#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
#পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী
এদিকে দুপুরের খাওয়া শেষ করে সবাই ড্রইং রুমে বিয়ের আলাপচারিতায় বসলো। আয়ানের সামনে বিয়ের বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইছেন না। তাই কৌশলে রাহেলা বেগম বকুলের বাবাকে বললেন,
——হামিদুর ভাই আয়ান আর বকুলের একটু নিজেদের মধ্যে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিলে ভালো হয়। ওদের দু,জনের নিজেদের মধ্যে অনেক কথা বলার থাকতে পারে।
রাহেলা বেগমের কথা শুনে হামিদুর মা আসমা বেগমের মুখের দিকে তাকালেন। আয়ান রাহেলা বেগমের এ কথা শুনে মনে মনে খুশী হলো। কারন ও যে বিয়েটা নিজের ইচ্ছে করতে আসেনি এটা বকুলকে জানানো দরকার। স্ত্রীর সব দায়িত্ব ও পালন করবে শুধু স্বামীর ভালোবাসা দিতে পারবে না।আসমা খাতুন আয়ানকে সাথে নিয়ে বকুলের রুমে পৌঁছে দিয়ে বললো,
——তোরা দুজনে কথা বল। আমার একটু ব্যস্ততা আছে।
আসমা বেগম আয়ানকে বকুলের রুমে পৌঁছে দিয়ে ড্রইংরুমে এসে বিয়ের আলোচনাতে অংশ নিলো।
আয়ান বকুলের রুমে এসে অবাক হয়ে গেল। খুব সুন্দর পরিপাটি করে ঘরটা গুছিয়ে রাখা হয়েছে। খাটে বুটিকের একটা চাদর বিছানো আছে। চাদরের সাথে ম্যাচ করে জানালার পর্দা লাগানো হয়েছে। পড়ার টেবিলের বইগুলো খুব সুন্দর করে গোছানো আছে। রুমে একটা রকিং চেয়ার আর একটা নরমাল চেয়ার আছে। একটা ওয়াড্রোব আছে। ওয়াড্রোবের উপর তাজা ফুলের তোড়া ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা আছে। মানিপ্লান্ট গাছের ঝাড় আর একটা ফুলদানিতে পানি দিয়ে রাখা আছে। রুমটাতে ফুলের হালকা মিষ্টি সুবাস ভেসে বেরাচ্ছে। বকুল খাটের এক কোনায় বসে আছে। আয়ানও খাটের এক কোনায় বসে পড়লো। রুমের ভিতরে শুনশান নিরবতা। আয়ান বকুলের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, “এখন দেখে মনে হচ্ছে ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। কিন্তু তখন যা তেজ দেখালো এই চেহারার সাথে তো সেই চেহারা মেলানো যাচ্ছে না। তবে সাধারণ পোশাকে মেয়েটাকে ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগছে”। যাই হোক নিরবতা ভঙ্গ করে আয়ান বললো,
—–আম্মু চেয়েছে বলে আমি আসলে তোমাকে বিয়ে করতে আসছি। স্ত্রী হিসাবে আমি তোমার প্রতি সব দায়িত্ব পালন করে যাবো তবে এর_____র
আয়ানের মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই বকুল স্বমূর্তি ধারণ করে বললো,
—–এই যে মিস্টার এসব ফালতু কথা আমার সাথে বলবেন না। দামড়া বেটা হয়ে এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন ফিডারে দুধ খান। আজ বলবেন মায়ের ইচ্ছায় বিয়ে করতে আসছেন কাল বলবেন মায়ের ইচ্ছায় বাচ্চা পয়দা করতে আসছেন এসব ফাউল কথা আমার সাথে বলবেন না। যা বলবেন ঝেড়ে কাশবেন। আর মায়ের ইচ্ছায় বিয়ে করতে আসলে বিয়ে বন্ধ করেন। আপনাকে বরের মাল্য দেওয়ার আমার এতো দায় পড়েনি।
——এই মেয়ে ক বললে তুমি কলা বুঝো কেন? একটু বেশী বুঝার চেষ্টা করো। নির্লজ্জ্বের মতো বাচ্চা পয়দা করার কথা বলতে তোমার মুখে আটকালো না। নাকি আমার মতো স্টাবলিস ছেলে দেখে ঘাড়ে সওয়ার হওয়ার লোভ সামলাতে পারলে না। এতোক্ষণ জানতাম জংলী রানী। আর এখন দেখছি মুখরা রমনী।
—–এখনও সময় আছে আপনার আম্মাকে বিয়ের আয়োজন করতে নিষেধ করুন। আর আপনি বলতে না পারলে আমি গিয়ে আন্টিকে বলে আসি। আর শুনুনু ঠাকুর ঘরে কেরে, আমি কলা খাই না। এসব আমার সাথে চলবে না। যা বলবেন স্পষ্ট ভাষায় বলবেন।
—–তোমাকে আর পাকনামো করতে হবে না। আমারই দুর্ভাগ্য!
আয়ান মনে মনে একটু ঘাবড়ে গেল। সত্যিই যদি ড্রইং রুমে গিয়ে বলে দেয় বিয়ে বন্ধ করতে ওর বাবা মা চরম অপমানিত বোধ করবেন। এই মেয়েকে দেখে যা মনে হলো এর দ্বারা সবই সম্ভব। তবে আয়ান একটু বিরক্ত বোধ করলো।
এই চন্ডালিনীর সাথে ওকে সারাজীবন থাকতে হবে। কি কপাল নিয়ে ও জন্মেছে! ড্রইংরুমে এসে এক কোনায় সোফায় বসে পড়লো। ওদিকে বকুলও ভাবলো আয়ান নিশ্চয় বিয়েটা ভেঙ্গে দিবে। আর যাই হোক বেচারা ওর মতো ঝগড়াটে মেয়েকে বউ করে নিবে না। রায়হান চৌধুরী আয়ানের মুখটা কালো দেখে জিজ্ঞাসা করলো,
—–আয়ান তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? তুমি ঠিক আছো তো?
—–হুম,
রাহেলা বেগম আয়ানের মুখের মানচিত্র দেখে মনে মনে অস্থির হয়ে উঠলেন। কখন আবার ছেলে বিয়েতে অমত করে বসে? মান সম্মান দুটোই তখন ডুববে। ঐ সুযোগে না জানি সাইফুল নিজের মেয়েকে রাহেলার কাছে গছিয়ে দেয়। রাহেলা নিজের ভাইয়ের মেয়েকে বউ করে নেওয়ার ইচ্ছে মোটেই নেই। এক তো আত্মীয়ের সাথে আত্মীয়তা করতে রাহেলার ভালো লাগে না। আর দ্বিতীয়ত জরিনার মেয়ে বলে কথা। মা যেমন হয় মেয়ে তো তেমনি হবে। জরিনা খুব স্বার্থপর। রাহেলা ওদের দুভাইয়ের একমাত্র বোন। বিয়ের আগে বড়ভাই সাইফুল ওকে চোখে হারাতো। আর ভাইটার বিয়ে হওয়ার সাথে সাথে পুরো পাল্টে গেল। যদিও রাহেলা খুব বেশী আশা করে না তবুও তো নিজের বাপের বাড়ি আস্তে ইচ্ছে হয়। কিন্তু জরিনার আচরণে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। মা বাবা মারা যাওয়ার পর যখন বাপের বাড়ি বেড়াতে আসতো সাইফুল বাজার করে দিয়ে হয়তো স্কুলে চলে গেল। জরিনা রান্না করতো। কিন্তু মুরগীর রান বুকের মাংসগুলো বক্সে তুলে রেখে দিতো। মাছের বড় বড় পেটিগুলোও লুকিয়ে রাখতো। দুপুরে স্বামী সন্তান নিয়ে খেতে বসে রাহেলা লজ্জ্বায় পড়তো। কারণ হাড্ডি ছাড়া তরকারীর বাটিতে কিছুই নেই। মাছের ছোটো ছোটো পিচ অল্প করে সব্জি জরিনা টেবিলে বেড়ে দিতো। নিজের মান সম্মান রক্ষার্থে বাপের বাড়িমুখো ও খুব একটা হয় না। আর ওদিকে ছোটো ভাই আমিনুল নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করে বাবা মায়ের অবর্তমানে শ্বশুর বাড়িটাকে আপন করে নিয়েছে। আজ যে রাহেলা জলঢাকা এসেছে এটা আমিনুল জানে। তবুও দেখা করতে আসার প্রয়োজন বোধ করলো না। আয়ানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললো,
—–আজ রাতেই তোমার বিয়ে।
আয়ান জানে, এখানে অমত করলে ওর মা,বাবা অসম্মানিতো হবে। তার উপর বাবার শরীর স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো না। তাই অমত করার সুযোগটা হাতে রেখে বললো,
—–এতো অস্থির হচ্ছো কেন? বিয়ে তো পরও করা যাবে।
সাইফুল ভাগনার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো,
—–রাহেলা আয়ান যখন একটু সময় হাতে নিতে চাইছে তখন ওকে একটু সময় হাতে দেওয়া উচিত।
——না,ভাইজান আমার পক্ষে ওর বাবাকে নিয়ে বার বার এতোটা পথ আসা সম্ভব না। আয়ানের অফিসও এতো ছুটি দিবে না। এছাড়া শুভ কাজ ফেলে রাখতে নেই। এখানে বিয়ের কাজ মিটে গেলে বাড়ি গিয়ে রিক্তাকে দিয়ে ওদের বাসর খাট সাজানোর ব্যবস্থা করো। আর কালকের জন্য বাজার করো। হামিদুর ভাইয়েরা কাল গিয়ে মেয়ে জামাই নিয়ে আসবে। আমিও কাল সন্ধার ফ্লাইটে ঢাকা চলে যাবো। আয়ান আর বকুল গাড়িতে করে ঢাকায় ফিরবে।
রায়হানও রাহেলার কথার সাথে সহমত প্রকাশ করলো। রাহেলার কথাগুলো শুনে আয়ান আর একবার চান্স নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
—–মা,বিয়ের শপিং তো কিছুই করা হয়নি?
—–সেসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। আমি সব গুছিয়ে এনেছি।
এ কথা বলে রাহেলা সায়ানকে বললো,
—–সুটকেসটা ভিতরে দিয়ে আয়। ০০১ পাসওয়ার্ড দিয়ে সুটকেসটা খুলতে বলিস।
রাহেলার গুছিয়ে আনা দেখে আয়ানের পুরোনো কথা মনে পড়লো। জেসিকার সাথে যখন ওর বিয়ে হয় পুরোটাই আয়ানকে গুছাতে হয়েছে। ও খেয়াল করেছে ওর মা প্রথম থেকে জেসিকাকে পছন্দ করেনি। হয়তো মায়ের অভিজ্ঞ চোখে জেসিকার ত্রুটিগুলো ধরা পড়ে ছিলো। সায়ান ভিতরে সুটকেসটা দিয়ে আসার সাথে সাথে হামিদুর লুবনান থেকে আয়ানের জন্য কেনা শেরওয়ানি কাট পাঞ্জাবীটা আয়ানের হাতে দিয়ে বললো,
—–তোমার আম্মুর কাছে মাপ নিয়ে কিনেছি। দেখতো বাবা তোমার পছন্দ হবে কিনা?
আয়ানও পাঞ্জাবীর দিকে তাকিয়ে মুখে মেকি হাসির প্রলেপ টেনে বললো,
—-না,খুব সুন্দর হয়েছে।
—–ফিটিংটা ঠিক হবে তো?
—–আম্মু যখন মাপ দিয়েছে ঠিকই হবে। আমার পাঞ্জাবী শার্ট ম্যাক্সিমাম আম্মুই কিনে থাকে।
এরপর ঘরের ভিতরে গিয়ে জুতো জোড়া সায়ানের হাতে পাঠিয়ে দিলো।
বিয়ের সুটকেস পাঠিয়ে দেওয়াতে বকুলের মনটা খারাপ হয়ে গেল। এতো তর্ক বিতর্ক করলো তবুও বিয়েটা রোধ করা গেল না।
যথারীতি মাগরিবের আযানের পর বিয়ের আয়োজন শুরু হলো। কাজী এসে বিয়ে কাজ সমাধা করলেন।আয়ান গোল্ডেন কালারের পাঞ্জাবী পরে বরের আসনে বসেছিলো। বকুলকে মেরুন লাল রঙের বেনারশী শাড়ি গায়ে জড়িয়ে হালকা সাজে বধুবেশে আয়ানের পাশে বসানো হলো। রাহেলা ব্যাগ থেকে দুটো গোলাপ বালা বকুলের হাতে পরিয়ে দিয়ে বললো,
—–এ বালা জোড়া আমার শাশুড়ী মায়ের দেয়া। আজ থেকে এর মালিক তুমি। খুব যত্ন করে রেখো। গলায় আর কানে হালকা গয়না পরিয়ে দিলো।
আয়ান একপলক বকুলের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। ওর পুরো পবিত্র মুখচ্ছবিটার দিক থেকে আয়ান যেন চোখ ফেরাতে পারছে না। চুম্বকের মতো ওর চোখ দুটো ঐ মুখটাতে আঁটকে আছে। সায়ান এক ফাঁকে আয়ানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, “এভাবে তাকিয়ে থাকিস না। দেখতে খুব অড লাগছে”। সায়ানের কথায় আয়ান চোখ নামিয়ে ফেললো। এরপর বকুলের বাবা আয়ানের আঙ্গুলে একটা সোনার আংটি আর হাতে ঘড়ি পরিয়ে দিলো। ঢাকা থেকে আনা মিষ্টিগুলো বর বউয়ের সামনে দেওয়া হলো। আয়ান অবাক হয়ে দেখলো এখানে সবাই বকুলের মুখে আস্তো মিষ্টি তুলে দিচ্ছে। ও মিষ্টিগুলো কোঁত কোঁত করে গিলে খাচ্ছে। ওর আসলে মিষ্টি খুব পছন্দের খাবার। আয়ানও ভাবছে ও পিছিয়ে থাকবে কেন? ও আস্তো মিষ্টি খাওয়া শুরু করলো। যদিও মিষ্টি খেতে ওর ভালো লাগে না। কিন্তু বকুলের খাওয়া দেখে মনে হলো এই বাজিতে ও বকুলের সাথে পেরে উঠবে না। তাই ওকে থামিয়ে দিতে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
—–বাপের জনমে এতো মিষ্টি মনে হয় দেখা হয়নি। তাই লোভ সামলাতে না পেরে হাভাতের মতো খাচ্ছো?..
চলবে