অবিবাহিত বউ পর্ব-২৪ এবং শেষ পর্ব

0
865

#অবিবাহিত_বউ
#শেষ_পর্ব
#লেখিকা_লক্ষী_দেব

তোহা শাড়ি পড়ে ভার্সিটিতে এসেছে। তবে আজকে ভার্সিটিতে ক্লাস করার কোনো উদ্দেশ্য নেই তার। নাহিদের সাথে শহরটা ঘুরে বেড়াবে। তোহার দিকে তাকিয়ে অরিন মিটিমিটি হাসছে। তোহা তা দেখে জিজ্ঞেস করল,
“হাসছিস কেন? আমাকে কী জোকারের মতো লাগছে?

অরিন এবার মুখের হাসিটা আরেকটু প্রসারিত করে বলল,
“জোকারের মতো লাগবে কেন? আমি তো তোর আর নাহিদ ভাইয়ার আগের ঝগড়া গুলোর কথা মনে করে হাসছিলাম।

অরিনের কথায় তোহা ও মুচকি হাসল। অরিন আবারো বলল,
“তোদের প্রথম যখন দেখা হলো তখন থেকেই ঝগড়া শুরু হয়েছিল। তুই তো নাহিদ ভাইয়াকে স’হ্যই করতে পারতিস না। আর এখন ভাইয়ার সাথে যাওয়ার জন্য শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছিস।

তোহা মুচকি হেসে বলল,
“কি করবো বল। ঠিক কখন, কীভাবে উনাকে ভালোবেসে ফেললাম বুঝতে পারছি না। হুট করেই যেন সব হয়ে গেল।

অরিন গেইটের ভেতরে তাকিয়ে দেখল নাহিদ আসছে। নাহিদের সাথে ফাহিম, রনি এমনকি রিয়া ও আছে। অরিন তোহাকে হালকা ধা’ক্কা দিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“ওই যে তোর উনি আসছে।

“তোর উনি ” কথাটা কানে যেতেই তোহার মুখের ল’জ্জার আভা ফুটে উঠল। শরীরে ভালো লাগার শিহরণ বয়ে গেল। তোহা চোখ তুলে দেখল নাহিদ ওদের কাছাকাছি চলে এসেছে।

নাহিদ তোহার সামনে দাঁড়িয়ে তোহার মুখের দিকে তাকাল। তোহা মাথা নিচু করে রেখেছে। নাহিদ জানে তোহা আজকে শাড়ি পড়ে আসবে। শাড়ি পড়ার কথাটা সেই বলেছিল কি-না। নাহিদ তোহার মুখের দিকে মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তোহা মাথা নিচু করে রাখলেও বুঝতে পারল কেউ একজন তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কে তাকিয়ে আছে এ ও তার অজানা নয়।

রিয়া তোহাকে শাড়ি পড়তে দেখে তোহার দিকে তাকিয়ে নাহিদের দিকে তাকাল। তোহার দিকে নাহিদ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজ মনে বলল,
“তোহার জায়গায় যদি আমি থাকতাম, তাহলে কি ভাইয়া আমাকে এভাবেই দেখতো?

কথাটা ম’স্তিষ্কে প্রভাব ফেলতেই নড়েচড়ে উঠলো রিয়া। নিজের ভাবনাকে ধি’ক্কার জানিয়ে বলল,
“কিসব ভাবছি আমি? না, না। আমার এসব ভাবা উচিত না। কিছুতেই না। নাহিদ ভাইয়া তোহাকে ভালোবাসে। আমি কি করে এসব ভাবছি? আল্লাহ আমার অবচেতন মনটা শান্ত, স্থি’র করে দাও।

রিয়া নাহিদের থেকে চোখ সরিয়ে নিল। মনে মনে স্থি’র করে নিল আর নাহিদের দিকে তাকাবে না। কিছুতেই না। চোখ যতই দেখার জন্য ছটফট করুক, মন যতই অবা’ধ্য হওয়ার চেষ্টা করুক সে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে।

রিয়ার মতো করে রনিও নাহিদকে তোহার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিল। ফাহিমকে হালকা ধা’ক্কা দিয়ে চোখের ইশারায় নাহিদের দিকে তাকাতে বলল। ফাহিম নাহিদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আরে মামা চোখ নামা। এভাবে তাকালে তো নজর লেগে যাবে।

ফাহিমের কথার তোহা আরো ল’জ্জায় নুয়ে পড়ল। তা দেখে নাহিদ মুচকি হাসল। ফাহিমের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“এভাবে বলিস না বন্ধু। বউটা ল’জ্জা পাচ্ছে।

নাহিদের কথায় ফাহিম, রনি শব্দ করে হেসে উঠল। নাহিদের ঠোঁটের হাসিও প্রসারিত হলো। রিয়া চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। অরিন একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাইয়া আমার তো ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। আপনারা এবার বেরিয়ে পড়ুন।

অরিন কথায় নাহিদ জবাব দেওয়ার আগেই রনি বলে উঠল,
“যা, যা। তোরই তো সময়। বিয়ের আগেই বউ পেয়ে গেছিস।

নাহিদ হাসল। কোনো জবাব দিল না। তোহার পাশে দাঁড়িয়ে তোহার হাতটা ধরে বলল,
“চলো।

নাহিদ বাইক স্টা’র্ট দিল। তোহা নাহিদের বাইকে উঠে বসে নাহিদের কাঁধে হাত রাখল। এতক্ষণ নিজের চোখ দুটোকে সামলে রাখলেও এবার সামলাতে পারল না। অবশেষে নিজের সকল বাধা, নি’ষেধ অ’মান্য করে চোখ জোড়া নাহিদের মুখে আটকে গেল। নাহিদের উচ্ছ্বা’সিত হাসি মুখটা দেখে রিয়ার মুখেও হাসি ফুটল। নিজেই বলল,
“তোমার মুখটা আজীবন হাসিতে পরিপূর্ণ থাকুক।

রিয়ার কথাটা নাহিদের কানে পৌঁছাল না। সে ইতিমধ্যে তোহাকে নিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল।
__________________

বাইকে নাহিদের পেছনে বসে নাহিদের ঘাড়ের দিকে তাকাল তোহা। নাহিদের ঘাড়ের ঠিক ডান দিকে কালো তিল দেখতে পেল। তোহা তার ডান হাতটা নাহিদের কাঁধ থেকে সরিয়ে ধীরে ধীরে নাহিদের ঘাড়ের তিলের উপর রাখলো। অমনি বাইকটা থেমে গেল। চমকে উঠল তোহা। বাইক কেন থামলো? তোহা এবারো হাতটা সরিয়ে নিল। নাহিদকে প্রশ্ন করল,
“বাইক থামালেন কেন?

নাহিদ তোহার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে বলল,
“বাইক থেকে নামো।

তোহা ঠোঁট উল্টে বাইক থেকে নেমে গেল। শাড়ির কুচি গুলো কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেছে। তোহা মাথা নিচু করে সেগুলো ঠিক করতে লাগলো। নাহিদ বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে তোহাকে কিছু না বলেই হাঁটতে লাগলো। তোহা কুচি ঠিক করে পাশে তাকিয়ে দেখলো নাহিদ নেই। অবাক হয়ে সামনের দিকে তাকাল। তখনই নাহিদকে রাস্তা পার হতে দেখল। আনমনে বলল,
“উনি আবার কোথায় যাচ্ছেন?

তোহা নাহিদের বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপতে লাগল। মিনিট পাঁচেক বাদে মাথায় কারো স্প’র্শ পেয়ে ঘাবড়ে গেল তোহা। তড়িগড়ি করে মাথা ঘুরাতে চাইলে পেছন থেকে পুরুষেয়ালী ক’ন্ঠে বলে উঠল,
“উফ, নড়ছো কেন? একটু ঠিক হয়ে বসো তো।

নাহিদের ক’ন্ঠ শুনে তোহা যেন প্রাণ ফিরে পেল। স্ব’স্তির শ্বাস ফেলে বলল,
“আপনি? হুট করে চলে এলে চমকাবো না?

নাহিদ জবাব দিল না। হাতে থাকা বেলি ফুলের গজরাটা তোহার চুলের খোঁপায় যত্ন করে গুঁজে দিতে লাগলো। গজরাটা গুঁজে দিয়েই তোহার সামনে এসে হাসি মুখে বলল,
“এবার পারফেক্ট আছে।

তোহা বাম হাতটা খোঁপায় রাখতেই বুঝতে পারল নাহিদ খোঁপায় ফুলের গজরা লাগিয়ে দিয়েছে। তোহা মুচকি হেসে বলল,
“পারফেক্ট আছে? কীভাবে পারফেক্ট হলো? আমিই তো পারফেক্ট না। বিয়ের পর কিন্তু আপনার সাথে খুব ঝগড়া করবো।

তোহার কথায় নাহিদ হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে তোহার বাম গালে ডান হাতটা রেখে বলল,
“তাতে কি? তোমার সাথে ঝগড়া করতে খারাপ লাগে না। তাছাড়া ঝগড়া করলে ভালোবাসা বাড়ে। ঝগড়া করাতে আমার কোনো সমস্যা নেই।

নাহিদ কথাটা বলেই চোখ টিপ দিল। তা দেখে তোহা লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে ফেললো। নাহিদ তোহার দিকে তাকিয়ে নেশা’লো কন্ঠে বলল,
“এই বউ।

নাহিদের ডাকে তোহা চোখ বুজে ফেললো। ইশ, ডাকটা এতো মধুর কেন? তোহা মুচকি হেসে চোখ খুলে নাহিদের চোখের দিকে তাকাল। কিন্তু সেই সর্ব’নাশা চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। মুহুর্তের মধ্যেই চোখ নামিয়ে নিল। নাহিদ বলল,
“কি হলো। তাকাও।

নাহিদের কথায় তোহা আবারো নাহিদের চোখের দিকে তাকাল। বেশি আগের বারের মতোই বেশিক্ষণ তাকানোর সাধ্য হলো না। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে হাত দিয়ে মুখ ডেকে বলল,
“আপনি আর তাকাতে বলবেন না। আমার ল’জ্জা লাগছে।

তোহার কথার ধরনে নাহিদ হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে বলল,
“আচ্ছা। আর তাকাতে বলবো না। এবার মুখ থেকে হাত নামাও।

তোহা হাত নামালো। তবে নাহিদের দিকে না তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় তোহার চোখ দুটো আটকে গেল। বুকের ভেতর শুরু হলো ভূমি’কম্প। এতক্ষণের লাজুক মুখটা মুহুর্তের মধ্যেই ভয়া’র্ত হয়ে গেল। তোহা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকেই সোজা হয়ে দাঁড়াল। নাহিদ তোহার ভয়া’র্ত মুখ দেখে অবাক হয়ে তোহার দৃষ্টি অনুসরণ করে রাস্তার দিকে তাকাল।

তখনই দেখতে পেল এক বৃদ্ধ লোক ব্যাগ হাতে রাস্তা পাড় হচ্ছে। আর কয়েক পা এগোলেই রাস্তা পাড় হয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু তিনি হাঁটতে পারছেন না। খুবই ধীর গতিতে হাঁটছে। এদিকে একটা বড় গাড়ি ধেয়ে আসছে। তোহা নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“উনাকে বাঁচাতে হবে।

তোহা আর এক সেকেন্ডের জন্য ও দাঁড়াল না। বৃদ্ধ লোকটাকে বাঁচাতে দৌড় লাগালো। তোহার কান্ডে নাহিদ স্ত’ব্ধ হয়ে গেল। আসন্ন বিপদের কথা ভাবতেই শরীর যেন অসাড় হয়ে আসলো। নাহিদ স্ত’ম্ভিত ফিরে পেতেই চেঁচিয়ে বলল,
“যেও না তোহা।

তোহা নাহিদের ডাক শুনল না। নাহিদ ও তোহার পেছনে দৌড়াতে লাগল। তোহা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ লোকটাকে ধা’ক্কা দিল। ধা’ক্কা খেয়ে লোকটা রাস্তার ওপাশে পড়ে যেতে নিলেই নাহিদ ধরে নিল। তোহার মুখে ফুটে উঠলো বিশ্বজয়ের হাসি।

তবে হাসিটা দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হলো না। তার আগেই বিশাল আকারের দান’বীয় গাড়িটা তোহার শরীরটাকে পি’ষে ফেলল। নাহিদ ‘তোহা’ বলে চেঁচিয়ে উঠলো।

রাস্তায় র’ক্তে রাঙানো তোহার মুখটা পড়ে থাকতে দেখেই নাহিদের বুকটা জ্ব’লে উঠল। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তে লাগলো নোনাজল। নাহিদ দৌড়ে গিয়ে তোহার মাথাটা কোলে নিয়ে বলল,
“এটা তুমি কেন করলে তোহা?

তোহা বহু ক’ষ্টে নাহিদের মুখের দিকে তাকাল। মুখ দিয়ে উচ্চারণ করল,
“শুনুন। আব্বুকে বলে দিবেন আমি আব্বুকে ভীষণ ভালোবাসি।

কথাটা বলে থামলো তোহা। মৃ’ত্যু যে খুব নিকটে দাঁড়িয়ে আছে। নাহিদ ভেজা ক’ন্ঠে বলল,
“তোমার কিছু হবে না তোহা। আমি তোমার কিছু হতে দেব না বউ। হসপিটালে নিয়ে গেলে তুমি ঠিক হয়ে যাবে।

নাহিদের কথা তোহা নামলো না। শেষ বারের মতো নাহিদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালোবাসি।

নাহিদের বুকের ভেতর রক্ত’ক্ষরণ শুরু হয়েছে। এইতো, একটু আগেই তো মেয়েটা কি সুন্দর ল’জ্জা পেল। কতো সুন্দর করে বলল ‘আমার ল’জ্জা লাগছে ‘। বিয়ের পর দুজন ঝগড়া করবে বলল। কিন্তু এখন? এখন সেই মেয়েটাই রাস্তায় পড়ে মৃ’ত্যুর সাথে লড়াই করছে।

তোহার চোখ দুটো ব’ন্ধ হয়ে আসছে দেখে নাহিদ বলল,
“চোখ বন্ধ করো না তোহা। প্লিজ তোহা তাকাও।

তোহা জোরে শ্বা’স নিয়ে তাকাল। নাহিদের গালে হাত রেখে বলল,
“প্রথমে আব্বু আমাদের মেনে নিল না। এখন নিয়তি। বুঝলেন, ভা’গ্যে আমাদের মিলন ছিলো না। আমি আপনার অবিবাহিত বউ হয়েই রয়ে গেলাম।

“তুমি আমার বউ হবে তোহা। তুমি আমারই হবে। তুমি কোথাও যাবে না।

তোহা নাহিদের কথা শুনলো কই? নাহিদকে একা করে পাড়ি দিল দূর আকাশে। এদিকে নাহিদ প্রলাপ করে চলেছে,
“এই বউ, বউ। তাকাও না এদিকে। এই বউ, তোমায় ডাকছি তো আমি।
________________

ট্রেনের মধ্যে বসে আছে নাহিদ। হাতে মোবাইল নিয়ে তোহার হাস্য’জ্জ্বল মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে। নাহিদের ঠিক বরাবর সামনের সিটে রিয়া বসে আছে। নাহিদের দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিন যে নাহিদের হাসি মুখটা দেখছিল তার পর থেকে এখনো নাহিদের মুখে হাসি দেখেনি। ভা’গ্যিস সেদিন অ’বাধ্য চোখটা নাহিদকে দেখে নিয়েছিল। তোহার মৃ’ত্যুর পর নাহিদ যেন হাসতে ভুলে গিয়েছে।

নাহিদ আর রিয়া দুজন নাহিদের মামার বাড়িতে যাচ্ছে। নাহিদ সব সময় মন মরা থাকে বিধায় নাহিদের আম্মু দুজনকে জোর করে পাঠিয়েছে। রিয়া আজও নাহিদকে মনের কথা জানায়নি। জানাবে কি করে? নাহিদ যে এখনো তোহাকে ভুলেনি।

নাহিদের পাশে একটা ছয়/সাত বছরের ছোট বাচ্চা ছেলে বসে আছে। মুখ তার অন’র্গল চলছে। নিজের মাকে বারবার একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে। নাহিদকে অনেকক্ষণ ধরে মোবাইলে একটি মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
“আঙ্কেল এই মেয়েটা কে?

বাচ্চাটার কথায় নাহিদ চোখ তুলে বাচ্চাটার দিকে তাকাল। আবারো তোহার ছবির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার অবিবাহিত বউ।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে