অবেলার বকুল পর্ব-০২

0
733

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী

এর মাঝে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। রাহেলা বেগম খেয়াল করলেন, জেসিকাকে আনার ব্যাপারে আয়ানের কোনো তাগিদ নেই। এটা নিয়ে উনি দুঃশ্চিন্তায় আছেন। সেদিন সকালে আয়ান অফিসে রওয়ানা দেওয়ার পর রাহেলা বেগম নাস্তার টেবিলে রায়হান চৌধুরীকে বললেন,
—–আমার কাছে বিষয়টা ভালো লাগছে না। জেসিকাকে আনার ব্যাপারে আয়ানের নিস্ক্রিয়তা আমাকে ভাবিয়ে তুলছে? কি করা যায় বলতো?
——এতো ভাবছো কেন? ভুলে যেও না ওরা ভালোবেসে বিয়ে করেছে। সুতরাং ওদের ভিতরে টানটা ঠিকই রয়েছে। হয়তো বিরহটাকে আর একটু অনুভব করে আয়ান ঠিক জেসিকাকে নিয়ে আসবে।
—–ভালোবেসে বিয়ে করেছে বলেই তো ভয়টা বেশী। বিয়ের আগেই যদি সব ভালোবাসার আদান প্রদান হয়ে থাকে তাহলে বিয়ের পরে তো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এখনকার ছেলে মেয়েরা যেমন ভালোবেসে বিয়ে করে তেমন ঘর ভাঙ্গতেও সময় নেয় না। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে?
—–বেশী ভাবনা হলে বেয়াইনকে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর করার ছলে জেসিকার আসার ব্যাপারে কথা বলতে পারো?
——পরামর্শটা ভালোই দিয়েছো। আজকালের মধ্যে ফোন দিবো।

আসরের নামাজ পড়ে রাহেলা বেগম জেসিকার মায়ের কাছে ফোন দেন।
—–হ্যালো বেয়াইন কেমন আছেন?
একটু গম্ভীর হয়ে জেসিকার মা বললো,
—–ভালোই আছি।
——জেসিকা কেমন আছে? ও আসবে কবে?
——ও ভালো আছে। সময় হলে যাবে।
——আমি কি গাড়ি পাঠাবো?
—–আপনার গাড়ি পাঠানো দরকার নেই। আয়ানকে বলবেন আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে হলে গাড়ি কিনে পাঠাতে হবে।
—–এ আপনি কি বলছেন? ওর তো নতুন চাকরি। ক,দিন আগে এতো গয়নাগাটি দিয়ে বিয়ে করলো। এরমধ্যে গাড়ি কেনার পয়সা কোথায় পাবে?
——সেটা তো জেসিকার বুঝার কথা নয়। স্বামী হিসাবে বউয়ের সবদিকে খেয়াল রাখা আয়ানের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। গাড়ির কারনে যার তার কাছে আমার মেয়ে কথা শুনতে পারবে না। আর গয়নাগাটির কথা বলছেন, অথচ আপনারা তো উসুল হিসাবে দশ লক্ষ টাকা কাবিনের মধ্যে পাঁচলক্ষ টাকা দেখিয়ে দিয়েছেন। তাহলে এটা এতো ঘটা করে বলার কি আছে? আমি একটু ব্যস্ত আছি। এখন রাখি।
ঠাস করে জেসিকার মা ফোনটা রেখে দিলো। রাহেলা বেগম ভীষণ অবাক হলেন। ভীষণ টেনশনে পড়লেন। জেসিকার মায়ের সাথে ফোনে কথা বলেছেন এটা সবার কাছে গোপন রাখলেন। রায়হান চৌধুরীর হার্টে রিং পরানো আছে। সে কারনে বেশ ভালোভাবেই গোপনীয়তা রক্ষা করলেন। রাহেলা বেগম উনাকে এসবের মধ্যে জড়াতে চাইলেন না।তাই রাতে খাবার টেবিলে আয়ানকে বললেন,
—–জেসিকা আর কতোদিন বাপের বাড়ি থাকবে। ওকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর?
——মা ও যখন নিজ থেকে বাপের বাড়ি চলে গেছে আসতে হলে ওকে নিজ থেকেই আসতে হবে। আমার অতো দায় পড়েনি ওকে হাতে পায়ে ধরে নিয়ে আসবো।
রায়হান চৌধুরী একটু চিন্তিত হয়ে বললেন,
—–এটা কেমন কথা হলো আয়ান? দু,জনকে জেদ করলে তো সংসার চলবেনা। একজন একটু ছাড় দিতে হবে।
——বাবা আমার পক্ষে আর ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়।
রাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে রায়হান চৌধুরী বললেন,
——তুমি ফোন করেছিলে?
——না,সময় পাইনি।
——আম্মু তুমি ফোন দিবে না। আর আব্বু তোমার শরীর ভালো থাকে না। তুমি এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে নিজের শরীর খারাপ করো না।

এর মধ্য একমাস পার হয়ে গেল। তখন ছিলো জুন মাস। আয়ানের অফিসে অডিট চলছিলো। এর মাঝে জেসিকা আয়ানকে ফোন দিয়ে বলে,
——তুমি আমাকে নিতে আসছো না কেন?
——তোমাকে কেউ ও বাড়িতে চলে যেতে বলেনি। তুমি নিজে থেকেই যখন গিয়েছো তখন নিজ থেকেই তোমাকে আসতে হবে। অফিসে অডিট চলছে। ব্যস্ত আছি। ফোন রাখো।
আয়ান ফোনটা রেখে দেওয়ার পর জেসিকার খুব আত্মসম্মানে লাগে। ওর ধারণা আয়ান ইচ্ছে করেই ওকে এভয়েড করার জন্য ফোন রেখে দিয়েছে। তাই ওকে শায়েস্তা করার জন্য অফিসের কাছে চলে আসে। তারপর ওকে ফোন দিয়ে বলে,
—–আয়ান আমি তোমার অফিসের নীচে আছি। তুমি এই মুহুর্তে না আসলে আমি আমার হাতের রগ কেটে ফেলবো।
আয়ানের তখন মিটিং চলছিলো। ও আস্তে করে ফোনে বলে তোমার যা ইচ্ছা হয় তাই করো। আমি এখন অফিসের মিটিং ফেলে নীচে নামতে পারবো না।
আয়ান ফোনটা রেখে দেয়। এর কিছুক্ষণ পর নীচের দারোয়ান দৌড়ে এসে মিটিং এ সবার সামনে আয়ানকে বলে,
—–স্যার আপনি যা করতে বলেছেন ম্যাডাম তাই করেছে।
মিটিং এ উপস্থিত আয়ানের বস আফজাল খান দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করে,
——আয়ান কি করতে বলেছে?
——ম্যাডামের হাতের রগ কেটে ফেলতে বলেছে?
আফজাল খান আয়ানের উপর রেগে গিয়ে বললেন,
——ছিঃ আয়ান চৌধুরী, আমি আপনাকে ভদ্রলোক বলেই জানতাম। অথচ ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে আপনি হোম ভায়োল্যান্সে লিপ্ত আছেন? খুবই দুঃখ জনক! আপনার মিটিং এ থাকতে হবে না। স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
আয়ান নিচে এসে জেসিকাকে অফিসের পাশে একটা ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সেখানে জেসিকার হাতে স্ট্রীচ দেওয়া হয়। এরপর আয়ান জেসিকার বাবাকে ফোন দিয়ে ডেকে মেয়েকে তার কাছে বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় চলে আসে।
এরপর আয়ান আর জেসিকার সাথে সংসার করতে চায় না। ওদের ডিভোর্স হয়ে যায়। কাবিনের পাঁচ লক্ষ টাকা আয়ান জেসিকাকে বুঝিয়ে দেয়। এরপর ট্রাক নিয়ে এসে জেসিকার বাবা আয়ানদের বাসা থেকে সব ফার্ণিচার নিয়ে যায়। অতঃপর আয়ানের এতো ভালো চাকরিটাও চলে যায়। কারণ জেসিকা অফিসে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে আয়ান ওকে নির্যাতন করতো। একসাথে এতোগুলো আঘাত হজম করতে না পেরে আয়ান ডিপ্রেশনে চলে যায়। এদিকে রায়হান সাহেবের শরীরও খারাপ হতে থাকে। সায়ান তখন ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। অসুস্থ শরীরে ছেলের ভিভোর্সর ধাক্কা সামলাতে না পেরে হার্টের অবস্থা অনেক বেশী খারাপ হয়ে যায়। যার ফলে উনাকে বাইপাস করতে হয়। সেসময় সায়ান মা বাবাকে অনেক সহযোগিতা করে। এদিকে আয়ানের মানসিক অবস্থা দিনদিন খারাপ হতে থাকে। অতঃপর রাহেলা বেগম ছেলেকে স্বাভাবিক করতে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানোর ব্যবস্থা করলেন। প্রথমদিকে আয়ান যেতে চাইতো না। পরে কল করে বাসায় ডেকে আনার ব্যবস্থা করলেন। এতে ভিজিটও অনেক টাকা গুনতে হলো। তবে উনার কাছে এই মুহুর্তে ছেলের সুস্থতা সবার আগে। তাই টাকা পয়সার বিষয়টা আমলে নিলেন না। একবছর চেষ্টার পর আয়ান অনেকটা সুস্থ হয়। এরপর বিভিন্ন চাকরিতে ইন্টারভিউ দিতে থাকে। অবশেষে ইউনিলিভারে চাকরি হয়। চাকরি পাওয়ার পর থেকে ও একটু রাত করে বাড়ি ফেরা শুরু করে। এখানে চাকরি করছে দশ মাস। প্রথমে অফিস ফেরত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসতো। তবে বেশ কিছুদিন হয় অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে। আর রাহেলা বেগমেরও ছেলের জন্য জেগে থাকে আর আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করে ছেলের যেন সুমতি হয়।
নিচে গেট খোলার শব্দে রাহেলা বেগম ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসলেন। বাইকের শব্দে বুঝতে পারলেন সেজান এসেছে। ড্রইংরুমের সবগুলো আলো নেভানো আছে। শুধু একটা মৃদু আলো টিম টিম করে জ্বলছে। দরজাটা ভেজানো ছিলো। আজ আয়ান একটু বেশীই দেরী করে ফেলেছে। জেসিকার সাথে ডিভোর্সের পর আয়ান বাবা মায়ের সাথেই থাকে। তিনতলাটা তালাবদ্ধ করে রাখা আছে। ও পা টিপে টিপে ভেজানো দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলো। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে যখনি উপরে উঠতে যাবে অমনি বেশ রাশভারী গলায় রাহেলা বেগম বলে উঠলেন,
——-এভাবে চোর ছ্যাচ্চোড়ের মতো ঘরে ঢুকছিস কেন। জানিসই যদি এতো রাত করে ঘরে ফেরা অন্যায় তাহলে এ কাজ কেন করিস?
——-তুমি এখনও ঘুমাওনি? তোমাকে না বলেছি আমার জন্য না জেগে সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়তে। আমার ফেরার সময় ঠিকই ফিরে আসবো।
——তুই তো বলেই খালাস। কিন্তু আমি তো মা। তোদের জন্ম দিয়েছি। তোর বাবার বদলির চাকরি ছিলো। বলতে পারিস এক হাতেই তোদের বড় করেছি। আমারও তো ইচ্ছে হয় তোদের সুখী সুন্দর জীবন দেখতে। এভাবে আর কতদিন চলবে আয়ান? তোমার বাবার বাইপাস হয়েছে। তার শরীর ও ভালো থাকে না। আমারও বয়স হয়েছে। এবার তো জীবনটাকে নিয়ে তোর নতুন করে ভাবা উচিত।
——জীবনটাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে গেলে কি করতে হবে বলো?
——বিয়ে কর।
——আমার পক্ষে এখন পাত্রী খোঁজা সম্ভব না।
——তোকে কিছুই করতে হবে না। এবার আমার উপর পুরোটা ছেড়ে দে।
——ঠিক আছে।
যদিও আয়ান মত দিলো কিন্তু রাহেলা বেগম মা হয়ে ছেলের বুক ভরা দীর্ঘশ্বাসের চাপা কষ্টটা ঠিকই অনুভব করতে পারলো।
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে