একটুখানি ভালোবাসা পর্ব-১০+১১

0
980

#একটুখানি ভালোবাসা
#পর্ব_১০_১১
#লেখনীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
অবশেষে আমাদের আংটি’বদল হয়ে যায়। মাধবীলতাকে দেখে বেশ খুশিই মনে হচ্ছে। নানু ভাই যখন মাধবীলতাকে সব বলল। তখন মাধবীলতা কিছুক্ষণ ভেবে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়ে দেয়। আমি ভাবতেও পারিনি মাধবীলতা এই ক’দিনের পরিচয়ে নানুর কথায় বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যাবে। নাকি সে আমায় পছন্দ করে?
আপাতত এসব চিন্তা বাদ দিলাম।
রাত ১১ টা বাজে। ছাদের এক কার্নিশে রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি মাধবীলতা আর আমি। কেউই কারো সাথে কথা বলছি না। কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর নিজেই নীরবতা ভেঙে বললাম,
‘- আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
মাধ্বী ভ্রু কুঁচকে তাকালো আমার দিকে।
ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে দিল,
‘- আপনি আবার কবে থেকে অনুমতি নিতে শুরু করলেন?
‘- আসলে বলছি যে! হঠাৎ কী মনে করে নানুর কথায় রাজি হয়ে গেলেন?
‘- কেনো আপনি খুশি হোন নি?
ধুর আমি কী প্রশ্ন করব? উল্টো সেই তো প্রশ্ন ছুড়ে মারছে আমাকে।
‘- আরে আমি কেনো খুশি হবো না? অবশ্যই খুশি। তবে আমি শুধু আপনার মনের কথাগুলো জানতে চাইছি।
‘- তারমানে বলতে চাইছেন আমি মন থেকে রাজি হয়নি।
এই মেয়ে তো দেখি আমাকে প্যাঁচে ফেলে দিচ্ছে।
‘- আচ্ছা ঠিক আছে বুঝতে পেরেছে। রাত অনেক হয়েছে। ঘুমোবেন চলুন।
নিচে নামার দু’কদম এগোতেই মাধবীলতা পিছন থেকে আমার হাত টেনে ধরে। সে আমার একটু কাছেই চলে আসে। মাধবীলতা তার একটা আঙুল আমার দিকে তাক করে, তারপর নিজের দিকে। তারপর দুই হাত একসাথে করে কিছু বুঝিয়ে দিল,
‘- আপনি কী আমার উপর রাগ করেছেন?
‘- না রাগ করিনি।
‘- আচ্ছা বলছি।
আমি বেশ কৌতূহল নিয়ে মাধবীলতার সামনে দাঁড়ালাম।
মাধবীলতা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে হাত নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিতে শুরু করল,
‘- আজ সকালে আপনার বুকে ঘুমিয়ে এক অন্যরকম আনন্দ পেয়েছি। কিছু মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল আপনার বুকের অতল গহ্বরে পৌঁছে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, কতটা সুখ যেন লুকিয়ে আছে আপনার এই বুকে। যদি আপনাকে বিয়ে করার জন্য কারণ দেখাতে বলেন তাহলে হাজারটা কারণ রয়েছে আপনাকে বিয়ে করার। প্রতিটি মেয়েই চায় তার জীবনসঙ্গিনী এমন একজন হোক! যে মানুষটা তাকে একটু ভালবাসবে তাকে একটু নিজের মতো করে বুঝবে, যার কাছে স্বাচ্ছন্দ্যে নিজের মনের অনুভূতি গুলো প্রকাশ করা যায়। এতোটুকু হলেই আমার নারী’জাতিরা অনেকটাই খুশি।
‘- তা আপনার কেনো মনে হলো আমি ভালোবাসবো এবং নিজের মতো করে বুঝবো?
‘- বোঝাই যায়! বোকার মত প্রশ্ন করছেন আপনি। যে মানুষটা অন্যের ভালোবাসার জন্য এতটা যুদ্ধ করতে পারে নিজের পরিবারের সঙ্গে। সে মানুষটার কাছে যে খাঁটি ভালোবাসা পাবো সেটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
মাধবীলতা বলতে বলতে একদম কাছে এসে শার্টের বোতাম নিয়ে খেলা করছে।
‘- এতটা বিশ্বাস আমার উপর?
‘- হয়তো পরিচয়টা অল্প কিছু সময়ের। তবে এতটুকু বুঝতে পেরেছি আমি মানুষ চিনতে ভুল করিনি। অগাধ বিশ্বাস রয়েছে আপনার প্রতি।
আরও কিছুটা মুহূর্ত কেটে যায় সেভাবে।
‘- রাত তো অনেক হলো এবার ঘুমোতে চলুন।
মাধবীলতা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়। আবার ইশারা দিয়ে বলে,
‘- একটা কথা বলব?
‘- হ্যাঁ বলুন।
‘- তার আগে আপনার চোখ দুটো বন্ধ করুন।
‘- কেনো? কী এমন বলবেন যে চোখ বন্ধ করতে হবে?
‘- আরে চোখ দুটো বন্ধ করুন না। নাহলে বলতে পারবো না। আর এক মিনিট পর চোখ খুলবেন।
‘- আচ্ছা ঠিক আছে চোখ বন্ধ করলাম। এবার বলুন কী বলবেন!
মাধবীলতা কী যেন করছে। একটু পর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে দৌড়ে নিচে চলে গেলো। এক মিনিট পর আমিও চোখ খুললাম। হাতে ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো মুড়িয়ে দিয়েছে। আস্তে আস্তে কাগজের টুকরো টি খুললাম। তিন শব্দে সুন্দর করে লেখা ” আমি আপনাকে ভালোবাসি “।
ঠোঁটের কোণে আপনা-আপনিই হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
বিষয় টা হোতো এমন যে, মাধবীলতা যদি কথা বলতে পারতো তাহলে মুখে ” আমি আপনাকে ভালোবাসি ” বলেই দৌড় দিতো।
মাধবীলতার পাগলামি টা বেশ মনে ধরলো আমার।
আমিও ঘরে এসে শুয়ে পড়ি। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হলাম। লাগেজ নিয়ে বাইরে বের হলাম। মিথিলা আর প্রহরও এসেছে। মাধবীলতাও তৈরি হয়ে নিয়েছে।
নানু ভাই আমার কাছে এসে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
‘- নানু ভাই তুই যাসনে!
বলতে না বলতেই চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
নানুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় চুম্বন করে বললাম,
‘- নানু ভাই মায়াপুরী আর কতটা দূর?
‘- এতটা দূর! যে তোর আসতে পাঁচ বছর লেগে গেলো।
‘- আচ্ছা আমার বুড়ী বউটা তোমায় কথা দিলাম আমি অল্প কিছুদিনের মধ্যে আবার চলে আসবো।
‘- কথা দিলি?
‘- কথা দিলাম তোমায়। মাধবীলতা মিহি কোথায়?
মাধবীলতা উত্তর দেওয়ার আগেই নানু ভাই বলল,
‘- মিহি আমার কাছেই থাকবে। আমি ওকে যেতে দেবো না।
‘- কিন্তু নানু মিহিকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে।
‘- ওটা কোনো ব্যাপার না। হাজারটা স্কুলে ভর্তি করানো যায়। ওকে আমি আমাদের জেলার সবচেয়ে ভালো স্কুলে ভর্তি করাবো তুই চিন্তা করিস না।
‘- কিন্তু নানু মিহি কী থাকবে মাধবীলতাকে ছাড়া? মিহি কোথায়? ওকে ডাকো।
এমন সময় মিহি হাতের উল্টো পিঠ চোখ ডলতে ডলতে সবার সামনে আসে।
মিহির সামনে একহাঁটু গেড়ে বসলাম।
‘- তুমি তোমার নানু ভাইয়ের সঙ্গে থাকবে বুড়ী?
‘- হ্যাঁ আমি নানু ভাইয়ের সঙ্গে থাকবো। তোমরা কেউ আদর করো না। নানু ভাই আমাকে সবসময় আদর করে। তোমরা পঁচা আমার নানু ভাই ভালো।
মিহির এমন পাকা পাকা কথা শুনে সবাই হেঁসে দেয়৷
এবার মাধবীলতাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
‘- মিহি যদি এখানে থাকে তাহলে আপনার কী কোনো সমস্যা হবে?
মাধবীলতা মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দেয়।
‘- পারবেন ওকে ছাড়া একা থাকতে?
মাধবীলতা এগিয়ে এসে মিহির থুতনিতে হাত বুলিয়ে কপালে আদর দিয়ে ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে দিল,
‘- আমি তো সবসময়ই চাই আমার বোনটার প্রতিটি মুহূর্ত যেন হাসিখুশি কাটে। প্রথম প্রথম ক’টা দিন হয়তো ওকে ছাড়া কাটাতে খুব কষ্ট হবে। তবে মানিয়ে নেবো। আগে তো মিহি এতটা প্রাণবন্ত ছিল না। আমিই বা সময় দিতাম কবে ওকে? নানুকে পেয়ে ও যখন এতটা খুশি তাহলে তাই থাকুক। ওর মুখের হাসির জন্য আমি সবকিছু ত্যাগ করতে পারি।
আমি মাধবীলতার কথাগুলোর জবাব স্বরূপ শুধু একটা মুচকি হাসি দিলাম।
মিথিলার সামনে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,
‘- কিরে বুড়ী কেমন আছিস? কেমন লাগলো তোর শ্বশুরবাড়ি? তোর শ্বাশুড়ি মা’য়ের ভালোবাসা পাচ্ছিস তো?
মিথিলা একটা ভুবনভোলানো হাসি দিয়ে বলল,
‘- আমি অনেক ভালো আছি ভাইয়া। আর শ্বাশুড়ি মা আমাকে মায়ের মতোই ভালোবাসে। আমি যখন কাজ করতে যাই তখন আমাকে ধমক দিয়ে বলে আমি যখন বুড়ী হয়ে যাব তখন আমাকে রান্না করে খাওয়াবে! এখন গিয়ে পড়ায় মনোযোগ দাও অনেক বড় হতে হবে তোমাকে। একদিন তুমি অনেক বড় ডাক্তার হবে। আর আমি যখন বুড়ী হয়ে বিছানায় পড়ে থাকবো তখন তুমি আমার দেখাশোনা করবে কেমন। ( গত পর্বে মিথিলার পড়াশোনার বিষয়টায় ভ্যাজাল করে ফেলেছিলাম। মেডিকেলের জায়গায় অনার্সের উল্লেখ করেছিলাম।)
মিথিলার কথা শুনে মামার দিকে তাকালাম তার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। যে নিজের মেয়ের মুখে তার সুখের কথা শুনে তার প্রতিক্রিয়াটা কেমন হয়। মামার চোখের কার্নিশে অশ্রু এসে বাসা বেঁধেছে। চোখের পলক ফেললেই টুপ করে অশ্রুজল পাটিতে পরবে।
মিথিলার মুখের হাসিই বলে দিচ্ছে সে কতটা খুশি।
‘- নিজের খেয়াল রাখিস বুড়ী। তোর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আর প্রহরের খেয়াল রাখিস ঠিকমতো।
প্রহরের কাঁধে হাত রেখে বলি,
‘- নিজের আর আমার বোনের প্রতি যত্ন নিও। ভালো থেকো। আসি।
মিথিলা আমাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই বলে দিলাম,
‘- একদম ইমোশনাল হবি না।
মিথিলা ” ভাইয়া ” বলেই জড়িয়ে ধরলো।
সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। ছোট মামা আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দিল। ট্রেনে ওঠার পর মিথিলার মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মনে হয় কোনোকিছু নিয়ে খুব চিন্তিত।
‘- কী ব্যাপার মাধবীলতা? আপনার মুখটা এমন শুকনো শুকনো লাগছে কেনো? কী ভাবছেন?
মাধবীলতা চুপটি করে রইলো।
‘- আচ্ছা মিহিকে একা রেখে যেতে কষ্ট হচ্ছে বুঝি?
মাধবীলতা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়।
‘- আচ্ছা মুখ গোমড়া করে রাখতে হবে না। অল্প কিছুদিনের মধ্যে আবারও আসবো।
এবার তো মলিন মুখটা হাস্যজ্বল করে তুলুন। আপনি কী জানেন আপনি হাসলে আপনাকে কতটা সুন্দর লাগে? এতটা মায়াবতী লাগে আপনাকে!
ফিক করে হেঁসে ওঠে মাধবীলতা। আহ! মাধবীলাতার মলিনতা কাটাতে তার একটুকরো হাসিই যথেষ্ট।
দীর্ঘ সময় জার্নির পর গন্তব্যে পৌঁছালাম আমরা।
বাড়িতে এসে পরেরদিনই অফিসে জয়েন করি।
অফিসে যেতেই অদ্ভুত কিছু চোখে পড়ে আমার।
চলবে ইনশাআল্লাহ,,,

#একটুখানি_ভালোবাসা
#পর্ব_১১
#লেখনীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
অফিসে প্রবেশের সঙ্গেই ভিতর থেকে গানবাজনার শব্দ কানে ভেসে আসে। অফিসের ভিতর গান বাজায়। কার এতবড় সাহস? কাজে ফাঁকি দিয়ে গান শুনছে। কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেলাম। আশ্চর্য! কেউ-ই কারো ডেস্কে নেই। তাহলে গান বাজছে কোথায়? শব্দকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম। সবাই কাজ বাদ দিয়ে গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচছে।
‘- কী হচ্ছে এখানে?
সবাই গান ও নাচের তালে এতটাই মগ্ন যে আমার কথা শুনতেই পেলো না। এবার জোরে কিছুটা চিৎকার দিয়ে বললাম,
‘- কী হচ্ছে এখানে?
সবাই আমাকে দেখে যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো।
সবাই যে যার জায়গায় স্টিল দাঁড়িয়ে আছে। কারণ আমার অফিসের এমপ্লয়িরা জানে কাজের প্রতি অবহেলা করলে আমি কতটা রাগী হয়ে থাকি।
‘- কী হচ্ছে এসব? আজ প্রথম আমার অফিসে আসতে একটু দেরি হয়েছে। সেটার ফায়দা নিয়ে আজকেই আপনাদের এসব করতে হচ্ছে?
‘- স্যা**র আসলে!
‘- হ্যাঁ বলুন আসলে নকলে কী?
‘- আসলে স্যার আজ আমাদের সিনিয়র অফিসার সাগর ভাইয়ার জন্মদিন। তাই আমরা ছোট্ট একটা কেক কেটে আনন্দ করছিলাম।
সাগর ভয়ার্ত চাহনিতে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।
‘- গান কার ফোনে বাজছিল?
কেউ কোনো কথাই বলছে না।
‘- আমি কিছু বলেছি? গান কার ফোনে বাজছিল?
সবার পিছনে আড়াল থেকে মাধবীলতা বেরিয়ে এলো। তিনি তার ফোনটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিল ‘- গানটা আমার ফোনেই বাজছিল স্যার “!
‘- ওহ তাহলে নাটের গুরু আপনিই? আর এতক্ষণ কত সুন্দর করে সবার পিছনে আড়াল হয়ে ছিলেন।
‘- আর কখনো হবে না স্যার?
‘- তা বললে তো শুনবো না ম্যাডাম। ভুল যখন করেই ফেলেছেন তখন শাস্তিও নিশ্চয়ই পেতে হবে।
আমার কথা শুনে মাধবীলতা ছোটখাটো একটা ঢোক গিললো।
সাগরের সামনে গিয়ে হঠাৎ গানটি চালু করে দিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বললাম,
‘- জন্মদিন উপভোগ করুন।
এই বলে কেবিনে চলে এলাম।
সবাই আমার এমন আচরণে অবাক হয়ে যায়। একটা দিনই তো? করলো নাহয় একটা দিন তাদের মতো করে উপভোগ।
কিছুক্ষণ পর মাধবীলতা আমার কেবিনের সামনে এসে দরজায় কড়া নাড়ছে। অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল।
‘- বসুন।
মাধবীলতা আমার সামনে চেয়ারে বসে পড়ে।
‘- এরপর থেকে যেন আর এই অনুমতি গুলো দিতে না হয়৷
‘- ঠিক আছে স্যার। কিন্তু স্যার একটা কথা ছিল?
চোখ রাঙিয়ে তাকালেই মাধবীলতার মুখের দিকে।
‘- না মানে সত্যিই কী আমি শাস্তি পাবো?
ল্যাপটপের কাজ বন্ধ করে ভ্রু কুঁচকে মাধবীলতার মুখপানে চাইলাম।
‘- কেনো ভয় হচ্ছে বুঝি?
সে নখ কামড়াতে কামড়াতে বলে,
‘- না মানে, ইয়ে মানে,,,
‘- যে হারে মানে মানে করছেন! পরীক্ষার প্রশ্নেও এতো মানে বের করতে বলে না।
বেচারি মাধবীলতা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
‘- আর শাস্তির কথা বলছেন? শাস্তি! সে তো বাড়িতে গিয়ে পাবেন।
‘- আর একটা কথা? আমি শুনেছি কাজে ফাঁকি দিলে নাকি আপনি খুব বকা দেন। কিন্তু আজ দিলেন না কেনো?
‘- বকা দেবো আপনাকে? তাও আবার এতগুলো মানুষের সামনে? পাগল নাকি? আপনার সাথে একটু ঝাঁঝালো কণ্ঠে কথা বললেই কেঁদে ফেলেন। আর যদি দেই বকা! তাহলে তো সবার সামনে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদবেন। এখন এই ফাইলটা নিয়ে গিয়ে আস্তেধীরে কাজ করুন।
মাধবীলতা ফাইলটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে নিজের মনেই বলতে লাগলো,
‘- ব্যাটা উচ্চিংড়ে, খাটাশ। আমাকে বলে আমি কি-না ছাগলের মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করব? আজ শুধু বাড়ি যাও চান্দু। কফির মধ্যে শুকনো মরিচের গুঁড়ো খাইয়ে কাঁদাবো আপনাকে। তারপর দেখবো কে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদে হুহ। কিন্তু একটা কথা! উচ্চিংড়ে টা তো আমাকে ছাগল বলেনি। তাহলে আমি কেনো নিজেকে ছাগলের মতো ভাবছি। উফফ আমিই একটা গাধী।
নিজেই নিজের মাথায় টোকা দিয়ে ডেস্কে বসে কাজে মনোযোগ দিল মাধবীলতা। কিছুক্ষণ কাজ করার পর কাজ থেকে মন উঠে যায় মাধবীলতার। পুনরায় সেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ বিষয়টাতেই ফিরে যায় সে।
এদিকে যে আমি চুপিচুপি মাধবীলতার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সে টেরই পাইনি। এদিকে মাধবীলতার সামনে থাকা মিস সুবর্ণা আমাকে দেখেই উঠতে যাবে ঠিক তখনই আমি তাকে হাতের ইশারায় বসতে বলি। মাধবীলতা সুবর্ণার হাত ধরে টান দিলো।
‘- কিছু বলবেন মাধবীলতা আপু?
মাধবীলতা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো। তারপর খাতায় লিখতে লাগলো,
‘- সুবর্ণা আপু! আমি আপনাকে কেঁদে দেখাবো! আপনি শুধু এতোটুকু বলবেন যে আমি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদি কিনা?
মাধবীলতার লেখাগুলো পড়ে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে নিজের হাসি কে দমিয়ে রাখলাম। এরকম পাগলামির কী কোনো মানে হয়?
লেখা শেষ করে মাধবীলতা কাগজটি সুবর্ণার হাতে ধরিয়ে দিলো। সুবর্ণা লেখাগুলো পড়ে একবার আমার দিকে আরেকবার মাধবীলতার দিকে তাকাতে শুরু করল। আমি হাতের ইশারায় তাকে বুঝিয়ে দিলাম চালিয়ে যান। সুবর্ণা নিজের হাসিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তারপরও একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
‘- ঠিক আছে আপু আপনি কাঁদতে শুরু করুন। আমি দেখে বলছি আপনার কান্না কীরকম।
টেবিলে থাকা পানি ভর্তি গ্লাস থেকে কয়েক ফোঁটা পানি নিয়ে নিজের চোখের নিচে লাগিয়ে মাধবীলতা মিছেমিছি কান্না শুরু করলো। মাধবীলতার এমন কান্নার শব্দ শুনে সব কর্মচারীরাই মাধবীলতার দিকে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইল। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না যে এখানে কী হচ্ছে? মাধবীলতা এভাবে কিছুক্ষণ তার রঙ তামাশা চালিয়ে যেতে থাকলো। তারপর হঠাৎ তার মিছে’কান্না থামিয়ে খাতায় লিখতে শুরু করল,
‘- এখন বলুন তো আমি কী ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেছি?
সুবর্ণা লেখাটি পড়ার পর বলল,
‘- একদমই না! আপনি তো অনেক সুন্দর করে কাঁদছিলেন! কত সুন্দর নিষ্পাপ দেখাচ্ছিলো আপনাকে। কে বলেছে আপনি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদেন?
মাধবীলতা হতাশা নিয়ে লিখতে শুরু করল,
‘- কে আর বলবে আপু! ওইযে আমাদের উচ্চিংড়ে, খাটাশ স্যার বলেছে আমি নাকি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করি।
সুবর্ণা কাগজটি হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুখের উপর হাত দিলো। সম্ভবত সে নিজের হাসিকে আটকানোর চেষ্টা করছে।
এই মেয়ে তাহলে আমাকে এসব ভাবে? আমি কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলাম,
‘- আমি উচ্চিংড়ে আর খাটাশ তাই না?
মাধবীলতা আবার লিখতে শুরু করল,
‘- এই আপু আপনি ওই বজ্জাত স্যারের মতো এমন রাগী কণ্ঠে কীভাবে কথা বললেন?
সুবর্ণা মাধবীলতাকে বলে,
‘- আপনার পিছনে তাকিয়ে দেখুন।
সুবর্ণার কথা শুনে মাধবীলতা পিছন ফিরে তাকায়। আমাকে দেখে যেন সে জমের দেখতে পেলো। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের মতো কান্না শুরু করল।
এখনো তাকে কিছু বললামই না। আর তাতেই কাঁদতে শুরু করল? এরকম আজব ক্যারেক্টার আগে কখনো দেখিনি। আমি বকা দেবো ভেবেই হয়তো কাঁদছে। বুদ্ধি আছে। বকা খেয়ে কান্নার আগেই নিজে নিজে কান্না শুরু করল।
‘- এ’কি আপনি কাঁদছেন কেনো? আপনাকে তো এখনো কিছুই বলিনি আমি।
কোনোমতেই সে কান্না বন্ধ করছে না। বুঝতে বাকি থাকলো না যে আমি যতক্ষণ তার সামনে থাকবো সে অনবরত কেঁদেই যাবে। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে বললাম,
‘- আচ্ছা আমি কিছুই বলব না। আমি চলে যাচ্ছি। তবুও কান্না বন্ধ করুন।
আমি দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আমি আড়াল হতেই মাধবীলতার কান্না বন্ধ হয়ে গেলো। আমি আড়াল থেকে উঁকি দিলাম।
কান্না বন্ধ করে খুশি হয়ে লাফালাফি শুরু করেছে। এটা মেয়ে নাকি বানর? আমাকে এভাবে টুপি পড়ালো? তাকে প্রথম দেখায় আমি ভাবতেই পারিনি সে এতটা চঞ্চল হতে পারে।
সবাই একসময় করতালি দিল। সুবর্ণা বলল,
‘- অভিনন্দন মাধবীলতা আপু। এই প্রথম কেউ স্যারের হাত থেকে বিনা বকা খাওয়ায় বেঁচে গেলো।
সবাই সন্ধ্যার আগে অফিস থেকে চলে যায়। মাধবীলতার অসম্পূর্ণ ফাইলের কাজ শেষ করতে প্রায় রাত ন’টা বেজে গেলো। অফিস থেকে বেরিয়ে জুয়েলার্সের দোকান ঘুরে বাড়ি ফিরতে রাত দশটা বেজে যায়। ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম। মাধবীলতা আমার জন্য না খেয়ে বসে ছিল এতক্ষণ। টেবিলে বসতেই ইশারা করল,
‘- এতক্ষণ লাগে বাড়ি ফিরতে।
‘- একটু জরুরি কাজে ব্যস্ত ছিলাম তাই আসতে দেরি হয়ে গেলো। এখন শুরু করুন।
খেতে খেতে আবীরকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘- আচ্ছা আবীর নয়নের মায়ের কী অবস্থা এখন?
‘- মোটামুটি সুস্থ। আর কিছুদিনের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে।
‘- এ’তো খুব ভালো কথা। আর নয়ন কী নিজেকে পরিবর্তন করতে পেরেছে নাকি এখন আগের সেই বদভ্যাস গুলো বহাল রয়েছে?
‘- ভাইয়া কখনো কী এরকমটা হয়েছে? যে আপনি কাউকে ভালোবেসে বুঝিয়েছেন আর সে বুঝেনি? নয়ন একেবারেই পরিবর্তন। আর এসব তো ও শখ করে করতো না। বাবা মরা ছেলে। তারউপর মা অসুস্থ ছিল। মায়ের চিকিৎসার জন্য মাঝেমধ্যে চুরি করে ঔষধ কিনে আনতো। এটা তো ওর পেশা নয়। ওর মায়ের জন্য এখন কঠোর পরিশ্রম করে নয়ন।
‘- যাক, শুনে ভালো লাগলো যে নয়নে নিজেকে পরিবর্তন করে নিয়েছে।
খাওয়া শেষ করে মাধবীলতা’কে নিয়ে ছাদে গেলাম।
‘- এ’কি আপনি আমাকে ছাদে নিয়ে আসলেন কেনো? আর আপনার হাতে এটা কিসের প্যাকেট?
‘- আজ অফিসে যে কাণ্ড গুলো করেছেন সেগুলোর শাস্তি দেওয়ার জন্য আপনাকে ছাদে নিয়ে আসলাম।
মুহূর্তেই মাধবীলতার হাস্যজ্বল মুখটা মলিন হয়ে যায়।
‘- আপনি সত্যিই আমাকে শাস্তি দেবেন?
‘- আমার কথার কখনো নড়চড় হয় না।
মাধবীলতা আবার সেই টেকনিক খাটানোর চেষ্টা করলো। মানে কান্না করার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই তাকে থামিয়ে দিলাম।
‘- উহু! একদম কান্নার চেষ্টা নয়। এবার মাফ নেই। চোখদুটো বন্ধ করুন।
‘- শাস্তি কী কেউ চোখ বন্ধ করে দেয়?
‘- অবশ্যই আমি দেই। যেটা বলেছি সেটা দ্রুত করুন। চোখ দুটো বন্ধ করুন।
ধমকের সুরে মাধবীলতা বেশ ভয় পেয়ে যায়। তাই দ্রুত চোখ বন্ধ করল। আমি আস্তে আস্তে মাধবীলতার দিকে এগিয়ে গেলাম। মুখটা একদম তার কাছের নিয়ে গেলাম। আমার গরম নিশ্বাস মাধবীলতার কানের উপর পড়তেই মাধবীলতা শিউরে ওঠে। শরীরের মধ্যে অদ্ভুত একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে।
ফিসফিস করে বললাম,
চলবে ইনশাআল্লাহ,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে