অমানিশা পর্ব-০৬

0
407

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ৬

রাত্রি ক্লাস ওয়ানের বাচ্চাদের কাগজের প্রজাপতি বানিয়ে হাতে হাতে দিয়ে গান গাইছিল। রুহিয়া ক্লাসে ঢুকে বলল,

এখন কি ক্লাস?

বাংলা।

তো বাংলা ক্লাসে আপনি প্রজাপতি বানিয়ে সময় নষ্ট করছেন যে।

আসলে এটা নিয়ে ছড়া আছে ওটাই পড়াচ্ছি। তাই ওরা আনন্দ পাবে তাই বানিয়ে দিচ্ছি।

ওদের আনন্দ দেবার জন্য আপনাকে বেতন দেয়া হয়না মিস রাত্রি। ঠিকমতো না পড়িয়ে শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন।

আপনি ভুল বললেন। আনন্দ পেলেই ওরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পড়াশোনা করবে।

আমি ঠিক না ভুল সেটা আপনি বিচার করতে আসবেন না। চাচা আমাকে সবদিক নজর রাখতে বলেছেন। এমন চললে আমি ওনাকে জানাতে বাধ্য হব।

রুহিয়া কথাগুলো বলেই বের হয়ে গেল। রাত্রি ওর মতো করে ক্লাস চালিয়ে গেল।

স্কুলে টিচার্স রুমে বসেছিল রাত্রি। আয়ান এসে ঢুকল এমন সময়। রুহিয়া একপাশে বসে ছিল। ওর পাশে চেয়ার ফাঁকা ছিল। হাত নেড়ে আয়ানকে বসতে ইশারা করল। আয়ান গিয়ে চেয়ারটা নিয়ে রাত্রির পাশে এনে বসে পড়ল। রুহিয়া ভীষণ রেগে গেছে বোঝাই যাচ্ছে। চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। আয়ানের এই মেয়েটার প্রতি এতো আগ্রহ,মেলামেশা ওর কাছে অসহ্য লাগছে।

আয়ান এসেই জোরে জোরে বলল,

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মিসেস রাত্রি।

রাত্রি জিভ কেটে বলল,

এমা ! কি বলেন এসব,আমি মিসেস নই।

আয়ান মনে মনে খুশি হলো। ও বলল,

ও আচ্ছা,সরি। তবে আপনাকে ধন্যবাদ।

কিন্তু ধন্যবাদ কিসের জন্য?

এই যে আপনি কি সুন্দর করে বাচ্চাদের সাথে খেলছিলেন। আমার না মনে হয়েছে যে শিশুদের শুধু পড়ার জন্য চাপে না রেখে ওদের মতো করে ওদের সাথে মেশাটাই একজন শিক্ষকের‌ বিশেষ গুন। আর আপনি এই কাজটা এতো চমৎকার ভাবে করলেন। আমার খুব খুব ভালো লেগেছে ব্যাপারটা। সত্যি আপনার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে।

কোন ক্লাসের কথা বলছেন?

ঐ যে প্রজাপতি বানিয়ে ক্লাস নিলেন।

কি যে বলেন। আপনি বেশি বেশি বলছেন। ওটাতো ওদের পড়ার একটা অংশ।

কিন্তু সবাইতো এসব করে না।

আমি চেষ্টা করি। এই স্কুলের সবাই খুব আন্তরিক।

আয়ান দেখল রুহিয়া উঠে চলে যাচ্ছে।

আয়ান সেদিকে একবার দেখে বলল,

আপনি কারো কথায় কিছু মনে করবেন না। আসলে আমাদের এক একজনের চিন্তা ভাবনা এক এক রকম। আর ভালো কিছু করতে গেলে বাঁধা আসবেই।

আমি কিছুই মনে করিনি।

কিন্তু আমি মনে করব। আপনি যদি এখন আমার লাঞ্চটা শেয়ার না করেন।

আমিওতো লাঞ্চ এনেছি।

তা জানি। ওটা থাক। আসলে মা এই এতোটা বিরিয়ানি দিয়ে দিয়েছেন। আমি একা খেতে পারি না। খাওয়ার সময় গল্প করতে না পারলে আমার গলা দিয়ে কিছু নামে না। আর তাছাড়া আমার মায়ের হাতের বিরিয়ানি ভীষণ মজা হয়। আপনাকে খাওয়াতে ইচ্ছে করছে। আপনি খেয়ে প্রশংসা করবেন সেটা আমি আবার মাকে গিয়ে জানাব। মা অনেক খুশি হবেন।

রাত্রি হেসে বলল,

আচ্ছা চলুন।

তরফদার সাহেব বসে আছেন ছোট মেয়ের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের রুমে। স্যার একটু কড়া কথাই শুনিয়ে দিলেন। বাঁকা করেই বললেন,

এই বয়সে মেয়েকে ফোন দিয়েছেন। আপনার মতো সচেতন মানুষের কাছে এটাতো আশা করিনি।

তরফদার সাহেব প্রথমে কিছু বুঝলেন না। অবাক হয়ে বললেন,

মানে কি হয়েছে একটু পরিস্কার করে বলবেন কি?

আপনার মেয়ে গোধূলি মোবাইল ফোন এনেছে স্কুলে। আপনি তো জানেন এই স্কুলে নিয়ম কানুন কতটা কড়াকড়ি ভাবে মানা হয়।‌ অথচ আপনার মেয়ে মোবাইল নিয়ে এসেছে।‌ এটা আবার সে কমনরুমে গিয়ে সবার সামনেই ব্যবহার করছে। কতবড় সাহস! এভাবে তো অন্যরাও নিয়ম ভাঙতে উৎসাহিত হবে। ভাগ্য ভালো ওর এক ক্লাসমেট বিষয়টা ইনফর্ম করেছে আমাদের।

কি বলছেন এসব! ও মোবাইল এনেছে? আচ্ছা স্যার,আমি দেখছি বিষয়টা। ওকেতো ফোন দেয়া হয়নি। বাসার কারোটা নিয়ে এসেছে হয়তো। আমি কথা দিচ্ছি আর এমন হবে না।

আচ্ছা আপনি বলছেন তাই ওকে কিছু বললাম না। এরপর এমন হলে টিসি দিতে বাধ্য হবো।

তরফদার সাহেব ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন। জীবনে কখনো কেউ তাকে এভাবে তাচ্ছিল্য করে কথা শোনাতে পারেনি। তিনি বরাবরই মেয়েদের সুশৃঙ্খল ভাবে বড় করতে চেয়েছেন। বড় মেয়েকে খুব সুন্দর করে মানুষ করেছেন। কিন্তু গোধূলির বেলায় নানাসময় নানা ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। মেয়ের এমন আচরণে তিনি ভীষণ রেগে গেলেন।‌ কিছু দিন থেকেই কিসব উলটা পালটা কান্ড করছে এই মেয়ে । বড় মেয়েকে যেই ছেলেটা দেখতে এলো তারসাথে যোগাযোগ করেছে। আজ আবার এই কান্ড।

কিন্তু তার মেয়ে মোবাইল কোথায় পেল। তাও আবার স্মার্ট ফোন। এটাতো বাড়ির কারো ফোন না। আগেও পাড়ার পরিচিত লোকজন গোধূলি সম্পর্কে নানা বিচার দিয়েছে। তবে সেসব এতো বড় কিছু ছিলো না। হয়তো কোনো বন্ধুর সাথে কোথাও দেখেছে কেউ। তবে গত ক’দিন এর ঘটনায় তিনি অবাক হয়ে যাচ্ছেন। পড়াশোনায় একদম ভালো করতে পারছে না মেয়েটা। অথচ আজেবাজে কাজে জড়িয়ে পড়ছে।

গোধূলি বাবার সাথে বাড়িতে ঢুকল ভয়ে ভয়ে । পুরো রাস্তায় বাবা কিছু বলেনি। বাসায় গিয়ে কি করবে আল্লাহ জানেন। তবে কি কৈফিয়ত দেবে মনে মনে সেটা ঠিক করে ফেলল ও। বাবা নিশ্চয়ই খুব রেগে আছেন।

তরফদার সাহেব বাড়িতে এসেই বসার ঘরের সোফায় গা এলিয়ে বসে পড়লেন। ওনার কেমন অস্থির লাগছে। একটু পানি চাইলেন নাজমার কাছে। গোধূলি একপাশে দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। নাজমা বলল,

আপনি এসময় আসলেন আর গোধূলিকে কোথায় পাইলেন। তিনি গোধূলিকে চোখ দিয়ে কি হয়েছে জানতে চাইলেন। গোধূলি চুপ করে দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে থাকল। তরফদার নাজমাকে বললেন,

তোমার গুনধর মেয়ের স্কুলে ডাক পড়েছিল।

কেনো,স্কুলে ডেকেছে কেনো?

এতো সবে শুরু। আরো কত কি যে দেখবা।

এই কি হয়েছে গোধূলি,তোর বাবাকে কেনো ডেকেছে?

ও কি বলবে? তোমার মেয়ে স্কুলে মোবাইল নিয়ে গেছে।

কি বলেন? ও মোবাইল পাবে কোথায়?

সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করো। তোমার এই মেয়ে বিপথে চলে গেছে নাজমা। আমার মান সম্মান কোথায় যে নিয়ে ফেলবে।

তরফদার সাহেব মোবাইল নাজমার কাছে দিয়ে বললেন,

এই দেখো,এই মোবাইল তোমার মেয়ে নিয়ে গেছে।

এই তুই মোবাইল কই পাইছিস?

আমার মোবাইল না।

তো তোর কাছে আসল কিভাবে? মিথ্যা বলছিস তুই।

আমি নিয়েছিলাম এক বন্ধুর কাছে।

ও মিথ্যা বলছে কিভাবে দেখেছ? ও অনেক চালাক হয়ে গেছে। মা বাবার সাথে চালাকি করছে তোমার মেয়ে।
আমি সত্যিই বলছি বাবা, বিশ্বাস করো। শখ করে ছবি তুলতে নিয়েছিলাম।

আমিতো তোমার মোবাইল দেখেছি। সাব্বির নামের ঐ ছেলের সাথে তোমার মেয়ে রীতিমতো যোগাযোগ রেখেছে। গতকাল একটা আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে আমার ফোনে। তোমার মেয়ে ঐ সাব্বিরের‌ সাথে এখানে সেখানে ঘুরতে যায় এসব জানিয়েছে আমাকে। আমি ভেবেছিলাম কেউ মিথ্যা করে বাড়িয়ে বলছে। আর আজকেই তোমার মেয়ের স্কুল থেকে ডাক পড়ল। আমি এই মোবাইলেও সব মেসেজ দেখেছি। এই মেয়ে যে কি করতে যাচ্ছে ও ভালো জানে।

গোধূলি চুপ করে রইল।

নাজমা মেয়েকে মারতে মারতে বললেন,

কোথায় পেয়েছিস এই মোবাইল। বল শিগগির। বদমাইশ মেয়ে কোথাকার!

মারতে মারতে মেয়েকে মাটিতে ফেলে দিলেন। পা দিয়ে লাথি দিলেন অনবরত।

তরফদার বললেন,

নাজমা ওর স্কুলে যাওয়া বন্ধ। পড়ালেখা করতে গিয়ে যদি এসব করে তাহলে পড়াশোনা না করাই ভালো। বাসায় পড়ুক। আমি বাসায় টিচার ঠিক করে দেব। পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসবে।

গোধূলি এবার মুখ খুলল। চিৎকার করে বলল,
এটা করতে পারো না তোমরা,আমি কি ক্রিমিনাল যে বন্দি করে রাখবা? আমাকে এভাবে আটকে রাখতে পারবে না তোমরা।

নাজমা আবারও মেয়েকে মারতে শুরু করলেন।

আমরা যা বলছি তাই হবে। পরিবারের মান সম্মান নিয়ে খেলবি তুই। কোথাও যাওয়া হবে না। বেশি পাখনা গজাইছে। পাখনা কিভাবে কাটা লাগে আমার জানা আছে ভালো করে। সব বন্ধ আজ থেকে।

গোধূলির স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। বাড়িতে একজন টিচার এসে পড়াতে লাগলেন। ওর মোবাইল নিয়ে নেয়া হয়েছে, তাই সাব্বিরের সাথে যোগাযোগ বন্ধ থাকল। গোধূলির সব রাগ গিয়ে পড়ল রাত্রির ওপর। গোধূলি বোনের সাথে কথা বন্ধ করে দিলো।

আজ রাত্রিদের স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাত্রি শাড়ি পরেছে। এমনিতেই শাড়ি পরা হয় না কখনো। ওর তাই লজ্জা লাগছে। হাঁটতে চলতেও সমস্যা হচ্ছে বেশ।

ছেলেরা সবাই পাঞ্জাবি পরেছে। আয়ান একটা অফহোয়াইট কালারের পাঞ্জাবি পরেছে। ওকে অন্যদিনের থেকে আলাদা লাগছে বেশ। না চাইতেও কয়েকবার আয়ানের দিকে চোখ গেল রাত্রির। আর প্রতিবারই চোখাচোখি হয়ে গেল।

আস্তে আস্তে কুচি ধরে হেঁটে টিচার্স রুমে যাচ্ছিল রাত্রি কোথা থেকে আয়ান এসে পড়ল।

আপনার শাড়িটা কিন্তু সুন্দর।

হুম,সবাইতো একরকম শাড়ি কিনেছি।

তবে আপনার শাড়িটা একটু বেশি সুন্দর।

রাত্রি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই আয়ান হাসিমুখে আস্তে করে বলল,

শাড়িটা একটু উঁচু করে পরুন, হাঁটতে আর সমস্যা হবে না।

রাত্রি বুঝল ওর যে হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে আয়ান ওটা খেয়াল করেছে। সত্যিতো শাড়িটা বেশ নীচু হয়ে গেছে পরাটা। রাত্রি কমনরুমের দিকে এগুলো। আয়ানের এই কেয়ারিং এটিচিউড ভালো লাগল ওর।

এখন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। একটু পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হবে। রাত্রির একটা আবৃত্তি আছে। ছোটদের পরিবেশনা শেষ হলেই শিক্ষকদের পারফরম্যান্স হবে।

রুহিয়াকে আয়ানের আশেপাশেই দেখা যাচ্ছে। হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন বলেই চলেছে। আয়ান অবশ্য এদিক ওদিক দেখছে।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আগে আগে আয়ান রাত্রির কাছে এলো,

একটা কথা বলব?

হুম। বলে ফেলুন।

আপনার হাতের চুড়ি আর গলার মালাটা কি খুলে ব্যাগে রাখা যায় কিছু সময়ের জন্য?

রাত্রি একটু অবাক হলো। এটা আবার কিরকম কথারে বাবা।

আয়ান বলল,
না থাক,সমস্যা হলে থাক।

আয়ান চলে গেল। রাত্রি একটু পর কি মনে করে চুড়ি আর মালা খুলে হাতব্যাগে রেখে দিল।

একটু সময় পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। ছোটদের একটা দলীয় নাচ হচ্ছে। এরপর রাত্রির আবৃত্তি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছে আয়ান আর রুহিয়া। রাত্রির নাম বলতে গিয়ে আয়ান মিষ্টি মেয়ে উপাধি জুড়ে দিলো।

রাত্রি আবৃত্তি করল জীবনানন্দ দাশের কবিতা। সবাই খুব প্রশংসা করল।

প্রতিষ্ঠান প্রধান বললেন,

আপনিতো বেশ ভালো আবৃত্তি করেন। এতোদিন এই প্রতিভা লুকিয়ে রেখেছিলেন কেনো। এখন থেকে বাচ্চাদের আবৃত্তি ক্লাস আপনি নেবেন। আমি রুটিন করে দেব নতুন করে।

এরপর আরও কিছু পারফরম্যান্স হলো।‌ সবশেষে গান গাইতে উঠল আয়ান। রাত্রি জানতোইনা আয়ান যে গান গাইবে। গিটার হাতে মঞ্চে উঠতেই চারিদিক হাততালিতে মুখরিত হলো। অল্প সময়ে আয়ান সব স্টুডেন্টদের কাছে পপুলার হয়ে উঠেছে।

আয়ান উঠেই শুরু করল,

‘হাত খালি গলা খালি কন্যার নাকে নাকফুল’

রাত্রি বুঝল কেনো ওকে ওসব খুলতে বলেছে আয়ান। গানটা ওকে নিয়েই গাইছে। আয়ান তাকিয়ে আছে ওর দিকেই ।লজ্জামাখা আবেশে গানের সাথে ঠোঁট মেলাল রাত্রি। ভীষণ এক ভালো লাগা আচ্ছন্ন করল ওকে।

চারদিন পর গোধূলি সুযোগ পেলো সাব্বিরকে ফোন করার। ছুটির দিন তাই রাত্রি বাসায় ছিল। ও গোসলে ঢুকলে ওর মোবাইল নিয়ে সাব্বির কে ফোন করে ছোট করে সব ঘটনা জানাল।‌

সাব্বির বলল,

দেখি আমি দু’দিন এর মধ্যে সব ব্যবস্থা করে রাখব। তুমি পরশু একবার কল দিও যেভাবেই হোক।

গোধূলি লুকিয়ে স্কুলের ব্যাগে কিছু কাপড় আর টুকটাক দরকারি জিনিস নিয়ে রেখেছে। স্কুল ব্যাগে নিয়েছে যেন কেউ দেখলে ভাববে স্কুলে যাচ্ছে। মায়ের আলমারিতে একটা গলার হার,একজোড়া বাউটি আছে। ওটাও নেবে ঠিক করে রেখেছে।

এভাবে পালিয়ে গেলে এ বাড়িতে কেউ মানবে না। আর কিছু পাওয়ার আশাতো দূর, কোনদিন বাড়িতেই হয়ত ঢুকতে পারবে না। তাই ও ঠিক করল যা কিছু পারবে সাথে করে নিয়ে নেবে। মেয়ে হিসেবে ওরতো অধিকার আছে সবকিছুতে। এভাবে নিলেও অন্যায় কিছু হবে না।

গোধূলির গলাতে একটা দশ আনার চেইন আছে। একজোড়া ছোট্ট কানের দুল। এগুলো তো আছেই। মায়ের আলমারিতে তালা দেয়া থাকে না। বাড়িতে বাইরের লোক নেই তাই তালা দেওয়ার দরকার হয় না। মা গোসলে ঢুকলে ঐ সময় বাড়ি একদম ফাঁকা থাকে। তখন আলমারি থেকে নিতে হবে জিনিসগুলো। আর সব জিনিস গোছানোই আছে। টুক করে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যেতে পারবে।

সকালে রাত্রির ফোন থেকে কথা হয়েছে সাব্বিরের সাথে। সাব্বির সব ঠিক করে রেখেছে। গোধূলি বলে রেখেছে আজ দুপুরের পর বের হবে। সাব্বির সুপার মার্কেট যেতে বলেছে ওকে। ঐখানে অপেক্ষা করবে গোধূলির জন্য।

গোধূলির ভয় করছে না একটুও। বরং ভালোই লাগছে। একটু এডভেঞ্চার লাগছে বিষয়টা। আর এসব পড়াশুনা করতে হবে না। এতো কড়া শাসনে থাকতে হবে না। শুধু সাব্বির আর ও। সাব্বির নিশ্চয়ই বাবার মতো এতো রুড হবে না। মন দিয়ে সংসার করবে ও। ভালো বরতো পাচ্ছেই। মা বাবা থাকুক ওনাদের আদরের রাত্রিকে নিয়ে। ওরাও বুঝুক যে গোধূলি ফেলনা না। রুপ থাকলে আর কিছু লাগে না। এতো পড়াশোনা করেওতো আপার জন্য আনা বর ওকেই পছন্দ করল। ও কম না কোনো দিক থেকেই। শুধু এ বাড়ির লোকজন ওর কদর করলো না।

নাজমা কাজ শেষ করে শুয়ে পড়লেন। একটু পর গোসলে যাবেন। খুব ক্লান্ত লাগছে। বাড়িতে কেউ নেই এসময়। গোধূলি আছে, কিন্তু ঐদিনের পর থেকে তেমন কথাবার্তা বলে না।‌ সারাদিন নিজের ঘরে শুয়ে বসে কাটায়।

গোধূলি একবার মার ঘরে উঁকি দিলো। মা এখনো গোসলে যায়নি। ঘুমিয়ে পড়লে সমস্যা। আপার আসার সময় হয়ে যাবে। গোধূলি একটু পর আবার এলো ঘরে। এ কয়দিন মায়ের সাথে কথা বলেনি তেমন। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

মা ঘুমাও?

না শুয়ে আছি। কিছু বলবি?

বেলা হয়ে গেলো আর তুমি শুয়ে আছো। খুব ক্ষুধা পেয়েছে। তুমি গোসল করলে একসাথে খাব।

নাজমা উঠে বসলেন। এই কয়দিন মেয়ের সাথে ভালো করে কথা বলা হয়নি। মেয়েটা চুপচাপ ছিলো। আজ নিজে থেকে এসেই কথা বলছে। একসাথে খেতে চাইছে। ওনার খুব ভালো লাগছে।

আসলে সংসারে একজন যদি রাগ করে থাকে তাহলে সবার মনেই অশান্তি চলতে থাকে। বাবা মা সন্তানের ভালোর জন্য শাসন করেন এটা ঠিক, কিন্তু সন্তানের গায়ে হাত তুলতে কার ভালো লাগে?

এই যে মেয়েটা দোষ করল,ওকে বকতে মারতে ওনার কি ভালো লেগেছে? যত রাগই হোক ভেতর ভেতর মেয়ের জন্য তার খুব কষ্ট হয়। এই যে মেয়ে ভালো করে কথা বলছে কি যে শান্তি লাগছে। তিনি নিজেও হয়তো একটু বেশি খারাপ ব্যবহার করেছেন। এভাবে এতো শাসন না করে বুঝিয়ে বললেও তো পারতেন।

তিনি গোধূলিকে পাশে ডেকে বসালেন। মাথায় হাত বুলিয়ে ডুকরে উঠলেন।

আমার সোনা মা,কেনো এমন করিস মা। তুই আর রাত্রি ছাড়া আমাদের আর কে আছে বল। তুই ভালো করে পড়াশোনা কর। তারপর তোর যাকে পছন্দ হয় তার সাথেই বিয়ে দেব দেখিস। আমরাতো তোর শত্রু না, একমাত্র মা বাবাই নিঃস্বার্থ ভাবে সন্তানের ভালো চায়। তোদের খারাপ কিছু হলে তোর বাবা মরেই যাবে। মানুষটা সবসময় শুধু তোদের কথাই ভাবে।

আচ্ছা ঠিক আছে,বুঝেছি আমি। এখন যাওতো গোসল করে এসো। এসে আমাকে খাইয়ে দিবে আজ।

নাজমা বললেন,

তুই বস,আমি এখুনি গোসল করে আসছি।

আচ্ছা যাও। তাড়াহুড়ো করতে হবে না। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। তুমি আরাম করে গোসল সারো।

নাজমা গোসলে ঢুকতেই গোধূলি বাইরে থেকে বাথরুমের দরজার ছিটকিনি আস্তে করে লাগিয়ে দিলো। তারপর আলমারি খুলল। ড্রয়ার খুলেই গয়নাগুলো নিয়ে নিল। ড্রয়ারে একটা খাম চোখে পড়ল। খামটা হাতে নিয়ে দেখল এক বান্ডিল টাকা। টাকা কিসের গোধূলি বুঝলো না। বাবা তুলে এনেছেন বোধহয়। সাধারণত এতো টাকা আলমারিতে থাকে না। গোধূলি একটু ভেবে খামটা নিয়ে নিলো। জলদি করে গোছানো ব্যাগ আর জিনিসপত্র নিয়ে বের হয়ে পড়ল বাড়ি থেকে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে