#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-আট
মাহবুবা বিথী
রিক্তা ওদের দু,জনকে ইশারায় কথা বলতে দেখে খুব খুশী হলো। ওর ফুফুকে একটা পজেটিভ নিউজ দিতে পারবে এটা ভেবে মনে মনে রিক্তার ভীষণ ভালো লাগলো। চা নিয়ে আসার সময় রাহেলা রিক্তাকে বলেছিলো,
” রিক্তা একটু খেয়াল করে দেখে আসিস ওদের মাঝে সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা? ছেলেটাকে আমি একরকম জোর করেই বিয়ে দিলাম। বকুলকে মানিয়ে নিতে পারবে কিনা কে জানে। আর বকুলও কি আয়ানের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে?”
রিক্তা চা নাস্তা পৌঁছে দিয়ে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে আসলো। আয়ানের জন্য রিক্তার ভীষণ মায়া হয়। ওর লাইফে এরকম একটা ঘটনা ঘটে যাওয়াতে বেচারা একটা মানসিক ট্রমার মধ্যে ছিলো। আয়ানকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে রাহেলাও ওর সাথে স্ট্রাগল করে গেছে। এই ঘটনাগুলো রিক্তা জানে। যদিও রিক্তার মা আয়ানের সাথে ওর বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু রিক্তা চায়নি। রিক্তা ছোটোবেলা থেকে আয়ানকে নিজের ভাইয়ের মতো দেখে আসছে। ওর তো কোনো ভাইবোন নেই। রিক্তা ওর বাবা মায়ের একমাত্র সম্তান। বড় ভাইয়ের স্থানটা ও আয়ানকে দিয়েছে। তাই আয়ানের এই কষ্টটা রিক্তাকেও অনেক আহত করে। ও মন থেকে চায় আয়ান আর বকুল যেন অনেক সুখী হয়। এজন্য ওদের দু,জনকে এভাবে ইশারায় কথা বলতে দেখে ওর মনটাও আবেগে আপ্লুত। তাই আর দেরী না করে ফুফু রাহেলার কাছে চলে গেল। রাহেলা তখন সবাইকে নিয়ে নাস্তার টেবিলে বসেছে। রিক্তাকে দেখা মাত্রই রাহেলার চোখ দুটো উৎসুক হয়ে উঠলো। রায়হানও কিছু শোনার অপেক্ষায় রিক্তার মুখের দিকে চেয়ে থাকলো। রিক্তা বেশ উৎফুল্ল হয়ে রাহেলাকে বললো,
—-আয়ান ভাইকে নিয়ে আর চিন্তা করো না। দেখো খুব শীঘ্রই আয়ান ভাইয়ের জীবন থেকে বিষাদের মেঘ কেটে যাবে।
রিক্তার কথার সাথে তাল দিয়ে সাইফুল বললো,
—-আমাদের বকুলের ও মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আছে। তুই ওদেরকে নিয়ে আর ভাবিস না। রাহেলা তাড়াতাড়ি নাস্তা করে ফেল। পিঠাগুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
—-ভাইয়া বাবুর্চির রান্না কতদূর?রিক্তা তুইও খেতে বস।
—-তোমরা খেয়ে নাও। আমি আম্মুর সাথে খেয়ে নিবো।
—–রান্না প্রায় শেষ হয়ে আসছে। ভোর থেকে রান্না শুরু করেছে। রাতেই গরু আর খাসীর মাংস কিনে রেখেছিলাম। মুরগী আর পোলাওয়ের চাল মশলাপাতি সকালে কিনে এনেছি।
রায়হান খেতে খেতে সাইফুলকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-ডেজার্টের আইটেম রাখেননি ভাইয়া?
—-পায়েস রাঁধতে বলেছি।
সায়ানের দিকে তাকিয়ে সাইফুল বললো,
—-ছোটো ভাগনে মফস্বল শহরের বিয়ে কেমন লাগছে?
—-মন্দ না।
সাইফুল তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বললো,
—-আমি বাবুর্চির কাছে যাই। তাগাদা না দিলে দেরী করে ফেলবে। গ্রামের দু,একজনকে দাওয়াত দিয়েছি। ডেকোরেটর থেকে লোক চলে আসবে। উঠোনে খাওয়ার ব্যবস্থা করবো। আমিনুল রংপুর থেকে রওয়ানা দিয়েছে।
জরিনা কিচেন থেকে চা বানিয়ে টেবিলে দিয়ে বললো,
—আয়ানের বিয়ে উপলক্ষ্যে অনেকদিন পর বাড়িটা জমজমাট হলো।
চা খাওয়া শেষ করে সাইফুল বাবুর্চির কাছে চলে গেল।ওদিকে আয়ান আর বকুল নিজেদের রুমে নাস্তা করে নিলো। আয়ান খাওয়া শেষ করে বকুলকে বললো,
—আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।
—-বলুন,আমি শুনছি।
—-আমার ডিভোর্সের ব্যাপারটা তোমার নিশ্চয় জানা আছে।
—-হুম,
—-আমার সেই ক্ষতটা এখনও পরিপূর্ণ সেরে উঠেনি। তাই আর কাউকে এতো তাড়াতাড়ি নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নিতে চাইনি। আব্বু অসুস্থ হয়ে যাওয়াতে বাধ্য হলাম। আসলে জোর করে কি ভালোবাসা হয়?
—-জানি জোর করে ভালোবাসা হয় না। তবে যে চলে যায় তার জন্য নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না। সে যদি সত্যি ভালোবাসতো তাহলে আপনাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে যেতে পারতো না। যে সম্পর্কগুলো নড়বড়ে ভিতের উপর তৈরী হয় সেগুলো যতো তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে যায় ততই ভালো। সারাজীবন কষ্ট পাওয়ার চেয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসাটা আমার কাছে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়।
আয়ান এই পুঁচকে মেয়েটার মুখে ভারী ভারী কথাগুলো শুনে অবাক হলো। মনে মনে ভাবছে জন্মের পর মাকে হারিয়ে মেয়েটা একা একা বড় হয়েছে। যদিও ওর বাবা ওর দাদী সাথে ছিলো কিন্তু মায়ের জায়গাটা তো শুন্যই ছিলো।সেই শুন্য স্থানটার কারনে ওর ম্যাচিউরিটি এতো বেশী। যাই হোক আয়ান ভাবছে ওকে একটা কথা জানানো দরকার। গলাটা একটু কেশে পরিস্কার করে নিয়ে বললো
—-বকুল, আমি তোমাকে এখন যে কথাটা বলবো তুমি শুনে হয়তো কষ্ট পাবে। তারপরও আমার তোমাকে কথাটা জানানো উচিত। আমি তোমার লোকদেখানো স্বামী হিসাবে তোমার প্রতি আমার সব দায়িত্ব পালন করে যাবো। তুমি ও আমার প্রিয়তম স্ত্রীর ভুমিকায় অভিনয় করে যাবে। তুমি যতদূর লেখাপড়া করতে চাও আমি তোমাকে সাপোর্ট দিবো। তবে স্বামীর ভালোবাসাটুকু তোমায় কোনোদিন দিতে পারবো কিনা জানি না।
বকুল ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে বিছানায় বসে আয়ানের কথাগুলো চুপচাপ শুনছিলো। আয়ান ওর নিরবতার প্রাচীরটা ভেঙ্গে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—-তুমি কিছু বললে না?
—-আসলে আমি বিশ্বাস করি যেটা আমার সেটা আমার কাছ থেকে কেউ কোনোদিন কেড়ে নিতে পারবে না। পরমকরুনাময় আল্লাহপাক আমাকে আজ অথবা কাল ঠিক দিয়ে দিবেন। কিন্তু যেটা আমার নয় তার জন্য হাজারবার মাথা ঠুকলেও সেটা কখনও আমার হবে না। তাই আপনার এই কথাগুলো শুনে আমার বলার কিছু নাই।
আয়ান মনে মনে বকুলের উপর খুশী হলো। ওর কাছে বকুল তেমন কিছু আশা করে না সেটা ভেবে নিজেকে বেশ ভারমুক্ত মনে হচ্ছে। বকুলের আয়ানের দিকে তাকিয়ে মনে হলো ওর মুখ থেকে এ কথাগুলো শোনার পর একটা রিল্যাক্স ভাব আয়ানের বডিল্যাঙ্গুয়েজে ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ বকুলের বুকের ভিতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। ও ভাবছে কি ভাগ্য নিয়ে ও পৃথিবীতে আসছে! জন্মের পর থেকে মায়ের ভালোবাসা পায়নি আবার বিয়ের পর স্বামী নামক মানুষটি ওকে বলছে,ও যেন কখনও স্বামীর ভালোবাসার প্রত্যাশা না করে? নিজের এই দুর্বলতা আয়ানের সামনে প্রকাশ করলো না। তবে মনে মনে আয়ানকে বললো, “মিস্টার জীবনটাকে আপনি সিনেমা কিংবা নাটক পাননি। আপনি আমাকে ন্যাঁকা ন্যাঁকা করে সিনেমার ডায়লগ বলবেন আমিও নায়িকা শাবানার মতো নাকের জল চোখের জল এক করে আপনার ভালোবাসা পাবার প্রত্যাশা করে যাবো। সেই মানুষ আমি নই। হয়তো একদিন এমন মুহুর্ত আসবে আমাকে ভালোবাসা দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করবেন”।
এই মুহুর্তে বকুল বাহ্যিকদিক থেকে কঠিনভাব বজায় রেখে বললো,
—-আমাদের মনে হয় এখন রুম থেকে বের হওয়া উচিত।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আয়ান বললো,
—-তা ঠিক,সকাল দশটা বাজতে চলেছে।
ওরা দু,জনে বেশ হাসি হাসি মুখ করে ঘর থেকে উঠোনে বেরিয়ে আসলো। ওদেরকে এভাবে দেখে রাহেলার চোখটা ভিজে গেল। রিক্তা মুচকি হেসে বকুলকে বললো,
—-ভাবী ভাইয়াকে নিয়ে নদীর পাড়টা ঘুরে এসো। তোমার তো আবার তিস্তার সাথে জন্ম জন্মান্তরের প্রেম। আজ তো শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছো। তোমার প্রেমিকের কাছে বিদায় নিয়ে এসো।
—-কিযে বলোনা রিক্তাপু,তোমার মুখে কোনো লাগসম নেই। কখন যে কি বলে ফেলো তার কোনো ঠিক নাই।
রাহেলা বুঝতে পারলো বকুল রিক্তার কথায় খুব লজ্জা পেয়েছে। তাই সংকোচটাকে আড়াল করতে বকুলকে বললো,
—-এতে লজ্জা পাবার কিছুই নাই। তিস্তাকে আমিও খুব ভালোবাসি। বলতে পারিস ও আমার জীবনের প্রথম প্রেম। আয়ানকে নিয়ে তিস্তার পাড়টা ঘুরে আয়।
আয়ান বকুলের সাথে ঘুরতে যাওয়ার সময় সায়ানকে ডেকে বললো,
—-,গাড়িটা ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে রাখিস। আজকে আবার গাড়ি নিয়ে ঢাকায় যেতে হবে।
—-আমি একা একা গাড়ি ধুইতে পারবো না। তোমাকে সাহায্য করতে হবে।
আয়ান কিছু বলার আগেই রিক্তা বললো,
—আমি তোমাকে সাহায্য করবো। উনারা ঘুরতে চলে যাক।
আয়ান আর বকুল হেঁটে হেঁটে তিস্তার পাড়ের দিকে চলে আসলো। বালুর উপর দিয়ে দু,জন হাঁটছে। চওড়া বিশাল নদী। স্রোতগুলো পাথরে ধাক্কা খেয়ে কলকল শব্দ করে বয়ে চলছে। পাশাপাশি দুটো মানুষ মৌনতার চাদরে পরিবেশটা যেন ঢেকে রেখেছে । হঠাৎ জোরে বাতাস বয়ে যাওয়ার কারনে ধুলো উড়তে শুরু করলো। আয়ানের চোখে সানগ্লাস থাকার কারনে ওর কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু বকুলের চোখে বালু ঢুকে যাওয়াতে ও কিছুই দেখতে পারছিলো। যন্ত্রণায় ছটফট করছিলো। ওর কষ্ট দেখে আয়ান কাছে এসে বললো,
—-টিসু দিয়ে আমি তোমার চোখটা পরিস্কার করে দিচ্ছি।
এ কথা বলে আয়ান একদম বকুলের কাছে চলে এলো। একটা পুরুষালী সুবাস বকুলকে যেন আচ্ছন্ন করে ফেললো। আয়ান ওর আঙ্গুল দিয়ে বকুলের চোখ স্পর্শ করাতে ওর শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। আয়ান ওর চোখটা একটু ফাঁক করে টিসু দিয়ে ময়লা ক্লিন করে দিলো আর ফুঁ দিতে লাগলো। আয়ানের মুখ দিয়ে বের হওয়া গরম বাতাসে বকুলের পুরো শরীরে শিহরণ খেলে গেল। বকুল যেন ওর বুকের ভিতরে লাগামছাড়া হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনতে পারছে। আয়ান যেন এই মুহুর্তে পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দর চোখ দুটোর মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাইছে।
চলবে