#এই মন তোমাকে দিলাম (তৃতীয় পর্ব)
#ঈপ্সিতা মিত্র
যাইহোক, সেদিন হিয়ার মনে অদ্ভুৎ একটা রাগ এসে জমা হয়েছিল। সেই রাগ নিয়েই সন্ধ্যেবেলা বসেছিল বইয়ের টেবিলে। এই সময় স্পন্দনের নাম্বার থেকে রিং হলো হঠাৎ ফোনে। কিন্তু হিয়া আজ নাম্বারটা দেখেও অদেখা করে দিল। লাইব্রেরীতে তো দেখেও চিনতে পারলো না ছেলেটা! তাহলে এখন হঠাৎ কল করছে কেন! কথা বলার দরকারই নেই হিয়ার সাথে। কথাগুলো ভেবেই বইয়ের পাতায় মন দিল। কিন্তু এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই চেনা গলার স্বর কানে এলো।
” কি রে, মোবাইলটা তো চোখের সামনে। তাহলে ফোনটা ধরছিলিস না কেন আমার?”
এই প্রশ্নে হিয়া ঘুরে তাকাতেই দেখে ওর ঘরের দরজায় স্বয়ং স্পন্দন দাঁড়িয়ে। কিন্তু এই মুহূর্তে হিয়া বেশ গম্ভীর মুখ করেই বললো,
——–” তুমি এখানে? কি দরকার হলো হঠাৎ! আজ ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরীতে যখন দেখা হলো, তখন তো দেখেও চিনলে না!”
কথাগুলো বেশ ক্ষেপেই বললো হিয়া। কিন্তু স্পন্দন এই কথায় মুচকি হেসে বললো,
——-” কেন? তুইই তো কদিন আগে বলেছিলিস আমাকে, যে ক্যাম্পাসে তোর সাথে দেখা হলে যেন আমি তোকে না চিনি! তাহলে এখন রেগে যাচ্ছিস কেন?”
এই কথার ঠিক আর কোন উত্তর দিতে পারলো না হিয়া। আসলে রাগটা তো শুধু ওকে অদেখা করে চলে যাওয়ার জন্যই না! রাগটা ওই মেয়েটার সাথে অতো নিবিড় ভাবে কথা বলার জন্য। কথাগুলো ভেবেই হিয়া বললো,
—–” আচ্ছা, ওই মেয়েটা কে ছিল তোমার সঙ্গে? ও ই কি সুচেতা? তোমাদের ল্যাবে যে নতুন এসেছে।”
কথাটা শুনে স্পন্দন বেশ অবাক হয়েই বললো,
——-” বাবা! তুই চিনিস সুচেতা কে! ভীষণ স্কলার মেয়েটা। দিল্লী ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিল। এখন বাবার ট্রান্সফার হয়ে কলকাতায়। যাইহোক, আমি লাইব্রেরী থেকে তোর জন্য একটা বই তুলেছিলাম। বায়ো কেমিস্ট্রির পেপারে কাজে লাগবে তোর। সেটা দিতেই এসেছি।”
কথাগুলো বলেই স্পন্দন বইটা টেবিলে রাখলো। কিন্তু হিয়ার মুখটা কিরকম অন্ধকার হয়েছিল সেই সময়। তাই বেশি কিছু বললো না। তখনই খেয়াল করলো স্পন্দনের ফোনটা বেজে উঠেছে। স্পন্দন এই মুহূর্তে ওর সামনেই ফোনটা ধরে বললো,
——” হ্যাঁ সুচেতা, বলো। তোমাকে র-ফাইলস গুলো মেল করে দিয়েছি আমি। আর কিছু পিডিএফ ও মেল করেছি।”
কথাগুলো শেষ করেই ও হিয়াকে ঈশারায় হাত নাড়িয়ে ‘ আসছি ‘ বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, সুচেতার সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে। কিন্তু হিয়া কিরকম থমকে গেল যেন। সুচেতার ফোনটা কি আর কিছুক্ষণ বাদে ধরা যেত না! সারাদিন তো কাজ করে একসাথে। একটু সময়ের জন্যই তো এসেছিল স্পন্দন হিয়ার কাছে! তখনও ফোনটা ধরতেই হবে! না কি হিয়ার সাথে কথা বলাটা এখন আর অতটা ইম্পর্টেন্ট না স্পন্দনের কাছে। কথাগুলো ভেবে কেমন মনটা অন্ধকার হয়ে গেল ওর।
তবে এর কিছুদিন পরে হিয়ার মনে আরেকবার ধাক্কা লাগলো ভীষণ। সেদিন প্র্যাকটিকাল শেষ করে হিয়া ওই দুপুরের দিকে যাচ্ছিল ক্যান্টিনে। সাথে কৌশানী, রণিতাও ছিল। সেই সময়ে চোখে পড়লো করিডোর দিয়ে স্পন্দন আর সুচেতা বেশ হেসে হেসে গল্প করতে করতে এগিয়ে আসছে। দৃশ্যটা দেখেই হিয়ার মনটা কেমন থমকে গেল এই মুহূর্তে। তখনই কানে এলো রণিতা আর কৌশানীর কথা।
কৌশানী এই সময় কেমন নিজের মনেই বলে উঠলো,
—–” এই ল্যাবের নতুন মেয়েটা কি সারাক্ষণ স্পন্দনদার সাথে ঘোরে! লাইব্রেরীতে, ক্যান্টিনে, ল্যাবে, সব সময় তো এই মেয়েটার সাথেই দেখি আজকাল।”
এই কথায় রণিতা অল্প হেসে বললো,
——” আর স্পন্দনদাকে ঝাড়ি মেরে লাভ নেই কৌশানী! আমি তো সিওর এই সুচেতা বলে মেয়েটার সাথে কিছু চলছে স্পন্দনদার। ইউনিভার্সিটির অনেকের মুখেই তো শুনছি। ইভেন স্পন্দনদাদের ল্যাবের অনির্বাণদা, শুভ্রদা সবাই সেদিন ক্যান্টিনে সুচেতাদি আর স্পন্দনদাকে নিয়ে আলোচনা করছিল। ওরা না কি কাজের বাইরেও ঘুরছে একসাথে।”
কথাগুলো বেশ হাসি হাসি মুখে বললো রণিতা। কিন্তু এইসব শুনে কৌশানী ভীষণ অন্ধকার মুখেই বললো,
——” একটা মাত্র ক্রাশ ছিল আমার! সে ও ফস্কে গেল!”
কিন্তু এই কথাবার্তার মাঝে হিয়া কিরকম চুপ হয়ে গেল যেন সেইদিন। তার মানে কি স্পন্দনের জীবনের খালি জায়গাটা দখল করে ফেলেছে এই মেয়েটা! কথাটা আনমনে মনে হয়েছিল ওর।
<৫>
এই এলোমেলো ভাবনার ভিড়ে দুদিন পর হিয়া স্পন্দনদের বাড়ি গিয়েছিল, কিছু নোটস ফেরৎ দিতে। আসলে একই সাবজেক্ট বলে স্পন্দনের পুরনো বইপত্র, নোটস হিয়ার খুব কাজে লাগে। কিন্তু আজ স্পন্দনের ঘরের বাইরে থেকেই শুনতে পাচ্ছিল একটা মেয়েলি গলার আওয়াজ। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে যেতেই দেখলো স্পন্দনের ঘরে বসে আছে সুচেতা, ল্যাপটপ কোলে নিয়ে। কিন্তু হিয়ার এই মুহূর্তে সত্যি কিরকম অস্থির লাগছিল যেন। এই মেয়েটা এখন বাড়িতেও এসে হাজির হয়েছে! কথাটা ভাবতেই ও এবার বেশ গম্ভীর হয়ে দরজায় নক করেছিল স্পন্দনের। কিন্তু স্পন্দন এবার বই থেকে চোখ সরিয়ে দরজায় হিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়েই বলেছিল,
—–” তুই! তুই আবার কবে থেকে নক করে ঢুকছিস আমার ঘরে?”
এই কথায় সুচেতাও এবার আনমনে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখেছিল হিয়াকে। তারপর একটু চিন্তা করে বলেছিল,
——” ও আমাদের ইউনিভার্সিটির না? ওকে আমি ক্যাম্পাসে দেখেছি অনেকবার!”
সেই মুহূর্তে স্পন্দনের কিছু বলার আগেই হিয়া বেশ গম্ভীর মুখে বলে উঠেছিল,
—–” হ্যাঁ, এম.এস.সি, ফার্স্ট সেম..”
কথাটা শেষ করেই হিয়া স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,
——” এই যে তোমার নোটসগুলো। দিয়ে গেলাম।”
কথাটা বলেই হিয়া কাগজগুলো পড়ার টেবিলে রেখে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু তখনই স্পন্দন বলে উঠেছিল সঙ্গে সঙ্গে,
——-” এত তাড়া কিসের তোর? কোথায় যাচ্ছিস? একটু বোস।”
এই কথায় হিয়া কিরকম স্থির ভাবেই বলেছিল,
——” না, আমার মনে হয় তোমরা বিজি আছো। পরে কখনো আসবো।”
কথাটা বলেই হিয়া আর কোন প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বেরিয়ে গেছিল ঘরটা থেকে। কিন্তু সেই মুহূর্তে স্পন্দনের মনে যেন খটকা লেগেছিল একটু। হিয়াকে তো আগে কখনো এতটা গম্ভীর দেখেনি! কিছু কি হয়েছে মেয়েটার! তাই চলে গেল। কথাটা হঠাৎ মনে হয়েছিল ওর।
<৫>
কিন্তু হিয়ার সাথে এরপর আর কোন কথা বলার সময় পায়নি স্পন্দন কদিন। আসলে সামনেই একটা সেমিনার আছে মুম্বাইয়ে। ল্যাব থেকে সেই সেমিনারটা এটেন্ড করার জন্য সুচেতা আর স্পন্দন যাবে। সেই জন্য কদিন ধরে খুবই বিজি ছিল দুজন। প্রেজেন্টেশন রেডি করা, পোস্টার ডিজাইনিং হাজারো কাজ! তাই স্পন্দন প্রায় রাত আটটা নটা অব্দি ল্যাবে থাকতো কখনো কখনো সুচেতার সাথে। নইলে কখনো সুচেতার বাড়ি, তো কখনো স্পন্দনের বাড়ি এসে কাজ করতো দুজনে। হিয়ার তবে আজকাল ইউনিভার্সিটিতে ছড়ানো কথাগুলো সত্যি লাগে ভীষণ। স্পন্দন আর সুচেতা তো পারলে চব্বিশ ঘণ্টাই একসাথে থাকে! তাহলে কি সবার ধারণাটাই ঠিক! ওদের মধ্যে কাজ ছাড়াও অন্য কোন সম্পর্ক আছে! সেদিন সন্ধ্যেবেলা ঘরের জানলা দিয়ে যখন দেখেছিল স্পন্দনের সাথে একই ট্যাক্সি করে ওই চশমা পড়া মেয়েটাও নামলো স্পন্দনদের বাড়ির সামনে, তখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখটা আবছা হয়ে গেছিল হিয়ার। মনটা ভেঙে গেছিল যেন কাঁচের টুকরোর মতন। তাহলে সবার কথাটাই হয়তো সত্যি। নইলে ইউনিভার্সিটির বাইরেও সারাক্ষণ দুজন একসাথে কেন থাকবে!
আর আজকাল তো এই নতুন মানুষটার জন্য স্পন্দন ভুলেই গেছে পুরনো বন্ধুত্বকে। নইলে প্রায় আটদিন হয়ে গেল, স্পন্দন হিয়াকে একটাও মেসেজ করেনি। একবারও কথা বলেনি। আগে তো হিয়া ওর কাছে পড়তে না গেলে স্পন্দন নিজে হাজির হতো বাড়িতে, হিয়ার সাথে একটা দিনও না কথা বলে থাকতো না ছেলেটা! আর আজ সব বদলে গেল! কথাগুলো ভেবেই চোখটা ভিজে এসেছিল সেই মুহূর্তে। মনে হয়েছিল স্পন্দনের হয়তো আর ঠিক মনেই পরে না হিয়াকে!
তবে সেদিন রাতে হঠাৎ হিয়ার ফোনটা বেজে উঠেছিল। স্ক্রিনে সেই একজনের নাম্বার। হিয়া আজ একটু সময় নিয়েই ফোনটা ধরেছিল। তখনই উল্টো দিকের মানুষটা বলে উঠেছিল,
——-” কি রে, কি হয়েছে তোর? আমি নয় সেমিনারের কাজে বিজি বলে তোর সাথে দেখা করতে পারিনি! কিন্তু তুই একটা ফোন অব্দি করলি না যে! তুই কি কোন ব্যাপারে রেগে আছিস আমার ওপর?”
এই প্রশ্নে হিয়া একটু ধীর স্বরেই বললো,
—— ” না, রাগবো কেন! আসলে তুমি তো এখন ইউনিভার্সিটির পর বাড়িতে এসেও খুব বিজি! সুচেতাদি দেখছি আসছে মাঝে মাঝে। তাই আমি আর যাইনি।”
এই কথায় স্পন্দন কিছুটা ক্লান্ত স্বরেই বললো,
——–” সত্যি, কাজের চাপ ছিল রে খুব! আসলে কালই তো বম্বের ফ্লাইট। পরশু সেমিনারটা!”
এটা শুনে হিয়া অল্প অবাক হয়ে বলেছিল,
——-” তুমি বম্বে যাচ্ছো? ”
এই প্রশ্নে স্পন্দন সাথে সাথেই বলে উঠেছিল,
——-” আরে! কাজের চাপে তোকে বলা হয়নি। আমি আর সুচেতা ল্যাব থেকে যাচ্ছি বম্বে। ওখানে প্ল্যান্ট ফিজিওলজির ওপর একটা সেমিনার আছে। আমরা এটেন্ট করবো।”
এই কথায় হিয়া যেন আরো নিশ্চুপ হয়ে গেছিল আজ। স্পন্দন আর সুচেতা একসাথে যাবে বম্বে! এটা ভেবেই ভিতরটা ভাঙছিল কেমন। তবে সেই মুহূর্তে স্পন্দন হিয়ার এই নিঃস্তব্ধতার মাঝে বলেছিল,
——” তোর কি কিছু হয়েছে? এত চুপ কেন! অন্য বার আমি যখন সেমিনারে গেছি, তুই তো একটা লিস্ট ধরিয়ে দিতিস, যে তোর কি কি লাগবে সেই জায়গা থেকে। মনে আছে, আগের বছর যখন জার্মানি গেছিলাম, তোর জন্য কতগুলো চকলেট আনতে হয়েছিল আমাকে! আর, এইবার কিছু চাই না? ”
এই প্রশ্নে হিয়া বেশ অবাকই হলো হঠাৎ! তার মানে এত ব্যস্ততা, নতুন মানুষের ভিড়েও স্পন্দন ওকে নিয়ে ভাবে! কথাটা মনে হতেই ও বললো শান্ত গলায়,
——-” তুমি ভালো করে সেমিনার টা দাও। অল দ্যা বেস্ট.. আর কিছু চাই না আমার। ”
কথাটা বলেই হিয়া ফোনটা রেখে দিয়েছিল সেইদিন। আসলে কিছুই যেন বলার ছিল না ঠিক! অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছিল বুকে। মনে হচ্ছিল খুব নিজের কেউ ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে! অন্য একজন এসে হঠাৎ করে সবটা বদলে দিচ্ছে। আর হিয়ার চারিদিকটা খালি হয়ে আসছে। ভীষণ রকম শূন্যতা এসে ঘিরে ধরছে ওকে।
কিন্তু এই খারাপ লাগাটা আরো বেশি হলো এর পরের কদিন কিছু ছবি দেখে। আসলে স্পন্দন ফেসবুকে সেমিনারের বেশ কিছু ছবি পোস্ট করেছিল নিজে। আর সেই সমস্ত ছবিতে স্পন্দনের সাথে সুচেতাও ছিল। যদিও হিয়া প্রথমে দেখেনি এইসব। কিন্তু সেদিন ক্লাসে যেতেই রণিতা বলেছিল,
——-” দেখলি ফেসবুকটা একবার? বেচারা মেয়েগুলোর ক্রাশ স্পন্দন দা তো এনগেজড হয়ে গেল! কৌশানী তো সেই দুঃখেই আজ ইউনিভার্সিটি আসেনি।”
কথাটা শুনেই হিয়ার কেমন ধাক্কা লেগেছিল যেন। ও একটু গম্ভীর মুখেই বললো,
——” মানে! কি হয়েছে?”
এই প্রশ্নে রণিতা বেশ হাসি হাসি মুখেই ফোনটা খুলে ছবিগুলো দেখালো হিয়াকে। তারপর অল্প মজার ছলেই বললো,
——-” আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি এরা প্রেম করছে। নইলে আজ অব্দি স্পন্দনদা কোন মেয়ের সাথে নিজের ছবি দেয়নি! আর এই সুচেতার সাথে ছবিতে ছবিতে ভরিয়ে দিয়েছে ফেসবুক। সত্যি! ইউনিভার্সিটির কত মেয়ের মন ভেঙে গেল আজ!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো রণিতা। কিন্তু হিয়ার এই মুহূর্তে কিরকম সবটা এলোমেলো হয়ে গেল যেন! চোখ দুটো না চাইতেও ঝাপসা হয়ে এলো হঠাৎ। মনে হলো কিছু একটা ভাঙছে ভীষণ জোরে মনে; যেটা শুধু হিয়া বুঝতে পারছে। তাই কোন রকমে চোখের জলটাকে আড়াল করে হিয়া বললো,
——” আমি একটু আসছি রণিতা। লাইব্রেরীতে কাজ আছে আমার।”
কথাটা শেষ করেই ও বেরিয়ে এলো ক্লাস থেকে। তারপর কোন দিকে না তাকিয়ে বাইরে গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করলো জোরে। মনে হলো একাকীত্ব চাই ভীষণভাবে। সবার থেকে আলাদা হয়ে কিছুটা সময় চাই নিজের জন্য।
<৬>
যাইহোক, এরপর পাঁচ দিন বাদে স্পন্দন ফিরেছিল কলকাতা। তবে আজ দিনটা একটু স্পেশ্যাল ওর জন্য। আজ ফিফটিনথ সেপ্টেম্বর। স্পন্দনের জন্মদিন। হিয়া আজ মন খারাপের ভিড়েই স্পন্দনের কথা রেখেছিল। নিজে সকালবেলা পায়েস রান্না করে দিয়ে এসেছিল স্পন্দনের বাড়ি। কিন্তু তখনও পর্যন্ত ফেরেনি ছেলেটা এয়ারপোর্ট থেকে। তাই দেখাও হয়নি হিয়ার সাথে! তবে হিয়া ভেবেছিল স্পন্দন আজ আসবে ওর কাছে। প্রত্যেক বছরের মতন হিয়ার সাথে সেলিব্রেট করবে জন্মদিনটা। তাই সত্যিই আজ ভীষণ মন থেকে অপেক্ষা করছিল হিয়া স্পন্দনের। তবে ভাবনাটা ঠিক মেলেনি সেদিন ওর। সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলেও স্পন্দন আসেনি একবারও হিয়ার কাছে! এমনকি হিয়া তো সুন্দর একটা সালোয়ার পড়ে রেডিও হয়েছিল সন্ধ্যেবেলা। ভেবেছিল স্পন্দন হয়তো প্রত্যেকবারের মতন আজ এসে বলবে, —–” চল, ঘুরে আসি কোথাও থেকে! তোর ট্রিটটাও তো দিতে হবে! কি খাবি বল?”
কথাগুলো আজ খুব মনে পড়ছিল হিয়ার। আর এই ভাবনার ভীড়েই ও দাঁড়িয়েছিল ছাদে, একা। এখন ঘড়িতে রাত দশটা। না, আর কোন অপেক্ষা নেই হিয়ার, কারণ এতোক্ষণে ও বুঝে গেছে স্পন্দন আর আসবে না! বুঝে গেছে সবটা বদলে গেছে ছেলেটার। হিয়া আর কোথাও নেই স্পন্দনের জীবনে। পুরনো মুহূর্তগুলো, পুরনো সময় হয়তো শেষ! কথাগুলো ভেবেই চোখটা ভিজে আসছিল হিয়ার সেইদিন। তখনই অন্ধকারের মাঝে হঠাৎ স্পন্দনের গলার স্বর,
——–” তুই ছাদে একা একা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? রিয়ালি সরি রে, আমি একদম আসতে পারিনি সন্ধ্যে থেকে!”
কথাগুলো বলতে বলতেই স্পন্দন হিয়ার কাছে এসেছিল, আর খেয়াল করেছিল ওর কালো মেঘের মতন থমকে থাকা মুখটা। স্পন্দন এবার একটু এলোমেলো হয়েই বলেছিল,
——” তুই রেগে আছিস আমার ওপর? আসলে সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ করে ল্যাব থেকে সবাই এসে হাজির বাড়িতে। সুচেতা এই সারপ্রাইজটার প্ল্যান করেছিল! আমি তো কিছুই জানতাম না! সবাই একসাথে কেক নিয়ে এসে হাজির। সেই জন্য আসতে পারিনি তোর কাছে!”
কথাগুলো একসাথে বলেছিল স্পন্দন। কিন্তু হিয়া এই মুহূর্তে অল্প কথায়ই বলেছিল,
——-” না! আমি রাগবো কেন! যাইহোক, অনেক রাত হয়েছে। তুমি বাড়ি যাও।”
কথাগুলো বলেই হিয়া চলে যাচ্ছিল, কিন্তু তখনই স্পন্দন ওর হাতটা ধরে বলল,
——-” কোথায় যাচ্ছিস! আই নো, তুই রেগে আছিস। তুই তো সকালে পায়েসও করে এনেছিলিস! আমি খেয়েছি। খুব সুন্দর খেতে হয়েছিল। আমার জন্মদিনের বেস্ট গিফ্ট…”
এই কথায় হিয়া এই মুহূর্তে আর চুপ না থেকে অল্প হেসে বললো,
——-” কি যে বলছো! বেস্ট গিফ্ট তো বার্থ ডে কেকটা। যেটা সুচেতাদি এনেছিল তোমার জন্য, সন্ধ্যে বেলা।”
কথাটা শুনে স্পন্দন এবার বেশ অবাক হয়েই বললো, ——-” সুচেতার গিফ্ট! কি সব বলছিস! সুচেতা এখানে কোথা থেকে এলো?”
এই কথায় হিয়া আর নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে সোজাসুজিই বললো,
——-” কেন! সুচেতাদিই তো এখন সব জায়গায়। ইউনিভার্সিটিতে, বাড়িতে, ফেসবুকে। সব সময়ই তো তোমরা একসাথে! তাই ওর গিফ্টটাই তো তোমার কাছে স্পেশ্যাল হওয়ার কথা।”
চলবে,,