#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_১২_১৩
#Saji_Afroz
আজরা কাঁপছে। তা বুঝতে পেরে ইনতিসার বলল,
তুমি কী খুব বেশি ভয় পেলে আজরা?
এইবার ইনতিসারের কাছ থেকে এক ঝাটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় নাবীহা। তার এমন কাণ্ডে ইনতিসার অবাক হয়। সে কিছু বুঝে উঠার আগেই নাবীহা বলল, লাইট কোনদিকে? প্লিজ জ্বালিয়ে দিন। আমি আজরা নই।
তার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় ইনতিসার। কিন্তু সময় নষ্ট না করে রুমের লাইট অন করে সে। নাবীহা কে দেখে চমকে উঠে ইনতিসার। সে বলল, আপনি এখানে?
নাবীবা বলল, আজরা পাঠিয়েছিল নাক ফুল নিতে।
এই বলে মাথা নিচু করে ফেললো নাবীহা। ইনতিসার নিজের করা কর্মের জন্য লজ্জিত হয়ে বলল, আসলে আমি ভেবেছি আপনি আজরা! ওর এক বান্ধবী বলেছিল ও নিচে এসেছে। আমি খুবই দুঃখিত।
-ইটস ওকে।
এই বলে আর সময় নিলো না নাবীহা। ড্রেসিংটেবিল এর উপর থেকে নাক ফুল টা নিয়ে একপ্রকার ছুটেই রুম থেকে বেরুলো সে। পথিমধ্যে তার দেখা হয় আজরা ও মানতাশার সাথে। মানতাশা কটমট করতে করতে বলল, ফোন কেন ধরছিলি না?
-সাইলেন্ট ছিল!
আজরা বলল, আমি আরও টেনশন করছিলাম।
মানতাশা বলল, এতবড়ো বাড়িতে হারিয়ে যাবি বলে টেনশন করছিল ও।
কথাটা যে তাকে ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে ভালোই বুঝতে পেরেছে নাবীহা। সে আজরার দিকে নাক ফুলের বাক্সটা এগিয়ে দেয়। আজরা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তা পরিয়ে দিতে বলল।
নাবীহা তার নাকে ফুলটা পরিয়ে দিতে থাকে। আজরা খেয়াল করলো, নাবীহার হাত কাঁপছে। সে বলল, ঠিক আছিস তুই? হাত কাঁপছে কেন?
-কই না তো! আমি ঠিক আছি। কী হবে আমার?
ওদিকে ইনতিসার মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো বিছানার উপরে। যতবার সে মনকে বুঝিয়ে আজরার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে যায়, ততবারই নাবীহার চিন্তা তার মাথায় আসবে। আজ তো নাবীহা সরাসরিই চলে এসেছে। তাও তার বাহুডোরে! এতবড়ো ভুল সে কীভাবে করলো?
নাবীহা কী বিষয়টা সহজ ভাবে নিয়েছে নাকি ভুল বুঝছে তাকে? আর যদি আজরাকে এসব বলে! সেও বা কী ভাববে?
এসব ভেবে অস্থির হয়ে উঠে ইনতিসার। ঠিক তখনি ইলারা জামানের ফোন আসলো। তিনি বললেন, জামাই বউ কোথায় চলে গেলি? সবাই তোদের খুঁজছে।
-আসছি মা।
এই বলে ইনতিসার বেরিয়ে আসে। একটু আসতেই সে আজরা, মানতাশা ও নাবীহার দেখা পায়। তাকে দেখেই নাবীহা ছাদের দিকে হাঁটা শুরু করে। তার পিছু নেয় মানতাশা।
আজরার হাসি মুখ দেখে ইনতিসার বুঝলো, তাকে নাবীহা কিছু জানায়নি। পাশে এসে তার সাথে কথা বলে বিষয়টা আরও ভালোভাবে বুঝলো সে। শান্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে নাবীহার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো সে আপনমনে।
.
.
-শুনেছি ইনতিসার নাবীহা কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল?
-তাই! তবে হয়নি কেন বিয়ে?
-নাবীহার পরিবার চায়নি। সাজিরের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার।
-এতবড়ো ভুল করলো তারা? নাবীহা এখানে এসে এসব দেখে নিশ্চয় পস্তাবে।
-ওর নসীবেই ছিল না আসলে এসব।
তারা এসব কথা বলতে এতই ব্যস্ত যে, কখন নাবীহা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি।
বান্ধবীদের এসব কথা শুনে নাবীহা বলল, মোটে পস্তানোর মতো কিছু হয়নি। আজরা যে ভালো আছে এটা দেখেই আমি অনেক খুশি। আর এসব কথা তোদের কে বলেছে?
তারা সবাই মানতাশার দিকে তাকাতেই নাবীহা বুঝলো এটা তার কাজ। মানতাশা আমতাআমতা করে বলল, আমি তো জাস্ট তোর সুনাম করতেই বলেছিলাম। এই যে তুই সাজিরের জন্য এতসব কিছু ছাড়লি…
তাকে থামিয়ে নাবীহা বলল, এসব নিয়ে আর কখনো যেন তোকে কিছু বলতে না শুনি।
এই বলে নাবীহা অন্যদিকে চলে যায়। অন্যান্য বান্ধবীদের উদ্দেশ্যে মানতাশা বলল, আফসোস সে ঠিকই করছে। কিন্তু প্রকাশ করছে না। দেখবি খুব দ্রুত সেটাও করবে।
.
.
অনুষ্ঠান শেষে যে যার বাড়িতে চলে আসে।
বাড়ি পৌঁছে মানতাশা নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই তার ফোনের রিং বেজে উঠে। এজাজের ফোন দেখে বিরক্ত হলেও রিসিভ করলো সে। নাহলে যে প্রতিনিয়ত ফোন আসতে থাকবে জানা আছে তার। সে রিসিভ করতেই এজাজ বলল, এসেছ বাসায়?
-হু।
-কবে এলে?
-মাত্রই।
-আজরা ভালো আছে?
-অনেক ভালো আছে! এত বিশাল বাড়িতে কে খারাপ থাকতে পারে বলো তো?
-বিশাল বাড়ি?
-হু। আজরার কপালের মতোই বিশাল। ওর কপালটা একটু বড়ো বলে অনেকেই মজা নিতো। অথচ মুরুব্বি দের কথাই ঠিক হলো।
-কী কথা?
-এই যে, যাদের কপাল বড়ো হয় তারা ভাগ্যবতী হয়।
-তোমার কপাল তো বড়ো না। তবুও তুমি ভাগ্যবতী।
-কীভাবে?
-আমাকে পেতে চলেছ বলে।
ব্যঙ্গসুরে মানতাশা বলল, তোমার কী ইনতিসারের মতো বিশাল বাড়ি আছে? না আছে অনেক গুলো গাড়ি?
-যতটুক আছে আলহামদুলিল্লাহ। এতেই সারাজীবন ভালোভাবে কেটে যাবে আমাদের। তাছাড়া আমার সুন্দর একটা মন আছে না? যেই মনটা পুরাটাই তুমি তুমি করে।
এসব কথা শুনতে বিরক্ত লাগছে মানতাশার। তাই সে কথা শেষ করার জন্য বলল, ঘুম পাচ্ছে।
-স্বাভাবিক। ক্লান্ত তো। আচ্ছা ঘুমাও।
এজাজ কে বিদায় জানিয়ে ফোন রাখলো মানতাশা। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো সে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে আজরার শশুরবাড়ির প্রতিচ্ছবি। মানতাশার কপালেও কী এমন শশুরবাড়ি জুটবে?
.
.
.
আজ মা বাবার সাথে নিজের বাড়িতে এসেছে আজরা। তিনদিন এখানেই থাকবে সে।
চিরচেনা এই বাড়িটা তার কত আপন! অথচ আজ এখানে এসেও মন শান্ত নয়। ইনতিসারের কথা যে খুব করে মনে পড়ছে। তিন দিন তার দেখা পাবে না ভাবতেই কষ্ট লাগছে। এটাই বুঝি স্বামীর প্রতি ভালোবাসা?
ইনতিসার রুমে এসে বিছানার দিকে চোখ পড়তেই আজরার মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। কাল গুটিসুটি মেরে মেয়েটা শান্তির ঘুম দিয়েছিল এখানে। আজ সে নেই। যদিও তিন দিন পরেই সে চলে আসবে।
এই ভেবে ফ্রেশ হয়ে আসে ইনতিসার। নাবীহার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভাবতেই অস্থির হয়ে উঠে সে।
নাবীহা কে এতটা কাছে পেয়ে তার কী খুশি হওয়া উচিত ছিল? কিন্তু সে তো খুশি হতে পারেনি। বরং এরূপ কাণ্ডের জন্যে লজ্জিত সে৷ না জানে এসব নিয়ে নাবীহাই বা কী ভাবছে!
.
.
সকালে কারও চিৎকারে ঘুম ভাঙে নাবীহার। দ্রুত ড্রয়িংরুমে ছুটে এসে দেখলো তার মা নায়লা খাতুন কাঁদছেন। পাশে দাঁড়িয়ে আছে বড়ো বোন নাফিসা। তার চোখেও পানি। কী হয়েছে জানতে চাইলে নাফিসা ভাঙা গলায় বলল, তালাক দিয়েছে আমাকে।
একথা শুনে বিস্ময় এর শেষ পর্যায়ে চলে যায় নাবীহা। সে বলল, কেন?
-তাদের অনেক লোভ। বাবার কাছ থেকে বারবার টাকা চাইতে বলতো ব্যবসার জন্য। কিন্তু আমি তো জানি বাবা টাকা দিতে পারবে না। তাই বলিওনি। এসব নিয়ে ঝগড়া হত। আর আজ আমাকে তালাকই দিয়ে দিলো!
বিকট শব্দ শুনে পেছনে ফিরে তাকায় সকলে। তারা দেখলো, মোহাম্মদ জাকির মেঝেতে পড়ে রয়েছেন। নাবীহা চ্যাঁচিয়ে বলে উঠলো-
বাবা!
.
.
একা একা ভালো লাগছে না আজরার। ইনতিসার কে ফোন দেবে দেবে করেও দিতে পারছে না। অপেক্ষা করছে ইনতিসারের ফোনের। কারণ সে ব্যস্ত মানুষ। অফিসেও থাকতে পারে এই সময়ে।
সময় কাটানোর জন্য মানতাশা কে ফোন করে বাসায় আসতে বলল আজরা। এরপরই নাবীহা কে ফোন দেয় সে। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ করলো নাবীহা। আজরা তাকে কোথায় জিজ্ঞাসা করলে ওপাশ থেকে সাজিরের কণ্ঠস্বর শুনতে পায় সে। আজরা বলল, নাবীহা কোথায়?
নরমস্বরে সাজির বলল, আছে। একটা অঘটন ঘটেছে।
চ্যাঁচামেচির শব্দ শুনে আজরা জানতে চাইলো, কী হয়েছে? এত শব্দ কেন?
-নাবীহার বাবা আর এই পৃথিবী তে নেই।
কথাটি শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো আজরা। কী বলবে বুঝতে পারছে না সে। সাজির বলল, এখন আমরা হাসপাতালে।
-আমি এখুনি আসছি।
-এখানে এসো না। বাসায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। ওখানেই এসো।
এই বলে ফোনের লাইন কেটে দেয় সাজির। আজরা নাবীহার কথা ভেবে অস্থির হয়ে উঠলো। প্রাণ প্রিয় বাবাকে হারিয়ে নিশ্চয় পাগলপ্রায় হয়ে গেছে মেয়েটা!
.
আজরা কে সারাদিন ফোন দেওয়া হয়নি ইনতিসারের। সেও ফোন দেয়নি। এতবেশি ঘুমিয়ে ফেলেছে ইনতিসার! যদিও সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নিয়েছিল। সকাল থাকায় আজরা ঘুম ভেবে বিরক্ত করেনি। সেও আবার শুয়ে পড়ে। কখন যে চোখ দু’টো লেগে এসেছিল!
অবশ্য বেশ কয়েক দিন অনেকটা ধকল গেছে। ঘুম হয়নি ভালো মতো।
ফোন হাতে নিয়ে আজরা কে কল করতে চেয়েও করলো না সে। ভাবলো আজ তাকে চমকে দেবে। আজরার বাড়ি যাবে সে। এই ভেবে উঠে পড়ে ইনতিসার৷ আজরা নিশ্চয় তাকে এভাবে হুট করে দেখে চমকে যাবে।
দুপুরের শেষের দিকে নাবীহার বাবা মোহাম্মাদ জাকিরের মৃত দেহ দাফন করা হয়। ডাক্তার বলেছেন তিনি হার্ট অ্যাটাক এ মারা গেছেন।
তার কোনো বড়ো ছেলে না থাকায় সাজিরই সব দায়িত্ব পালন করেছে। নিজেই সব সামলে নিয়েছে। শুধু তাই নয়। তার পরিবারও নাবীহাদের পাশে ছায়ার মতো আছেন। যদিও সাজেদা বেগমের আপন ভাই মোহাম্মদ জাকির। বোন হিসেবেও তার দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু তিনি শুধু বোনের দায়িত্ব পালন করছেন তা নয়। নাবীহার পুরো পরিবার কে আগলে রাখার চেষ্টা করছেন নিজেকে স্বাভাবিক রেখে। সবাই ভেঙে পড়লে কী চলবে?
নাবীহার পাশে বসে রয়েছে মানতাশা ও আজরা। নিশ্চুপ ভাবে বসে রয়েছে নাবীহা। মানতাশা ও আজরার চোখও অশ্রুসিক্ত। নাবীহার কষ্টটা তারা অনুভব করতে পারছে। কিন্তু কিছু করার নেই। দুনিয়ার কোনো শান্তনার বাণী যে নাবীহার কানে পৌঁছবে না তারা জানে। তবুও মাঝেমধ্যে শান্তনার বাণী তারা শোনাচ্ছে নাবীহা কে। মাঝেমধ্যে বাবার কথা বলে কেঁদে উঠছে সে। আবার মাঝেমধ্যে একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছে।
এভাবে আরও কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আজরার ফোনে তার মা এর কল আসলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলল, জামাই এসেছে বাসায়। তাড়াতাড়ি আয়!
আজরা একথা শুনে মানতাশা কে জানিয়ে নাবীহাকেও বিদায় দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আসার আগে নাবীহা কে বলল সে, আমি আবারও আসব। নিজের খেয়াল রাখিস।
মানতাশা তার সাথেই থাকে।
এদিকে আজরার মা এর কাছে ইনতিসার শুনলো, তার এক বান্ধবীর বাবা মারা গেছে। আজরা সেখানেই গেছে। তবে চলে আসবে। তাই তার জন্য অপেক্ষা করছে ইনতিসার।
খানিকক্ষণ পরে আজরার আগমন ঘটে। দ্রুত ছুটার কারণে হাঁপাচ্ছে সে। ইনতিসার কে দেখে বলল, আপনি হুট করে? না মানে কিছু জানালেন না তো।
-ভেবেছি তোমাকে সারপ্রাইজ দিই।
টেবিলের উপরে থাকা উপহারের বাক্স ও ফুলের তোড়া দেখতে পায় আজরা। এসব দেখে সে বলল, সত্যিই সারপ্রাইজ হয়েছি আমি। তবে সারাদিন আপনার খবর নিতে পারিনি বলে দুঃখিত। আসলে …
তাকে থামিয়ে ইনতিসার বলল, শুনেছি। কার বাবা মারা গেছেন?
-নাবীহার।
একথা শুনে কয়েক সেকেন্ড এর জন্য নিশ্চুপ হয়ে যায় ইনতিসার। নাবীহার দুঃখ ভরা মুখের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠছে তার। সে আজরা কে বলল, আমায় বলোনি যে? অন্তত জানাযায় যেতাম!
আজরা বলল, আসলে এতটুক মাথায় আসেনি আমার।
কথা বাড়ালো না ইনতিসার। শুধু জিজ্ঞাসা করলো, নাবীহা এখন কেমন আছে?
-ভালো না। প্রিয় জন হারিয়েছে সে। নিজেকে স্বাভাবিক করতে একটু তো সময় এর প্রয়োজন।
ভেবেছিল আজরা কে নিজের সাথে নিয়ে যাবে আজ। এরপর হানিমুনে যাবে কোথাও। আজরা কে আর নিজের সাথে যেতে বলল না ইনতিসার। মনটা খারাপ হয়ে গেল তার একথা শুনে। বিষণ্ণ ইনতিসার কে দেখে আজরা বলল, চিন্তিত দেখাচ্ছে আপনাকে?
-ও কিছু না। তুমি তো দেখছি ঘেমে ভিজে একাকার হয়ে গেছ। ফ্রেশ হয়ে আসো।
ইনতিসার কে বসতে বলে ফ্রেশ হতে গেল আজরা। ইনতিসারের মনটা আবারও অশান্ত হয়ে উঠলো নাবীহার কথা ভেবে। মেয়েটা ঠিক আছে তো?
তিন দিন কেটে যায়। ইনতিসার আজরা কে বাড়ি নিতে আসে। আজরার কথাতে নাবীহার সাথে দেখা করতে যায় তারা। ঠিক করে ওখান থেকেই শশুরবাড়ি ফিরে যাবে।
ড্রয়িংরুমে বসে আছে ইনতিসার। আজরার সাথে ভেতর থেকে আসে নাবীহা। তাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো ইনতিসার। এ কী হাল হলো মেয়েটার! চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, মুখটা শুকিয়ে গেছে একেবারেই। নিশ্চয় বাবা কে খুব বেশি ভালোবাসতো সে!
ইনতিসার তাকে বসতে বললে নাফিসা এসে বলল, আপনি বসুন না!
তারা সকলে বসলো। নাফিসা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আজ প্রথম আমাদের বাসায় এলেন আর এমন একটা মুহুর্তে এলেন যে সেভাবে আপ্যায়ন করতে পারছি না।
-কী যে বলেন না! আপনাদের এখন সেই অবস্থা আছে নাকি? বরং কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমাদের জানাবেন।
এদিকে নাবীহা নিশ্চুপভাবে বসে রয়েছে। গত কয়েকদিন যাবত সে এইরকমই থাকছে। এভাবে হঠাৎ বাবার মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছে সে।
খানিকবাদে বাড়ির উদ্দেশ্যে উঠে পড়লো ইনতিসার ও আজরা। নাবীহা কে জড়িয়ে ধরে আজরা বলল, আমি আবার আসব। নিজেকে শক্ত কর নাবীহা।
সে হ্যাঁ সূচকভাবে মাথাটা নাড়লো। ইনতিসার কিছু বলতে চেয়েও বলল না। এক পলক নাবীহা কে বেরিয়ে পড়লো সে। তারই বা কী করার আছে? নাবীহা অন্য কারও হবু স্ত্রী। আর আজরা তার স্ত্রী। এই চরম সত্যিটা মেনে নিতে শুরু করেছে সে। নাবীহা কে সামলানোর জন্য সাজির তো আছেই। সে নাহয় আজরার সাথেই নতুন জীবনটা ভালোভাবে শুরু করুক!
-নাবীহার বাবা মারা গেছেন আজ তিন দিন হয়ে গেছে। এখন তো আমি মা কে নিয়ে আসতে পারি তোমাদের বাসায়?
এজাজের কথা শুনে তিরিক্ষি হয়ে উঠলো মানতাশার মেজাজ। এজাজ কী বুঝছে না, তাকে এড়িয়ে চলতে চায়ছে মানতাশা!
নিজেকে স্বাভাবিক করে মানতাশা বলল, যত তাড়া পরিবার নিয়ে আসার জন্য দেখাচ্ছ একটু যদি জবের জন্য দেখাতে তো হতই!
-তোমার কী মনে হয় আমি জব খুঁজছি না? মুখে বললেই তো আর জব হয়ে যাচ্ছে না!
-আগে যে কাজটা করছ সেটাই মন দিয়ে করো না।
-কিন্তু তোমার বাবা যে বলেছিলেন আমার পরিবার নিয়ে যেতে?
-উনি ওসব আমার মন রক্ষার জন্য বলেছেন। আসল কথা তো আমি জানিই।
-কী?
-এই যে উনি খুশি হতে পারেননি। চেয়েছিলেন কী আর পাচ্ছেন কী! আমি তো ভয় পাচ্ছি অন্য বিষয়ে।
-কী বিষয়?
-তোমার পরিবার কে ডেকে যদি উল্টাপাল্টা বলেন? তার চেয়ে একটা জবের ব্যবস্থা করেই এসো না!
এজাজ একটু ভেবে বলল, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি মানতাশা। আঙ্কেল কে একটু ম্যানেজ করো? আমি তাড়াতাড়ি জবের চেষ্টা করছি।
এজাজের সাথে কথা বলতেই ইচ্ছে হয় না মানতাশার। কিন্তু হুট করে এভাবে সম্পর্ক ছিন্নও করা যায় না। কিছু তো একটা করতে হবে ওর থেকে মুক্তি লাভের জন্য। কী করা যায়…
শশুরবাড়িতে আসার পর থেকে নিজের রুমের দিকে যেতেই পারেনি আজরা। তারা সবাই আজরা কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একসাথে গল্প গুজব করে একেবারে রাতের খাবারের পর নিজের রুমে আসতে পারে সে।
রুমের দরজা খুলেই অবাক হয়ে যায় সে ও ইনতিসার। ফুল দিয়ে সাজানো রুমটি দেখে একে অপরের দিকে তাকালো। কিছু বুঝে উঠার আগেই পেছন থেকে বন্ধু আসমল বলল, সারপ্রাইজ!
ইনতিসার বলল, তাই বুঝি এতক্ষণ রুমে আসতে দিচ্ছিলি না?
-জি হ্যাঁ। সেদিন তো কিছু হয়নি। ভাবলাম আজ কিছু হোক। নাহয় যে ভাগনা বা ভাগনী আসতে খুব বেশি সময় বেশি নিয়ে ফেলবে। এত বেশি সময় আমরা দিতে পারব না।
তার কথা শুনে আজরা লজ্জা পায়। সে হেসে ভেতরে চলে যায়। ইনতিসার বলল, ভাবীর সামনেও এসব বলা লাগবে তোর?
আসমল ফিসফিসিয়ে বলল, কাজটা সেরে নিস এইবার। নতুন করে সবটা শুরু কর। অল দ্যা বেস্ট।
-কিন্তু বাসায় কী বলেছিস? না মানে বাসর সাজালি আবার?
-বলেছি এটা আমার তরফ থেকে উপহার।
এই বলে আসমল চলে যায়। ইনতিসার ভেতরে এসে বলল, ওসবে কিছু মনো করো না যেন। বন্ধু মানুষ তো…
-আমি কিছু মনে করিনি।
এই বলে ফ্রেশ হতে যায় আজরা। ভারী শাড়িটা বদলে হালকা একটা শাড়ি পরে বেরুলো সে।
ইনতিসারও ওয়াশরুমে আসলো। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখলো সে। ভাবলো আজরার কথা। আজরা তার স্ত্রী। তার ভাবনা জুড়ে সেই থাকবে। অন্য কেউ কেন আসবে? এখন থেকে অন্য কিছু সে ভাবতে চায় না। আজরা কেই নিজের সবটা উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসতে চায় সে। চলতে চায় তার সাথে বাকিটা পথ।
এই ভেবে সেও ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে।
এসে দেখলো, আজরা ফুলভর্তি বিছানা টার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ইনতিসার বলল, ঘুমোনোর অসুবিধে হলে ফুলের পাপড়ি গুলো সরিয়ে দিতে পারো।
-আমিও এটা ভাবছিলাম। আপনার অসুবিধে হবে।
এই বলে ফুলের পাপড়ি গুলো একপাশে সরিয়ে রাখে। আজরা কে খুব বেশি ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তার মনটাও হয়তো বিষণ্ণ। এই ভেবে ইনতিসার বলল, শুয়ে পড়বে?
আজরা হ্যাঁ সূচকভাবে মাথাটা নাড়ে। ইনতিসার বলল, আসো তবে।
দু’জনেই শুয়ে পড়ে। আজরার চোখে ঘুম রয়েছে। তবে বুকের মাঝে হাতুড়ি পেটাতে শুরু করেছে। আবারও সেই ফুলে সাজানো বিছানায় আছে সে। পাশে রয়েছে ইনতিসার। আগেরবার ইনতিসার সময় চেয়েছিল। এখনো তারা একসাথে সময়ই কাটাতে পারেনি। তাই ইনতিসারের কাছে কিছু আশা করাটা বোকামি। কিন্তু আজরার যে খুব করে ইচ্ছে করছে, তার বুকে মাথা রাখতে।
নিজের ইচ্ছে টাকে দমিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করে নিলো আজরা৷
এদিকে বন্ধু আসমলের কথা বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ইনতিসারের। সে একটু আগেও বলেছে, যত দ্রুত সম্ভব সম্পর্ক টাকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে। নতুবা অন্যসব চিন্তা মাথা থেকে এর সহজে যাবে না তার।
ইনতিসার ভাবতে থাকলো হানিমুনে কোথায় যাওয়া যায় আজরা কে নিয়ে? কয়েক দিন তাকে নিয়ে দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসলে হয়তো বাকি সব চিন্তা মাথা থেকে সরে যাবে। কোন দেশে যাওয়া যায়? আজরার পছন্দও থাকতে পারে। ওকেই জিজ্ঞাসা করা যাক। এই ভেবে সে আজরার দিকে ঘুরে তাকায়।
আজরা হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। এই ভেবে তাকে আর ডাকলো না সে। কিন্তু আজরার পেটের দিকে চোখ পড়তেই ইনতিসার অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ফ্যানের বাতাসের কারণে তার কোমর থেকে শাড়ির অংশ সরে গেছে। তাই তার পেটটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যা খুব করে ছুয়ে দিতে ইচ্ছে হলো ইনতিসারের। নিজের এই ইচ্ছে কে সে দমিয়ে রাখতে পারলো না। আলতো করে হাত বসায় আজরার পেটে।
এদিকে ইনতিসারের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠে আজরা। সে ঘুমোনোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। কিন্তু পারছিল না। এমন কিছুরই অপেক্ষায় যেন ছিল সে! সে যে জেগে আছে তা বুঝতে দিলো না ইনতিসার কে। পরম আবেশে চোখ জোড়া বন্ধ করেই থাকলো।
ইনতিসার নিজেকে আটকাতে পারছে না। আজরার পেটে নিজের হাত বুলাতে বুলাতে নাভির দিকে চলে যায় সে। নাভিতে আঙুল ছোয়াতেই আজরা তার নরম বালিশটা এক হাত দিয়ে চেপে ধরে। আজরার আরও কাছে এসে তার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দেয় ইনতিসার। হঠাৎ মনে হলো, মেয়েটার ঘুম ভেঙে যাবে। এই ভেবে তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে নেয় সে। আজরার কাছ থেকে দূরে সরে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ে ইনতিসার।
আপনমনে ভাবলো, সবকিছুর শুরুটা সুন্দর হওয়া উচিত। আজরা জেগে উঠলে কী মনে করতো! তার সম্মতি না নিয়ে এসব কী করতে যাচ্ছিলো সে? ভাগ্যিস গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মেয়েটা।
এদিকে নিজের উপরে রাগ হলো আজরার। সে চাইলেই ইনতিসার কে সরে যাওয়া থেকে আটকাতে পারতো। দু’জনে ভেসে যেতে পারতো সুখের সাগরে। নিশ্চয় সে ঘুম ভেবে থেমে গেছে ইনতিসার। এমনটা না করে সেও কী সাড়া দিতে পারতো না সুখের এই খেলায়?
এই ভেবে ছটফট করতে থাকে আজরা।
.
চলবে
#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_১৪
#Saji_Afroz
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে আসে আজরা৷ বিশাল এই রান্নাঘর তাদের। কত সাজানো গোছানো! সবকিছুই চোখের সামনে রয়েছে। কিন্তু গোছানো ভাবে। যখন যেটা ইচ্ছে সেটা সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যাবে।
আজরা কে দেখে রান্নাঘরে থাকা দু’জন বুয়া এগিয়ে এল। তারা জানতে চাইলো তার কী প্রয়োজন। আজরা বলল, আজকের সকালের নাস্তাটা আমি বানাতে চাচ্ছি।
তাদের মধ্যে একজন বলল, সে কী! আপনি এখানে এসেছেন জানতে পারলেও ম্যাডাম খুব রাগ করবেন। প্লিজ রুমে যান। আপনার কী লাগবে সেটা বলুন?
-কিছুই বলবে না। আমি সবাইকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। প্লিজ না করবেন না!
অনেকটা জোরাজোরির পর তারা আজরার কথাতে রাজি হয়। আজরা নিজ হাতে নাস্তা বানাতে শুরু করলো।
মা-বাবার একমাত্র মেয়ে হলেও মোটামুটি সব কাজই পারে সে৷ রান্নার হাতও বেশ ভালো তার। সেই রান্না শশুরবাড়ির মানুষদের না খাওয়ালে কী চলে? তারাও জানুক, তাদের ঘরের বউও পারদর্শী।
ঘুম ভেঙে পাশ ফিরে আজরা কে না দেখে উঠে পড়লো ইনতিসার। ভাবলো সে ওয়াশরুমে। কিন্তু সেখানেও পেল না। ওয়াশরুম খালি পেয়ে ইনতিসার ফ্রেশ হতে যায়।
এদিকে রান্নাঘরে আজরা কে দেখে ইলারা জামান চমকে উঠলেন। আজরা শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে পরোটা বানাচ্ছে। ইলারা জামান এসে হেসে বললেন, তুমি এইখানে কী করো? নতুন বউ এসব করে নাকি? তাছাড়া পুরাতন হলেও করার প্রয়োজন নেই। এত মেয়ে কেন রেখেছি? আমার ছেলের বউ কে কষ্ট দেওয়ার জন্য?
এক নাগাড়ে তার এত কথা শুনে হেসে ফেললো আজরা। সে বলল, কোনো কষ্ট না! আমি রান্না করতে পছন্দ করি।
-তবুও…
অন্যসময় করতে। কালই মাত্র বাড়ি থেকে এলে তুমি।
-আমার রান্না কেমন খেয়েই দেখুন না একবার মা!
মা ডাকটি শুনে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে ইলারা জামানের। তার একটি মেয়ে ছিল। যে কিনা জন্মের সময় মারা গেছে। আর সন্তান হয়নি তার। একটি মেয়ের খুব শখ ছিল তার। ইনতিসারের বউকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসা দেবেন, এমনটাই ভেবে রেখেছিলেন তিনি। আজ আজরার মুখে মা ডাক শুনে মনে হচ্ছে নিজের মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন। তার দুচোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলে আজরা তা দেখলো। সে বলল, আপনার চোখে পানি?
-খুশির অশ্রু!
এই বলে আজরা কে জড়িয়ে ধরেন তিনি। আজরা কিছু বুঝতে পারলো না। আবার কিছু জিজ্ঞাসাও করলো না। শুধু ইলারা জামানের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, খুশির অশ্রু হলে তো প্রতিনিয়ত ঝরবে! কারণ আমরা সবাই সবসময় অনেকবেশি খুশিতে থাকব।
তিনি চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, এটাই তো চাওয়া। এখন আসো। আমি সাহায্য করি তোমাকে।
-না মা…
-একদম চুপ। মাংসে লবণ দিয়েছ তো? আর কী করতে হবে বলো তো?
তাদের দেখে বুয়াদের মুখেও হাসি ফোটে। ইলারা জামান কে অনেকদিন পরে রান্নাঘরের কাজে হাত লাগাতে দেখা যাচ্ছে। অনেক বেশি খুশিও দেখাচ্ছে তাকে। আজরা কে পেয়ে তিনি আসলেই বেশ খুশি!
.
.
-তোর চাকরী করার কী প্রয়োজন? আমি যতদিন বেঁচে আছি তোর কষ্ট করতে হবে না তে মা। সংসার জীবনে পা দে। ওদিকটা সামলা।
বাবার কথা শুনে নাবীহা বলল, তা বললে তো হয় না বাবা। অনেক তো তুমি করলে। এইবার আমায় একটু করতে দাও?
মেয়ের কথা শুনে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে তার দু-চোখ। বড়ো ছেলে নেই বলে সবসময় আফসোস করতেন তিনি। নাবীহা তার সেই দুঃখটাও গুছতে চলেছে।
তিনি নাবীহা কে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমার ভালো মেয়েটা। দেখবি জীবনে অনেকটা উন্নতি করবি।
বাবার স্মৃতিচারণ করছিল নাবীহা। বাবার কথা মনে হতেই শোয়া থেকে উঠে পড়লো সে। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছে।
কী হত তার চাকরি টা আরও আগেই হয়ে গেলে? বোনের সংসারে টাকা পাঠাতে পারলে আজ তার সংসারে অন্ধকার নেমে আসতো না।
বাইরে শোরগোল শুনতে পেয়ে শরীরের কাপড় ঠিক করে সেদিকে এগিয়ে যায় নাবীহা।
নাফিসা ও তার মা এর সামনে বসে রয়েছেন কয়েকজন আত্মীয়৷ তাদের কথোপকথন শুনতে থাকে নাবীহা।
-মুখে তালাক দিয়েছে বললেই তালাক হয়ে যায় ইসলামে। তিন তালাক দিয়েছে তো না কি?
খালার কথা শুনে নাফিসা বলল, জি।
-এখন কাগজ পত্রের মাধ্যমে ডিভোর্স টা হতে হবে। এতে করে তুমি কাবিনের টাকা পাবে।
-কিন্তু সে তো বলছে এক টাকাও দেবে না।
-টাকা দেবে না মানে! মামলা করে দেবে। এই সময়ে তোমাদের টাকা প্রয়োজন। এখন তো বাবাও নাই। সংসার চলবে কীভাবে? যেভাবে হোক টাকা জোগাড় করতে হবে।
নায়লা খাতুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ছেলেটা কে একটা ভালো কলেজে ভর্তি করাব ভেবেছিলাম। ওর ও পড়াশোনার প্রতি বেশ আগ্রহ। এখন কীভাবে কী হবে?
এই বলে শব্দ করে কেঁদে উঠলেন তিনি। নাবীহা আবারও ফিরে আসে নিজের রুমে। পরিবারের সকলের এই হাহাকার যে সে দেখতে পারছে না! খুব তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে হবে তার।
.
.
.
ডাইনিং রুমে বসে সবাই নাস্তা করছিল। নাস্তার ফাঁকে ইলারা জামান বললেন, তোরা শুধু খেয়েই যাচ্ছিস? রান্না টা কেমন হয়েছে বলছিস না?
ইনতিসার বলল, বেশ ভালো। তবে আজ একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে।
-কেমন?
-অনেক বেশি ভালো।
-দেখতে হবে না কে রান্না করেছে?
-কে?
-আজরা।
আজরার দিকে তাকিয়ে ইনতিসার বলল, তোমার রান্না তো বেশ মজা!
ইলহাম শেখ বললেন, আসলেই! বউ মা তুমি কিন্তু আমার লোভ বাড়িয়ে দিলে। মাঝেমধ্যে রান্না করে খাওয়াতে হবে।
আজরা হেসে বলল, প্রতিদিনই খাওয়াব আপনাকে। কী খেতে ইচ্ছে করে শুধু বলবেন।
-তা বলব! একটু এদিকে আসো তো এখন?
আজরা উঠে তার পাশে আসলো। তিনি পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে আজরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটা নাও।
টাকা দেখে আজরা বলল, টাকা কেন বাবা?
-আজ প্রথম রান্না করলে। কিছু তো দিতে হবে তোমাকে। রাখো এটা।
সে নিতে না চাইলেও ইলহাম শেখের জোরাজোরি তে নিতে হলো।
এরমধ্যে কারও ডাকে পেছনে ফিরে তাকায় আজরা। মানতাশা কে দেখে অবাক হয়ে বলল, এত সকালে তুই?
মানতাশা ভেতরে এসে সবাই কে “হ্যালো” জানিয়ে বলল, এদিকে যাচ্ছিলাম একটা কাজে। ভাবলাম দেখে যাই তোকে।
-খুব ভালো করেছিস। আয় আগে আমাদের সাথে নাস্তা সেরে নে।
-আমি করে এসেছি।
-তাতে কী! আয় তো।
ইলারা জামানও বসতে বললে মানতাশা বসলো।
খাওয়ার এক পর্যায়ে ইনতিসার বলল, ভাবছি কয়েক দিনের জন্য বাইরে কোথাও থেকে ঘুরে আসি। এ ক’টা দিন তুমি অফিস ম্যানেজ করতে পারবে না বাবা?
তিনি হেসে বললেন, নিশ্চয়। বউ মা কে নিয়ে ঘুরে আসার কথা তো আমিই বলতাম তোকে। কোথায় যাবি ভাবলি?
আজরার দিকে তাকিয়ে ইনতিসার বলল, কোন দেশে যেতে চাও তুমি?
দেশ! একথা শুনে মানতাশার চোখ জোড়া বড়ো বড়ো হয়ে গেল। আজরা দেশের বাইরে হানিমুনে যাবে?
আজরা মিনমিনে স্বরে বলল, কিন্তু আমার তো পাসপোর্ট রেডি নেই।
একথা শুনে ইলারা জামান বললেন, আচ্ছা ব্যাপার না! আগে কাছে কোথাও ঘুরতে যাও। আমি পাসপোর্ট, ভিসা এসবের ব্যবস্থা করছি। দেশে কোথায় যেতে চাও বলো?
আজরা একগাল হেসে বলল, কক্সবাজার। কখনো যাইনি, আমি।
-কী বলো! তবে অবশ্যই সেইখানে যাওয়া উচিত। আর দেশের বাইরে কোথায় যাওয়ার ইচ্ছে?
-সেভাবে কখনো ভেবে দেখিনি! আপনারা যা বলেন।
-মালদ্বীপ, নেপাল বা সিঙ্গাপুর এই তিনটা থেকে বেছে নিতে পারো।
একথা শুনে মানতাশা আপনমনে বলল, কক্সবাজারই যে মেয়ে দেখেনি সে কিনা এখন দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবে!
সে হালকা কেশে আজরা কে বলল, মালদ্বীপ যেতে পারিস। তোর তো এমন জায়গা পছন্দ।
হ্যাঁ সূচকভাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় আজরা।
ইনতিসার বলল, তবে মালদ্বীপের ব্যবস্থা করো মা। আজরার পছন্দ কেই প্রথমে গুরুত্ব দিই। কিন্তু এরপর সিঙ্গাপুর যেতে হবে। আমার ইচ্ছে তে।
-নিশ্চয়!
খাওয়া শেষে মানতাশা কে নিয়ে নিজের রুমে আসে আজরা। মানতাশা আজরার হাতে টাকা দেখে বলল, সকাল সকাল হাতে টাকা নিয়ে কী করছিস?
-শশুর দিয়েছে।
-কেন?
-আজ প্রথম রান্না করলাম তো।
-ওহ! কত আছে এতে?
-দেখিনি এখনো।
-আমায় দে দেখি।
এই বলে আজরার হাত থেকে টাকা গুলো নিয়ে দেখলো, তাতে দশ হাজার রয়েছে। মানতাশা অবাক হয়ে বলল, কয়েকটা পরোটা আর মাংস রান্না করেই দশ হাজার টাকা পেয়ে গেলি?
-দশ টাকা দিলেও খুশি হতাম। শশুর খুশি হয়ে দিয়েছেন বলে কথা!
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে আজরা বলল, কে?
ইনতিসারের গলার স্বর শুনে তাকে ভেতরে আসতে বলে আজরা। সে ভেতরে এসে বলল, অফিসের ফাইল নিতে এসেছি।
-বেরুচ্ছেন?
-হ্যাঁ। তোমার কিছুর প্রয়োজন হলে ফোন দিও।
এই বলে সে ড্রয়ারে খুলে ফাইল নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মানতাশা বলল, ভাইয়ার সাথে কী আপনার বাবাও যান অফিসে?
-সবসময় অফিসে উনি যান না। বয়স হয়েছে তো৷ সব আমিই সামলাই। তবে প্রয়োজনে যান।
ফাইল খুঁজে পেলে ইনতিসার বেরুতে যাবে ঠিক তখনি মানতাশা বলল, আমি কী আপনার সাথে যেতে পারি? আপনার অফিসের ওদিকেই যেতে হবে আমাকে৷ যদি নামিয়ে দিতেন?
আজরা বলল, কেন দেবে না? কিন্তু আর কিছুক্ষণ থাকতি তুই? ভালো লাগছে আমার।
-আবার আসব রে। কাজ আছে তাই।
-তবে আবার আসবি বল?
-নিশ্চয় আসব।
-নাবীহাকেও নিয়ে আসিস। একটু ঘুরাফিরা করলে ভালো লাগবে ওর।
-আচ্ছা।
এই বলে আজরা কে বিদায় জানিয়ে ইনতিসারের সাথে বেরুলো মানতাশা।
ড্রাইভার থাকার কারণে পেছনের সিটে গিয়ে বসে ইনতিসার। মানতাশাও তার পাশে এসে বসলো।
বান্ধবীদের দেওয়া বাজির কথা মনে হতেই ইচ্ছে করেই এমন সময়ে এখানে এসেছে মানতাশা। কিন্তু কীভাবে কী করবে মাথায় তার আসছে না। গাড়ি চলতে শুরু করে।
ইনতিসার ফোনে ব্যস্ত। মানতাশা বলল, আমি কিন্তু কথা না বলে থাকতে পারি না। আপনি সারাপথে এইরকম চুপচাপ থাকবেন?
ফোনের দিক থেকে নজর সরিয়ে ইনতিসার মৃদু হেসে বলল, তুমি কথা বলতে চাইলে নিশ্চয় বলব।
-ধন্যবাদ। এখন বলুন আজরা কে কেমন লাগে আপনার?
-ভালো লাগে বলেই বিয়েটা করেছি।
-বিয়েতে অনেকেই বলাবলি করছিল, আপনি আরও সুন্দর মেয়ে জীবনে পেতেন। বিষয়টা কে কীভাবে দেখছেন?
এমন একটা প্রশ্ন আশা করেনি ইনতিসার। তাও মানতাশার মুখে। সে বলল, তাই? আমি কাউকে বলতে শুনিনি।
-আপনার সামনে নিশ্চয় বলবে না।
-যদি বলেও থাকে তারা ভুল বলেছে। আজরাই আমার জন্য ঠিক। এমন মেয়েই তো আমার পছন্দ। ওকে পেয়ে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।
-হুম। তবে আজরা আমার বান্ধবী হলেও একটা সত্যি কথা আমিও বলতে চাই।
-কী?
-আপনি চাইলে যেকোনো মেয়েকেই পটাতে সক্ষম হবেন।
-আমি আর মেয়ে পটানো! বিয়ের আগেই কখনো এসব হয়নি আমার দ্বারা। আর এখন তো…
তাকে থামিয়ে মানতাশা বলল, এখনো পারবেন। বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে! একবার ট্রাই করেই দেখুন। যেকোনো মেয়ে পটে যাবে।
এই বলে দুষ্টু একটা হাসি দেয় মানতাশা। ইনতিসার তার দুষ্টু হাসির পেছনের রহস্য বুঝতে পারলো না।
মানতাশা তার গন্তব্যে আসতেই নেমে পড়ে৷ যাওয়ার আগে ইনতিসারের ফোন নাম্বার চেয়ে বলল, দুলাভাই কে মাঝেমধ্যে বিরক্ত করব। নাম্বারটা দিন?
আজরার বান্ধবী বলে এক কথাতেই ফোন নাম্বার দিয়ে দেয় ইনতিসার। এরপর তাকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। মানতাশা বিরক্ত হয়ে গাড়ি ঠিক ঠিক করতে করতে ভাবলো, ধুর! কোনো কাজ তো নাই। এখন গাড়ি ভাড়া খরচ করে বাসায় যাওয়া লাগবে।
একরাশ বিরক্তি নিয়ে গাড়ি ঠিক করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো মানতাশা। কিন্তু বাসায় এসে এজাজ কে দেখে বিরক্তি যেন আরও বেড়ে গেল তার। এজাজ আবারও তার বাসায় কী করছে!
.
চলবে