#অবুঝ_দিনের_গল্প
#লেখনীতে_সাবরিন_জাহান
#পার্ট_১(সূচনা পর্ব)
“বাবা, এত এত পদের খাবার আজ রান্না করছো যে মা?কোনো রাজ দরবারের লোকজন আসবে নাকি গো?”
ভাবার ভঙ্গিমা করে মাকে জিজ্ঞেস করলো তনয়া।
মা মুচকি হেসে উত্তর দিলেন,
মা: তোর মামু আসবে রে তনু।তাদের জন্যই এত আয়োজন!
তনয়া: আরিফা ওরা?
মা:হুমম,কিন্তু এবার তাদের ছেলেও আসবে।
তনয়া:উম..(কিছুটা ভেবে)বিদেশ ছিল যে,সে?
মা: হ্যাঁ,শহরের মানুষ।তার উপর ছেলে বিদেশি,আমাদের ওই ডাল-ভাতে কি তাদের চলবে?
তনয়া: এবার বুঝলাম,মা খিদে পেয়ে গেছে গো।তোমার এই এত পদের রান্না দেখে পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে।একটা বেগুন ভাঁজা দেও না ।গরম ভাতের সাথে খাবো।
মা: আচ্ছা দিচ্ছি,কিন্তু বড় বান্দরটা কোথায় রে?
তনয়া: ওকে তো দেখলাম বিথী আপুদের সাথে যেতে।
মা: এই মেয়েকে নিয়ে আর পারি না।কই এসএসসি শেষ করেছে,এখন মায়ের কাজে সাহায্য করে টুকিটাকি কাজ শিখবে। তা না, মহারানী ঘুরে বেড়াচ্ছে।আমার হয়েছে যত জ্বালা। পারি না বাপু আর।
এরকম হাজারো বক বক করতে করতে কাজ করতে লাগলেন তিনি।তনয়া নিশ্চুপে উঠে সোহার কাছে গিয়ে বসলো।তনয়া আর সোহা দুইজনই সমবয়সী।এবার টেনে উঠলো।সোহা তনয়ার কাকুর মেয়ে।
তনয়া: জানিস,এবার বিদেশি ভাইয়াটাও নাকি আসবে!
সোহা:হুমম,শুনলাম তো।আচ্ছা,উনি কি আরিফা আপুর মত আমাদের সাথে মিশবে?আমি তো শুনেছি শহরের মানুষরা গ্রামের মানুষদের সইতেই পারে না।আর উনি তো বিদেশি।
তনয়া: তাও ঠিক,কিন্তু যেখানে অরিন আপু আছে সেখানে এত ভাবনার কিছুই নেই।মিশতে না পারলেও,অরিন আপু বাধ্য করবে মিশতে।মিলিয়ে নিস।
সোহা: চল,অরিন আপুকে খবরটা দেই।
তনয়া: কিন্তু খুঁজবো কোথায়?
সোহা: আরে আমাদের গ্রাম কি অত বড় নাকি। ছোটই তো। কোথাও না কোথাও পেয়ে যাবো,চল।
বলেই তনয়াকে টেনে নিয়ে গেলো।উঠান পেরিয়ে বের হতে নিবে তখনই ডাক দিল লামিয়া।সোহার বড় বোন।
লামিয়া:কোথায় যাচ্ছিস?
সোহা:অরিন আপুকে খুঁজতে।
লামিয়া: কেনো?
তনয়া:আসলে মা খুঁজছিল!
লামিয়া: মেয়েটার সবে মাত্র পরীক্ষা শেষ হয়েছে।এখন একটু ঘুরুক ফিরুক।এমনেই কয়েকদিন পর কলেজ এর ডাক পড়বে।অযথা কেন বিরক্ত করবি?আর তোদের না পরীক্ষা সেকেন্ড টার্মের। যা পড়তে।
তনয়া:আচ্ছা।
সোহা আর তনয়া ভিতরে চলে গেলো।
গ্রাম বাংলার প্রকৃতির সাথে অন্য কোনো প্রকৃতির মিল পাওয়া যায় না।আর হয় যদি সকালের মিষ্টি রোদ্দুরের মাঝে বহমান নদীর দৃশ্য,তাহলে তো কোনো কথাই নেই।এরকম দৃশ্য উপভোগে বিভররত অরিনের মন কিছুটা বিরক্ত হলো বিথীর নামে মাত্র আফসোসের জন্য।বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে এলো ওর।এই সুন্দর পরিবেশ উপভোগের মাঝে এরকম আশাহত সুর ওর বিরক্তির মূল কারণ।
বিথী: এভাবে কেনো তাকিয়ে আছিস? আমি তো শুধু বললাম,তোর ভাই আমাকে না বলে চলে গেছে।
অরিনের এই মুহূর্তে ঠাটিয়ে বিথীকে দুইটা থাপ্পড় মারতে মন চাচ্ছে।কিন্তু আপাতত সেই ইচ্ছা দমন করে ,মেকি হেসে বলতে লাগলো –
অরিন: হ্যাঁ,এই জন্যই তো ভাইয়া যখন বলতে এসেছিল ,”বিথী আমি যাচ্ছি।” তখন কে জানি বলছিলো,”যাচ্ছো,যাও।তাতে আমার কি?”
বিথী ভরকে গেল, পরক্ষণেই গাল ফুলিয়ে বললো ,
বিথী:আমি কি করতাম?তোর ভাই যাওয়ার একদিন আগে আমায় বলেছে যে ,সে শহরে যাচ্ছে কাজের জন্য।আরো আগে বললে কি হতো?
অরিন: ভাইয়া যদি আরো আগে বলতো,তুই এভাবেই মুখ ফুলিয়ে থাকতি,মন খারাপ করে।যাওয়ার আগে প্রিয় মানুষকে এভাবে মন মরা দেখতে কার ভালো লাগবে?আর ভাইয়া কি শখ করে গেছে নাকি?এখানে তেমন কোনো কাজ নেই।নিজে কিছু করতে গেলেও অনেক খরচ।এত টাকা কই পাবে?শহর না গিয়ে জীবন চলবে?এই দেখ ,তোরা দুইটাও তো কলেজের জন্য শহরে তোদের আত্মীয়দের কাছে চলে যাবি।বেচারি আমি একাই গ্রামে থাকবো।
হৃদিতা: তুই মন খারাপ কেন করছিস?তোর তো এমনিতেও গ্রাম ছেড়ে কোথাও যেতে ভালো লাগে না,তাই না।
অরিন:সেটা ঠিক আছে,কিন্তু তোরা না থাকলে ,আমি তো একা হয়ে যাবো। সামর্থ্য থাকলে তোদের সাথে একই কলেজের হোস্টেল এ থাকতাম।
হৃদিতা: আমরা দুইজন যদি ম্যানেজ করে দেই?
অরিন: না,মা মানবে না।
বিথী: মন খারাপ করিস না।বন্ধে আমরা আসবো।
অরিন:আচ্ছা বাদ দে,নে এবার উঠি।বাড়িতে গেলে নির্ঘাত বকুনি খাবো আজ।
বিথী ,হৃদিতা অরিনের সাথে উঠে হাঁটা লাগালো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
“ও অরিন, হুনো না।”
পাশ থেকে কেও ডাক দেওয়ায় তিনজনেই তাকালো।রামু তার পান খাওয়া লালচে দাঁত কেলিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
হৃদিতা:আবার ইনি!
বিথী: কি চাই?
রামু আবারও দাঁত কেলিয়ে বললো,
রামু: ইয়ে ওই অরিন আফা না কইলো,মোরে ওই লম্বা ধবধবে ফর্সা মাইয়াডার লগে বিয়া দিবো? তা ফোন নাম্বার আছেনি গো?
হৃদিতা মুখ চেঁপে হাসলো,একদিন মজার ছলে অরিন উনাকে ক্যাটরিনা কাইফের ছবি দেখিয়ে বলেছিলো তার বউ বানাবে।সেই থেকে বেচারা সুন্দরী বউয়ের আশায় বিয়ে করছে না।অরিন হতভম্ভ।মানুষ কতটা ভোলা হলে এখনও নায়িকার জামাই হবার স্বপ্নে মশগুল থাকে।
রামু: কিগো আফা!
অরিন কিছুটা নড়ে চড়ে দাড়ালো,মুখটা সিরিয়াস ভঙ্গিমা করে বললো,
অরিন: ভেবেছিলাম তো দিবো।কিন্তু তোমার কপালে যে সে নেই।
কথাটা বলে কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে তাকালো।
রামু: এইহান কিয়া কও আফা?
অরিন: আরে উনি কিছুদিন আগেই ভিকিকে বিয়ে করে মধু চন্দ্রিমা কাটাচ্ছে।
রামুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো,
রামু: বিয়া করি হালাইছে?
অরিন: হুমম,তুমি উনাকে ভুলে যাও গো।আর বিয়ে করে ফেলো।ঠিক আছে?আমরা যাই।
বলে এক মুহুর্ত ও দাড়ালো না। দিলো তিনজন দৌড়।কিছুদূর দৌড়ে গিয়ে ব্রেক কষলো তিনজনই।পিছে ফিরে রামুর উদাসীন চেহারা দেখে তিনজনই আফসোসের সুর তুলে মুহূর্তেই অট্টহাসিতে মেতে গেলো।
বিথী: আহারে,কত বড় ধোঁকাটাই না খেলো।
হৃদিতা: হয়!অরিন ওদিকে কি দেখছিস?
দূরেই এক যুবককে দেখছিলো অরিন।তার চোখে মুখে বিরক্তি,দেখে মনে হচ্ছে বেশ অস্বস্থি হচ্ছে তার।হৃদিতার কথায় ওকে বললো,
অরিন: গ্রামের মাটিতে বিদেশি বাবুর ঢেরা বসেছে দেখা যাচ্ছে।
বিথী: মানে?
অরিন: সামনে দেখ!
দুইজনও সেই যুবককে দেখলো।অরিন এগিয়ে গেলো,তার পিছু পিছু বিথী আর হৃদিতাও।কিছুদূর যেতেই যুবকের কর্কষ কণ্ঠ শোনা গেলো।কাওকে উদ্দেশ্য করে ক্ষিপ্ত মেজাজে বলছে ,”গাড়িতে আসার সময় বেশি করে ফুয়েল ভরতে পারলে না?”
হৃদিতা: এ দেখি বড়লোকের ছেলে!
বিথী: দেখতেও মাশাআল্লাহ!
অরিন: ওই শুরু তোদের লু’চুগিরি।চুপ থাক।দেখতে দে!
বিথী: তুই এখানে থেকে ওদের দেখে কি করবি?
অরিন: ছেলেটার চেহারাটা পরিচিত লাগছে,তাই মনে করার চেষ্টা করবো।
হৃদিতা: বাড়ি গিয়ে মনে করিস, চল!
অরিন: কিন্তু….
বিথী: অরিন,দুপুরে বাড়ির বাইরে থাকা ঠিক না।জানিস তো গ্রামে কিরকম সব লোক থাকে। কারো নজরে পড়লে সমস্যা।
অরিন আর কথা বাড়ালো না ,ঘুরে হাঁটা লাগালো।তখনই পিছন থেকে কেও “অরিন আপু” বলে ডাক দিলো।তিনজন আবার ফিরে তাকালো।ডাক দেওয়া মানুষটিকে দেখে মুচকি হেসে বললো,”আরিফা,তুমি এখানে?”
অরিন আরিফার পিছনে লক্ষ্য করতেই দেখলো ওর মামা আর মামী দাড়িয়ে।সাথে ওই ছেলেটা।
আরিফা: আরে আমরা তো তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছিলাম।কিন্তু মাঝপথে গাড়ির তেল শেষ।আর রাস্তাটাও খেয়াল নেই বাবার।তার উপর ফোনে নেটওয়ার্ক ও নেই।
মামা অরিনের দিকে এগিয়ে এসে বললো,”কেমন আছিস মা?”
অরিন মুচকি হেসে বললো,”আলহামদুলিল্লাহ।”
আরিফা: যাক,এখন আমাদের বাড়ি নিয়ে চলো।ভাইয়ার মেজাজ সেই রকমে গরম হয়ে আছে।
অরিন একবার ছেলেটার দিকে তাকালো।এতক্ষণে বুঝতে পারলো,মুখটা কেনো পরিচিত লাগছিলো।
অরিন: বাড়ি এখান থেকে বেশি দূর না। মাঠ পেরিয়ে গেলেই বাড়ি।হেঁটেই যাওয়া যাবে ।
পিছন থেকে বিস্মিত কণ্ঠে ছেলেটি বলে উঠলো,”এই উত্তপ্ত রোদে গাড়ি ছাড়া হেঁটে মাঠ পার করতে হবে?”
অরিন ভ্রু কুঁচকে তাকালো।আহামরি এত বড় মাঠও না যে পার করতে করতে রাত হয়ে যাবে।কেবল পাঁচ মিনিটের রাস্তা।
অরিন: পাঁচ মিনিটের পথ হাঁটতে পারবেন না নাকি?
ছেলেটি: উফ,এমনেই এই গাড়ির জন্য এতক্ষণ দাড়িয়ে ছিলাম,আর এখন আবার হাঁটতে হবে!
পাশ থেকে অরিনের মামা বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,”আহ,আদ্রিয়ান।সামান্যই তো।কথা না বলে হাঁটো।”
অজ্ঞতা হাঁটার উদ্দেশ্যে সবার সাথে পা বাড়ালো আদ্রিয়ান,কিন্তু মাটিভেদ করে বেরিয়ে আসা শিকড়ে হোচট খেয়ে পড়ে গেলো। তা দেখে আরিফা জোড়ে হেসে দিলো।
আরিফা: তুই দেখি হাঁটতেও পারিস না ঠিক মত।
আদ্রিয়ান: যত্তসব,এই জন্য আমি গ্রামে আসতে চাইনি।গ্রাম মানেই অসহ্যকর।
অরিন বিরক্তি নিয়ে তাকালো।গ্রাম মানেই অসহ্যকর?কি সব বলছেন উনি?
অরিন:হাঁটতে পারেন না নিজে আর দোষ দিচ্ছেন গ্রামের?
আদ্রিয়ান ভ্রু কুঁচকে অরিনের দিকে তাকালো।এতক্ষণ ভালোভাবে না দেখলেও কালো কামিজ পরিহিত অরিনকে একটু পর্যবেক্ষণ করে নিলো।দেখতে সাধারণ হলেও,চেহারায় অদ্ভুত মায়া আছে।আদ্রিয়ান ওসবে পাত্তা না দিয়ে কর্কশ কণ্ঠে আবারও বলে উঠলো,”আ’ম নট ইন্টারেস্টেড টু সে এনিথিং এবাউট ইট এট দিজ মুমেন্ট।”
ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো অরিন।আপন মনেই বির বির করে বললো,”ইংরেজ এর বংশধর”
মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে সবাই।আদ্রিয়ান বিরক্তি নিয়ে হাঁটছে।মাঠের কিছু অংশ ভেজা থাকায় পিছলে পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলাচ্ছে বারবার।অরিন একবার ওর দিকে তাকাচ্ছে তো একবার সামনে ঘুরে মিট মিট করে হাসছে।মূলত আদ্রিয়ানের এই দশা ও চরম উপভোগ করছে।ধপাস করে কিছু পড়ার শব্দ হওয়ায় সবাই হাঁটা থামিয়ে পিছে ফিরে তাকালো। কাঁদা মাটিতে কাঁদা লেপ্টে বসে আছে আদ্রিয়ান।পা পিছলে কাঁদার মাঝেই পরে গেলো।এবার আর নিজেকে সংযত করতে পারলো না অরিন।শব্দ করে হাসতে লাগলো।ওর হাসি শুনে আরিফাও হাসতে লাগলো।বিথী আর হৃদি মুখ চেপে হাসছে।আদ্রিয়ান এর বাবা মা হাসবে না আফসোস করবে বুঝতে পারছে না।ওদের হাসি দেখে রাগে শরীর কাঁপছে আদ্রিয়ান এর।অরিন বুঝতে পেরে হাসি থামালো।সতর্ক পায়ে আদ্রিয়ান এর কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল।আদ্রিয়ান এক পলক তাকিয়ে বললো,”নো নিড”।বলে একা একাই উঠতে গিয়ে আবারও পড়ে গেলো। এবার বিথী আর হৃদিও শব্দ করে হেসে দিলো। আদ্রিয়ানের রাগ হচ্ছে প্রচুর।সামনে কারো হাত দেখতে পেয়ে হাতের মালিকের দিকে তাকালো।
অরিন তার তাকানো দেখে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,”মিস্টার ইংরেজ বাবু!যেটা পারেন না সেটা নিয়ে এটিটিউড না দেখানোই উচিত।এতক্ষণে আমার হাত ধরে উঠেও পড়তে পারতেন।কিন্তু না ইগোর জন্য সেই আবার পড়লেন।এবার তো ধরুন!”
আদ্রিয়ান অবাক কণ্ঠে বললো,”ইংরেজ বাবু?”
চলবে