#আমার_শহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১১
আমি গাড়ির সামনের দরজা খুলতেই ঝুমা এসে বলল “ভাবি আমি সামনে বসি?” আমি কোন কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে তাকে বসতে বলে নিজে পিছনে গিয়ে বসলাম। গাড়ি চলছে আমি পিছনে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি বাইরে।জারিফ সামনে মিররে আমার দিকে একবার তাকিয়ে গাড়ি চালাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। জারিফের চাহুনি তে আজ রাগ ছিল। যা আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কেন? আমরা অবশেষে পৌঁছে গেলাম। সব কাজ শেষ করে জারিফ ঝুমাকে বলল “কিছু খাবি?” “আইস্ক্রিম খাবো” ঝুমা বলে উঠলো। আমরা গাড়িতে উঠে একটা আইস্ক্রিম পার্লারে গিয়ে নামলাম। জারিফ ওয়েটার কে ঝুমার পছন্দের আইস্ক্রিম দিতে বলল। ঝুমা আমাকে জিজ্ঞেস করলো “ভাবি তুমি কোন আইস্ক্রিম খাও?” আমি ঝুমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললাম “আমি আইস্ক্রিম খাইনা।” আমার কথা শুনে জারিফ আমার জন্য কফি দিতে বলল। আমি চুপ করে কফি খাচ্ছি আর ঝুমা কে দেখছি। সে খুব মজা করে আইস্ক্রিম খাচ্ছে।খাওয়া শেষ করে আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। আমি পিছনে বসে সামনে জারিফ কে দেখছিলাম। কিন্তু সে আমার দিকে একবারও তাকালনা।
খাবার টেবিলে বসতে যাব তখনি ঝুমা এসে জারিফের পাশে বসে পড়লো। আমি দাড়িয়ে দেখলাম। কোন কথা না বলে রত্না খালার পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। ঝুমা বলল “ভাইয়া তুমি আমাকে ছোট বেলায় খাইয়ে দিতেনা। এখন দাও।আমার হাত ব্যাথা করছে।” জারিফ একবার আমার দিকে তাকিয়ে ওর প্লেট টা সামনে নিয়ে ওকে খাইয়ে দিতে লাগলো। আমি এক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি।বুকের মাঝে এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। না পারছি বলতে না পারছি সহ্য করতে।খুব কষ্ট হচ্ছে। এসবের মাঝে জারিফের এমন আচরণটাও আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে ঘরে গেলাম। দরজায় দাড়িয়ে দেখছি জারিফ আর ঝুমা কি যেন গল্প করছে আর হাসছে। আমি একটু সময় দাড়িয়ে তাদের গল্প শুনলাম। সেই ছোটবেলার গল্প। তারা দুজন গল্পে এতোটাই ব্যস্ত যে আমার ঘরে আসার কথা কেউ জানেনা। আমি একটু শব্দ করতেই দুজনে আমার দিকে ঘুরে তাকায়। আমি কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে যাই। বাইরে বসে টিভি দেখছি। এমন সময় ঝুমা এলো। “ভাবি কি করছ?” আমাকে জিজ্ঞেস করলো। আমি তার দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত ভাবে উত্তর দিলাম “কিছুনা।বস”। বলেই ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম জারিফ কোথাও যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিচে নামছে। কিন্তু ছুটির দিন তো সে সাধারনত বাইরে যায়না। আমি উঠে তার কাছে দাড়াতেই আমার দিকে একবার তাকাল। “কোথাও যাচ্ছেন?” “কাজ আছে।” আমার দিকে না তাকিয়ে হাতা ফোল্ড করতে করতে বলল। আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আমি পিছনে ঘুরে তার যাওয়া দেখলাম।
চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। হালকা একটু খানি আলো। সেই আলোয় আমার মুখটা দেখা যাচ্ছে। সাথে আমার চোখের পানিও। হ্যা আমি কাদছি। জারিফের এই অবহেলা আমার আর সহ্য হচ্ছেনা। আমি আর পারছিনা এই সব মেনে নিতে। আমি না বুঝে জারিফ কে যে কষ্ট দিয়েছি তার কিছুটা হলেও আজ পাচ্ছি। কিন্তু সেই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। আমার বুকের ভিতরে অদ্ভুত রকমের এক ঝড় চলছে। সেই ঝড় এক মাত্র জারিফ থামাতে পারে। কিন্তু সে তো আমার সাথে কথাই বলছেনা। কিন্তু কেন?
“ফারিয়ার ক্লাস কবে থেকে শুরু?” বাবা খেতে খেতে কথাটা আমাকে বলল।“জানিনা বাবা। ফারিয়া বলতে পারবে।” আমি নিচে তাকিয়ে বললাম।“আমি সব কথা বলে দিয়েছি। আমার পরিচিত। ওখানে ফারিয়ার কোন সমস্যা হবেনা।আমি সব ব্যাবস্থা করে ফারিয়া কে বলতেই সে রাজি হয়ে গেলো।” বাবার কথা শুনে আমি খাবার হাতে নিয়ে ফারিয়ার দিকে তাকালাম। সে মাথা নিচে করে খাচ্ছে আর বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার মানে এটা ফারিয়ার ডিসিশন ছিলোনা।কিন্তু আমি না বুঝেই মেয়েটার সাথে খারাপ ব্যাবহার করেছি। তার মনটা ভীষণ খারাপ। তার কষ্টটা আমি উপলব্ধি করতে পারছি কারন মুখে কষ্টের ছাপ টা স্পষ্ট। সে আমার দিকে একবারও তাকালনা। আমি ঘরে গিয়ে দেখি ফারিয়া বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। আমি তার সামনে গিয়ে পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “মন খারাপ?” সে আমার কথায় একটু অবাক হল। আমি যে তার সামনে সেটা বিশ্বাস করতে পারছেনা মনে হয়। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি আর সে সামনে। মাথা নাড়িয়ে না বলল। “তাহলে এখানে দাড়িয়ে আছ যে?” আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম। সে কিছু না বলে চলে যেতে নিলে আমি তার হাত ধরে ফেলি। সে দাড়িয়ে যায়। আমি একটানে তাকে আমার কাছে নিয়ে আসি। তারপর তার হাত ছেড়ে কোমর ধরে তাকে আমার বুকের সাথে আটকে নেই। সে খুব জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে আমার বুকে। আমি তার কপালে আমার কপাল ঠেকিয়ে বলি “সরি জান। খুব কষ্ট পেয়েছ?” সে আর কিছু বলতে পারলনা। কেদে ফেলল। আমি তার মাথাটা আমার বুকে চেপে ধরি। সে পরম আবেশে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আজ আমাদের মাঝে বাধা সংকোচ লজ্জা কিছুই নেই। শুধু আছে ভালবাসা। আমি তাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে গেলাম। আজ সেও আমার ভালবাসার স্পর্শ পেতে চায়।
আমি আজ অনেক সকালে উঠেছি। সূর্য উঠা দেখব বলে। মাঝে মাঝে এমন সকালে সূর্য উঠতে দেখতে খুব ভালো লাগে। নিচে গিয়ে দেখি কেউ উঠেনি। আমি চা বানিয়ে নিয়ে উপরে গেলাম। বারান্দায় দাড়িয়ে ধোঁয়া উঠা গরম চায়ে চুমুক দিয়ে অপেক্ষা করছি সূর্যের জন্য। কিন্তু আজ খুব বেশি সময় নিচ্ছে সূর্যটা উঠতে। এমন সময় আমার পেটে কারও উষ্ণ হাতের স্পর্শ পেয়ে আমি চমকে উঠলাম। “রিলাক্স জান।” আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে জারিফ বলল। “আমি ছাড়া তোমাকে এভাবে কে ধরবে বল।“ বলেই আমার চুলে মুখ ডুবিয়ে দিলো। তারপর কানে আসতে আসতে বলল “এতো সকালে এখানে কি করছ?” “সূর্য উঠা দেখব।” আমি একটু হেসে উত্তর দিলাম। “মানে?” আমাকে ছেড়ে দিয়ে সামনে এসে বললেন। “মানে আবার কি? সূর্য উঠবে আর আমি সেটা দেখব।অপেক্ষা করছি।” উনি আমার কথা শুনে সামনের আকাশে তাকালেন। সূর্যটা সবে তার লাল আভা ছড়িয়েছে। আকাশে মেঘের মাঝে লাল সাদা মিলে অসাধারন এক রুপ নিয়েছে। উনি নিজের অজান্তেই বলে ফেললেন “অপূর্ব!” তারপর আমার দিকে ঘুরে বললেন “আমি আগে কখনো সূর্য উঠা এভাবে দেখিনি। সত্যি অনেক সুন্দর।” “জানেন আমি না মাঝে মাঝেই সূর্য উঠা দেখতাম। গ্রামের আকাশে সূর্যটা অন্য রকম লাগতো। সকাল সকাল মনটা ভীষণ ভালো হয়ে যেত।” “আর আমার শহরের সূর্য?” আমার দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলেন। “সেটার লালা আভা আমার জীবনে প্রেমের ছন্দ ছড়িয়ে দেয়।” আমি একটু হেসে বললাম। উনি আমার কাছে এসে তার দুই হাতে আমার দুই গাল ধরে পরম আদরে আমার ঠোঁটে চুমু দিলো। কিন্তু আমি আজ তাকে বাধা দিলাম না। তার ভালবাসার পরম ছোঁয়ায় আমিও আজ সায় দিলাম।
আজ ঝুমারা চলে যাবে। আমি রত্না খালার সাথে অনেক গল্প করলাম। তাদের এক্সজন্য কিছু উপহার এনেছি। খালা কে তার উপহার দিয়ে দিলাম। খালা খুব খুশি হয়েছে। কিন্তু ঝুমার বোধ হয় তেমন ভালো লাগেনি। মুখে কিছু না বললেও তার চেহারা দেখে বেশ বুঝতে পারছি। মুখটা ভার করে জারিফের সাথে কথা বলছে। সে যেতে চাচ্ছেনা। কিন্তু তার মায়ের কিছু কাজ থাকায় বাধ্য হচ্ছে যেতে। তার খুব মন খারাপ। আর আমার উপরে একটু বেশিই। আমার সাথে তেমন কোথাও বলছেনা। জারিফ তাদেরকে গাড়িতে করে ট্রেনে উঠিয়ে দিতে গেলো। কিন্তু ঝুমা খুব কাঁদছিল। আমি তার সামে গিয়ে বললাম “কাজ শেষ করে আবার চলে আসবে কেমন?” কিন্তু সে আমার কথার কোন উত্তর না দিয়েই জারিফ কে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। জারিফ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি খুব সহজ ভাবে বিষয়টা মেনে নিলাম। কারন আমি জানি জারিফ আমাকে ভালবাসে।
চলবে…