#আলো_আঁধার
পর্ব ঃ- ১১
~আঁখি দেব তৃপ্তি
“বলে ফেলতে পারেন সমস্যা নেই।”
“না অন্যদিন বলবো।”
“আচ্ছা, যেমন আপনার ইচ্ছে। ”
“হুম। আচ্ছা আগে এটা বলেন নাম টা এমন কেন?”
“এমন কেন তা কী আমাকে দেখে বুঝতে পারছেন না।”
“আসলে ঠিক মিলাতে পারছি না।”
“হুম বুঝেছি। আসলে আমার জন্মের আগেই বাবা মা নাম রেখে ফেলেছিলেন আলো কিন্তু পরে দেখা গেলো আমি তাদের জীবনে অন্ধকার হয়ে নেমে এসেছি। তাই আমি নিজের নাম এমন লিখি এখন যাতে তা আমার স্ট্রাগল করা অতীত ভুলতে না দেয়।”
“গায়ের রং কালো হলে কী কেউ অন্ধকার হয়ে যায়!”
“আমার মাকে দেখলে আপনি অবাক হবেন। দুধে-আলতা গায়ের রং। বাবাও শুনেছি দেখতে সুন্দর। তাদের ঘরে আমার এমন রুপ তারা ঠিক মেনে নিতে পারেন নি।”
“শুনেছেন মানে? আপনার বাবা নেই?”
“আছেন।”
“তাহলে শুনেছেন বলছেন কেন?”
“আসলে আমি উনাকে কখনো দেখি নি।”
“মানে? বুঝলাম না!”
“না বুঝারই কথা। আচ্ছা আমায় উঠতে হবে। ”
“এভাবে কনফিউশনে রেখে চলে যাবেন?”
“অপরিচিত কাউকে কী একদিনে সব বলা যায়? কিছুটা কনফিউশনে থাকা ভালো। ”
“তাহলে আবার কবে দেখা হচ্ছে? ”
“দেখা হওয়াটা কী খুব জরুরি? ”
“হুম, সব প্রশ্নের উত্তর জানতে ইচ্ছে আছে তো।”
“আমি বলে কয়ে প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে দেখা করি না। যদি কখনো চলার পথে দেখা হয় বলা যায় কিনা ভেবে দেখবো। আসি।”- বলে আলো উঠে চলে যেতে শুরু করলো।
” আরে এ কেমন কথা? ফোন নাম্বারটা তো দিয়ে যান।”
আলো আর ফিরে তাকালো না। চলে গেলো সামনের দিকে।
সন্ধ্যার পর প্রতিদিনের মতো আড্ডায় বসেছে ঈশান, নিলয় ও শ্রাবণ। ওদের আড্ডা দেওয়ার ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। প্রায়সময়ই ঈশান ও শ্রাবণ যখন কোনো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলে নিলয় তখন মোবাইলে কোনো বইয়ের পিডিএফ খুলে বসে থাকে। এর জন্য পরে ওকে ওদের চড়-থাপ্পরও খেতে হয় কিন্তু সে কোনোদিন মজা করেও কারো গায়ে হাত তুলতে পারে না।
“কীরে শ্রাবণ আজ তোকে অন্যমনস্ক লাগছে? “-ঈশান।
” কই না তো?”-শ্রাবণ।
“আমি কী বুঝতে পারি না? বল কী হয়েছে? ”
“না তেমন কিছু না একটা ফটোগ্রাফির কম্পিটিশন নিয়ে ভাবনায় আছি। ”
“ও, বড়সর কোনো প্রাইজ আছে নাকি? ”
“হুম, দার্জিলিং ট্যুর প্যাকেজ। ”
“ওয়াও।”
“হুম, এটা আমার স্বপ্নের ট্যুর জানিসইতো।”
“আমি তো বলেছিলাম তোকে নেক্সট ইয়ার যখন আমি যাব ইন্ডিয়া তখন তোকে নিয়ে যাব।”
“সেই সাধ্য কী আর আমার আছে”
“খরচ নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না। আমি আছি তো।”
“তুই আর এভাবে কতো করবি বল। এসব নিজের কাছেও কীরকম একটা লাগে অনেক সময়। ”
“এখানে কীরকম লাগার কী আছে তুই আমার বন্ধু না?”
“তাও ইশান। আমি নিজের চেষ্টায় যেতে চাই।”
“হুম, চেষ্টা করে যা আমার বিশ্বাস তুই পারবি।”
“হুম, দেখি”
“কম্পিটিশনের লাস্ট ডেট কবে?”
“এই মাস এর ৩০ তারিখ পর্যন্ত। ”
“ও তাহলে তো ১৫ দিন আছে হাতে। ছবি তোলায় লেগে পর ভালোভাবে।”
“হুম, কম্পিটিশনটা নিয়ে আমার অনেক আশা তৈরি হয়ে গেছে এরমধ্যেই। ”
“হুম, চিন্তা করিস না তুই ঠিক পারবি।”
“কীসের কম্পিটিশন? “- বলে উঠালো নিলয়। নিলয় ঈশান ও শ্রাবণের মাঝখানে বসে ছিল তাও সে কিছুই শুনেনি। ঈশান ও শ্রাবণ রাগী চোখে ওর দিকে তাকালো। ওদের তাকানো দেখে ভীত গলায় নিলয় বললো- ” সরি দুস্ত আমি আসলে…. ”
“একদম চুপ থাক তুই নয়তো…..”- ঈশান।
একথা শুনে চুপ হয়ে গেল নিলয়। নিজের ফোন প্যাকেটে রাখলো। কিন্তু তারপরই ওর ফোন বেজে উঠলো। ঈশান ও শ্রাবণের দিকে একবার তাকিয়ে ফোন আবার বের করলো নিলয়। দিয়া ফোন করেছে।রিসিভ করলো নিলয়।
” হ্যালো দিয়া বল। ”
“কোথায় তুই এখন?”
“এইতো আমি ঈশান ও শ্রাবণ আড্ডা দিচ্ছি। ”
“ও, আমার এখন ফুসকা খেতে ইচ্ছে করছে বাসায় নিয়ে আয়।”
“এখন? এতো রাতে! ”
“এতো রাত কোথায় রে মাত্র সন্ধ্যা শেষ হলো। ”
“তাও তোদের বাসা অনেক ভেতরে আর তোদের মালিকের ওই কুকুরটা খুবই ভয়ংকর। ”
“তুই এতো ভীতু কেন রে? আমি যদি প্রমিকে এখন বলি ফুসকা নিয়ে আসতে ও কোনো কথা না বলে নিয়ে আসবে আর তুই…! ”
“আচ্ছা, প্রমিকে এখন বলতে হবে না আমি দেখছি। ”
“হুম, তাড়াতাড়ি আসিস আর ফুসকায় যাতে ঝাল বেশি হয়। ”
“আচ্ছা।”
“দিয়া কী বললো রে নিলয়”- ঈশান।
” ও নাকি এখন ফুসকা খাবে। আমাকে নিয়ে দিতে বলেছে।”
“ভালো যা নিয়ে যা।”
“তোর বাইক দিয়ে দিয়ে আসি চল ঈশান।”
“আমি কেন যাব? আমার অন্য কাজ আছে তুই যা।”
“তাহলে শ্রাবণ দুস্ত চল না আমার সাথে। ”
“না আমারও কাজ আছে। তুই যা।”- শ্রাবণ।
” আমি একা কীকরে যাব?”
“কেন ভয় পাচ্ছিস নাকি? ”
“না ঠিক ভয় নয় তাও অতোটা জায়গা।”
“যেতে পারলে যা নয়তো দিয়াকে বলে দে যে তুই ভয় পাস হাহাহা।”
“একদম হাসবি না তোরা বলছি। আমি কো তোদের সাথে যাই না?”
“গিয়ে উদ্ধার করো হুহ। যা তো দেখি তোর সাহস। ”
“আচ্ছা যাচ্ছি লাগবে না আমার কাউকে সাথে।”- বলে নিলয় চলে গেল। ঈশান ও শ্রাবণ ওর কান্ডকারখানা দেখে হাসিতে মেতে উঠলো।
” মা রাতে কী রান্না হবে?”- আলো।
“ছোট মাছ আর ডাল।”- আলোর মা।
” আর কিছু নেই?”
“তুই কিছু খেতে চাইলে বল।”
“না থাক লাগবে না।”
“এক্সিবিশনের খবর কী রে আলো?”
“ভালোই। আমার আঁকা পেইন্টিং সবার মন জয় করে এগুচ্ছে দেখি কতোটা সামনে যেতে পারি।”
“আমার বিশ্বাস তুই জিতবি।”
“আগে আগে কিছু বলো না তো মা।”
“আচ্ছা শোন তোকে কিছু কথা বলার ছিল।”
“বলো।”
“পাশের বাসার তোর সিমা আন্টি তোর জন্য আবার একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। ছেলে নাকি ভালো ব্যবসায়ী। ”
“মা তোমার কী আর কোনো কাজ নেই কতোবার বলেছি আমি বিয়ে করবো না।”
“এমন করে কেন বলিস মা? আমার চিন্তা আরও বেড়ে যায়।”
“বিয়ে করে তুমি কী পেয়েছো মা? একটা কালো মেয়ে জন্ম দেওয়ার জন্য তোমার সবকিছু চলে গেল এটাই কী বিয়ে আর সংসার? তাহলে আমি এই সমাজে বিয়ে করে কীভাবে সুখী হবো মা? কে দিবে আমাকে ভালবাসা আর সম্মান?”
“সবাই তো আর সমান নারে মা।”
“এতো ধাক্কা খেয়েও তোমার হুস হলো না মা? তাও বলছো সবাই সমান না? হাতে গোনা ২/৩ জন ছাড়া কাউকে পেয়েছো কখনো তোমার পাশে? দেখেছো আমাকে কেউ সিমপ্যাথী না দেখিয়ে ভালবেসে কিছু সময়, খুশি দিতে?”
“বুঝার চেষ্টা কর মা।”
“আমি বুঝি মা। আমাকে কিছু সময় দাও আমি ঠিক প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেখাবো। তখন আর আমার খাওয়া পড়ার জন্য তোমাকে এতো ভাবতে হবে না। ”
“এভাবে কেন বলছিস?”
“তাহলে আর কীভাবে বলবো? বার বার বলার পরেও তোমার এক কথা।”
“আচ্ছা যা, তোর যেমন ইচ্ছে থাক। আমি আর বলবো না বিয়ের কথা।”
“সেই ভালো।”
তনিমা গ্রাম থেকে আলোকে নিয়ে শহরে আসার পর তার আগের এক বান্ধবীর সহায়তায় একটি কেজি স্কুলে চাকরি নেয়। তারপর আলোকে নিয়ে ছোট্ট একটি বাসায় কোনকরকম কষ্ট করে দিন কাটায়। আলো কলেজে উঠার পর সেও ১/২ টা টিউশনি করে নিজের হাতখরচ নিজেই চালাতে শুরু করেছিল। মেয়েটা জীবনের প্রতি ধাপে কষ্ট করতে করতে এসেছে আজ পর্যন্ত তাই তার স্বপ্ন অনেক বড় হওয়ার। কিন্তু তনিমার শরীর আজকাল ভালো যাচ্ছে না। প্রায়ই রক্তবমি হয়। আলোকে যদিও এসব ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি তাও অনেক চিন্তায় থাকে আলোর মা। এর জন্যই মেয়ের বিয়ে দিতে চাওয়া। যদি ভালোমন্দ কিছু ঘটে যায় তাহলে পরে আলোকে কে দেখবে এই চিন্তায় আজকাল ঘুমও ঠিকমতো হয়না তনিমার।