#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-দশ
মাহবুবা বিথী
বকুলকে গাড়িতে উঠিয়ে গাড়ির দরজাটা খুব জোরে লাগিয়ে দিলো। সেই শব্দে বকুলের সহপাঠি ছেলেটার শ্রবনইন্দ্রিয় চমকে উঠলো।
বকুল ভাবছে,ওতো তেমন কিছুই করেনি। শুধু একটু হেসে হেসে কথা বলেছে। এতে ওর কি অন্যায় হলো বকুল বুঝতে পারলো না। কিংবা ওর বর আয়ানের কোথায় লাগলো সেটা ও আন্দাজ করতে পারছে না। অথচ এই আয়ান ওকে বাসর রাতে বলেছিলো,” তুমি আমার কাছে কোনোদিন স্বামীর ভালোবাসা আশা করো না।”বকুল আয়ানের আচরণে তব্দা খেয়ে গেল।
আয়ান গাড়িতে বসে সিট বেল্টটা বেঁধে নিলো। গাড়ি চালাতে শুরু করলো। বকুল জানালা দিয়ে বাইরের তাকিয়ে দেখে মুক্ত আকাশে নাম না জানা পাখিগুলো ডানা মেলে উড়ছে। ও দেখে মনে মনে ভাবলো, ওর ইচ্ছা ছিলো ঐভাবে বলাকাদের মতন স্বাধীনভাবে উড়তে। অথচ এই মানুষটার কারনে ওকে খাঁচায় বন্দী হতে হলো। ফার্মগেট থেকে মোহাম্মদপুর খুব বেশীদূর নয়। আয়ান বেশ তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেল।
তারপর গাড়ি থেকে নেমে এতো জোরে গাড়ির দরজা লাগিয়ে দিলো যে রাহেলা বাসার ভিতর থেকে সেই শব্দ শুনে অবাক হলো। এরপর গাড়ি দরজা খুলে বকুলের হাত ধরে টেনে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। রাহেলা জানালা দিয়ে এই দৃশ্য দেখে চিন্তিত হয়ে ভাবতে লাগলো, “ঐ দুটির মাঝে কি ঘটলো কে জানে?”
আয়ান খুব শক্তভাবে বকুলের হাত ধরেছিলো। এতে কাঁচের চুড়ি ভেঙ্গে হাত কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এরপর বকুলকে খাটে বসিয়ে দিয়ে আয়ান চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলো,
—দু,মাস হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে, কোনোদিন তো দেখলাম না আমার সাথে বত্রিশ পাটি বের করে কথা বলতে? এমন ভাবে থাকো যেন একটা রোবট। আমার ধারণা ছিলো তুমি মনে হয় হাসতে জানো না।
আয়ানের কথাগুলো শুনে বকুল যেন আকাশ থেকে পড়লো। কারন আয়ান নিজের হাতেই তো ভালোবাসার আদান প্রদানের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে। তবে আজ কেন এই দরজাটা ও খুলতে চাইছে। বকুল ভাবছে, তবে কি ও আয়ানের মোহ নাকি অভ্যাস অথবা অধিকারবোধ।
—-কি ব্যাপার এখন তো দেখছি বোবা হয়ে গিয়েছো?
—-আমি কার সাথে হাসবো কার সাথে কাঁদবো এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনি কেন এর মাঝে নাক গলাতে চাইছেন?
—-ঐ তো একটা জিনিস ই ভালো করে জীবনে আয়ত্ব করেছো। আর তা হচ্ছে লম্বা চওড়া কথার ফুলঝুড়ি। বিবাহিত নারী হয়ে পরপুরুষের সাথে ঢলাঢলি করতে তো ভালোই লাগে। কেউ চরিত্রের দোষ ধরতে পারবে না। নিজের এই অপকর্মের সুবিধার জন্য স্বামী নামক সাইনবোর্ডটি তো ঝোলানো আছে তাই না?
এ কথাগুলো বলে আয়ান রুম থেকে বের হয়ে পাশের রুমে চলে গেল।
গোধুলী নেমে এসেছে। হেমন্তিকার দিনের আলো নিভে গিয়ে রাত্রির অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। স্বামীর কাছে অপমানিত বকুলের দুচোখ দিয়ে বাদলের ধারা বইছে। বকুল বিছানায় ওর শরীরটা এলিয়ে দিলো। হাতটা কেটে যাওয়াতে বেশ ব্যথা করছে। ইচ্ছে হচ্ছে না ফাস্ট এইড বক্স থেকে মেডিসিন নিয়ে লাগাতে? বকুল শুয়ে শুয়ে ভাবছে বিয়ে হয়েছে দু,মাস আয়ান কি ওকে পরিপূর্ণ স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছে? আয়ানের এই আচরণটা বকুলকে কতটা ব্যথিত করে তার খোঁজ কি কখনও ও নিয়েছে। অথচ আজ নিজের অধিকারবোধ ফলাতে এসেছে।
আয়ানের নিজের রুমে এসে খুব খারাপ লাগছে। এতো কঠিন কথাগুলো বলে বকুলকে ও আঘাত করতে চায়নি। কিন্তু ওকে ওভাবে ঐ ছেলেটার সাথে কথা বলতে দেখে ওর প্রচন্ড রাগ হলো। নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে কথার তিক্তবাণে বকুলকে আঘাত করে গেল। অথচ মেয়েটা স্ত্রী হিসাবে আয়ানের প্রতি সব দায়িত্ব নিরবে পালন করে যায়। আয়ানের কাপড় লন্ড্রী করে আনা থেকে শুরু করে অফিসের টিফিন সব নিজ দায়িত্বে করে। ওতো পারে না ওর বাবা মাকে সঙ্গ দিতে। সায়ান ওর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু বকুল ওর বাবা মাকেও company দেয়। বিশেষকরে ওর বাবা খুব ফুরফুরে মেজাজে থাকে। অথচ মেয়েটাকে ও নোংরা কথাগুলো বলে আহত করলো। আয়ান এখন অপরাধবোধে ভুগছে। আর বকুলের প্রতি ওর আজকের আচরণ দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল। তাইতো বকুল তো ঠিক কথাই বলেছে। ও কার সাথে হাসবে কার সাথে কাঁদবে একান্তই ওর ব্যাপার। তবে কি ও বকুলকে আস্তে আস্তে ভালোবেসে ফেলছে। নাকি কলেমা পড়ে কবুল বলাতে ওর উপর অধিকারবোধ ফলাতে ইচ্ছে হয়েছে। অথচ ওতো নিজেই ওর আর বকুলে মাঝে সযতনে দুরুত্বের দেয়াল তুলে দিয়েছে। আজ কেন সেই প্রাচীর এই মনটা ভেঙ্গে ফেলতে চাইছে? বড় রহস্যময় মানুষের মন।
পাশাপাশিরুমে দু,জন নরনারী বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ। এদের মাঝে একজন আস্তে আস্তে প্রেম যমুনায় ডুবতে শুরু করেছে আর একজন অভিমানের দেওয়ালটা আরো শক্ত করে গেঁথে তুলতে চাইছে। ওরা জানে না ওদের ভাগ্যে কি লেখা আছে। আর এই সম্পর্কের শেষ পরিনতি বা কি?
মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হয়েছে। আয়ান ওজু করতে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় বিছানায় শুয়ে থাকা বকুলের দিকে দৃষ্টি চলে গেল। আসলে দুটো রুমের মাঝে একটা ওয়াশরুম। ওয়াশরুমে যেতে হলে আয়ানকে এ রুমে আসতে হয়। হঠাৎ চোখ পড়লো বকুলের হাতের উপর। তখনও রক্তে জায়গাটা ভেজা আছে। বকুল কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আয়ান ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এসে বকুলের হাতটা ভালো করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলো। বকুলের মুখের দিকে চোখ পড়তেই ও দৃষ্টি ফেরাতে পারলো না। গোলাপী ঠোঁট জোড়া ওকে যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে চাইলো। হঠাৎ বকুল পাশ ফিরতে আয়ান ওখান থেকে সরে আসে। ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে মাগরিবের নামাজটা আদায় করে নেয়।
এদিকে সন্ধের চা খেতে বকুল নীচে নামেনি দেখে রাহেলা বেগম নিজেই উপরে এসে বকুলকে ডেকে বললেন,
—-উঠে পড় বকুল। নীচে আয়। আমি টেবিলে ডিনার দিয়ে দিচ্ছি।
একথাগুলে বলে রাহেলা নীচে চলে গেল। বকুল ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলো। নিজের হাতে ব্যান্ডেজ দেখে একটু অবাক হলো। মনে মনে আয়ানকে বললো,”জুতো মেরে গরু দান করতে কে বলেছে আপনাকে?”
বকুল নিচে নেমে সবার সাথে ডিনার করতে বসলো। ওর হাতে ব্যান্ডেজ দেখে রাহেলা আঁতকে উঠে বললেন,
—-এ বিপদ আবার কখন ঘটলো?
আয়ান বকুলের দিকে তাকিয়ে আছে। বকুল ওর দিকে না তাকিয়ে বুঝতে পারছে আয়ান এ বিষয়টা নিয়ে অস্বস্তিতে আছে। বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বকুল বললো,
—-তেমন কিছু না। চুড়িটা খুলতে গিয়ে ভেঙ্গে ফেলেছি। ভাঙ্গা চুড়িটা দিয়েই জায়গাটা একটু কেটেছে। ফাস্ট এইড দিয়েছি সেরে যাবে।
আয়ান কিচেনে গিয়ে চামচ নিয়ে এসে বকুলের হাতে দিলো। রায়হান খেতে খেতে বললো,
—-এরকম হলে সাবান নয়ত তেল মাখিয়ে নিও। তা
হলে খুলতে সুবিধা হবে।
কেন যেন আয়ানের নোংরা কথাগুলো ওর কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অভিমানের বর্ষণগুলো দলা পাকিয়ে গলার কাছে আটকে আছে। যে কোন মুহুর্তে বাদলের ধারা হয়ে দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে পারে। তাই কোনো রকমে দুটো ভাত মুখে পুরে খাওয়া শেষ করে ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। রাহেলা বকুলের মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। তাই আর জোর করেনি। তবে নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলেকে পর্যবেক্ষন করতে লাগলো। বকুল ভালোমতো না খাওয়াতে আয়ানও তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে উঠে পড়লো।
পাশাপাশি রুমে দুটোমানুষ বিনিদ্র রাত্রি যাপন করছে। বড়ই অদ্ভুত এই পৃথিবী। তার থেকে অদ্ভুত মানুষের মন পাখি। কখন যে কার আকাশে সে উড়ে নিজেই জানে না। এই অদ্ভুত মন পাখিটা মাঝে মাঝে ইগো দ্বারা শাসিত হয়। তখনই ঘটে যতো বিপত্তি। বাসর রাতে আয়ানের বলা কথাগুলো যেমন বকুলের ইগোতে লেগেছে তেমনি আয়ান নিজের ইগোর বেড়াজালে আটকে ছটফট করছে। পারছে না ইগোর দেয়াল ভেঙ্গে দিয়ে বকুলকে নিজের বুকের পশমে জড়িয়ে নিতে। আয়ানের চোখটা একটু লেগে এসেছিলো। হঠাৎ রাত গভীরে গোঙ্গানীর শব্দে আয়ানের ঘুম ভেঙ্গে গেল।
চলবে