এই_ভালো_এই_খারাপ পর্ব-০৬

0
461

#এই_ভালো_এই_খারাপ(৬)
#Jannat_prema

আচমকা এমন ভাউ আওয়াজ শুনে ভয়ে লাফিয়ে পিছিয়ে যেতে কারো নাকের সাথে বাড়ি খেয়ে হতভম্ব হয়ে গেছে সকাল। আদিল নাকে বাড়ি খেয়ে আর্তনাদ করে উঠলো,

” আউচ! আমার নাক ফেটে গেলো মনে হয়। এই মেয়ে চোখে দেখো না আমাকে? ”

সকাল চোখ বড় বড় করে আদিলের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আদিলের শক্ত নাকের সাথে মাথায় বাড়ি খেয়ে হালকা ব্যাথা পেলো সকাল। নাকে ব্যাথা পাওয়ায় চোখে পানি এসে গেছে আদিলের। নাক ডলে সকালের দিকে তাকালো। সকাল ক্ষিপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠলো,

” সমস্যা কি আপনার? এমন কুত্তার মতো কানের কাছে ঘেউ ঘেউ করার মানে কি৷ একদম ভালো হয়েছে। আমাকে ভয় দেখাতে এসে নিজেই ব্যাথা পেয়েছেন। ”

আদিল নাক থেকে হাত সরালো। সকাল আদিলের নাকের দিকে তাকালো৷ নাক ডলার কারণে লাল হয়ে আছে। সকালের মায়া হলো আদিলের নাকের উপর। আদিল ভ্রূ কুঁচকালো। চোখ ছোটো ছোটো করে বললো,

” কি বললে তুমি? আমি কুত্তার মতো ঘেউঘেউ করেছি? ”

সকাল নির্লিপ্ত সুরে বললো,

” তা নয়ত কি? আপনি তো আর মিউমিউ করেননি! ”

আদিল সকালের দিলে তেড়ে এসে বললো,

” আমি এমন কিছুই করিনি। আমি শুধু ভুতের মতো ভাউ করেছি। আর তু__”

” তারমানে আপনি নিজেকে ভুত ভাবেন? ”

আদিল চোখ গরম করে তাকালো সকালের দিকে। মেয়েটা এতো কথা পেঁচাতে পারে। আদিল ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললো,

” তুমি আসলে নির্বোধ একটা মেয়ে! ”

সকাল হা করে তাকিয়ে আছে আদিলের দিকে। আদিল কথাটা বলেই ছাঁদ থেকে নেমে গেলো। সকাল গাল ফুলিয়ে বিরবির করে বললো,

” উনি মনে হয় মহাজ্ঞানী। হুহ! ”

.

বৌভাতের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। ভোর একবার আশেপাশে তাকিয়ে আবদ্ধকে দেখার চেষ্টা করলো৷ সেই যে সকালে নাস্তার সময় দেখেছে এখন পর্যন্ত তার দেখা নেই। সকালটাও এতোক্ষণ তার পাশে থাকলেও এখন সে ছবি তুলতে ব্যাস্ত। আলিফার শরীর একটু খারাপ লাগায় সে বিশ্রাম নিচ্ছে। ভোর একটা হিসেব এখোনো মিলাতে পারছে না৷ তার যে সিফাতের সাথে বিয়ে না হয়ে আবদ্ধর সাথে হলো সে বিষয়ে কারো কোনো কথা নেই৷ সবটা যেনো এভাবেই হওয়ার কথা ছিলো। মনে হচ্ছে বিয়েটা সিফাতের সাথে নয় আবদ্ধর সাথেই হতো। কোথাও একটা মনে হচ্ছে খটকা রয়েছে৷ এর পিছনে কিছু একটা তো লুকিয়ে আছে। যেটা ভোর জানে না। তাহলে কি সত্যি কিছু একটা তার থেকে লুকিয়েছে সবাই? এতো কিছু চিন্তার মাঝে ভোরের চোখ আটকে গেলো আবদ্ধর উপর। কালো কোর্টের ভিতর সাদা শার্ট কালো প্যান্ট পরিহিত আবদ্ধকে দেখে মুগ্ধ হলো ভোর। সেই আগের মতোই আবদ্ধকে কালো রঙের জামা হোক বা কোর্টে ভোরের কাছে সব সময় আকর্ষনীয় লাগছে। আবদ্ধর গায়ের রঙ ফর্সা হওয়ায় মুখের চাপ দাড়িতে ভিষণ সুন্দর লাগছে৷ চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করে রেখেছে আজকে। ভোর নিজের অজান্তেই মনে মনে আওড়ালো,

” আমার সুদর্শন আবদ্ধ। ”

পরমুহূর্তে নিজেকে অদৃশ্য এক থাপ্পড় লাগালো ভোর। এই বোয়াদবটাকে এভাবে দেখা উচিত না। ধোঁকাবাজ ছেলে! ভোর চোখ নামিয়ে নিলো। তবুও বারবার আবদ্ধর দিকে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে। আবদ্ধ যতবার ভোরের দিকে তাকিয়েছে, ঠিক ততবার নিজেকে সামলেছে। বুকের বাম পাশে হাত রেখে মুখ দিয়ে শ্বাস ফেললো আবদ্ধ। মেয়েটা মনে হয় তাকে মেরে ফেলবে৷ আবদ্ধ নিজেকে কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণ করলো। লাল রঙের শাড়ি পরিহিত ভোরকে আবদ্ধর কাছে কোনো জীবন্ত লাল গোলাপ মনে হচ্ছে। আবদ্ধ আবারো ভোরের দিকে তাকালো। হিট করে যেনো তার সকল মুগ্ধতা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে গেলো ভোরের দিকে৷

” আসসালামু আলাইকুম ভাবি! আমি নাদিম। আবদ্ধ ভাইয়ের কাজিন। ”

হাত বাড়িয়ে কথাটা বললো নাদিম। ভোর মুচকি হেসে যেই নাদিমের হাতের সাথে হাত মিলাতে যাবে, তখন-ই কোথা থেকে আবদ্ধ এসে নাদিমের বাড়িয়ে রাখা হাতের সাথে নিজের হাত মিলালো। আবদ্ধর কাজে ভোর আর নাদিম হকচকালো। আবদ্ধ অতশত পাত্তা না দিয়ে বললো,

” কেমন আছিস, নাদু? ভাই থাকতে ভাবির সাথে হাত মিলানোর দরকার নেই। ভাই পছন্দ করে না এসব। ”

নাদিম মেকি হাসি দিয়ে বললো,

” স’রি ভাই। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আচ্ছা তোমরা থাকো আমি আসি। ভাবি হাসি। ”

শেষের কথাটা ভোরের দিকে তাকিয়ে বললো৷ ভোরও মেকি হাসি দিয়ে মাথা নাড়লো। নাদিম প্রস্থান নিতেই আবদ্ধ ভোরের পাশে বসলো৷ ভোর যে হাত দিয়ে নাদিমের সাথে হাত মিলাতে গেলো আবদ্ধ সবার আড়ালে সেই হাতটা চেপে ধরলো। ভোর ব্যাথায় নাক মুখ কুঁচকে আবদ্ধর দিকে তাকালো। ব্যাথাতুর কন্ঠে বললো,

” আমি হাতে ব্যাথা পাচ্ছি আবদ্ধ। হাতটা ছাড়! ”

আবদ্ধ ভোরের মুখের দিকে তাকালো। হাত আগের মতোই ধরে রেখে বললো,

” তুই ওর সাথে হাত মিলাতে যাচ্ছিলি কেনো? তোকে নিষেধ করেছিলাম অচেনা কোনো ছেলের সাথে__”

” সেগুলো পুরোনো কথা। আর যে এই কথাগুলো বলেছিলো সে একটা ধোঁকাবাজ ছিলো৷ ভোর কখোনো ধোঁকাবাজের কথা শুনে না। ”

কথাগুলো বলেই আবদ্ধর হাত থেকে নিজের হাত জোর করে ছাড়িয়ে নিলো ভোর। আবদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ভোরের দিকে। ভোরের কথাগুলো তার হৃদয়ে তীরের মতো বিধলো। আবদ্ধ দাঁত চেপে সেখান থেকে উঠে চলে গেলো।

.

ভোরদের বাড়ির সবাই এসেছে। শ্রাবন্তী আক্তার মেয়েকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো৷ কালকে থেকে মেয়েটার জন্য বুকের ভিতর হাহাকার করছিল। ভোরকে জড়িয়ে ধরতেই যেনো শান্ত হলেন তিনি। সকাল মা আর বোনের এতো দরদ দেখে মুখ লটকে আছে। শ্রাবন্তী আসতেই সকালকে নিজের সাথে সাথে রাখছে। বিয়ে বাড়িতে কত ছেলে আছে। এভাবে তো আর সবার মাঝে জোয়ান মেয়েকে ছেড়ে রাখা যায় না। বাদল সাহেব ভোরের সাথে কথা বলে চলে গেলেন আবদ্ধর বাবার কাছে। এক সময় শ্রাবন্তী আক্তারকে নিজের সাথে খেতে নিয়ে গেলেন নায়েলি বেগম। ভোর এখন আপাতত আবদ্ধর রুমে। আদিল কিছুক্ষণ পরপর উঁকি মারছে সেদিকে। সকাল ভোরের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। আদিল ভাবলো, মেয়েটা এখন কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে৷ অথচ তার সাথে কথা বলার সময় মনে হয় মুখে তিতা করলা মেখে কথা বলে। আদিল মনে মনে আফসোস করলো। তার মতো হ্যান্ডসাম বয়কে এই মেয়ে কি ভাবে ইগনোর করছে? যেখানে ভার্সিটির সুন্দরী মেয়েরা তার সাথে লাইন মারতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আদিল এই নিয়ে সকালকে পরে দেখে নিবে। মেয়েটার ভাব বেড়েছে।

.

বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ হলো অনেক্ষণ আগে৷ আজকে ভোর আর আবদ্ধ ভোরদের বাড়িতে যাবে। আবদ্ধ নিজের গাড়ি নিয়ে যাবে বলেছে। এতে কেউ অমত করেনি। সকাল ভোরের পাশে বসলো। ড্রাইভিং সিটে আবদ্ধ বসলো। তার পাশে আদিল এসে বসে গেলো। আবদ্ধ ভোরের দিকে তাকালো। সকালের সাথে টুকটাক কথা বলছে। ভোর আড় চোখে আবদ্ধকে দেখার চেষ্টা করলো। আবদ্ধ সামনের দিকে থাকায় দেখতে পেলো না।

আবদ্ধরা বাসায় আসতেই শ্রাবন্তী ব্যাস্ত হলো আপ্যায়ন করতে৷ প্রথম বার মেয়ের জামাই বাসায় আসলো। বাদল সাহেবও ব্যাস্ত হলেন। ভোর কোনোদিকে না তাকিয়ে চলে গেলো নিজের রুমের দিকে। আবদ্ধও ভোরের পিছনে যাওয়া ধরতেই ভোরের সব কাজিন ঝেকে ধরলো তাকে। অগ্যতা আর যাওয়া হলো না তার। নাস্তা পানি করার পর সকলে সিদ্ধান্ত নিলো তারা ছাঁদে আড্ডা দিবে। প্ল্যানটা ছিলো সকালের। মিম আর রাইসা সহ আরো কয়েকজন সামিল ছিলো এই প্লানে। এতোগুলো মেয়ের মাঝে আদিল এক অসহায় পথিকের ন্যায় বসে আছে। তার সাথে ছেলে বলতে একটা ছেলেই আছে। তাও ভোরের একমাত্র মামার ছেলে আশিক৷ এতোক্ষণ আশিকের সাথে সে আড্ডা দিচ্ছিলো আশিকের গিটার নিয়ে। সকাল তাকে বললো গিটার নিয়ে আসতে। আদিল গিটার বাজাতে পারে বিধায় কিছুক্ষণ টুংটাং করলো। আশিক আদিলকে জিজ্ঞেস করলো,

” তুমি গিটার বাজাতে পারো? ”

আদিল মুচকি হেসে বললো,

” ভাইয়ের থেকে শিখেছি। ”

তখন ছাঁদে হাজির হলো আবদ্ধ আর ভোর। সকালই ওদের টেনে নিয়ে এসেছে। সবাই নিজ নিজ জায়গায় বসতে সকাল বললো,

” শুনো! আমরা একটা গেম খেলবো। ”

” কি গেম? লুডু? ”

সকাল বিরক্ত হয়ে তাকালো আদিলের দিকে। ছেলোটা সব সময় তার কথার মাঝে নাক গলাবে। সকাল তপ্ত সুরে বললো,

” জ্বী না। খেলাটা হলো লটারি খেলা। মানে এখানে যতজন আছে ততজনের জন্য কাগজে আলাদা আলাদ করে কিছু লিখা থাকবে। যেমন, গান, নাচ, কবিতা, আরো অনেক কিছু। তো এখানে প্রথমে বোতল ঘুরানো হবে। বোতল ঘুরিয়ে যার দিকে বোতলের মুখ থাকবে তাকে যে কোনো একটা কাগজ নিতে হবে। কাগজে যেটা লিখা থাকবে সেই মানুষটাকে সেটা করতে হবে। বুঝেছো সবাই? ”

সবাই মাথা নাড়ালো৷ আবদ্ধর দৃষ্টি তখন ভোরের দিকে৷ মেয়েটা তার দিকে একবারো তাকাচ্ছে না। প্রথমে মিম বোতল ঘুরালো। ভাগ্য ক্রমে তখন বোতলের মুখটা আবদ্ধর দিকে থেমে গেলো৷ সবাই একসাথে চিল্লিয়ে উঠলো। ভোর তখন আবদ্ধর দিকে তাকালো। সকাল কাগজের বক্সটা এগিয়ে দিতেই আবদ্ধ একটা কাগজ নিলো। কাগজটা খুলতেই দেখলো গান। সকাল উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” কি উঠেছে ভাইয়া? ”

আবদ্ধ আবারো ভোরের দিকে তাকালো। বললো,

” গান। ”

আবদ্ধর কথায় হইহই করে উঠলো সবাই। বললো,

” আপনাকে গান গাইতে হবে কিন্তু ভাইয়া। গান না গাইলে কিন্তু হবে না। ”

আবদ্ধ সবার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,

” অবশ্যই গাইবো৷ অত্যন্ত বউয়ের জন্য হলেও গাইতে হবে। ”

সবাই মিটমিট করে হেসে উঠলো। ভোর তখন আবদ্ধর দিক থেকে চোখ নামিয়ে নিলো। আবদ্ধর গান গাওয়া মানে অন্যকিছু। এক অন্য অনুভুতি। আবদ্ধ গান গাইবে শুনে বুকের ভিতর ধুকপুক করছে ভোরের। একবার কলেজ ফাংশনে আবদ্ধ গানে নাম দিয়েছিলো। সেদিনই আবদ্ধর প্রতি আরো মুগ্ধ হলো ভোর। আবদ্ধ তখন গান গাওয়ার পুরোটা সময় ভোরের দিকে তাকিয়ে ছিলো৷ তখন দুজনের মধ্যে ছিলো এক মিষ্টি অনুভূতি। ছিলো দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসার বন্ধন। কিন্তু সেগুলো যে অতীত। ভোর মনে মনে তীব্র ভাবে চাইলো, আবদ্ধ গান যেনো না গায়। সে চায়না আর সেই পুরোনো অনুভূতিগুলো জাগাতে। কিন্তু তার মনের কথায় কি আর সব হবে। উহু! কখোনো হবে না।

চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে