আমার তুমি পর্ব-০৬

0
353

#আমার_তুমি
#পর্ব_৬
#জান্নাত_সুলতানা

প্রিয়তা ভীষণ ব্যথা পাচ্ছে চুল খামচে ধরে রাখায়।তবুও কিছু বলে নি। কিন্তু তার মাকে নিয়ে এভাবে বলা সে অসহায় কণ্ঠে বলে উঠে

-“প্লিজ মনি তুমি যা বলার আমাকে বলো।
তবুও আমার মাকে নিয়ে কিছু বলো না।”

-“এই চুপ একদম চুপ।
বেশি বার বেড়েছিস।আর যদি মির্জা বাড়ির মেজো ছেলের আসে পাশে দেখেছি তো তুই আমার আসল রূপ দেখবি।”

কথা গুলো বলেই তিনি প্রিয়তা কে ছেড়ে দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।
প্রিয়তা ধপ করে নিচে বসে পড়ে।
দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে শব্দহীন কান্না কাঁদতে থাকে।
তার ভীষণ কষ্ট হয় এই ষোল বছর বয়সে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। সে তো এখান থেকে মুক্তি চায়।
কিন্তু আজ থেকে তার সেই চেষ্টাও করা যে বারণ।
কেন তার জীবন টা এমন হলো? একটু সুখ হলো কি এমন হতো?
সব অভিমান বাবা আর মৃত মায়ের উপর হয়।তার মা কি করে পারলো এমন নিষ্টুর পৃথিবীর তাকে একা ফেলে চলে যেতে?
একবারও কি মনে হয় নি তার ছোট মেয়ে টা এই নিষ্টুর পৃথিবীর কিভাবে বেঁচে থাকবে?
এসব ভাবতে ভাবতে প্রিয়তা কান্না করতে করতে মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়ে।

————–

-“মা তুমি কেন করো এমন ওর সাথে?
তুমি নিজেও তো কষ্ট পাও ওর সাথে এমন ব্যবহার করে।”

-“চুপ চাপ নিজের রুমে যাও।
আর ভুলেও ভাইকে এসব বলতে যেয়েও না।”

আয়না ঘৃণার দৃষ্টি ফেলে মায়ের রুম থেকে বেড়িয়ে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সেখানে দরজা ঘেঁষে মেঝেতে বসে কাঁদতে কাঁদতে বিরবির করে বলে উঠে

-“আমি জানি না তোকে কষ্ট দিয়ে মা কি পায়।
কিন্তু আমি আল্লাহর কাছে সব সময় দোয়া করি যাতে তুই এই নরক জীবন থেকে খুব তাড়াতাড়ি মুক্তি পাস আমার ছোট কলিজা।”

আয়নাও মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়ে।
কি মিল দুই বোনের মাঝে কি সুন্দর ভালোবাসা। তবে তা কারোই প্রকাশ করা হয় না।
তবে তাদের অজান্তেই তারা নিজেদের কষ্ট একে অপরের মাঝে ভাগ করে নিচ্ছে।
শুধু মিতা সওদাগরের জন্য তা প্রকাশে ফুটছে না।

—–
এদিকে মিতা সওদাগর হাউমাউ করে কান্না করছে।সে চায় না এই ছোট্ট নিষ্পাপ জান টাকে কষ্ট দিতে।
কিন্তু তিনি এই মেয়ে কে দেখলে কিছুতেই ভুলতে পারে না তার কালো দিনের কথা গুলো।
সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে মন চায়।
তিনি তার প্রথম যে দিন সংসারের তার স্বামী শফিক সওদাগর দ্বিতীয় বিয়ে করে বাড়ি ফিরে তিনি সে দিন স্তব্ধ হয়ে গিয়ে ছিলেন।
কারণ তারা একে-অপরে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, আর তাদের দুই টা বাচ্চাও ছিল একজন বারো বছরের একটা পুত্র সন্তান আর সাত বছরের একটা ক্যানা সন্তান ছিল।
সেখানে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে? এটা কোনো স্ত্রী মেনে নিতে পারবে? ভালোবাসার মানুষটার পাশে কাউকে মেনে নেওয়া যায় না সেখানে ভালোবাসার মানুষ তার উপর স্বামী সেখানে দ্বিতীয় বিয়ে, কি করে মানতো?আর তাই তিনি কোনো দিন মেনে নিতে পারে নি।
প্রিয়তার মা প্রহেলিকা শফিক সওদাগরের ফুফাতো বোন ছিল।
সিরাজ সওদাগর আর তার ছেলে শফিক সওদাগর বোনের এক মাত্র ভাগ্নের বিয়েতে যায়।
সব ঠিক ঠাক ছিল।
কিন্তু বিয়ের দিন জানতে পারে যে ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে সে ভালো না।
আর তাকে পুলিশ থানায় আটকে রেখেছে তাই সে বিয়ে করতে আসে নি।
সে দিন বোনের দিকে তাকিয়ে প্রহেলিকা কে শফিক সওদাগরের সাথে বিয়ে দেবে বলে ঠিক করে শফিক সওদাগরের বাবা সিরাজ সওদাগর।
শফিক সওদাগর কিছুতেই রাজি না।
কম বয়সে বিয়ে করে ছিল বিধায় তার দুই বাচ্চা আছে কেউ বলতো না।
আর তখন সিরাজ সওদাগর বাধ্য করে তাকে বিয়ে করার জন্য।
তিনিও শর্ত দিয়েছিল বাবা কে যে বিয়ে করবে কিন্তু কখনো স্বামীর অধিকার দেবে না মেনেও নেবে।কারণ তার মন হৃদয়ে, মস্তিষ্ক জুড়ে ছিল তার প্রিয়তমা স্ত্রী আর দুই সন্তান।
সিরাজ সওদাগর তাতেই রাজি হলেন।
অবশেষে বিয়ে করে বউ নিয়ে ওই দিন রাতে বাড়ি ফিরে তারা।
প্রহেলিকা কোনো শব্দ করে নি সে যেনো কাঠের পুতুলের মতো সব মেনে নিয়ে ছিল বাবা, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে।
এক মাত্র মেয়ে ছিলেন তিনি।
চাইলেই তাকে পড়া লেখা করাতে পারতো তার বাবা মা।
কিন্তু প্রহেলিকা সে দিন বাবার সম্মানের কথা চিন্তা করে বিয়ে করে শফিক সওদাগরের কে।
তবে সে দিন রাতে মিতা সওদাগর কিছু বলে নি।
শফিক সওদাগরও থাকে নি নতুন বউয়ের সাথে।
তিনি মাথায়ও আনে নি আরও একটা বিয়ে করেছে।
প্রথম স্ত্রী কে কথা দিয়েছিলন বাবা যত দিন বেঁচে থাকবে ততদিনে তিনি কিছু করতে পারবে না।
কিন্তু তিনি প্রহেলিকার ধারে কাছেও যাবে না।
প্রহেলিকা মেনে নিয়ে ছিল সব শুধু মানতে পারে নি মিতা সওদাগর।
উঠতে বসতে খোঁটা আর বাড়ির সব কাজ করাতো ছোট প্রহেলিকা কে দিয়ে।
এভাবে চলছিল দিন।
প্রহেলিকা ইন্টার পাস করেছিল কিন্তু ভার্সিটির আর যাওয়ার সুযোগ হয় নি।দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছিল দুই বছর।
এর মধ্যে শোনা গেলো প্রহেলিকার মা মারা গিয়েছে।
সবাই ছুটে গেলো সে দিন শুধু বাড়িতে রয়ে চায় মিতা আর তার দুই সন্তান।
সেখানে যাওয়ার পর তার মা মারা যাওয়ার দুই ঘন্টা পর তার বাবাও চলে যায়।
প্রহেলিকা তখন পাগল হয়ে পড়ে।
ষোলো বছর বিয়ে হয়ে আঠারো বছর পা দেওয়া যুবতীর মা বাবা সবাই তাকে ছেড়ে চলে গেলো।
শফিকের ততদিনে প্রহেলিকার প্রতি কিছু টা অনুভূতি তৈরি হয়ে গিয়ে ছিল।
সেখানে তারা দু রাত তিন দিন ছিল আর সেই রাতের ভালোবাসার চিহ্নস্বরূপ প্রিয়তা আসে।
কিন্তু তাতে করে আরও অত্যাচার বেরে যায় মিতার।আগের চেয়ে দ্বিগুণ কষ্ট দিতেন প্রহেলিকা কে।শফিক কিছু বলতো না আর সে তো বাড়িতেও বেশি থাকতো না নতুন নতুন হোটেলের কাজের চাপে ভুলেই বসে ছিল।তার ভুলের কষ্ট একটা মেয়ে দিন রাত সহ্য করছিল।অথচ ভুল টা কিন্তু তারও সমান দোষ ছিল কিন্তু কষ্ট টা শুধু একজনই ভুগ করতো।আর আয়না আয়ান তাদের মনে হতো সত্যি প্রহেলিকার জন্য তাদের সংসারের অশান্তি সাথে দুজনেই ছোট কিছু করার ছিল না।
সিরাজ সওদাগরের কিছু করার ছিল না তিনি ততদিনে বিছানায় থেকে আর উঠতে পারতেন না।
সে নিজেই অন্যর উপর নির্ভরশীল সেখানে তিনি কি করে কি করতেন।

-“মিতু?”

শফিক সওদাগরের ডাকে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে মিতা সওদাগর।
চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ে তা শুকিয়ে দাগ বসেছে।
তিনি কঠিন চোখে তাকিয়ে রূঢ় কণ্ঠে খিটখিটে স্বরে বলে উঠে

-“আমাকে তুমি ওই নামে একদম ডাকবে না।
সেই অধিকার তুমি ঊনিশ বছর আগেই হারিয়েছো।”

শফিক সওদাগর আর কিছু বলে না চুপ চাপ লুঙ্গি হাতে ওয়াশ রুম চলে যায়।
তিনি তার কথা রাখতে পারে নি।
আর আজও স্ত্রী কথা রাখতে এই ছোট্ট প্রাণ টার দিকে ফিরেও দেখে না তবুও তার স্ত্রীর ক্ষোভের শেষ নেই।
তার মেয়ের নিশ্চয়ই এই খারাপ বাবা টার উপর বড্ড অভিমান জমে আছে।
আচ্ছা মিতা কি কোনো দিন তার উপর থেকে সেই ওয়াদা তুলে নেবা না?
না, না অবশ্যই তুলে নিবে আর মিতা নিজেও তার ভালোবাসার মানুষের শেষ চিহ্ন কে আগলে নিবে।
আচ্ছা সেই দিন কবে আসবে?
আদোও কোনো দিন আসবে?

————-

-“চোখ মুখের এই অবস্থা কেন?”

প্রিয়তা স্কুল থেকে বেড়িয়ে এসেই দেখলো আজ সাদনান একা বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আজ সারা আসে নি। আর প্রিয়তার এমন অবস্থা থেকে সাদনানের বুকের ভিতর মুচড় দিয়ে উঠে।
চোখ মুখ ফোলে লাল হয়ে আছে।যে কেউ দেখলে নিসন্দেহে বলে দিতে পারবে মেয়ে অনেক কেঁদেছে।
প্রিয়তা সাদনানের প্রশ্নে একটু ভীতু হয়।আমতা আমতা করে জবাব দেয়

-“বেশি ঘুমিয়েছি।”

-“মিথ্যা।
কান্না করার কারণ কি আমি?”

প্রিয়তার উত্তরে সাদনান শান্ত কন্ঠে বলে উঠে।

-“কি মনে করেন নিজে কে?
আমি কেন আপনার জন্য কান্না করবো?
আর আমার পা আছে আমি হেঁটে বাড়ি যেতে পারবো রোজ আমাকে নিতে আসতে হবে না।”

কথা গুলো প্রিয়তা জোরে জোরে বলেই উল্টো ঘুরে বাড়ির পথে হাঁটা ধরে। আশে পাশের কিছু মানুষ তাকিয়ে আছে।কিছু মেয়েও সাদনানের দিকে তাকিয়ে আছে।অন্য সময় হলে প্রিয়তা এদের চোখ দিয়ে ভস্ম করে দিতো।কিন্তু এখন সে চুপ চাপ
তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সাদনান ভ্রু কুঁচকে সে দিকে এক পলক তাকিয়ে বাইক থেকে নেমে গিয়ে প্রিয়তার কাঁধে ব্যাগ টা টেনে ধরে।
প্রিয়তা কাঁদছে।
চোখ মুখ লাল হয়ে আছে।সে তো ইচ্ছে করে এমন ব্যবহার করে নি এসব চায়ও না করতে। কিন্তু না করলে যে মিতা সওদাগর তাকে আবারও মারবে আর মা কে গা*লি দেবে।
সাদনানের প্রিয়তার এরূপ অবস্থা থেকে থমকে গেলো। তার চঞ্চলতা মস্তিষ্ক এটাও বুঝে নিলো মেয়ে টা ইচ্ছে করে তাকে এসব বলে নি।
কিন্তু কেন বলেছে?
কি কারণ হতে পারে?

-“এটা যেনো আমার সামনে লাস্ট কান্না হয়।
তুমি কি ভাবো তুমি না বললে আমি জানতে পারবো না?
ভুল, এক ঘন্টার ভিতর আমি সব ইনফরমেশন পেয়ে যাব।
আর তার পর কি হবে সে টা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।
তৈরি থেকো প্রিয়তা সওদাগর।
মির্জা সাদনান শাহরিয়া খাঁচায় খুব শীগগির বন্দী হওয়ার জন্য ”

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে