এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-০১

0
2971

#এই মন তোমাকে দিলাম (প্রথম পর্ব)
#ঈপ্সিতা মিত্র
<১>
মার্চের প্রথম সপ্তাহের আগমন হয়ে গেছে শহরে। চারিদিকে একটা মিষ্টি রোদ, আর বসন্তের হওয়া ছড়িয়ে। তার মাঝেই বি.ডি স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন প্রায় এক ঘন্টা ধরে। এমনিই বটানির মতন একটা ভজোকটো সাবজেক্ট। তার মধ্যে আবার ব্রায়োফাইটস এর চ্যাপ্টার। হিয়ার মাথার ওপর দিয়েই যাচ্ছিল সবটা। সত্যি! বাবার কথায় মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে ফেঁসে গেছে পুরো। এত এত পড়াশোনা কি ওর ধাতে সয়! এমনিই ছোট্ট একটা মাথা। তার মধ্যে প্ল্যান্ট ফিজিওলজি, ইকোলজি, বায়ো কেমিস্ট্রির মতন সাবজেক্ট মাথায় ঢোকাতে ঢোকাতেই জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে! এইসবই ভাবছিল আনমনে। তখনি অবশেষে বি. ডি স্যারের এক ঘণ্টার লেকচার সমাপ্ত হলো। আর হিয়া যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো! এরপর আধ ঘণ্টা বাদে আর একটা ক্লাস হলেই আজকের মতন মুক্তি এই ইউনিভার্সিটি থেকে। কথাটা ভেবেই ও রণিতা কে বলে উঠলো,
——-” এই, বাড়ি যাওয়ার আগে ফুচকা খাবি তো আজ? ইশ, অনিল কাকু কালকের ফুচকার আলুটা যা মেখেছিল না! এখনো মুখে লেগে আছে।”
কথাটা শুনে রণিতা একটু চিন্তা করে বললো,
——” ফুচকা! কিন্তু কত মোটা হয়ে যাচ্ছি রে! সূর্য কাল ই বলছিল, আমার একটু ডায়েট করা দরকার। নইলে দুদিন বাদে ডবল চিন থেকে ট্রিপল চিন হয়ে যাবে। ”
এই কথায় হিয়া বেশ ভ্রু কুঁচকেই বললো,
—— ” সেই। তুই ওর কথায়ই নাচ সারাক্ষণ! আর ও যে তোকে এইসব বলেছে, ও নিজে নিজের ভুঁড়ি টা আয়নায় দেখেছে কখনো! মনে তো হয় যা খায় সব গিয়ে ওই পেটেই জমা হয় ছেলেটার।”
কথাগুলো বেশ রেগেই বললো হিয়া। তবে সেই মুহূর্তেই হঠাৎ পিছনের বেঞ্চের সোমা, রিয়া, কৌশানীর গলার আওয়াজ কানে এলো ওর। বেশ উত্তেজিত হয়েই বলছিল ওরা,
——” করিডোর দিয়ে কে যাচ্ছে দ্যাখ! আজ আবার নীল শার্ট পড়েছে স্পন্দনদা। চোখ সরানো যাচ্ছে না যে!”
ওদের কথা শুনে ক্লাসের আরোও পাঁচ ছজন মেয়ের চোখ চলে গেল করিডোরে। তার মধ্যে সুলগ্না তো বলেই উঠলো,
——” সত্যি রে, এরকম হ্যান্ডসম ছেলে দেখলেও চোখ স্বার্থক। যদি একবার একে পটাতে পারতাম! পুরো ইউনিভার্সিটির ক্রাশ যাকে বলে!”
কথাটা কিরকম গোলে জল হয়ে বললো ও। কিন্তু হিয়ার এই মুহূর্তে সবার রিয়্যাকশন দেখে, কথা শুনে পা থেকে মাথা অব্দি জ্বলে গেল যেন! আর ও ওই জ্বলন্ত চোখ নিয়েই জানলার দিকে তাকিয়ে দেখলো সেই রিমলেস চশমার শান্ত মিষ্টি মুখের ছেলেটা নিজের মনে করিডোর থেকে হেঁটে যাচ্ছে ল্যাবের দিকে। সে যদিও জানে না যে এই নীল শার্ট, ইন্ট্রোভার্ট পার্সোনালিটি, স্টুডিয়াস নেচারের জন্য কত ফ্যান ওর ইউনিভার্সিটিতে! তার ওপরে ইউনিভার্সিটির ফেস্টে গান গেয়ে তো এমনিই ভীষণ পপুলার। কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে, হিয়ার দিন রাত সবার মুখে এই স্পন্দন নামটা শুনে শুনে ক্লান্ত। মানে সত্যি! এরা আর কাউকে পেল না! শেষে এই একটা ছেলের ওপরই সবার নজর! যাকে কি না তুলি সেই ছোট্টবেলা থেকে মনের মধ্যে জায়গা দিয়ে বসে আছে। যার কথা ভেবেই সেই স্কুল লাইফ থেকে কত প্রেমের কবিতা লিখেছে! কত সিনেমার গান ভেবেছে। সেই একটা ছেলেকেই হতে হলো ইউনিভার্সিটির সার্বজনীন ক্রাশ! কথাগুলো ভেবেই কেমন মুখটা অন্ধকার হয়ে এলো ওর। ফুচকা খাওয়ার ইচ্ছেটাও মন থেকে চলে গেল কেমন।
<২>
আসলে স্পন্দনকে হিয়া যখন প্রথম দেখেছিল, তখন হিয়ার ক্লাস নাইন। স্পন্দনরা নতুন বাড়ি কিনে এসেছিল ওদের পাড়ায়। সেই সময় দুর্গা পুজো ছিল। স্পন্দন সেইবার অষ্টমীতে ভিড়ের মধ্যে হিয়ার ঠিক পাশটায় দাঁড়িয়েই অঞ্জলী দিয়েছিল গোলাপি রঙের একটা পাঞ্জাবি পড়ে। আজও মনে আছে সেই দিনটা। যখন অঞ্জলীর মন্ত্রচ্চারণ এর মাঝে ও প্রথম দেখেছিল ছেলেটাকে! সেদিন কিছু না ভেবেই হিয়া নিজে থেকে আলাপ জমিয়েছিল স্পন্দনের সাথে। অঞ্জলী শেষ হওয়ার পরই জিজ্ঞেস করেছিল,
——” তোমরা কি পাড়ায় নতুন? আগে কখনো দেখিনি তো!”
এই প্রশ্নে স্পন্দন বলেছিল,
——” হ্যাঁ, এক সপ্তাহ হলো এসেছি। কিন্তু আমি তোমাকে চিনি। মানে দেখেছি।”
এই কথায় হিয়া একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করেছিল,
——-” আমাকে! কোথায় দেখেছো? ”
প্রশ্নটা শুনে স্পন্দন অল্প হেসে বলেছিল,
—— ” চারদিন আগে স্কুল থেকে ফেরার সময় তুমি আমাদের উল্টোদিকের দয়াল কাকুদের বাড়ির কলিং বেলটা জোরে বাজিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলে ইচ্ছে করে, সেই সময় আমি ব্যালকনিতে ছিলাম। দেখেছি তোমাকে।”
এই কথায় হিয়া একটু ঢোঁক গিললো নিজের মনে। আসলে এরকম দুষ্টুমি ও হামেশাই করে থাকে। পাড়ায় এর বাড়ি, ওর বাড়ি কলিং বেল টিপে কেটে পড়ে। কিন্তু এই প্রথম ওর এই দুষ্টুমির একটা আই উইটনেস আছে জেনে কেমন নার্ভাস লাগলো হঠাৎ! হিয়া তাই আর কথা না বাড়িয়ে বললো,
——-” আমি আসছি এখন। বাড়িতে মা জলখাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে।”
কথাটা বলেই ও এক ছুট দিয়েছিল সেদিন। তবে সন্ধ্যেবেলা মণ্ডপে আবার দেখা হয়েছিল স্পন্দনের সাথে। যদিও হিয়া আর নিজে থেকে কথা বলেনি। তবে এরপর স্পন্দন নিজে থেকে এসেই বলেছিল,
——-” আচ্ছা, একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি?”
হিয়া এটা শুনে একটু ইতঃস্তত হয়ে বলেছিল,
——-” হ্যাঁ, বলো। কি প্রশ্ন? ”
এই কথায় স্পন্দন সঙ্গে সঙ্গেই বলেছিল অল্প হেসে, ——- ” এরকম ভর দুপুরে লোকের বাড়ি কলিং বেল টিপে চলে যাওয়াটা কি তোমার হবি?”
হিয়া এই কথায় কি বলবে বুঝতে পারেনি। এলোমেলোভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো শুধু। একবার যদি পাড়ার অন্য কাউকে ছেলেটা এই কথাটা বলে দেয়, আর এটা গিয়ে মায়ের কানে পৌঁছয়, তাহলে কপালে শনি নাচছে। কিন্তু হিয়ার এই করুণ মুখটা দেখে স্পন্দন জোরে হেসে ফেলেছিল সেই মুহূর্তে। তারপর ওকে আশ্বস্ত করে বলেছিল, ——” ডোন্ট ওরি.. তোমার এই সিক্রেট এর ব্যাপারে কেউ জানবে না। আমি এমনি মজা করছিলাম। ফ্রেন্ডস?”
শেষ কথাটা স্পন্দন হিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে বলেছিল। এটা শুনে হিয়া আর না করেনি ওকে। হাসি মুখে নিজের হাতটা মিলিয়েছিল স্পন্দনের সঙ্গে।
তখন আবার স্পন্দন বলে উঠেছিল,
——” আমি কিন্তু তুই করে বলবো এরপর থেকে।কারণ তুমি তুমি টা আমার ঠিক আসে না ছোটদের সাথে।”
এই কথায় হিয়া চোখ দুটো বড় বড় করেই বলেছিল,
——” আমার ক্লাস নাইন। কে বললো আমি ছোট?”
কথাটায় স্পন্দন আলতো হেসে বলেছিল,
——” আমার কলেজের ফার্স্ট ইয়ার। তাই তুই এমনি যতই বড় হোস, আমার থেকে সারা জীবন ছোটই থাকবি।”
না, এই কথার আর কোন উত্তর দিতে পারেনি হিয়া। যাইহোক, সেইদিন থেকেই ছেলেটা ওর বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। তারপর জীবনের যত উল্টো পাল্টা কীর্তি ও স্পন্দনকে জানিয়েই করেছে। এই যেমন ওর অঙ্ক স্যারের সাইকেলের চাকা লিক করে দেয়া, হোলির দিন ছাদ থেকে লোকের গায়ে বেলুন ছোড়া, গেস্ট এলে তার জুতো লুকিয়ে রাখা, এইসব ছোট খাটো ঘটনা ঘটিয়ে ও স্পন্দনের কাছে এসেই সারেন্ডার করতো। তবে ওদের এই বন্ধুত্ব দেখে পাড়ার সবাই বেশ অবাক হয়েছিল প্রথমে। আসলে স্পন্দন পড়াশোনায় ভীষণ ভালো, শান্ত স্বভাবের, উচ্চ মাধ্যমিকে স্টার পাওয়া ছেলে! সে কি করে পাড়ার সব থেকে দুষ্টু মেয়েটার বন্ধু হলো, এটা কেউ বুঝতো না ঠিক! তবে এরপর একদিন হিয়ার মা এসে স্পন্দন কে বলেছিল,
—– ” বাবা, তুমি সপ্তাহে একটা দিন হিয়া কে একটু অঙ্কটা দেখিয়ে দিতে পারবে? ওর অঙ্কের টিচার তো আর ধৈর্য দেখাতে পারলো না! ছেড়ে দিল হঠাৎ। তাই তুমি যদি একটু সপ্তাহে একটা ঘন্টা দেখাও, খুব হেল্প হবে ওর। আর তোমরা তো খুব ভালো বন্ধুও!”
কথাটায় স্পন্দন হ্যাঁ বলে দিয়েছিল সেইদিন। তারপর হিয়া প্রত্যেক সপ্তাহে বই খাতা নিয়ে হাজির হতো স্পন্দনদের বাড়ি। যদিও প্রথম প্রথম পড়ায় মন থাকতো না বিশেষ! কখনো অঙ্ক করতে করতে মাঝ পথে থেমে গিয়ে হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা, তো কখনো পেট ব্যাথা করছে বলে বইপত্র বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা। সবই করেছে হিয়া। তবে স্পন্দন ধৈর্য্য না হারিয়ে বুঝিয়ে বুঝিয়ে ঠিক অঙ্কগুলো করাতো ওকে। আর সেই জন্যই সেইবার মাধ্যমিকে হিয়া সবাইকে অবাক করে লেটার পেয়েছিল অঙ্কে। যদিও রেজাল্টটা দেখে ওর নিজের চোখেই বিশ্বাস হয়নি সেদিন! তবে স্কুল থেকে ফিরেই হিয়া আর অপেক্ষা করেনি। সোজা গেছিল স্পন্দনের বাড়ি। সেই সময় ছেলেটা সবে কলেজ থেকে ফিরেছে। তবে হিয়ার রেজাল্ট দেখে ওর সারাদিনের ক্লান্তি এক সেকেন্ডে দূর হয়ে গেছিল কেমন! অঙ্কে বিরাশি। এই নাম্বারটা দেখেই ও আনন্দে জরিয়ে ধরেছিল হিয়া কে। আর সেই প্রথম স্পন্দনের স্পর্শে হিয়া কেমন স্থির হয়ে গেছিল হঠাৎ! এই ছেলেটার হাসি মুখ, আলতো ছোঁয়া যেন কিছু একটা বদলে দিয়েছিল হিয়ার মধ্যে। একটা অন্য রকম ভালো লাগা এসে জড়ো হয়েছিল মনে। যেরকম এর আগে কখনো ফিল হয়নি! এরপর শুধু মাত্র স্পন্দনের জন্যই হিয়া উচ্চ মাধ্যমিকে সাইন্স নিয়ে পড়েছিল। যাতে আগের মতন প্রত্যেক সপ্তাহে অঙ্ক নিয়ে এই ছেলেটার কাছে হাজির হতে পারে। এরপর দিন যত এগিয়েছে, হিয়ার মনে স্পন্দনের জন্য ফিলিংস গুলো একটু একটু করে বেড়েছে রোজ। সে দোলের দিন আবির খেলা হোক, কি দুর্গা পুজোয় একসাথে ঠাকুর দেখা, বছরের এই স্পেশ্যাল স্পেশ্যাল দিনগুলোতে হিয়া মনে মনে স্পন্দনের সাথেই থাকতে চেয়েছে। ওর জন্যই প্রত্যেক ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে একটা করে গোপাল কিনে নিজের ডায়রির ভিতর যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে। এমনকি স্পন্দনের কাছে পড়বে বলে ওর সাবজেক্ট বোটানি নিয়েই ভর্তি হয়েছিল অনার্সে। যদিও সাবজেক্টটার প্রতি খুব বেশি ভালোবাসা ছিল না হিয়ার। তাও ওই একজনের জন্যই পড়াশোনা করে ফার্স্ট ক্লাসটা পেয়েছিল বি.এস.সি তে। তারপর বাবার কথায় ভর্তি হয়েছিল মাস্টার্সে। তবে ওই ইউনিভার্সিটিতেই তো স্পন্দন রিসার্চ স্কলার। তাই মাস্টার্সের পড়াশোনার চাপটাও হাসি মুখে মেনে নিয়েছিল হিয়া। কিন্তু এইসবের পর যখন জানলো স্পন্দনের ইউনিভার্সিটিতে কি লেভেলের ফ্যান ফলোয়িং; কত মেয়ের ক্রাশ ওই একটা ছেলে! তখন হিয়ার মনের ফিলিং গুলো টুকরো টুকরো হয়েছিল বৈ কি। রাগে ভিতরটা জ্বলেও গিয়েছিল ভীষণভাবে। মনে হয়েছিল দৌড়ে গিয়ে স্পন্দনকে জড়িয়ে ধরে বলে দিক নিজের এতদিনের জমানো ভালোবাসা। কিন্তু, সেটা তো সম্ভব না। কিছু কথা মনে থাকলেও মুখে আসে না নিজে থেকে। তাই চুপ করে দিনগুলো পার করছিল হিয়া। তবে এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটলো।

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে