আমার ভীনদেশী এক তারা পর্ব-০৬

0
546

#আমার_ভীনদেশী_এক_তারা
#পর্ব৬
#Raiha_Zubair_Ripte

গালে হাত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হেলেন। তার সামনে রাগী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে অ্যাডেলা উইলসন। বারবার ঘনঘন শ্বাস ফেলছে অ্যাডেলা। তার শ্বাস ফেলার শব্দ জানান দিচ্ছে সে কি পরিমানে জেগে আছে। হেলেনের দিকে দু কদম এগিয়ে বলে,,

” তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হই। তুমি হ্যাভেনের মৃ’ত্যু কামনা করছো। আর আমি কখন তোমার মাথা খেয়েছি পিটার কে বিয়ে করার জন্য। যেখানে আমি তোমাকে হ্যাভেনের স্ত্রী হিসেবেই মানি নি সেখানে ভাবলে কি করে আমি পিটারের পাশে তোমাকে মানবো। তোমাকে ইচ্ছে করছে জা’নে মে’রে ফেলতে। তোমার কি মনে হয় পিটার জানে না। পিটার কে আগে থেকেই সাবধান করে দিয়েছিলাম। তোমার চালচলন দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম আমার ছোট ছেলেকে রেখে এখন আমার বড় ছেলেকে ফাঁসাবে।

হেলেন ভয়ে এক ঢোক গিলে। এই মহিলাকে দিয়ে তার ভরসা নেই। সত্যি সত্যি মে’রে ফেলতেও দু বার ভাববে না। মহিলা টা তো বাসায় ছিলো না। আসলো কখন তাহলে? এই তো একটা সুযোগ ছিলো পিটারের কাছে এই মহিলার ব্যাপারে এসব বলে কান ভাঙানোর। সব প্ল্যান ভেস্তে দিলো মহিলা টা। হেলেন কিছু একটা ভেবে অ্যাডেলার পা ধরে কান্নারত কন্ঠে বলে,,

” মা ভুল হয়ে গেছে কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলছি মাথার ঠিক ছিলো না। আমায় মাফ করে দিন। এই ভুল আর হবে না।

অ্যাডেলা হেলেনের থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে নেয়। হুংকার দিয়ে বলে,,

” তুমি কেবল মাত্র এই বাড়িতে আছো অ্যাঞ্জেলেকার জন্য। ও আমার হ্যাভেনের সন্তান বলে তোমায় এবার ছেড়ে দিচ্ছি। দ্বিতীয় বার কিন্তু ছেড়ে দিবো না। আর তোমার লজ্জা হওয়া উচিত ছিলো আমার ছেলেটা কোমায় পড়ে আছে তার সেবা যত্ন না করে তুমি এখন আমার বড় ছেলের পেছন পড়ে আছো। ছোটলোক দের বিয়ে করলে তো এমন ই হবে। ক্যারেক্টারলেস মেয়ে একট।

কথাটা বলে বেরিয়ে যায় অ্যাডেলা। হেলেন বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রাগে তার সারা শরীর জ্বলছে। এই মহিলা উঠতে বসতে ছোটলোক বলে খোঁটা দেয়। শুধু সম্পত্তির জন্যই এখনো পড়ে আছি এই বাড়িতে তা না হলে কবেই চলে যেতাম এই বাড়ি ছেড়ে। পিটার টাও এক নারীতে আসক্ত শুদ্ধ পুরুষ। বেটাকে কিছুতেই নিজের বাগে আনতে পারলো না। কবে এই হ্যাভেন কোমা থেকে সুস্থ হবে আর নিজেদের সম্পত্তির ভাগ নিতে পারবে।

পিটার ছাঁদে এসে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে পিটার নিজেই অবাক হয় মানুষ কি করে পারে ভালোবাসার মানুষটার বিপদে তার পাশে না থেকে উল্টো নিজের সুখের সন্ধান অন্যত্র খুঁজতে। আকাশের দিকে তাকিয়ে কালো মেঘের সাথে থাকা চাঁদ টার উদ্দেশ্যে বলে,,,

” আচ্ছা চাঁদ কিভাবে পারে তারা ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে অন্যত্র সুখ খুঁজতে। আমি তো পারি নি এনা ব্যাতিত অন্য কারো কাছে নিজের সুখ খুঁজতে। হ্যাভেন আর হেলেন তো ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো তাহলে হেলেন কি করে বদলে গেলো। আজ হ্যাভেন কোমায় না থাকলে হয়তো হেলেন এমন বদলে যেতো না।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে এনা ফ্রেশ হয়ে পুরোপুরি রেডি হয়ে রুম থেকে বের হয়। সাতসকাল এনা কে রেডি হয়ে নিচে নামতে দেখে ফারাহ্ বেশ অবাক হয়। এনার দিকে এগিয়ে এসে বলে,,

” কি ব্যাপার ননদীনি সাতসকাল বেলা কোথায় যাওয়া হচ্ছে।

এনা হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে বলে,,

” ভাবি হেফজিবা এসেছে শশুর বাড়ি থেকে। তাি মিট করতে যাচ্ছি।

” তার জন্য এতো সকালে।

” শুধু কি হেফজিবা আসছে নাকি আমাদের পাবলো,অ্যানিয়াস,জ্যারেড,ক্লো, আনন্দ, আসছে।

” বাপ্রে সবাই তাহলে মিট করছো।

” হ্যাঁ ভাবি তুমি ও চলো তাহলে।

” না তোমার ভাই আসবে আজ। এসে আমায় বাসায় না দেখলে বাবু রাগ করবে।

এনা কিছু না বলে মুচকি হেসে বেড়িয়ে যায়।

বোর্ডেন্স পার্ক শহরতলী এলাকায় অবস্থিত। পার্ক টির সামনে দাঁড়িয়ে আছে এনা এখানল আরও একটি পার্ক যা ঠিক এডমন্টন সিটি এক্সিবিশন সেন্টারের সামনে অবস্থিত। পার্কের আরেক পাশে রয়েছে নর্থল্যান্ড ফার্ম যেখানে গ্রীষ্ম কালে বিভিন্ন ধরণের সবজির চাষ করা হয়। এই পার্কটি এত আহামরি কিছু নয় বা এখানে আহামরি কিছু দেখবার আছে। পার্কের ভিতরে নানা ধরণের ভাস্কর্য রয়েছে যার কারণে অন্যান্য পার্ক থেকে এটা একদমই আলাদা। পুরো পার্কটি সবুজের চাদরে ঢাকা, ভিতরে হাঁটার জন্য আলাদা ওয়াকওয়ে রয়েছে। শিশুদের জন্য আলাদা প্লে- গ্রাউন্ড রয়েছে। বনভোজনের জন্য অনেকগুলো শেড রয়েছে। মর্নিং বা ইভিনিং ওয়াক করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে বসার বেঞ্চের অভাব নেই। সপ্তাহশেষে কিংবা বিশেষ কোন দিনে এখানে ভিড় একটু বেশি থাকে। যেমন গত জুলাই ১ এ অনুষ্ঠিত কানাডা ডে তে এখানে ভিড় লক্ষ্যনীয় ছিল। এবং গত রোজার ঈদের দিনেও এখানে অনেক বাঙালী পরিবার এবং অনেক মুসলিম পরিবার এসেছিলেন সময় কাটাতে। এই পার্কে সারি সারি পাইন গাছ এবং ঝাউ গাছ লক্ষ্যনীয়। গ্রীষ্মকালে এই স্থানটি চিরসবুজ থাকলেও, শীতকালে তা হয়ে ওঠে চিরশুভ্র। শীতকালীন সময়ে এই পার্ক জনমানব শূন্য থাকে সবসময়।

এনা বারবার হাত ঘড়ি টার দিকে তাকিয়ে সময় দেখছে। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে এখানে কারো দেখা মিলে নি। সাইড ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে আনন্দের নাম্বারে ফোন করতেই আনন্দ ফোন কেটে দেয়। এনা বিরক্ত হয়,ফের আনন্দর নাম্বার রেখে হেফজিবার নাম্বারে ফোন করে। হেফজিবা ও ফোন কেটে দেয়। এবার এনার প্রচন্ড রাগ লাগছে। এতোক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছে তাদের আসার নাম গন্ধ নেই তার উপর ফোনটাও ধরছে না। হেফজিবার ফোনে ছোট করে একটা টেক্স দেয় সে চলে যাচ্ছে। মেসেজ টা সেন্ট করতে দেরি কিন্তু পেছন থেকে হুড়মুড়িয়ে পাবলো,অ্যানিয়াস,জ্যারেড,ক্লো, আনন্দর আসতে দেরি হয় নি। এনা হঠাৎ তাদের দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। সন্দিহান চোখে জিজ্ঞেস করে,,

” কি রে তোরা এখন কোথায় থেকে আসলি। ফোন দিয়েছিলাম ধরিস নি কেনো একটাও।

হেফজিবা এগিয়ে এসে এনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,,

” দোস্ত কতগুলো বছর পর তোকে জড়িয়ে ধরলাম। সব বিষাক্ত তিক্ততা যেনো উধাও হয়ে গেলো। আর আমরা কেবলই এসেছি তুই যখন ফোন দিলি তখন গাড়ি থেকে নামছিলাম তাই আর রিসিভ করি নি।

এনা হেফজিবা কি জড়িয়ে ধরলো। কতোগুলো বছর পর প্রানপ্রিয় বান্ধবী কে দেখতে পেলো। আনন্দ এনার থেকে হেফজিবা কে ছাড়িয়ে এনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,,

” দোস্ত আমাকেও একটু জড়িয়ে ধর। আমি তোর বাংলাদেশে তোর বাসার পাশে ছিলাম না। আমিও কানাডাতেই ছিলাম ছয় বছর পর আমিও তোকে দেখলাম।

আনন্দের কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেঁসে ফেলে। আনন্দের মাথায় চাটি মে’রে বলে,,

” হয়েছে আর সেন্টি খেতে হবে না।

কথাটা বলে পাবলো,অ্যানিয়াস,জ্যারেড, আর ক্লো এর দিকে তাকাতেই তারা এগিয়ে আসে। ক্লো এনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,,

” ভালো আছিস তুই?

এনা ক্লো এর পিঠে হালকা চ’ড় মে’রে বলে,,

” ছাড় বেদ্দপ আমার জান বেরিয়ে গেলো। এভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে।

ক্লো এনাকে ছেড়ে দেয়। পাবলো, অ্যানিয়াস,জ্যারেড। এনার সাথে হ্যান্ডসেক করে। পাবলো এনাকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,,

” এনা তুই অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছিস। বাংলাদেশে কি ভাতের অভাব ছিলো নাকি তোর বাপ তোরে ভাত দিতে পারে নি কোনটা।

জ্যারিড অ্যানিয়াস ও পাবলোর কথায় সায় জানিয়ে বলে,,

” তাই তো রে এনা তোর চেহারার এই অবস্থা কেনো। যখন ভিডিও কল দিতি তখন তো এমনটা দেখাচ্ছিলো না।

এনার এদের এতো প্রশ্ন করা দেখে বলে,,

” তোরা চুপ করবি। মিট করতে এসেছিস নাকি আমায় এটা ওটা জিজ্ঞেস করে সময় ব্যায় করতে এসেছিস।

হেফজিবা এনার কথাকে সমর্থন করে বলে,,

” হ্যাঁ বাদ দে এসব কথা। চল আগে ঘুরি ফিরি খাওয়াদাওয়া করি তারপর কথাবার্তা।

শহরের মূল প্রাণকেন্দ্র জ্যাস্পার এভিনিউ থেকে কিছুদূর হাঁটলেই চোখে পড়বে এক বিশাল খোলা জায়গা যেখানে কবুতরেরা বিচরণ করছে। খোলা স্থানটি ঠিক এডমন্টন পাব্লিক লাইব্রেরীর সামনে। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার উইন্সটন চার্চিলের নামে এই স্থানটির নামকরণ করা হয়েছে, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই খোলা স্থানে অনেক ফুলের গাছের সারি আপনার চোখে পড়বে, যা এখানকার পরিবেশকে রঙিন করে তুলেছে। একপাশে পাব্লিক লাইব্রেরি এবং এর অপর পাশে স্থাপিত হয়েছে এডমন্টন কমিউনিটি হল যা একটি মনোমুগ্ধকর স্থাপত্য কর্ম। দুটো পিরামিড আকৃতির ভবনের সমন্বয়ে নির্মিত হয়েছে এই কমিউনিটি হল যার একপাশে আছে একটি লম্বা মিনার এবং এর উপরে একটি বড় ঘড়ি ফিট করা আছে। পিরামিড আকৃতির স্থাপত্য দুটি সম্পূর্ণ কাঁচের তৈরি এবং সূর্যের আলোর প্রতিফলন এর সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলে। ওপেন স্কয়ারের ঠিক মাঝখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে যার সম্পর্কে আমার কোন সঠিক ধারণা নেই। তাছাড়াও এখানে আরও কয়েকটি স্ট্যাচু রয়েছে। এই ওপেন স্কয়ারের ঠিক নিচেই রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড এল আরটি ট্রেইন স্টেশন এবং পূর্বপাশের রাস্তা পার হলেই চলে যাতে পারেন আলবার্তো আর্ট গ্যালারিতে । এখানে প্রায় সময়ে বিভিন্ন ওপেন সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য সময়ে এই স্থানটি প্রায় ফাঁকা অবস্থায় থাকে। অনেকেই এখানে ইভিনিং ওয়াক করতে আসেন। তাছাড়াও জ্যাস্পার এভিনিউতে অবস্থিত বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারীগণ অফিস ব্রেকে এখান থেকে ঘুরে যান। এখানে বিশ্রাম নেবার জন্য অনেকগুলো সিটিং বেঞ্চ রয়েছে। সিটিং বেঞ্চ গুলোতে বসে আছে এনা, হেফজিবা পাবলো,অ্যানিয়াস,জ্যারেড,ক্লো, আনন্দ। ঘুরাঘুরি করে হাপিয়ে গেছে তারা। তাই খানিকটা বিশ্রাম করার জন্য তারা এখানে বসেছে।

হঠাৎ সামনের দিকে তাকাতেই বেশ চমকে উঠে এনা সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে। পিটারের স্ত্রী অন্য এক লোকের সাথে হাতে হাত ধরে ঘুরছে। আর লোকটার কোলের এক বাচ্চা আনুমানিক বয়স হবে তিন। এনা কথার মাঝেই হঠাৎ উঠে দাঁড়াতেই হেফজিবা পাবলো,অ্যানিয়াস,জ্যারেড,ক্লো, আনন্দ, সবাই ভ্রু কুঁচকে এনার দিকে তাকায়। এনা কিছু না বলে সামনে থাকা লোকটার কাছে দৌড়ে চলে যায়।

#চলবে?

( ভুল ত্রুটি গুলো ধরিয়ে দিবেন। হ্যাপি রিডিং)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে