অবেলার বকুল পর্ব-১৩

0
601

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-তেরো
মাহবুবা বিথী

অভিমানে বকুলের দু,চোখ বেয়ে বরষার বারিষধারা গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। আর মনে মনে আয়ানকে বললো,”আপনি তো আমাকে ভালোবাসতে পারলেন না। অথচ আমি যে ভালােবাসার চোরা স্রোতে ভেসে গেলাম। এখন এখান থেকে আমার পরিত্রাণের উপায় কি? অথচ আপনি আজও জেসিকাকে ভুলতে পারেননি। তাহলে শুধুমাত্র নিজের মায়ের কথায় আমাকে বিয়ে করা আপনার উচিত হয়নি।”
বকুল নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করলো। আসলে যার কপালে মায়ের ভালোবাসা জোটে না সে পৃথিবীর কারো ভালোবাসা পাবার যোগ্য হয়ে উঠে না। বকুল রাতে ডিনার না করেই শুয়ে পড়লো। ওদিকে আয়ান ও ডিনার করলো না। বকুলকে ভালোবাসতে ওর খুব ইচ্ছে হয়। কিন্তু দুরুত্বের দেয়ালটুকু তো ও নিজ হাতে তুলে দিয়েছে। সেটা ভেঙ্গে দিয়ে এই মুহুর্তে বকুলের কাছাকাছি আসতে ওর আত্মসম্মানে বাঁধছে। এদিকে এতোদিনপর জেসিকার ফোন ওকে অস্বস্তিতে ফেলছে। আয়ান নিজেও অবাক হয়েছে যে ও এখন ওর মোবাইলে জেসিকার নাম্বার সেভ করে রেখেছে। বকুল তো মনে হয় জেসিকার ব্যাপারটা জানে। কে,জানে এবার হয়তো দুরত্বটা আর একটু বাড়বে।আয়ান নিজ থেকেই এখন দুরত্বের দেয়ালটা ভাঙ্গতে চাইছে। কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। এসব নানা ভাবনায় বারান্দায় রকিংচেয়ারটায় বসে থেকে রাতটা পার করে দিলো। বকুল রুমে থেকেই বুঝতে পারছে আয়ান সারারাত বারান্দায় বসে ছিলো। ও রুমে নিকোটিনের গন্ধ অনুভব করছে। কারণ দুটোরুমের সাথেই বারান্দার সংযোগ আছে। আর আজই তাপমাত্রা ফল করলো। যদিও এতোদিন শীত অনুভূত হয়নি কিন্তু আজ যেন ভালোই শীত পড়েছে। ঠান্ডায় এভাবে খোলা বারান্দায় বসে থাকলে জ্বর হতে পারে। এই কারনে আয়ানকে রুমের ভিতরে চলে আসার জন্য বকুলের বলবার ইচ্ছে হল। পরক্ষণে অভিমানের আগুনে পুড়ে যাওয়া মনটা নিজেকে প্রবোদ দিলো। যার অন্তরে ওর জায়গা হয়নি তার জন্য এতো ভেবে লাভ কি? ভোরের দিকে বকুলের চোখ দুটো লেগে আসছে।
রাহেলা বেগম ডিনার করার জন্য আয়ান আর বকুলকে ডেকেছিলো। দুটোর কেউ খেতে না আসাতে উনারও মনটা খারাপ হয়ে গেল। উনি নিজেও কিছু মুখে তুলতে পারলেন। কে,জানে,উনার এই সিদ্ধান্তের কারনে না জানি দুটোজীবন নষ্ট হয়। এই ভাবনায় রাতে উনার দু,চোখে ঘুম এলো না। কেন যেন উনার মনটা কু গাইছে। তাই ফজরের নামাজ পড়ে উপরে চলে আসলেন। দরজা নক করার সাথে সাথে আয়ান এসে দরজা খুলে দিয়ে টলতে টলতে বিছানায় শুয়ে পড়লো। উনি দু,রুমে দু,জনের বিছানা দেখে বললো,
—-কিরে, তুই এ রুমে কেন?
—-ঐ রুমেই ছিলাম। শরীরটা খারাপ লাগছে। ঘুম আসছে না। এপাশ ওপাশ করছিলাম। ভাবলাম ওর ঘুম যদি ভেঙ্গে যায় তাই এই রুমে চলে আসছি।
আয়ান যতই অভিনয় করে বলুক না কেন রাহেলা বেগমের অভিজ্ঞ চোখ অনেক কিছুই বুঝে ফেললো। আয়ানকে ওভাবে বিছানায় শুয়ে পড়তে দেখে কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। এখনকার জ্বরগুলো ছোঁয়াচে। দু,দিন আগে বকুলের জ্বর হলো এখন আবার আয়ানের জ্বর আসছে।
—এতো জ্বর শরীরে আমাকে ডাকলেই পারতি। আমি তো রাতে প্রায় জেগেই থাকি। ফাস্ট এইড বক্সটা কোথায়? জ্বরটা মেপে দেখতে হবে।
—-দেখো, টেবিলের উপর রাখা আছে।
একথা বলেই আয়ান জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। রাহেলা বেগম তাড়াতাড়ি ফাস্ট এইড বক্স খুলে থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে দেখলেন। ১০৪ড্রিগ্রী। ফোন দিয়ে সায়ানকে ডাক্তার ডেকে আনতে বললেন। রাহেলা বেগম ছেলের এই অবস্থা দেখে হাউমাঁউ করে কাঁদতে লাগলেন। উনার কান্নার শব্দে বকুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। বকুল এরুমে চলে এসে রাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-মা,কি হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেন?
—দেখনা,আমার ছেলেটা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। জ্বরে ওর শরীর পুড়ে যাচ্ছে।
বকুল ওয়াশরুমে গিয়ে এক বালতি পানি নিয়ে আসলো। এরপর ওকে আড়াআড়ি শুয়ে দিয়ে মাথার নিচ থেকে বালিশটা সরিয়ে প্লাস্টিকের ক্লথ বিছিয়ে দিলো। তারপর একটানা একঘন্টা ওর মাথায় পানি ঢাললো। জ্ঞানটাও ফিরে আসলো। চোখ মেলে তাকাতে রাহেলা বেগম ছেলের মুখের উপর ঝুঁকে বললেন,
—-এখন কেমন আছিস বাবা?
—-ভালো, আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি একটু ঘুমাবো।
একথা বলে ও আবার চোখটা বন্ধ করলো। সায়ান ততক্ষণে ডাক্তার নিয়ে এসেছে। ডাক্তারকে দেখে রাহেলা বেগম বললেন,
—-দেখুন না ডাক্তার সাহেব,আমার ছেলের কি হলো? রাতেই তো আমার ছেলে পুরো সুস্থ ছিলো।
—-এতো অস্থির হবেন না। আমাকে আগে রোগী দেখতে দিন।
মাকে এভাবে অস্থির হতে দেখে সায়ান বললো,
—আম্মু তুমি এভাবে প্যানিক করো না,জ্বর বেশী আসাতে মনে হয় ভাইয়া জ্ঞান হারিয়েছিলো।
জ্ঞান ফিরে আসাতে বকুল শুকনো টাওয়েল দিয়ে ভালো করে মাথা মুছে দিলো। এরপর গামছা ভিজিয়ে দু,হাত পিঠ,বুক পায়ের তলা সব মুছে দিলো। থার্মোমিটার দিয়ে মেপে দেখলো জ্বর১০২ড্রিগ্রী। ডাক্তার আয়ানকে দেখে বললো,
—-ঠিক সময়ে ওর মাথায় পানি ঢালা হয়েছে। না,হলে অনেক বড় ক্ষতি হতে পারতো।
কিছু টেস্ট আর ওষুধ দিয়ে ডাক্তার চলে গেল। সায়ান ডাক্তারকে এগিয়ে দিয়ে ওষুধ আনতে ফার্মেসীতে চলে গেল। রাহেলা বেগম বকুলের নার্সিং এ খুশী হয়ে ওকে বললেন,
—আল্লাহপাক তোকে স্বামী সুখে অনেক সুখী করুন। ভাগ্যিস তোর মাথাটা ঠিকভাবে কাজ করছিলো। আমার তো তখন মাথা কাজ করছিলো না। তুই ওর কাছে একটু বস। আমি সুপ বানিয়ে নিয়ে আসি।
রাহেলা বেগমের কথা শুনে বকুল মনে মনে বললো,ও এই কপাল নিয়ে পৃথিবীতে আসেনি যে স্বামীর সংসারে সোহাগিনী হয়ে রাজ করে বেড়াবে।
বকুলকে বসিয়ে রেখে রাহেলা বেগম নিচে চলে গেলেন। আয়ান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। বকুল এক দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর আয়ানের মাথার চুলে বিলি কেটে দিলো। একসময় বকুল আয়ানের কাছ থেকে উঠে যেতে চাইলে পিছন দিক থেকে ওড়নায় টান পড়ে। তাকিয়ে দেখে আয়ান বিছানা থেকে উঠে বসে ওড়নাটা টেনে ধরেছে। বকুল এপাশ থেকে ওড়নাটা টেনে ধরে কিছু বলার আগেই আয়ান হ্যাঁচকা টান মেরে বকুলকে নিজের বুকের দিকে টেনে নিলো। বকুল টাল সামলাতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,
—জ্বর শরীরে কি শুরু করেছেন?
—-কিছুই তো শুরু করিনি
—-ছাড়ুন আমাকে, সারারাত বারান্দায় বসে জ্বর বাঁধাতে কে বলেছে?
—-জ্বর না বাঁধালে জানাই হতো না তোমার ভালোবাসার গভীরতা। জংলী রানি, ছাড়ার জন্য তো ধরিনি। তুমি আমার কলেমা পড়া বউ। সুতরাং এই ধরাতে কোনো অন্যায় নেই।
—কে বলেছে আমি আপনাকে ভালোবাসি? আমি আপনার কলেমা পড়া বউ এতোদিন এটা আপনার মনে ছিলো না?
—ভালো না বাসলে এভাবে মাথায় পানি ঢাললে কেন?আমি মরে যেতাম। এতে তোমার কি এমন ক্ষতি হতো।বরং আপদ বিদেয় হতো।
বকুল আয়ানের মুখটা চেপে ধরে বললো,
—আর এভাবে মৃত্যু কথা বলবেন না। আমাকে কষ্ট দিলে মনে হয় আপনার খুব সুখ লাগে তাই না? তাহলে আমার জ্বরের সময় আপনাকে কে বলেছিলো সেবা করতে?
—-কে,কাকে কষ্ট দেয়? তুমি তো কাছে আসার সুযোগই দাও না?
—-হুম, সব দোষ তো এখন আমার। আপনি তো আমাকে কাছে টানেননি।
—যদি সত্যিকথা বলি তোমাকে প্রথমদিন থেকে ভালোবেসে ফেলেছি। তবে কি জানোতো,ঘর পোড়া গরু সিঁদূরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। কাছে টানতে তো ইচ্ছে হতো। পরক্ষণে ভাবতাম, ভালোবাসলে কষ্ট পেতে হয়। এর থেকে দূরে থাকাই ভালো। কিন্তু আজ আর নিজেকে তোমা থেকে দূরে রাখতে পারলাম না।
বকুলের চোখ দিয়ে এতোদিনের সঞ্চিত ব্যথার মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়তে শুরু করলো। আয়ান টিসু দিয়ে ওর চোখটা মুছে দিয়ে বললো,
—আজ আমার আদরের স্রোতে তোমার সব অভিমানের জল ভেসে যাবে।
তারপর আয়ান বকুলের মুখের পানে নিজের ভালোবাসার দৃষ্টি মেলে ধরলো। লজ্জ্বায় আর কিছুটা ভয়ে বকুল চোখ দুটি বন্ধ করে ফেললো। বকুলের মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিয়ে কপালে ভালোবাসার চুম্বন এঁকে দিলো। একে একে বকুলের চোখ, চিবুকে আয়ান ওর ঠোঁট জোড়া ছুঁয়ে দিলো। বকুল আজ আর কোনো বাঁধা দিলো না। সবশেষে আয়ান বকুলের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট জোড়া ডুবিয়ে দিয়ে খুব শক্ত করে আলিঙ্গন করলো। এতোদিন ধরে জমে থাকা দ্বিধা আর অভিমানের মেঘ কেটে গিয়ে ওদের হৃদয়াকাশে ভালোবাসার সূর্যটা উঁকি দিলো। দুটোমানব মানবী প্রণয়ের টানে নিজেদের জড়িয়েছিলো। হঠাৎ কাশির শব্দে ওরা সম্বিত ফিরে পেলো।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে