অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব-৬+৭

0
506

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৬.

“তুমি মানুষ হইতে চাইলে সমাজ তোমাকে স্মরণ করাবে, তুমি মেয়েমানুষ,
‘মেয়ে’ নামক বিশেষণে সমাজ দুর্বলতা খুঁজে পায়, যেন তারা মিছে ফানুস!”

কবিতা খানা গোপনে আওড়িয়ে আড়ালে আবডালে হাসে অলকানন্দা। শাশুড়ির উষ্ণ বক্ষে খুঁজে নেয় ঠাঁই। সুরবালা নিজের বাহু বন্ধনে সুন্দর ভাবে আঁকড়ে ধরে পুত্রবধূকে। পুত্র মারা যাওয়ার পর মেয়েটার মাঝেই যেন নিজের ছেলেকে দেখতে পায় সে। মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলতেও তার বুক কাঁপছিল কিন্তু কী আর করার! সমাজে বাঁচতে হলে একেবারেই একরোখা হলে যে চলবে না। দিনশেষে সমাজেই তো থাকতে হবে। তাদের কিছু নিয়মকানুন না মেনে চললে তারা দূরে ছুড়ে মারবে আমাদের। অলকানন্দা শাশুড়িকে জড়িয়ে রেখেই বলল,
“মা, আপনি না চাইলে আমি রঙিন কাপড় আর পড়বো না। সাদাতেই আমি থাকবো। আমি অবশ্যই ভালো থাকতে চাই কিন্তু সেটা আপনাকে ছেড়ে না। আপনাকে নিয়েই আমি ভালো থাকবো। তার জন্য রঙিন কাপড় না হলেও হবে।”

সুরবালার চোখ থেকে এক ফোঁটা সুখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তা অলকানন্দার অগোচরেই রইলো। শাশুড়ি তার কাছে সবসময় শক্ত-পোক্ত ভরসাস্থল। আর ভরসাস্থলকে কেউই দুর্বল হতে দেখতে পারে না।

_

স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটায় আজ সুরবালার সপ্তাহ পূর্ণ হলো। অন্ধকারাচ্ছন্ন সবচেয়ে নোংরা, ছোটো ঘরখানায় সে মানিয়ে নিয়ে ছিল তার বৈধব্য নামক অসুখটিকে। কিন্তু আজ সকাল হতেই বিহারিণী মহলে নতুন উৎপাতের সৃষ্টি। যেহেতু সুদর্শন ছিলো বাড়ির কর্তা সেহেতু তার ঘরটা ছিল সবচেয়ে আলিশান। ঘরের প্রতি কোণায় যেন সুখ গড়িয়ে পড়ার চিহ্ন। তার ঘরের আসবাবপত্র হতে দেয়ালসহ সবটাই কারুকাজ সংবলিত। কোনো রাজপ্রাসাদের সাথে তুলনা করা যাবে নির্দ্বিধায়। অথচ আজ সেই রাজপ্রাসাদ শূণ্য। রাজার অভাবে সুখ গড়িয়ে পড়া ঘরটাও যেন খাঁ খাঁ করছে। আর সেই শূণ্য ঘরটাতে কে বাস করবে তা নিয়ে চলছে বাকবিতন্ডা। ঘরের অধিকার কেউ ছাড়তে রাজি না। পানকৌড়ি, মনময়ূরী, মনোহর সকলেই একটা রুম নিয়ে পড়েছে। রুম তো নয় তার আড়ালে এই বিরাট শাসনকার্যের ভার নেওয়াও যেন লক্ষ্য সকলের।

পানকৌড়ির স্বামী ধ্রুবলাল কিছুটা বিরক্ত হলো স্ত্রীর এমন স্বভাবে। কিছুটা কপাল কুঁচকেই বলল,
“ছেড়ে দেও না কৌড়ি। একটা ঘরই তো! সেটা নিয়ে আবার কিসের এত টানাটানি!”

“আপনার লজ্জা করলো নে অমন কথা কইতে? এমন একটা ঘর আপনি আমাকে কখনো দিতে পারবেন! অকর্মা পুরুষমানুষ যেহেতু হয়েছেন সেহেতু চুপ থাকবেন। যা বুঝেন না তা নিয়ে আবার এত কথা কিসের!”

স্ত্রী’র তীক্ষ্ণ বাক্যে চুপ হয়ে গেলো ধ্রুবলাল। লোকটা একটু সহজসরল ধরণের বলেই আজ শ্বশুর বাড়িতে ঘর জামাই হয়ে বউয়ের সকল বেমানান কথা সহ্য করে। ধ্রুবলাল চুপ থাকলেও চুপ থাকেনি অলকানন্দা। বাহিরের হৈচৈ শুনে ঘর ছেড়ে বেরুতেই নিজের ননদের এমন আচরণ তার চোখে লাগে। যা ছিল বড্ড অশোভনীয়। তাই সে-ই উত্তর দিলো,
“ঠাকুর জামাই অকর্মা না তুমি অকর্মা, ননদিনী?”

বিশাল বাকবিতন্ডা মুহূর্তেই শিথিল হয়ে গেলো। কৌড়ি উঠলো খেপে। কিছুটা হামলে পড়ে বলল,
“বউরাণী, মুখ সামলে কথা বলবে।”

“তুমি মুখ সামলে কথা বলো, ঠাকুরঝি। বয়সে তুমি আমার বড়ো হলেও সম্পর্কে আমি তোমার গুরুজন। তাই তোমার এমন আচরণ মোটেও আমি মানবো না। আর আমি ঠাকুর জামাইয়ের মতন অত ভালোও না যে তোমার এমন নির্মম আচরণও সহ্য করবো। ঠাকুর জামাই তোমাকে বড়ো ভালোবাসে আর শ্রদ্ধা করে বলেই এমন ভরা সভায় অপমানিত হয়েও জবাব দেয়নি৷ কিন্তু যে সম্মান বুঝেনা তাকে আদৌও সম্মান দেওয়া যায়?”

“বউরাণী!”

“এই বাড়িতে কণ্ঠ এত উঁচুতে উঠিয়ে কথা বলবেনা ঠাকুরঝি। কণ্ঠ উঁচু করতে হলে নিজের শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে করবে। মেয়ে মানুষদের বিয়ের পর সেটাই নিজের বাড়ি। বুঝেছ?”

অলকানন্দার শব্দের তীক্ষ্ণ বাণে বিদ্ধ হয় পানকৌড়ি। উঁচু মাথা ঝুঁকে যায় অবলীলায়। কথা বাড়ানোর সাহস পায়না বাড়ির দুই মেয়ে। তা দেখে বিজয়ীর হাসি হাসে মনোহর। ঘরটা বোধহয় এবার তার ভাগ্যেই এলো। কিন্তু তার এই হাসি দীর্ঘ স্থায়িত্ব হলো না। অলকানন্দা এর আগেই প্রশ্নবিদ্ধ করলো তাকে,
“তা ঠাকুরপো, ঘরখানা কি তুমি নিতে চাও?”

মনোহর সাথে সাথে মাথা উপর-নীচ করলো। আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল,
“হ্যাঁ বউ ঠাকুরণ, এ বাড়িতে ছেলে বলতে তো আমিই আছি। এটাতে তো আমার অধিকার তাই না বলুন?”

মনোহরের গদোগদো কণ্ঠে হাসলো অলকানন্দা। মাথা উপর-নীচ করে বলল,
“তা জীবনেও তো দেখলাম না বাড়ির কোনো কাজ করতে আর এখন অধিকার নিয়ে এত হৈচৈ ঠাকুরপো? এই ঘরে কেউ থাকতে পারবেনা। আমার স্বামী বেঁচে থাকাকালীন অনেক পরিশ্রম করেছে। তার পরিশ্রমেই তাে তার এই শখের ঘর। মৃত্যুর পর এটাকেও ছাড়বেনা তা তো হতে পারেনা। এই রুমে কেউ থাকতে পারবেনা। মানুষটা তার অল্প জীবনে অনেক শ্রম দিয়েছে। তার এই শ্রম এমন মিছে হতে পারেনা।”

অলকানন্দার কথায় চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো সকালে। সুরবালার ঠোঁটের কোণে খুব সুক্ষ্ণ হাসির রেখা দেখা দিল। সে বরাবরই বুঝে এসেছে তার পুত্রবধূর মনে তার পুত্র সম্পর্কিত কোনো অনুভূতি নেই অথচ আজকের কথায় তা মনে হলোনা মোটেও।

মনোহরের চোখে-মুখে কিছুটা রাগ দেখা গেল, রাগ দেখা দিল নন্দন মশাইয়ের মুখমন্ডলেও। সে তো প্রায় খেঁকিয়েই বলে উঠলেন,
“তোমার কথায় কী এখন সব হবে নাকি? কোন মুখে কথা বলো তুমি?”

“কথা বলার অধিকার আমার আছে। সেটা আমার স্বামী তো তার সাথে চিতায় নিয়ে যায়নি। সেই অধিকারেই বলছি।”

“মা গী মেয়েমানুষ বলেই এত কথা বলে। লাজ লজ্জা মোটেও নেই।”

পিসিমার বিশ্রী গালিতেও হাসলো অলকানন্দা। মাথার ঘোমটাটা আরেকটু টেনে বলল,
“শুনেছি রতনেই রতন চেনে। আমি যে ওসব মেয়েমানুষ আপনি চিনলেন কীভাবে? তাহলে কী….”

অলকানন্দার কথা সম্পূর্ণ হওয়ায় আগেই একটা সুরেলা মেয়েলী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“তাহলে বলা যায়, মা গীই তবে মা গী চিনেছে তাইনা?”

সুরেলা মেয়ে কণ্ঠে চমকে উঠলো উপস্থিত সকলে। কণ্ঠের মালকিনের দিকে তাকাতেই একটা সুন্দর নারীমূর্তির মুখমন্ডল দৃষ্টিগোচর হলো। লক্ষ্মী দেবী হতভম্ব চোখে চেয়ে অবাক কণ্ঠে বললো,
“তরঙ্গিণী, তুই আমারে অমন কথা কইতে পারলি?”

তরঙ্গিণী নামের মেয়েটির লতার মতন অঙ্গখানি হাসিতে লুটোপুটি খেলো। নীল রঙের চকচকে শাড়িখানার আঁচল দুলাতে দুলাতে বলল,
“তোমারে আমি অমন কথা কইতে পারি জেঠি? তুমি হলে গিয়ে সতীসাবিত্রী নারী।”

কথাটায় যেন ঠাট্টার ছোঁয়া ছিল। লক্ষ্মী দেবী মনে মনে বড্ড নারাজ হলেন বোধহয়। কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন নিজ ঘরে। বিরাট কথোপকথনের ভাঁটা পড়ে সেখানেই। তরঙ্গিণী নামক নারীটিকে দেখে বাকি সকলে খুশি হলেও খুশি হলোনা সুরবালা। তার চোখেমুখে একটা বিরক্ত ভাব যেন লেপটেই ছিল।

যে যার মতন চলে গেলেও দাঁড়িয়ে রইলো অলকানন্দা। তরঙ্গিণী দেহ দুলিয়ে দুলিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো অলকানন্দার দিকে। অলকানন্দার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অব্দি পরখ করে আপনমনেই বলল,
“তোমার রূপ কমানোর চেষ্টা চলেছিল নাকি, নন্দা? কিন্তু স্বয়ং ঈশ্বর যারে রূপ ঢেলে দেয় তার রূপ কমানোর সাধ্যি কারো আছে বলো?”

“তোমার তো রূপ বাড়লো আরও। প্রেমিক পুরুষ মরলেও কী রূপ বাড়ে না-কি?”

অলকানন্দার কথায় উচ্চস্বরে হেসে উঠলো তরঙ্গিণী। অলকানন্দার থুঁতনি ধরে বলল,
“তোমারও তো দেখলাম ভালোবাসা বেড়েছে। স্বামী মরলে কী প্রেম বাড়ে? নাকি শরীরের ক্ষুধা প্রেম বাড়ায়?”

“অমন ক্ষুধা তরঙ্গিণীর থাকে, অলকানন্দার না।”

তরঙ্গিণী এবার অবাক হলো। অলকানন্দা যে কথার উত্তরে দারুণ কথা বলতে শিখেছে তা সে হয়তো ভাবতেও পারেনি।

_

দিন পেরিয়ে রাত হলো। প্রকৃতি তখন ঝিমিয়ে এলো দারুণ ক্লান্তিতে। অলকানন্দা শুয়ে ছিল তার বিছানায়। তন্মধ্যেই ঘরে উপস্থিত হলো প্রসাদ। এসেই বরাবরের মতন দরজায় শব্দ তুললো। তার উপস্থিতি জানান দিলো। অলকানন্দা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। প্রসাদকে দেখেই তৎক্ষণাৎ উঠে বসলো। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“আসুন, আসুন।”

প্রসাদ গম্ভীর মুখে ভেতরে প্রবেশ করলো। রাশভারী কণ্ঠে বলল,
“পড়াশোনার ব্যাপারে কিছু তো জানালেন না। আগামী বুধবার আপনার পরীক্ষা। হাতে আর চারদিন অবশিষ্ট আছে।”

অলকানন্দা মাথা উঁচু করতেই মুহূর্তেই মাথা ঘুরে উঠলো তার। হড়বড়িয়ে বমি করে ভাসিয়ে ফেলল জমিন। আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব প্রসাদ। অলকানন্দার অসুস্থ কণ্ঠে ছুটে এলো তরঙ্গিণী, সুরবালাসহ বাকি রমনীগণ। কৃষ্ণপ্রিয়া গিয়ে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটাকে। আর্তনাদ করে উঠলো লক্ষ্মী দেবী,
“এমা বউ, তুই কী পোয়াতি হলি নাকি?”

#চলবে

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৭.

“বিহারিণী মহলের” ভেতর কবিরাজ ডাকানো হলো। গুমোট চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো একেকজন মানুষ। প্রায় বেশিরভাগ মানুষেরই ভয়- মেয়েটার ভেতর না আবার নতুন কোনো প্রাণ চলে আসে। কবিরাজ বিজ্ঞ হাতে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। কতক্ষণ নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে অলকানন্দাকে পরখ করে নেন। অলকানন্দার ভেতরে কোনো ভাবাবেগে দেখা যায় না। বয়স্ক কবিরাজ তা দেখে ভ্রু কুঁচকায়। একই গ্রামের বিধায় সে অলকানন্দাকে ছোটো বেলা থেকেই চেনে। আর সেই সুবাদেই প্রশ্ন করলো,
“নন্দু, তুই ভয় পাচ্ছিস না?”

কবিরাজের প্রশ্নে ডানে-বামে মাথা নাড়ায় অলকানন্দা। যার অর্থ “না”। কবিরাজ অলকানন্দার এমন উত্তরে কুঁচকানো ভ্রু আরও কুঁচকে ফেলে। অবাক কণ্ঠে বলে,
“ভয় পাচ্ছিস না কেন? তোর বয়স কম। তার উপর তোর স্বামী নেই। এখন যদি নতুন একটা প্রাণ দেখা দেয় তোর ভেতরে কীভাবে বাঁচবি বল? তোর তো এখনো নিজেরই ঠিকানা হলো না।”

“দাদু, এমন কিছু যে আদৌও হয়নি তা তুমিও জানো, আমিও জানি। আমি বলেছিলামও ওদের যেন ডাক্তার বৈদ্য না ডাকে। তবুও ওদের মনের খুঁতখুঁত পরিষ্কার করতে তোমাকে এনেই ছাড়লো।”

“তুই কীভাবে বুঝলি এমন কিছু যে হবে না?”

অলকানন্দা এহেন প্রশ্নে একটু অস্বস্তিবোধ করলো। তার চোখে-মুখে দেখা দিলো সেই অস্বস্তির ছায়া। যা দেখে অভিজ্ঞ জহরলাল হয়তো বুঝে গেলেন কিছু। অতঃপর অলকানন্দার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“তোর জীবন যুদ্ধ সহজ হোক, এই প্রার্থনাই করি। তোর ধারণাই ঠিক, তোর তেমন কিছুই হয়নি। খাবার দাবার সঠিক পাচ্ছিস না বলে শরীর দুর্বল হয়ে গেছে। সাবধানে থাকিস।”

জহরলালের কথায় ঘাড় নাড়ে অলকানন্দা। অতঃপর আরাম করে শরীর এলিয়ে দেয় মাটিতে বিছিয়ে রাখা শীতলপাটি খানায়। জহরলাল ততক্ষণে ঘর ছেড়ে বাহিরে চলে যায়। বাহির থেকে ভেসে আসে সকলের হরেক রকমের কণ্ঠ। তা শুনে হাসে অলকানন্দা। তার একটু শরীরের অসুস্থতাই যে সকলের ঘুম কেড়ে নিয়েছে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না তার। অথচ এই চিন্তা শরীর নিয়ে না, এই চিন্তা সম্পত্তি নিয়ে। যদি সম্পত্তির ভাগীদার চলে আসে তবে তো সকলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তো। অলকানন্দা চোখ বন্ধ করে ফেলে আপনমনেই। চোখের উপর ভেসে উঠে তার বৈবাহিক জীবনের প্রথম রাতের কথা। যে রাতে ঘরে স্বামী প্রবেশ করার কথা সে রাতে তার ঘরে প্রবেশ করেছিল স্বামীর মনোরঞ্জন করা নারী- তরঙ্গিণী। মাখনের মতন দেহখানি দুলিয়ে দুলিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল তার কাছে। অলকানন্দা তখন নতুন বউ। নির্বাক তার দৃষ্টিভঙ্গি। তাকে দেখেই তরঙ্গিণী মুখটা যেন কেমন বিকৃত করলো। এবং কেমন বাজে ইঙ্গিত করে বলল,
“রূপ তো আর দেহে ধরে না, কী আকর্ষণ শরীরে! আমার নাগর না আবার এই দেহেই আটকে যায়!”

অলকানন্দার তখন লজ্জায়, ঘৃণায় শরীরে আলাদা শিহরণ বয়ে যায়। তরঙ্গিণী তখন খিলখিল করে হেসে বলে,
“কার জন্য এত সাজ তোমার? আমি অনুমতি না দিলে তোমার স্বামী নামক পুরুষ একটা পা-ও ফেলবে না এ-ঘরে। তোমার স্বামী আমায় ভালোবাসে।”

অলকানন্দা তখন মুখ-চোখ শক্ত করে রেখেছিল। তরঙ্গিণী তা দেখে কত হেসেই না লুটোপুটি খেলো। তারপর কোমড় দুলিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর ছেড়ে। কিন্তু তরঙ্গিণীর কথাই সেদিন সত্যি হতে যাচ্ছিলো। সত্যিই সুদর্শন নতুন বধূকে চির অপেক্ষায় রেখে আর পা দেয়নি নিজের ঘরে। রাত তখন মাঝামাঝি। লাজ লজ্জা জলাঞ্জলি দিয়ে অলকানন্দার ফুলে সজ্জিত ঘরে উপস্থিত হয় তার শাশুড়ি সুরবালা। এবং শক্ত কণ্ঠে আদেশ করেন যেন এক্ষুনি তার স্বামীকে নিজের ঘরে নিয়ে আসে।

নতুন বধূ শাশুড়ি আজ্ঞা ফেলতে না পেরে আধ হাত ঘোমটা টেনে বেরিয়ে যায় স্বামীর উদ্দেশ্যে। এই বিরাট বাড়ির একটা কোণার রুমেই নিজের স্বামীকে পায় তরঙ্গিণীর সাথে। যারা অপবিত্র সুখে নিমজ্জিত ছিল। অলকানন্দার তো চোখ দু’টো তখন অশ্রুতে টইটম্বুর। যে মানুষটাকে নিজের স্বামী হিসেবে পেয়েছে, তাকে অন্য কোনো নারীর সাথে কেই-বা সহ্য করতে পারে! সেদিন অলকানন্দার অশ্রু দেখে হেসেছিল তরঙ্গিণী। সুদর্শন তো নতুন বধূর ঘরে যেতেই নারাজ। অতঃপর তরঙ্গিণী গোপনে নিয়ে তাকে শর্ত দেয়, তার দেওয়া কিছু ওষুধ অলকানন্দাকে রোজ খেতে হবে। তবেই সে তার স্বামীকে পাবে। ছোটো অলকানন্দা সেই শর্তে রাজি হয় এবং তারপরই তরঙ্গিণীর ইচ্ছেতে সুদর্শন অলকানন্দার সাথে নিজেদের ঘরে যায়। তরঙ্গিণীর কাছ থেকে যে সুদর্শনকে এনেছিল, ঘরে প্রবেশ করতেই সেই সুদর্শনের চেহারা বদলে যায়। নারী দেহ পেতেই সে সিংহ হয়ে ওঠে। অলকানন্দা ভেবেছিল সুদর্শন হয়তো তরঙ্গিণীকে ভালোবাসে কিন্তু সেদিন রাতে সুদর্শনের করা আচরণই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, সুদর্শন নারী আত্মা না নারীদেহ ভালোবাসে। তার কাছে হয়তো দেহটাই মোক্ষ। হোক সেটা তরঙ্গিণী কিংবা অলকানন্দার।

সেসব কথা ভাবতে ভাবতে নিদ্রা চলে এলো অলকানন্দার চোখে। চোখের পাতা ভারি হয়ে লেগে আসতেই তার ঘরে পা ফেলল কেউ। অলকানন্দার ঘুম মুহূর্তেই উবে গেলো। চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো তরঙ্গিণী দাঁড়িয়ে আছে তার ঘরে। তাকে দেখেই স্মিত হাসলো অলকানন্দা। হাসি নেই তরঙ্গিণীর মুখে। চোখ-মুখ কেমন ফ্যাকাসে রঙ ধারণ করে আছে!

তরঙ্গিণী’র ফ্যাকাসে বর্ণ দেখে অলকানন্দাই কথা বলল,
“কী ব্যাপার? আপনার চোখ-মুখের এ অবস্থা কেন?”

“যে ঘটনাটা আন্দাজ করেছিল সবাই সেটা সত্যি হলে বোধকরি মন্দ হতোনে।”

“আপনিও ভালো করে জানেন, আমিও জানি, সেটা সত্যি হওয়ার না।”

“আজ সুদর্শন নেই, কিন্তু তার দেওয়া একটা অস্তিত্ব যদি তোমার মাঝে থাকতো তবুও তো তাকে দেখে নিজের চোখ জুড়াতে পারতাম!”

“আপনার মাঝে সে-ই অস্তিত্ব এলোও খারাপ হয়না বলুন?”

অলকানন্দার কণ্ঠে কেমন বিদ্রুপের ছোঁয়া। তা দেখে তরঙ্গিণী মুখ পাংশুটে বর্ণ করলো। কঠিণ কণ্ঠে বললো,
“তা সম্ভব না তুমিও জানো, আমিও জানি।”

“কেন সম্ভব না? তিনি তো নাকি আপনাকে ভালোবাসতো?”

“হ্যাঁ বাসতো।”

“কতটা বাসতো?”

“যতটা ভালোবাসা থাকলে নতুন বধূর কাছে আমার অনুমতি না পেলে যায় না ঠিক ততটা।”

কথাটা বলার সময় অহংকারে যেন বুক ফুলে উঠলো তরঙ্গিণীর। তা দেখে বেশ কিছুটা উচ্চস্বরেই হাসলো অলকানন্দা। হাসতে হাসতেই বলল,
“আপনাকে তিনি ততটাই ভালোবাসতো যতটা ভালোবাসলে রাত কাটানো যায় কিন্তু বিয়ে করা যায় না। ঠিক ততটাই ভালোবাসতো, যতটা ভালোবাসলে আপনার শরীর ছেড়ে এসে আরেকজনের শরীরে আটকাতে তার দুই দন্ডও লাগেনি। ঠিক ততটাই ভালোবাসতো, যতটা ভালোবাসলে তার সন্তান গর্ভে ধারণ করার অধিকার আপনার নেই।”

তরঙ্গিণী আর কোনো কথা বললো না। চির সত্যি মানতে সবারই কষ্ট হয়। তরঙ্গিণীরও হয়েছে। সত্যি হজম করার চেয়ে কষ্টের বোধহয় কিছু নেই। আর একটা নারীর কাছে এটা মানা খুবই বেদনাদায়ক যে তার প্রেমিক তার মনকে না কেবল আর কেবল মাত্র তার দেহকে ভালোবেসেছিল।

”শুনুন?”

তরঙ্গিণী অলকানন্দার ডাকে ফিরে তাকালো। চোখেমুখে প্রশ্নের ছড়াছড়ি। যা দেখে অলকানন্দাই প্রশ্ন করলো,
“আপনি বিয়ে করেননি কেন?”

“যে মানুষ বিয়ে করবে বলে কথা দিয়েছিল, সে কথা রাখেনি।”

কথা শেষ করেই তরঙ্গিণী বেরিয়ে গেলো। অলকানন্দার বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। পুরুষ মানুষকে চেনা বড়ো দায়!

_

গভীর রাতে অলকানন্দার ঘরে জ্বলছে লন্ঠন। আগামীকাল তার স্কুলের পরীক্ষা শুরু। লন্ঠনের আলো নিভু নিভু হয়ে আসছে বাতায়নের কোল ঘেঁষে আসা বাতাসের জন্য। হুট করে বাহির থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসতেই অলকানন্দার কান খাড়া হয়ে উঠলো। কৌতুহলী সত্তাটা সে দমিয়ে রাখতে না পেরে ঘরের দরজা খুললো। কোমল পায়ে বেরিয়ে এলো ঘর ছেড়ে। পুরো বাড়িতে আধো আধো ঝিমিয়ে থাকা আলো জ্বলছে। অলকানন্দা পা টিপে বাড়ির অন্দরমহল ছেড়ে চলে এলো বিশাল বাড়িটার পেছনের দিকটায়। হাঁটতে হাঁটতে বাঁশঝাড় পেরিয়ে বাড়ির পেছনের একটা পরিত্যক্ত পুকুরপাড় চলে এলো। গাছের আড়ালে দাঁড়াতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। পুকুরপাড়ে চলছে বিরাট আয়োজন। কেউ মারা গেলে দাহ্য করার জন্য যেমন আয়োজন করা হয় তেমন আয়োজন চলছে। আর অলকানন্দাকে অবাক করে দিয়ে নন্দন মশাইয়ের হাসি ভেসে এলো। সাথে দেখা দিল লক্ষ্মী দেবীকেও। তাদের মুখে বিশ্ব জয় করা হাসি।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে