আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস
পর্ব – ৯
– ভেতরে যাবে না? গেটে তো তালা দেওয়া!
– ওহ শিট! আমাকে মনে করাবে না যে গেটে তালা দেওয়া থাকবে?
– আমি কিভাবে জানবো, আজব তো?
– যেখানে দুটো অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে, সেটা কি এমনি খোলা রেখে দিবে?
– সেটা তো তোমার জানা উচিত। পুলিশে চাকরি আমি করি, না তুমি?
তনিমা বিরক্ত হয়ে তাকালো অন্তুর দিকে। তার চোখ দেখে হাত উঁচু করে হেসে ফেলল অন্তু৷
– ওকে বাবা! আমার ভুল ছিলো, হয়েছে? আমি থানায় ফোন করছি। দেখি ওরা খুলে দেয় কিনা!
অন্তু ফোন নিয়ে ডায়াল করলো থানায়। তনিমা সরে এলো গেটের কাছে। কারুকার্য করা গেটের বাইরে থেকে দেখতে থাকলো ভেতরের সৌন্দর্য। চমৎকার দুটো জলপরী ভেজা শরীর নিয়ে ফোয়ারায় বসে জলকেলি করছে৷ সামনে মার্বেল পাথর বিছানো রাস্তায় ঝরা পাতার মেলা৷ এ কদিন যে এখানে কারো পা পড়েনি, বেশ বোঝা যাচ্ছে। দূরে দাঁড়িয়ে আছে তেতলা সুউচ্চ প্রাসাদ৷ সামনে লম্বা ঝুল বারান্দা। দুপাশে সিঁড়ি না দেখা গেলেও আন্দাজ করা যাচ্ছে। পুরোটা মিলে অপূর্ব সুন্দর৷ বাড়ির মালিকের রুচির তারিফ করতে হয়! এই ধরনের বাড়ি তৈরি কম ব্যাপার নয়।
– এই তনি, কথা হলো থানায়।
তনিমা প্রাসাদ থেকে চোখ না ফিরিয়েই বললো,
– কি বললো ওরা?
– চাবি নিয়ে আসছে। তবে মিনিট তিরিশেক দেরী হবে।
তনিমা সাথে সাথে ফিরে তাকিয়েছে।
– ত্রিশ মিনিট! এতক্ষণ কি করব আমরা? গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবো?
– উহু! তা থাকবো কেন? চলো, আমরা একটু ঘোরাঘুরি করি। আশেপাশে লোকজনের সাথে কথা বলা দরকার।
– লোকজনের সাথে কথা বলতে হলে আবার উলটো পথে যেতে হবে। গ্রামের শেষ সীমানা ছেড়ে এসেছি, ভুলে গেছো নাকি? গ্রাম থেকে বেরুবার সময় ঘুরে নিব একবার।
– তাহলে আর কি! চলো, এই বাড়ির আশপাশটা দেখি, নাকি?
তনিমা অমত করলো না। অন্তুর সাথে বাড়ির সীমানা প্রাচীর ধরে হাঁটতে লাগলো। এদিকটায় তেমন কেউ আসে না বোধহয়। সাধারণত কোন মাঠ ধরে মানুষ নিয়মিত যাতায়াত করলে, সেখানে পথ তৈরি হয়। কিন্তু এখানে তেমন কিছু নেই। বর্ষার মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। ছায়া ছায়া চারিদিক। কেমন যেন অশরীরী ভাব। তনিমা ঘড়ি দেখলো। বারোটা বাজতে সাত মিনিট বাকি৷ এমন দিনের বেলায় লোকচক্ষুর সম্মুখে নিশ্চয় অশরীরী কেউ ঘুরে বেড়াবে না? তবুও কেন যেন তনিমার শরীর শিরশির করে উঠলো। কারণ না থাকলেও বার কয়েক পেছনে তাকালো৷ বারবার মনে হচ্ছে কেউ যেন আছে এখানে। তাদের অনুসরণ করে হাঁটছে মৃদু পায়ে। অন্তু ততক্ষণে এগিয়ে গেছে। সামনে কাদাপানির পথ। হঠাৎ তনিমা হোঁচট খেল। নিজেকে কোনরকমে বাঁচাতেই টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ পেল সে ৷ তারপরই প্রায় ঝড়ের বেগে তার মাথার উপর থাকা জারুল গাছটি নড়ে উঠলো। পাতায় লেগে থাকা পানি এক নিমিষে ঝরে পড়লো গায়ে। চমকে উঠলো তনিমা। ভিজে গেছে অনেকখানি। শব্দ পেয়ে পেছনে ঘুরেছে অন্তু,
– এই কি হলো?
তনিমা দাঁড়িয়ে পড়েছে। বুক ধড়ফড় করছে। অন্তু দৌড়ে এলো তার কাছে!
– এই যা! ভিজে গেছো যে! এইভাবে কেউ গাছ ঝাকায়?
– গাছ আমি কখন ঝাকালাম?
অন্তু কোমরে হাত রেখে বললো,
– তুমি কিন্তু এখনো ডালটি ধরে আছো!
তনিমা খেয়াল করলো এবার। হাঁটতে হাঁটতে বেখেয়ালে কখন যেন জারুল গাছের চিকন ডালে হাত দিয়েছে। ঠিক তখনই হোঁচট খেয়েছিলো সে। নিজেকে বাঁচাতে কোনরকম ডাল আঁকড়ে ঝাকুনি খেয়ে থেমেছে। তবে গাছ নড়ে ওঠায়, পাতায় জমে থাকা পানি গায়ে ঝরে পড়েছে। নিজেকে একটু ধাতস্থ করে অন্তুর হাত ধরে এগুলো এবার। কিন্তু ভয়টা গেল না। অন্তুকে কিছু না বললেও, সে ঠিক জানে, হোঁচট এমনি এমনি খায়নি সে। বরং পেছন থেকে তাকে ধাক্কা দেওয়া হয়েছে।
অন্তু আর তনিমা এবার যে জায়গায় এসে থামলো, সেখানে বড় গাছপালার সংখ্যা বেশিই বলা চলে। এই মেঘাচ্ছন্ন দুপুরে পরিবেশটা ছমছমে। জায়গাটি থেকে শ্বেত মহলের উত্তর কোন দেখা যায়। এদিকে মহলের কোন জানালা নেই। অন্তু আর তনিমা দুজনই মহলের দিকে পেছন ফিরে দাড়িয়েছিলো। তাদের চোখে অবাক বিস্ময়। সামনে ভঙ্গ প্রায় লোহার গেট। তারপর কয়েক কদম এগুলে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, শেওলা ধরা, আগাছাপূর্ণ এক প্রাসাদ। গেটের পাশে থাকা ফলকে প্রাসাদের নাম খোদায় করা। সেটার অবস্থাও করুন। কি লেখা আছে, উদ্ধার করা ভিষণ মুশকিল। কিন্তু অবাক করা কাণ্ড, তনিমা লেখাটি উদ্ধার করতে পারলো৷ সেখানে লেখা,
নয়নতারা!
১১০৮ বঙ্গাব্দ।
– তাহলে এই হচ্ছে শ্বেতমহলের আসল রহস্য!
অন্তু হাসলো৷ বললো,
– যাবে নাকি ভেতরে?
তনিমা আঁৎকে উঠেছে সাথে সাথে।
– পাগল নাকি তুমি? এর মধ্যে দু-চার ডজন রাসেল ভাইপার ছাড়া আর কিছু পাবে না! খামোখা কামড় খেয়ে মরতে হবে। চলো ফেরা যাক! যা ধারণা করেছিলাম, তার বেশিরভাগই ঠিক! বিশাল দারুণ একটা নাটক সাজানো হয়েছে।
অন্তু মাথা নাড়লো,
– হুম, এবার খুঁজে বের করতে হবে নাটকের পরিচালককে।
তনিমা মাথা নাড়লো৷
– আমি যদি ভুল না করি, এই নাটকের পরিচালক আসলে বিখ্যাত লেখক আগন্তুক। তিনি দারুণ লেখেন মানতেই হবে। কিন্তু পরিচালনা যে এত ভালো করেন, তা ভাবতে পারিনি।
– তনি, আমাদের সাবধান হওয়াটা জরুরি। যিনি এত কিছুর এরেঞ্জমেন্ট করতে পারেন, তিনি যে আমাদের কিছু করবে না, তা ভাবা যাবে না।
তনিমা মাথা নাড়লো৷ ফিরতি পথে আসার সময়, সেই জারুল গাছের নিচে একটা ঘড়ি চোখের পড়লো তার। অদ্ভুত! ঘড়ির ১১.৫৫ তে কাঁটা আটকে আছে! কোন কিছুতে আঘাত লেগে বন্ধ হয়ে গেছে। আর সেটা কিছুক্ষণ আগেই!
—————————————————-
থানা থেকে একজন এসে শ্বেত মহলের তালা খুলে দিল। ঘুরে দেখার সময় বেঁধে দিলো ২০ মিনিট। অন্তু আর তনিমার পক্ষে এর মধ্যে যতটুকু সম্ভব হলো, ঘুরে দেখলো। চয়নরা যাওয়ার সময় পোশাক বাদে আর কোন কিছু এই বাড়ি থেকে নিয়ে যায়নি৷ লাবণ্যর ব্যবহৃত ডায়রী পর্যন্ত পড়ে আছে। সাথে থাকা পুলিশের চোখ এড়িয়ে লাবণ্যর দুটো জিনিস ব্যাগে ভরে নিলো তনিমা। তারপর একে একে মল্লিকা আর অনিন্দিতার ঘরগুলো দেখে বেরিয়ে পড়লো তারা। ততক্ষণে দুপুর হয়ে এসেছে। অন্তু গ্রামের কয়েকজনের সাথে কথা বললো শ্বেত মহল আর নয়নতারার বিষয়ে। বিশেষ কোন কিছু জানতে পারলো না। তবে এতটুকু বোঝা গেল, তাদের সবারই বাড়িটির প্রতি ভীতি আছে। সবাই ভাবে এই বাড়িতে জমিদার কন্যা নয়নতারার অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায়। তাই তারা ওইদিকে খুব একটা যায় না৷
গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসার আগে গাড়ী থামিয়ে একটা টঙের দোকানে বসে পড়লো দুজন। করোনা ভাইরাসের প্রকোপে গ্রাম জুড়েও কড়াকড়ি চলছে। লোকজন খুব একটা বাইরে নেই। অন্তু চা খাওয়ার ফাঁকে দেখলো, একটি বাচ্চাছেলে ফুলের ঝুড়ি হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে। ঝুড়িতে অল্প কিছু গাঁদা আর গোলাপ। অন্তু ডাকলো তাকে। ছেলেটি এগিয়ে এলো৷
– তোর বাড়ি এই গ্রামে?
ছেলেটি মাথা নাড়লো।
– ফুল বিক্রি করিস?
এবারও ছেলেটি নিঃশব্দে মাথা নাড়লো।
– কতদাম ফুলের?
এতক্ষণে ছেলেটি কথা বললো,
– গাঁদা ফুল ২০ টাকা শ, গোলাপ ৫ টাকা!
অন্তু চোখ কপালে তুলে বললো,
– বলিস কি! এত কমে ফুল বিক্রি করিস? সংসার চলে তোর?
সাথে সাথে ছেলেটির চটপট উত্তর,
– মাঝেসাঝে আপনাদের মতোন আপা- ভাই রা আইসা বেশি দামে ফুল কিনা নিয়া যায়! তখন লাভ করতে পারি!
অন্তু হেসে ফেললো!
– বাব্বাহ! বুদ্ধি তো ভালোই দেখছি। ইনডাইরেক্টলি বুঝিয়ে দিলি, আমার কাছেও বেশি দামে ফুল বিক্রি করতে চাস, তাই তো?
ছেলেটা এবার ভারী সুন্দর করে হাসলো৷ পাশের বেঞ্চে চায়ে চুমুক দিতে দিতে দুজনের কথপোকথন উপভোগ করছিলো তনিমা। ঠিক তখনই একটা প্রশ্ন খেলে গেল তার মাথায়! ছেলেটিকে কাছে ডেকে ব্যাগ থেকে একশ টাকার নোট বের করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– নে, এটা আমি দিলাম তোকে। ফুল কিন্তু নিব না৷ ওগুলো ভাইয়ার কাছে বিক্রি কর।
অন্তু পলকে তাকিয়েছে তনিমার দিকে। সে অবশ্য কোনদিক তাকাচ্ছে না। তার চোখ ছেলেটির দিকে নিবদ্ধ।
– খেয়েছিস কিছু সকাল থেকে? চা বিস্কুট খাবি?
ছেলেটি মাথা নাড়লো৷ তনিমা তাকে পাশে বসালো। তারপর একটা বিস্কুট তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– ক’ দিন আগে এই গ্রামে শহরের কিছু ভাই এসেছিলো, কয়েকটা আপাও ছিলো তাদের সাথে। ওই ভাইদের কেউ তোকে নয়নতারা ফুল এনে দিতে বলেছিলো?
ছেলেটি বিস্কুটে কামড় দিতে গিয়েও থেমে গেল। অবাক দৃষ্টিতে তাকালো তনিমার দিকে। তনিমা অভয় দিলো৷
– কোন ভয় নেই। তুই সত্যিটা বললে, আরো ১০০টাকা দিব।
ছেলেটা এইবার মুখ খুললো।
– এই গেরামে নয়নতারা ফুল নাই৷ আমি দূর থেকা আইনা দিয়াছিলাম, দুই বার! একটা ভাই বলসিলো আমারে।
তনিমা ঝটপট ফোন বের করলো। ফেসবুকে চয়নের আইডির ছবি গুলো দেখলো। এইবাড়িতে ঘুরতে এসে প্রথমদিন দারুণ সেলফি আপলোড দিয়েছিলো সে। চয়নের প্রায় কাঁধ ধরে ঝুকে আছে লাবণ্য। তার পাশে হাস্যজ্বল রূপম আর অনিন্দিতা। সব শেষে মল্লিকা। মল্লিকার ঘাড়ে হাত রেখে পেছনে দাড়িয়েছে প্রত্যয়। তিন মাস পর কত বদলে গেছে এই জীবনগুলো৷ অনিন্দিতা আর মল্লিকা পৃথিবীতেই নেই৷ লাবণ্যর থাকা না থাকা সমান। নরক কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে বাকি তিনজন। তনিমা ছবিটা এগিয়ে ধরলো ছেলেটির দিকে। বললো,
– ভালো করে দেখে বল তো, এদের মধ্যে কেউ তোকে ফুল আনতে বলেছিলো কিনা?
ছেলেটি তাকিয়ে থাকলো ছবিটির দিকে। তারপর হাত দিয়ে ইশারা করলো। তনিমার মুখের ভাব পাল্টে গেছে সাথে সাথে। অবাক চাহনি তার। ততক্ষণে পিছে এসে দাড়িয়েছে অন্তু। সে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
– প্রত্যয়!!!!
(চলবে)