে যদি খানিক প্রায়শ্চিত্ত হয় তার! এতকাল একটা চোরের জন্য সেজে এসেছে। আজ পুলিশের জন্য সাজবে। তার জীবনে, মরণে, মনে,মস্তিষ্কে কোথাও সেই চোরের জন্য কোনোপ্রকার জায়গা রাখবে না। কড়ি আঙুলে রামিমের মায়ের ফিরিয়ে দেয়া সেই আংটিখানাও পরল।
.
মুবিন এক কান ফুঁড়িয়েছে। কানে দুলও পরেছে। আয়নায় নিজেকে দেখে মুবিন প্রসন্ন। কানে দুল পরার বহুদিনের শখ ছিল তার। বাবার ভয়ে কান ফুঁড়াতে পারছিল না। আজ রাগে শেষ পর্যন্ত ফুঁড়িয়েই ফেলেছে। হাতে পরার জন্য একটা ব্রেসলেটও কিনে এনেছে। ব্রেসলেটটা পরে মায়ের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে মা আঁতকে উঠবেন। মুবিন সেটাই চায়। বাঁকা হাসল সে। কানে দুল, হাতে ব্রেসলেট পরে নিজের ঘর থেকে বেরিয়েই সে লিভিং রমের টিভিটা চালু করে আরাম করে বসল। পাশেই বাবা পত্রিকা পড়ছেন। এখনি নিশ্চয়ই গম্ভীর গলায় বলে উঠবেন, “টিভি বন্ধ করো, মুবিন। দেখছ না পত্রিকা পড়ছি?”
মঈন এখনও কিছু বলছে না। মনোযোগ সহকারে পত্রিকা পড়ে যাচ্ছে। মুবিন কপাল কুঁচকে বাবার দিকে তাকাল। কি ব্যাপার? কিছু বলছেন না কেন? মুবিন ঘাড় কাত করে বাবাকে দেখতে দেখতে টিভির ভলিয়্যুম আরো বাড়িয়ে দিলো। চ্যানেল পাল্টে গানের চ্যানেল দিলো। ধুম ধারাক্কা হিন্দি গান বেজে উঠতেই মঈন বিরক্ত হয়ে উঠল, “আহা মুবিন, তোমার মায়ের ঘরে যাও। সেখানে গিয়ে টিভি দেখো।”
মুবিন শয়তানি হাসি হাসল। না সে উঠল, না চ্যানেল বদলাল আর না সে বন্ধ করল টিভি। মঈন মুখের সামনে থেকে পত্রিকা সরাতেই মুবিন চট করে ঠোঁট থেকে হাসি মুছে ফেলল। বাবার চেহারা থেকে চোখ সরিয়ে টিভিতে চোখ রাখল। মঈন ধমকে উঠে বলল, “টিভি বন্ধ করো, মুবিন।”
মুবিন মনে মনে বলল, “কানের দুলটা দেখে না কেন?”
মঈনের দৃষ্টি দুলে আটকাতে মুবিন কান চুলকে বলল, “পারব না।”
মঈন রাগে থমথম করে উঠল। চোখ বড় বড় করে তাকাতেই মুবিনের কানে চোখ চলে গেল। সাথে সাথে বলল, “হোয়াট ইজ দিস, মুবিন?”
মুবিন অলস ভঙ্গিতে রিমোট রেখে উঠে দাঁড়াল। মঈন কঠোর গলায় বলল, “কখন করেছ এসব?”
মুবিন জবাব দিলো না। মঈন দ্বিগুণ ধমকে বলল, “এখনি খুলো।”
“না।”
মঈন উঠে এসে মুবিনের কানে হাত দিলো, “দেখি, আমি খুলে দিচ্ছি। এই বয়সে এসব পরতে নেই।”
মুবিন বাবার হাত সরিয়ে পিছিয়ে গেল, “বললাম না খুলব না।”
মঈন রেগে গেল। মুবিনও একগুঁয়ে, কোনোভাবেই খুলবে না। বাপ ছেলের চেঁচামেচি শুনে শিল্পী এদিকটায় এল। মুবিনের কানে দুল, হাতে ব্রেসলেট দেখে চট করে মেজাজ বিগড়ে গেলেও চুপ করে রইল। মঈন ওকে দেখে বিচার দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, “এসব করার বয়স তোমার ছেলের এখন হয়েছে?”
শিল্পী কাটাকাটা গলায় বলল, “কোন বয়সে কি করতে হয় তা তোমার কাছ থেকে আমার ছেলের শিখতে হবে না।”
মঈন বলল, “কি বললে?”
শিল্পী বলল, “তোমারোতো এই বয়সে প্রেম করার কথা না। তুমি যেহেতু করতে পেরেছ, তোমার ছেলেও বয়স মানবার কথা না, তাইনা?”
মুবিন এই ফাঁকে দৌড়ে পালাল। বর্তমানে শিল্পীর কাছে ছেলের সুশিক্ষার চাইতে ছেলের বাপকে অপদস্ত করাই যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
.
কড়িকে দেখে দীপা প্রায় চিৎকার করে উঠল, “আরে তোমাকে দেখি আমার চেয়ে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।”
“মোটেও না।”
দীপা বলল, “সত্যি বলছি, কড়ি।”
কড়ি দীপার পাশে বসে কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল। ফিসফিস করে বলল, “যে কোনো ছেলে দেখলেই কি পছন্দ করে ফেলবার মতন সুন্দর দেখাচ্ছে?”
দীপা ঘন ঘন চোখের পাপড়ি ফেলে, মাথা নেড়ে জোর দিয়ে বলল, “জি ম্যাডাম। যে কোনো ছেলের মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতন সুন্দর দেখাচ্ছে। তোমার আঙটিটাও খুব সুন্দর। রামিমের মা এটাই ফিরিয়ে দিতে এসেছিলেন, তাইনা?”
“হ্যাঁ।”
“যাক মায়ের আংটিটা অন্তত পেয়েছ। শান্তি লাগছে আমার।”
কড়ি নিজের হাতের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, উঁহু এটা তো ওর মায়ের না। রামিমের মা আসলে রামিম থেকে কোনো গয়নাই উদ্ধার করতে পারেননি। তিনি হয়তো ওর মোবাইলে ছবিটবি দেখে এটা বানিয়েছেন। বানিয়ে তাকে মিছেমিছি সান্ত্বনা দিতেই এটা দিয়ে গেছেন। প্রথমে সে বুঝতেই পারেনি। পুরোপুরি মায়ের আংটির প্রতিচ্ছবি এটি। আংটিটা ফেরত পেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়ে গিয়েছিল। মায়ের একই যে আংটিটা ছিল সেটা ওর অনামিকা আঙুলে হতো না। মধ্যমা আঙুলে পরতে হতো। খানিক বড় ছিল। পরে ট্রেনে উঠে আঙুলে দিতেই এই আংটিটা মধ্যমায় লাগেনি, লেগেছে অনামিকায়। একদম খাপে খাপ। তখন বুঝল এটা মায়ের না। এজন্যই ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে রামিমের মাকে জড়িয়ে ধরতে বাধ্য হয়েছে। মানুষটা বড় ভালো আর অসহায়। উনার সাধ্যে থাকলে সম্ভবত সবগুলোই উনি নতুন করে গড়ে দিতেন। কিন্তু যত টাকাই থাকুক অত গয়না একসঙ্গে গড়ে দেওয়া অসম্ভব। আর টাকা তো উনার না, রামিমের বাবার। রামিমের বাবা কঠিন মানুষ। রামিমের পিছনে বহু টাকা খুইয়েছেন তিনি। ছেলে তার সহায়সম্পত্তি কম নষ্ট করেনি! আর বোধহয় খোয়াতে চাইবেন না। কড়ির ধারণা রামিমের মা নিজের জমানো আধুলি থেকেই কড়িকে এই আংটিখানা দিয়ে গেছেন। কড়ি যে বুঝতে পেরেছে এটি সেই আংটি না, তা সে দিব্যি চেপে গেছে। কি দরকার একজন মায়ের স্বস্তি নষ্ট করবার? থাকুক নাহয় এই আংটিখানা আরেক মায়ের আশীর্বাদ হয়ে।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৭
মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হলো ভুলকে আঁকড়ে ধরে থেকে ভুল করা। আর মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় মিথ্যা হলো হাসি। দীপার হাসি হাসি মুখটা দেখে কড়ির খুব কষ্ট হলো। দীপা আসলে ভালো নেই। সে তাহমিদকে দেখে কষ্টে ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। চাপা ক্রোধে, কষ্টে ঝাঁঝড়া হয়ে সে প্রায় শরীর ঘেঁষে কাদিনের আরো কাছাকাছি বসল। কাদিন চমকে তাকাল।
দীপার ঠোঁট হাসছে কিন্তু চোখ? চোখজোড়া বিষণ্ন, টলটলে। কাদিন একবার ভাবল কি হয়েছে জানতে চাইবে। পরক্ষণেই মত পাল্টাল। থাক দরকার নেই। তাহমিদকে দীপা আর কাদিনের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে কড়ি দ্রুত পা চালাল। কাদিনের আগে গিয়ে দীপার হাত শক্ত করে ধরে বলল, “মেজো ভাবিকে আকবর চাচার ছেলের বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে আনি একটু।”
কাদিন বলল, “যা করিয়ে আন।” তারপর দীপার দিকে তাকিয়ে বলল, “একটু বুঝেশুনে কথা বলবে, প্লিজ।”
দীপা অবাক হয়ে কাদিনের দিকে তাকাল, “সে আবার কি উল্টাপাল্টা বলবে?
কড়ি দীপাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, “আজকে এত সুন্দর করে সেজেছি কারণ আজ আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। আমি তোমার মতন দুঃখিনী না। আমার সুখ দরকার। বাবা- ভাইদের ক্ষমা দরকার। তাই তাদের পছন্দে বিয়ে করে সুখী হতে যাচ্ছি। সত্যিকার সুখী। তোমার মাথায় কিছু ঢুকল?”
দীপা বলল, “হুম।”
কড়ি হতাশ হয়ে বলল, “তোমাকে সুখী থাকার ভাণ করে তাহমিদ ভাইয়াকে অনুশোচনায় পোড়াতে বলিনি। বুঝিয়েছিলাম সত্যিকার সুখী হয়ে তাহমিদ ভাইয়াকে তার জায়গাটা দেখিয়ে দাও। আর তুমি কি করছ! আমি সত্যিই হতাশ।”
দীপা বলল, “ঐ মেয়েটাকে নিয়ে এখানেও এসছে দেখলে?”
“জাহান্নামে যাক ঐ মেয়েকে নিয়ে। তুমি শুধু আমার ভাইয়ের দিকে নজর দাও।”
দীপা বলল, “তুমি ভালো আছ, কড়ি? বলা যতটা সহজ, জীবনে প্রয়োগ করা ততটাই কঠিন। এখনো রামিমের জন্য নির্ঘুম রাত কাটাও। এই সেমিস্টারটাও তো ওর বিরহেই ড্রপ দিয়েছ। মিথ্যে বলো না আমায়।”
“ওর জন্য নির্ঘুম রাত কাটানোর আগে মরে যাওয়া মন্দ না। রাত জেগে আমি শুধু নিজের বোকামির কথাই ভাবি। রামিম কি করে আমাকে ফাঁদে ফেলতে পারল সেই উত্তর খুঁজে ফিরি। কাঁদলেও নিজের জন্য কাঁদি। রামিমের জন্য নয়। আমি ত কখনোই অতটা বোকা ছিলাম না! তাহলে রামিম কি করে আমায় বোকা বানাতে পারল। এই ভাবতে ভাবতেই রাত পার হয়ে যায়। আর সেমিস্টার ব্রেক দিয়েছি বাবা আর ভাইয়াদের সাথে কদিন থাকতে চাই বলে। ওদের আমি ঠকিয়েছি।” কড়ি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
কড়ি থেমে আরো বলল, “আমার ভাই একটু মুডি কিন্তু খারাপ না। ভালো বললাম না প্রশংসা হয়ে যাবে বলে। আমি প্রশংসা করতে চাই না। তুমি সত্যি সত্যি মন থেকে ওকে মেনে নাও। তোমাকে মেনে নিতে হবে। আর না মানতে পারলে বিয়ে কেন করলে?” কড়ি খানিক রাগ দেখিয়েই বলল।
দীপা মন খারাপ করা গলায় বলল, “স্যরি।”
“স্যরি তুমি আমার ভাইকে বলবে। ও থাকতেও তোমার মন তোমার প্রাক্তনকে নিয়ে মাতম করতেই ব্যস্ত।”
দীপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কড়ি বলল, “এখন যাও গিয়ে আমার ভাইয়ের পাশে দাঁড়াও। এই প্লাস্টিক হাসি মুছে, স্বাভাবিক হও।”
দীপা গিয়ে কাদিনের পাশে দাঁড়াল। এবার আর শরীর ঘেঁষে দাঁড়াল না। তবে কষ্ট কষ্ট ভাবটা ছুঁড়ে ফেলে বলল, “স্যরি।”
কাদিন আৎঁকে উঠে আহত গলায় বলল, “কেন? আবার কি করলে, দীপা?”
দীপা এবার হেসে ফেলল। মিথ্যে কোনো হাসি নয়। সত্য এবং সুন্দর হাসি। বলল, “স্যরি বলেছি, আই লাভ ইউ বলিনি যে আঁৎকে উঠবেন।”
“স্যরিটা কিসের?”
“এমনি বললাম।”
“এমনি এমনি কেউ স্যরি বলে?” কাদিন বিরক্ত।
দীপা বলল, “কেউ বলে না বলে কি আমারো বলা মানা?”
কাদিন হাল ছেড়ে দিলো। এই মেয়েকে বোঝা এবং বোঝানো দুটোই অসম্ভব।
.
নিলয় আর ইমাদ ছবি তুলছে। ওদের দুজনের মাঝে দীপা আর কাদিন। চারজনের প্রশান্তবদন এর খুব সুন্দর একটা ছবি তুলতে ব্যস্ত ক্যামেরাম্যান। কড়ি জর্দা খেতে খেতে স্যুট, টাই পরা ইমাদের তীব্র নিন্দা করতে করতে ধরেই নিয়েছিল ইমাদ আজ আরো বেশি ফ্লার্ট করবে। ভাবতে ভাবতেই ইমাদের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। কড়ি লক্ষ্য করল ইমাদ সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো। কড়ি খানিক অবাক’ই হলো। চোখ সরিয়ে নিলো কেন? ব্যাপার কি? এই ফ্লার্টিং মাস্টার আজ বদলে গেল কি করে? জাদু! পরক্ষণেই হিসাব মিলিয়ে ফেলল। দীপার কাছ থেকে হয়তো ওর বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে শুনে শুধরে গেছে। দীপা যে ধরনের মেয়ে দিনে কতবার নিঃশ্বাস নেয় তাও গুনে গুনে বন্ধুদের বলে। হ্যাঁ এটাই হবে। নাসিমা ফুফু কড়িকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। কড়ি কাছে যেতেই কড়ির সাথে এক ভদ্রমহিলার পরিচয় করিয়ে বললেন, “আমার ভাইয়ের মেয়ে।”
কড়ি ভদ্রমহিলার সাথে কুশল বিনিময় করতে করতে ভদ্রমহিলার পাশে দাঁড়ান তাঁর ছেলেকেও দেখে নিলো। বাবা আর পরিবারের উপর ভরসা করে ভুল করেনি সে। সে তার বাবাকে ঠকালেও বাবা তাকে ঠকায়নি। ছেলে দেখতে ভালো। ক্লিন শেভ, ভদ্র চাহনী। চুলগুলো শুধু একটু বেশি ছোট করে ছাঁটা। তা ডিফেন্সের লোকদের চুল এমন করে ছাঁটাই থাকে। কোনো সমস্যা নেই। কথায় আছে মাছের রাজা ইলিশ, বাত্তির রাজা ফিলিপস আর স্বামীর রাজা পুলিশ।
.
অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যার পর বেশিরভাগ মেহমানরাই চলে গেল। বাড়িটা ফাঁকা আর শান্ত হয়ে উঠতেই ইমাদ উঠোনে একা একটা চেয়ার পেতে ৯০ ডিগ্রী এঙ্গেলে পায়ের উপর পা তুলে বসল। আজ আকাশে তারার রাজত্ব, চাঁদ মুখ লুকিয়ে আছে। নীলচে কালো রাতের সুনসান নীরবতা। মাঝে মাঝে রান্নাঘর থেকে কাঁচের থালা বাসন, কাপ পিরিচের সংঘর্ষের শব্দ আসছে। রান্নাঘরে বাড়ির মেয়ে বউরা বাসনকোসন গোছাতে ব্যস্ত। ইমাদ যে জায়গাটায় বসে আছে সেখান থেকে রান্নাঘর স্পষ্ট দেখা যায়। তবে উঠোনে অন্ধকার থাকায় ভেতর থেকে ইমাদকে দেখা অসম্ভব। তাই ইমাদ নিশ্চিন্তে বসে ব্যস্ত কড়িকে দেখতে লাগল। ইমাদ একটা বিষয় নিয়ে খুব অবাক হয়েছে। বিস্ময় তাকে ছাড়ছেই না। কড়িকে সবসময় তার কাছে একইরকম লাগে। এই যে কড়ি সাধারণ একটা কামিজ পরে, পাঞ্চক্লিপে চুল আটকে কাজ করে যাচ্ছে, আর যেই কড়ি দিনের বেলায় লাল গোলাপ সেজে ঘুরছিল দুই কড়ি তার কাছে একই। কড়ির বাড়াবাড়ি সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করেনি কেন? তার ভালোবাসার মানুষটাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছিল অথচ, তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেনি, চোখে ঘোর লেগে যায়নি, সে থ বনে যায়নি। এমন ত নয় যে কড়িকে তার সাজগোজে ভালো লাগেনি। ভালো লেগেছে, সুন্দরও লেগেছে তবে পাগল হয়ে যায়নি। অথচ, যেকোনো প্রেমিকের ঐ অবস্থায় নাই নাই হয়ে যাওয়ার কথা। তবে কি সে কড়িকে ভালোবাসে না? এই দ্বিধায় সে আজ কড়ির চোখে চোখ পর্যন্ত রাখতে পারেনি। অন্যায় হয়ে গেল না তো! সে আজীবন স্বচ্ছ থেকেছে। এক্ষেত্রেও সে তাই থাকতে চায়। হঠাৎ রান্নাঘরে কিসের একটা শব্দ হলো। ইমাদ ভাবনার জগত থেকে বেরুতেই বুঝতে পারল কড়ির হাত থেকে গ্লাস পড়ে ভেঙে গেছে। কড়ি নীচু হয়ে ঝুঁকে কাঁচের টুকরো হাতে তুলছে। সাথে সাথে ইমাদ অস্থির হয়ে গেল। কাঁচের টুকরো কড়ি কেন তুলছে? হাত কেটে যাবে তো! আচমকা তার মনে হলো সত্যিই সে কড়িকে ভালোবাসে। তার কোনো ভুল হয়নি। আসলে তার ভালোবাসা তাকে এতটা অন্ধ করে রেখেছে যে কড়ির বাড়াবাড়ি সৌন্দর্য তার চোখে পড়েনি। অতিরিক্ত আলো একসাথে চোখে এসে পড়লে মানুষ যেমন দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে, চোখে মমেলে তাকাতে পর্যন্ত পারে না, তেমনি অতিরিক্ত ভালোবাসায় তারও দেখার ক্ষমতা, মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা কড়ি কেঁড়ে নিয়েছে। সে উপলব্ধি করতে পারল, ভালোবাসার মানুষকে সবসময়ই চূড়ান্ত সুন্দর দেখায়। ঠিক ততটা সুন্দর যতটা সুন্দরের চেয়ে বেশি সুন্দর কখনো হওয়া সম্ভব না। তা সে যাই পরুক, যতই সাজুক, যেভাবেই থাকুক। তাই ইমাদের কাছে কড়ি হলো ধ্রুবকের মতন, যার মান কখনো পরিবর্তন হয়না। সবসাজেই, সকল রূপেই কড়ি তার কাছে অনন্য।
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে