আমার প্রথম সকাল পর্ব-০৩

0
339

#আমার_প্রথম_সকাল (০৩)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
জামিল চলে যাওয়ার পরপর ঘরের দুয়ারে দেখা মিলল জেঠি শ্বাশুড়ির। উনি এদিকেই আসছিলেন। সম্ভবত শ্বাশুড়ির সঙ্গে আলাপচারিতার উদ্দেশ্য। উনার নিজের ঘরেও ছেলের বউ আছে। জুনাইদদের পরিবারের আগাগোড়া সবদিক থেকেই তারা বেশ স্বচ্ছল পরিবারের মানুষজন। তবে সবার ভাগ্য আমার শ্বাশুড়ি আর জেঠি শ্বাশুড়ির মতো না। ছেলে এবং বউয়ের ঠ্যাঙ্গানি খেয়ে বাকিগুলো চুপচাপ মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও এই দুইজন সেদিক থেকে ঢের বাঁচা বেঁচে আছেন। তবে জেঠি শ্বাশুড়িও শুনি আজকাল আর ছেলে বউয়ের সঙ্গে লেগে বেশিদূর আগাতে পারেন না। প্রায় শুনি শ্বাশুড়ির কাছে নালিশ করেন, বউ নাকি তার মুখে মুখে তর্ক করেন। ছেলেটা নাকি ঠিক তার বউয়ের নেউটা হয়েছে। মা’কে ভুলে বউয়ের আঁচলের নিচে পড়ে থাকে। শ্বাশুড়ি মা এতে দাম্ভিকতার সহিত জবাব দেন, ” আমার ছেলে বাপু মা ছাড়া কিছু বুঝে না। তাই বউও কিছু বলার সাহস করে ওঠতে পারে না। বলবেই বা কেমন করে? জানে তো বেশি করলে যেমন পছন্দ করে ঘরে তুলেছি তেমন বিদেয় করতেও সময় নেবো না! ”

জেঠি শ্বাশুড়ি বলেন, ” এই দিকে তুই ভালোই করছিস দেখেশুনে এতিম মেয়ে ঘরে তুলছিস। বাপের বাড়ি চলে যেতে নিলে অন্তত হলেও একশবার করে ভাববে। আমিই জীবনে করলে সবথেকে বড় ভুল করছি বড়লোক বাড়ির মেয়ের এনে। কথায় কথায় এখন বাপের বাড়ির তেজ দেখায়। ”

শ্বাশুড়ির এতে বেশ গর্ববোধ হয়। অথচ উনি জানেনই না উনার একেকটা কর্মকান্ড আমার রোজকার একেকটা হাহাকার এবং দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয়। আল্লাহ না করুক, এমন কপাল গুণ নিয়ে পৃথিবীর আর কোনো মেয়ে না জন্মাক।

এতোক্ষণে খেয়াল করলাম জেঠি শ্বাশুড়ির সঙ্গে উনার বউমাও এদিকে আসছেন। উনার হাতে ইফতারির বাড়ি আর বউয়ের হাতে কিছু ফল। সেগুলো নজরে না পড়লেও সঙ্গে করে কেঁটে আনা অর্ধেকটা তরমুজ বেশ বোঝা যাচ্ছে। আমাকে দেখে জেঠি শ্বাশুড়ির বউমা মৃদু হাসল। জেঠি শ্বাশুড়ি এগিয়ে এলেন ঘরের চৌকাঠ মাড়িয়ে। আমার হাতে ইফতারির থালাটা তুলে দিয়ে বললেন, ” কিগো বউ! এখানে দাঁড়ায়া আছো ক্যান এই অসময়ে। আজকে কি ইফতারি বানাও নাই? ”

” জ্বি জেঠি এতোক্ষণ রান্নাঘরেই ছিলাম। জামিল ভাই ডাক দেওয়ায় এদিকে আসলাম। ”

” ওহ্। তা তোমার শ্বাশুড়ি কই? ”

” উনি ঘরেই আছেন। ” বলেই কালবিলম্ব না করে চলে এলাম রান্নাঘরের দিকে। দ্রুত হাতে চুলাটা বন্ধ করে দিয়ে প্রেসার কুকারের ঢাকনাটা খুলে রাখলাম। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে এসেছিলাম। নাহলে ছোলাগুলো তলানিতে লেগে একেবারে পুঁড়ে যেত। আমার পেছন পেছন কখন নীলা এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। নীলা হলো আমার জেঠি শ্বাশুড়ির ছেলে বউ। নীলা বলল, ” ভাবী ধরেন তরমুজটা কেটে ফেলেন। গরমের দিন কেটে কিছুক্ষণের জন্য ফ্রিজে রেখে দেন। দেখবেন রোজা ভাঙার পর ঠান্ডা ঠান্ডা খেতে ভালো লাগবে। ”

নীলার কথায় সায় দিয়ে তরমুজ কাটতে বসে গেলাম। নিজের কাজে ব্যস্তরত অবস্থায়ই নীলাকে বললাম, ” নীলা তোমার শ্বশুর শ্বাশুড়ির সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আসলে কেমন? ” জানি প্রশ্নটা করা ঠিক না। তবুও কৌতুহল থেকে নিজের ভাগ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার এক অবাধ্য প্রচেষ্টা থেকেই করা। নীলার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। জবাবে বলল,
” আর বলবেন না। জানেন ঘরে ঘরে একই কাহিনী। ”

” কিরকম? ”

” আপনার ঘরে যা চলছে আমার ঘরেও তা। বাপের বাড়ি থেকে যত পাঠায় উনাদের পেট ভরে না। একেকটা রাক্ষসের পেট যেন। অথচ কখনো খোঁজ নিয়ে দেখে না ছেলের শ্বশুর শ্বাশুড়ি ঠিক মতো খেল কি খেল না! ”

নীলার কথার ধরনে অবাক হলাম। সেই সঙ্গে এও বুঝলাম, ভাগ্য একা আমারই এমন না। সবাই একই পথের পথিক। সবাই এর ভুক্তভোগী।

নীলা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ” জানেন ভাবী পর পরই হয়। বাবার চেহারার দিকে তাকালে নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগে। আগে যে বেতন পেত তা দিয়ে আমার পরিবারটা হাসিখুশি এবং খুব ভালো ভাবে চলতে পারত। অথচ এখন সেই বাপ মাকে আমার জীর্ণশীর্ণ দেখায়। সারাক্ষণ তাদের মাথায় চিন্তা গুরপাক খায়। ছোট বোনের জন্য ভালো জায়গা থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসে বাবা সম্মতি দেয় না। ছোট ভাইটার সামনে এডমিশন। কোচিং খরচ, ঢাকায় থাকা খাওয়া কমসম খরচ না। তারওপর এনারা তো আছেনই। ”

” তোমার ছোটবোন তো দেখলাম মাশাআল্লাহ বড় হয়ে গেছে। ”

” হ্যাঁ। সে আর বলছি কি! বাবা এক মেয়েকে দেনা করে বিয়ে দিয়েছে, সেই দেনার ভোজা এখনো মাথার ওপর বয়ে বেড়াচ্ছেন। সেগুলো শোধ না হলে অন্যজনকে কীভাবে পরের বাড়ি পাঠায়? ”

নীলার কথা বলার ফাঁকে জেঠি শ্বাশুড়ির হাঁক ডাক পড়ল। ” এই নীলা ঘরে না গিয়ে ওখানে কি কর? কাজ কাম কি নাই? ”

” আমি আসি ভাবী। পরে সময় করে এসে কথা বলবোনে। ”

জেঠি নীলাকে এমনিতেও বাড়ির কারো সঙ্গে তেমন একটা মিশতে দেন না। উনার ভয় এমনিতেই নাকি নীলা ওনার হাতের নাগালের বাহিরে চলে গেছে এখন যতটুকু পারছেন টাইটে রাখতে, পরে মানুষের পাল্লায় আরো খারাপ হয়ে যাবে। উনার ভাবনা মতে মানুষ উনার ছেলে বউকে ফুসলায় কি-না!

নীলা চলে যাওয়ার পরপর শ্বাশুড়ি মা নিজের কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। নীলার রেখে যাওয়া ফলমূল নেড়েচেড়ে দেখলেন। উনার চেহারার রঙ বদলে গেছে এতোক্ষণে৷ বিড়বিড় করলেন নিজে নিজে, যা আমি শুনেও না শুনার ভাণ করে নিজের কাছে মনোনিবেশ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। ভাবমূর্তির ধরনে বোঝা গেল এসব উনার মোটেও পছন্দ হয়নি। কিয়ৎক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর শুনতে পেলাম শ্বাশুড়ি বলছেন, ” হ্যাঁ, মানুষের এসব দেখেই পার করতে হবে। কপালে এতো সুখ নিয়ে আসছি না-কি? তোমার মাও কি মহিলা, নাম মাত্র রোজার জন্য কয়েকপদ এনেই হাত খিচিয়ে বসে আছেন। বলি গরমের দিন আসল তো, ফোন করে বলিও এতো কিপ্টামি না করে সামনে যেন ফলমূল একটু বেশি করে পাঠায়। তোমরা ছাড়া আর খাওয়ার মতো আছে কে তার? ” পেছন ফিরে এক নজর তাকালাম শ্বাশুড়ির মুখের দিকে আর কোথাও যেন নীলার তখনকার বলে যাওয়া কথার সঙ্গে বেশ মিল খুঁজে পেলাম। তিনি পুনরায় বলে উঠলেন, ” এভাবে কী দেখতেছো? এসব কি আমরা খেতে বলছি নাকি? জুনাইদ তখন দেশে থাকবে। ওর এসব দেশি ফলমূল খাওয়ার প্রতি সখ বেশি। মেয়ের জামাইয়ের জন্য এতটুকু পারবে না তোমার মা? ”

কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেলাম না। উনি জুনাইদের নাম বেঁচে দিব্যি দায় সারা হওয়ার চেষ্টা করছেন। অথচ উনার ছেলে ঠিক কোনটা চায় আর কোনটা চায় না উনি ভেবেছেন সেসব সম্পর্কে আমার এতোদিনে বিন্দু পরিমাণও ধারণা হয়ে ওঠেনি। জুনাইদ যে কোনো কালেও পরের আশা করবার মতো ছেলে না সেসব বোধহয় উনি ওর মা হয়ে ভুলে বসেছেন।

মাগরিবের নামাজ শেষ হওয়ার পর প্রতিদিনকার মতো আমি রান্নার কাজে রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় পার করছিলাম। ইফতার শেষ করে শ্বাশুড়ি শ্বশুর তখন নিজেদের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। শ্বাশুড়ি হঠাৎ ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। এসেই জানতে চাইলেন, আমি জামিলকে কি বলেছি।

জামিলের সঙ্গে তখনকার সাক্ষাৎ এর পুরো কথাগুলো বললাম। শ্বাশুড়ি শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। ” তুমি পারলা না আমার ছেলেটার জুতোজোড়া আগাই দিতে? তাতে কি তোমার হাত ক্ষয় হয়ে যাইত? ”

” মা আমি তো উনার জুতো চিনিই না। তাহলে আমি কেন আগাই দিতে যাবো? আর উনারও কি উচিত হইছে এই কথাটা আমাকে বলার? বয়সে না হোক সম্মানের দিক থেকে তো আমি উনার ওপরেই তাই না! ”

” কি বললা! সম্মানের কথা যে বললা সে সম্মানটা তুমি আদায় করে নিতে জানছো? সম্মানটা দৌড়াই দৌড়াই আসবে না বুঝছো? আর এতো যে ব্যস্ততার অযুহাত দেখাইলা আমার ছেলেরে, সারাদিন করটা কি? তোমারে দিয়ে কোন কাজ করাই আমি শুধু রান্নাটা ছাড়া? ”

শ্বাশুড়ির চেচামেচি শুনে ও ঘর থেকে জেঠিমা অব্ধি বের হয়ে এসেছেন। জেঠিমাকে দেখা মাত্র আমি সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে রইলাম। বলা বাহুল্য শেষে জেঠিমার সামনে নিজের মা’কে না আবার গালাগাল শুনতে হয়। আমি চুপসে গেলেও এদিকে শ্বাশুড়ি চুপ করে নেই। তিনি নিজের মতো বকেই যাচ্ছেন বকেই যাচ্ছেন।

” বাপ তো সর্গে উঠে পা তুলে বসে আছে, মাও আমার ছেলের ঘাড়ে তুলে দিয়ে দিব্যি শ্বাস ছেড়ে বেড়াচ্ছে। এদিকে আমার ছেলেটার জীবনটা আমি নিজ হাতে শেষ করে দিছি। ” জুনাইদের জেঠিকে আসতে দেখে তিনি হনহনিয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরের দিকে। ঘরে যাওয়ার পরের প্রদক্ষেপটা যে ঠিক কি হতে পারে সেটা বেশ ভালো করে বুঝতে পারছি৷

চলবে……

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে