#অবিবাহিত_বউ
#পর্বঃ১৯
#লেখিকা_লক্ষী_দেব
ঘড়িতে বারোটা বাজার ঠিক পাঁচ মিনিট বাকি। অন্য দিনের মতো তোহা আজকে ঘুমিয়ে যায়নি। অপেক্ষা করছে নাহিদের কলের জন্য। রাত বারোটা মানেই যেন কিছু সুন্দর অনুভূতি, কিছু রঙিন মুহূর্ত। তোহার কাছে এই পাঁচ মিনিট পাঁচ বছরের মতো লাগছে। কিছুতেই যেন সময় ফুরাচ্ছে না। তোহা ছটফট করতে লাগলো। বারবার মোবাইলে সময় দেখতে লাগলো। কিন্তু পাঁচ মিনিট যে শেষ হচ্ছে না। তোহা সিদ্ধান্ত নিল আজকে নাহিদকে কড়া করে বকে দেবে। কেন সে এতো রাত করে কল দেয়? কেন রাত বারোটার সময়ই তাকে কল দিতে হয়? কোন জায়গায় লেখা আছে, রাত বারোটার সময় কল দিয়ে প্রেমিকার সাথে কথা বলতে হয়? এটা কি কোনো নিয়ম? শুধু শুধু কেন এতো দেরি করে কল দিবে?
তোহা আবারো মোবাইলে সময় দেখে নিল। বি’রক্ততে কপাল কুঁচকে তাকালো। সময়টাও কি তার সাথে খেলা করছে? ষাট সেকেন্ডে এক মিনিট হওয়ার জায়গায় কি একশ বিশ সেকেন্ডে এক মিনিট হচ্ছে নাকি? বারোটা বাজার এখনও দুই মিনিট বাকি আছে। তোহা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলো এই দুই মিনিট যেন খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে যায়।
অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হলো। ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় বারোটা বাজার কয়েক সেকেন্ড পরই তোহার ফোনটা বেজে উঠল। সেই সাথে তোহার হৃৎ’পিণ্ডটা তড়িৎ গতিতে লাফাতে লাগলো। তোহা আর এক মুহূর্ত বিল’ম্ব করল না। কলটা রিসিভ করে কানে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অপর পাশ থেকে নাহিদ বলে উঠল,
“এই বউ?
নাহিদ এমন মন মাতানো ডাকে আবেশে তোহার চোখ দুটো ব’ন্ধ হয়ে গেল। ইশ, লোকটা এতো সুন্দর করে, এতো মিষ্টি করে ডাকে কেন? নাহিদ এতো দেরি করে কল দেয় দেখে এতক্ষণ মনে যতো বি’রক্তি ছিল সব যেন এক নিমেষেই কর্পূরের মতো উড়ে গেল। বুকের ভেতর শুরু হলো ভালোলাগার এক আ’শ্চর্য তা’ন্ডব। যা তোহাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভালোবাসার রাজ্য। যেখানে শুধু দুটো মানুষের আবির্ভাব রয়েছে। আশেপাশে কোনো মানুষ নেই। কোনো প্রানী নেই। আছে কেবল নাহিদ আর তোহা, তোহা আর নাহিদ। তোহা নাহিদের ডাকে সাড়া দিয়ে বলল,
“হুম।
তোহার সাড়া পেয়ে নাহিদ মুচকি হাসল। মেয়েটা আজকাল বউ বলায় রেগে যাচ্ছে না। অবলীলায় তার বউ বলে সম্বোধন করাকে সমর্থন করে যাচ্ছে। নাহিদ বলল,
“তুমি আজকে ঘুমাও নি?
“উহু। ঘুম কিছুতেই আসছে না। আমি কতো চেষ্টা করলাম একটু ঘুমানোর জন্য। কিন্তু ঘুম যে আসছেই না। বারবার কেবল আপনার কথা মনে পড়ছে। আপনি আমার এ-কি সর্ব’নাশ করলেন বলুন তো?
তোহার এমন সর্ব’নাশ করার জন্য নাহিদের একটুও খারাপ লাগলো না। একটুও অনুশোচনা হলো না। বরং ভেতর ভেতর ভালোলাগার সৃষ্টি হলো। নাহিদ মুচকি হেসে বলল,
” তুমি জানো, তোমার এমন সর্ব’নাশ করার জন্য আমার নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। আমার একটুও খারাপ লাগছে না।
“কি আ’শ্চর্য! আপনার খারাপ লাগছে না? কেন খারাপ লাগবে না? আপনি জানেন আপনার একটা কলের জন্য আমি কতোটা ছটফট করি, কতোটা অ’স্থির অ’স্থির লাগে? আপনার মুখ থেকে বউ ডাক শুনতে শুনতে এখন আমার বউ সাজতে ইচ্ছে করে। কি অ’দ্ভুত! আপনি ভাবতে পারছেন? যেই আপনাকে স’হ্য করতে পারতাম না এখন সেই আপনার জন্য আমার এতো পরিবর্তন।
নাহিদ আবারো মুচকি হাসল। এমন সুন্দর প্রাপ্তির জন্য বুকটা ভরে উঠছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত সুখ তার নামে লেখা হয়ে গেছে। নাহিদ মৃদু হেসে বলল,
“ভালোবাসা বড় অ’দ্ভুত। তাইতো তোমার এমন পরিবর্তন। তোমার বউ সাজার ইচ্ছে খুব শীঘ্রই পূরন হবে। আমি তোমায় আমার ঘরের বউ করে নিয়ে আসবো।
তোহা মুচকি হাসল। আচমকাই বলে উঠল,
“শুনুন।
“বলো।
তোহা শ্বা’স ফেলল। সম’স্ত লাজ, ল’জ্জা, সংকোচ ভুলে আচমকাই বলে উঠল,
“ভালোবাসি।
আক’স্মিক তোহার এমন অভাবনীয় কথায় খুশিতে আত্ম’হারা হয়ে নাহিদ কোনো প্রতি’ক্রিয়া করা ভুলে গেল। নাহিদ কোনো কথা না বলায় ধীরে ধীরে তোহার ল’জ্জা লাগছে। ল’জ্জা যেন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে। তোহা ফট করে কলটা কেটে দিল। নাহিদ সৎবিৎ ফিরে পেয়ে দেখল ইতিমধ্যে কল বি’ছিন্ন হয়ে গেছে। নাহিদ মুচকি হেসে বলল,
“ইশ, বউটা কি সুন্দর করে বলল।
_____________
ভার্সিটিতে গিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে নাহিদকে খুঁজতে লাগল তোহা। কিন্তু আশেপাশে কোথাও নাহিদের দেখা পাওয়া গেল না। তোহার ভ্রুঁ কুঁচকে এলো। গেল কোথায় লোকটা? তোহা দীর্ঘ’শ্বাস ফেলে ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল। ক্লাসের সামনে বারান্দায় রিয়া দাঁড়িয়ে একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে। রিয়া তোহাকে দেখে মিষ্টি হাসল। রিয়াকে হাসতে দেখে তোহাও সৌজন্যতা রক্ষা’র্থে হাসলো। ক্লাসে ব্যাগ রেখে এসে তোহা দেখল রিয়া বারান্দা থেকে এক দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কৌতুহল বশত তোহাও নিচের দিকে তাকাল। ওমনি মাঠের মাঝখানে ফাহিম, রনি, নাহিদকে দেখতে পেল। নাহিদের মোবাইলে কিছু একটা করছে। কয়েক সেকেন্ড পরই ফোনটা কানে লাগালো। নাহিদ ফোনটা কানে লাগানোর সাথে সাথে তোহার ফোনটা বেজে উঠলো।
রিয়া তোহার কাছাকাছি থাকায় ফোন বেজে উঠার শব্দে চমকে পেছনে তাকাল। তোহার ফোনে কল এসেছে দেখে খুব সহজেই বুঝে গেল ফোনটা নাহিদ করেছে। তোহা মোবাইলের স্ক্রি’নে নাহিদের নাম্বার দেখে চোখ তুলে রিয়ার দিকে তাকাল। দুজনের চোখাচোখি হতেই রিয়া বলল,
“কলটা রিসিভ করো। হয়তো নাহিদ ভাইয়া কল করছে।
তোহা মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে কল রিসিভ করল। ফোনটা রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে নাহিদ উ’দ্বিগ্ন ক’ন্ঠে বলে উঠল,
“কোথায় তুমি? আজকে কি ভার্সিটিতে আসবে না?
তোহা মুচকি হেসে বলল,
“আমি তো ভার্সিটিতে এসে পড়েছি। বর্তমানে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনাকে দেখছি।
তোহার কথা শুনে নাহিদ চট করে উপরে তাকাল। মুহুর্তের মধ্যেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। তোহা চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। তা দেখে নাহিদ বলল,
“তুমি এতো ল’জ্জা পাও কেন?
তোহা এক শব্দে উত্তর দিল,
“জানিনা।
“আচ্ছা। ক্লাস শেষে গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকো।
তোহা ‘আচ্ছা’ বলে রেখে দিল। রিয়া গভীর দৃষ্টিতে তোহাকে পর্যবেক্ষন করল। নাহিদের সাথে কথা বলার সময় তোহা যখন ল’জ্জায় চোখ ঘুরিয়ে নিল, মুখের মধ্যে যখন খুশির উচ্ছাস দেখা গেল সবই খুব নিপুণ ভাবে পর্যবেক্ষন করল রিয়া।
রিয়ার গভীর চোখ দুটো যে তোহাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে তা তোহা বুঝতেই পারল না। রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাহিদকে সে পাবে না জানে। তবে ওদের কোনো ক্ষ’তি চায় না। রিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিধাতা, তুমি ওদের সুখী করো।
__________
ছুটির পর তোহা গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পর নাহিদ বাইক নিয়ে তোহার সামনে এসে দাঁড়াল। মুচকি হেসে বলল,
“বাইকে উঠো।
তোহার ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে বলল,
“কেন? কোথায় যাবো আমরা?
“তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসবো।
তোহা আর কথা বাড়ালো না। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে নাহিদের বাইকে উঠে বসল।
আজকে অফিস শেষে তারেকুল বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিল। হঠাৎ করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল তোহার ভার্সিটি ছুটি হওয়ার সময় হয়ে আসছে। তারেকুল গাড়ি ঘুরালো। ভার্সিটি থেকে তোহাকে নিয়ে একেবারে বাসায় ফিরবেন বলে। কিন্তু ভার্সিটির কাছাকাছি আসতেই তারেকুলের চ’ক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। রেস্টুরেন্টের সেই ছেলেটার বাইকে উঠে বসেছে তোহা। তোহা যে বলেছিল ছেলেটার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে সেই কথাগুলো কি মিথ্যা ছিল?
তারেকুল আর ভাবতে পারল না। তোহা তাকে মি’থ্যা কথা বলেছে তার বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু নিজের চোখকে ও যে অবি’শ্বাস করতে পারছে না। নাহিদ বাইক স্টা’র্ট দিলে তারেকুল নাহিদের পিছু পিছু গেল। নাহিদ তোহাকে বাসায় নামিয়ে চলে গেলে তারেকুলের গাড়ি এসে বাসার সামনে থামল। তোহা তারেকুলকে দেখে চমকে উঠল। বুকের ভেতর অজানা ভয় তা’ন্ডব চালানো শুরু করেছে। আব্বু কি তবে আমাদের দেখে ফেলেছে?
#চলবে
#অবিবাহিত_বউ
#পর্বঃ২০
#লেখিকা_লক্ষী_দেব
তারেকুল গাড়ি থেকে নামল। ধীর পায়ে তোহার সামনে দাঁড়িয়ে তোহার দিকে স্থি’র, শান্ত, শীতল দৃষ্টিতে তাকাল। তারেকুলের চোখে কোনো কঠোরতা নেই, কোনো ক্ষি’প্রতা নেই। তবুও তোহা শিউরে উঠলো। শুকনো ঢোক গিলল। আব্বুর অমন শান্ত, শীতল দৃষ্টি তার কাছে ভালো ঠেকছে না। হৃৎ’পিণ্ড ভয়ের কারণে দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। কিন্তু কিসের এতো ভয়? কিসের এতো অস্থি’রতা? আব্বু তো শান্তই আছে।
তোহা নানা ভাবে নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু অবুঝ, অবাধ্য মন যে কথা মানে না। মন বলছে কিছু একটা হবে। তারেকুল শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েই বলল,
“বাসায় যাও মামনি।
তোহা মাথা নিচু করে বাসার ভিতরে চলে গেল। তারেকুল ও তোহার সাথে সাথে গেল। বাসার ভিতরে গিয়ে তোহা যখন নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল তখনই তারেকুল ডেকে উঠল,
“দাঁড়াও তোহা।
তোহা দাঁড়িয়ে পড়ল। বুকটা কেঁপে উঠছে। উফ, প্রেমে এতো যন্ত্র’ণা কেন? এতো ভয় কেন? তোহা শুকনো ঢোক গিলে পেছন ফিরে তারেকুলের দিকে তাকাল। তারেকুল শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আমি তো তোমায় মিথ্যে বলতে শিখাইনি মামনি। তাহলে আমায় কেন মিথ্যে বললে?
তারেকুলের এমন কথায় তোহার বুকটা হু হু করে উঠল। মনের মাঝে যেই ভয়টা দানা বেঁধে ছিল শেষ পর্যন্ত সেই ভয়টাই সত্যি হলো। আব্বু আমায় ভুল বুঝল? তোহা ছল’ছল দৃষ্টিতে তারেকুলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি তোমায় মিথ্যে কথা বলিনি আব্বু।
তারেকুল ক্ষানি’কটা হাসল। তোহা দুচোখ দিয়ে আব্বুর তাচ্ছি’ল্যের হাসি দেখল। বুকের ভেতরে ইতিমধ্যে রক্ত’ক্ষরণ শুরু হয়ে গেছে। বুকটা ছিঁড়ে যদি আব্বুকে দেখাতে পারতাম। তাহলে হয়তো আব্বু বিশ্বাস করত আমি সেই দিন কোনো মিথ্যে কথা বলিনি। তোহা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সেদিন নাহিদ যখন তোহাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছিল তারেকুল সেদিন নাহিদের মুখটা না দেখলেও আজকে সরাসরি নাহিদের মুখটা দেখে ফেলেছে। সেই সাথে নাহিদের বাইকটাকেও চিনে ফেলেছে। তারেকুল দুচোখ বন্ধ করে শ্বা’স ফেলে বলল,
“তুমি সেইদিন কার বাইকে করে এসেছিলে? ছেলেটা কি তোমার ক্লাসের ছিল?
তোহা সেদিনের মতো আজকে মি’থ্যে কথা বলতে পারল না। দুপাশে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বুঝালো। তারেকুল আবারো হেসে বলল,
“তারপরও বলছো তুমি আমায় মিথ্যে কথা বলো নি?
তোহা আহত দৃষ্টিতে তারেকুলের দিকে তাকাল। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কি করে বিশ্বাস করাবে আব্বুকে? উফ, বুকের ভেতর কতো য’ন্ত্রণা হচ্ছে। তারেকুল তোহার দিকে ছল’ছল দৃষ্টিতে তাকাল। এতো আদর করে, এতো যত্ন করে ছোট থেকে তিল তিল করে গড়ে তোলা মেয়েটা তাকে মিথ্যে কথা বলছে? এ যে স’হ্য হচ্ছে না। তারেকুল বুকে পাহাড় সমান য’ন্ত্রণা নিয়ে চলে গেল।
তোহা থম মেরে ফ্লোরে বসে পড়লো। দুচোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। তোহা তারেকুলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কাতর স্বরে বলল,
“আমি তোমায় একটা মিথ্যে কথাই বলেছি আব্বু। আর কোনো মিথ্যে কথা বলিনি।
তোহার বলা কথাটা তারেকুলের কানে পৌঁছাল না। সে ততক্ষণে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিয়েছে। তোহা কতক্ষন নির্বাক হয়ে একই জায়গায় বসে রইল। কি করবে, কি করে আব্বুর ভুল ভাঙাবে কিছুই মাথায় আসছে না। চোখের সামনে আব্বুর ছল’ছল চোখ জোড়া ভেসে উঠছে। তোহার চোখ জোড়া বারে বারে ভিজে উঠছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
কেন সেদিন ওই একটা মিথ্যে কথা বলেছিলাম? ওই একটা মিথ্যে, ওই একটা মিথ্যেই এভাবে কাল হলো? আব্বুর সামনে আমাকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করে দিল? অথচ মানুষ কতো অবলীলায় হাজারো মি’থ্যে কথা বলে যাচ্ছে। কই, তাদের তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে আমার বেলায় কেন ওই একটা মিথ্যেই আমার কাল হলো? বিধাতা কেন এতো নি’ষ্ঠুর হলো?
তোহা উঠে দাঁড়াল। দুহাত দিয়ে চোখে পানি গুলো মুছে ফেলল। না, এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। আব্বুর ভুল ভাঙাতে হবে। তোহা গুটি গুটি পায়ে তারেকুলের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারেকুলের রুমের দরজায় ধা’ক্কা দিয়ে কান্না’মিশ্রিত ক’ন্ঠে বলল,
“আব্বু দরজাটা খুলো। আমার কথাটা প্লিজ শোন। আমি তোমায় মি’থ্যে কথা বলিনি আব্বু। আমার কথাটা একটু শুনো।
তোহা নিরাশ হলো। আম্মু নিশ্চয়ই রুমে আছে। হয়তো বা আব্বুর চোখ রাঙানিতে দরজা খোলার সাহস পাচ্ছে না। তোহা বি’ষন্ন মনে রুমের দিকে পা বাড়ালো। শরীরটা ভীষণ ক্লা’ন্ত লাগছে। মন চাচ্ছে ছোট বেলার মতো চিৎকার করে কান্না করতে। কিন্তু বড় হয়ে গেলে যে চিৎকার করে কাঁদতে নেই।
_________
তোহা বিছানায় শুয়ে আছে। মনের মাঝে ছিটে ফোঁটা ও আনন্দ নেই। চোখে কোনো ঘুম নেই। অথচ তার তখন এগারোটা পাড় করে বারোর ঘরে পৌঁছাচ্ছে। তোহা নির্নি’মেষ শূন্যে তাকিয়ে আছে। সকালেই যা নাস্তা করেছিল। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত মুখে কিছু তুলে নি। তুলবে কি করে? মন যে কোনো কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। তোহার আম্মু কয়েকবার খাওয়ার জন্য ডাকতে আসলেও তোহা ডিরেক্ট মানা করে দিছে।
ঘড়িতে যখন কাঁটায় কাঁটায় বারোটা বাজলো ঠিক তখনই নিস্ত’ব্ধ রুমে বিকট শব্দে তোহার মোবাইলটা বেজে উঠল। তোহা মোবাইলটা হাতে নিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে নাহিদের নাম্বারের দিকে তাকিয়ে রইল। কল রিসিভ করার কোনো তাড়া দেখা গেল না মুখ মন্ডলে। তখনই ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে গেল। তোহা দীর্ঘ’শ্বাস ফেলে মোবাইলটা হাতে নিয়ে রাখলো।
কয়েক সেকেন্ড পর মোবাইলটা আবারো বেজে উঠল। তোহা এবার আর দেরি করল না। মোবাইলটা বেজে উঠার সাথে সাথেই কল রিসিভ করে কানে দিল। ওপাশ থেকে হাস্যে’জ্জল ক’ন্ঠে নাহিদ বলে উঠল,
“ঘুমিয়ে পড়েছিলে বুঝি?
তোহা বি’দ্রুপ করে হাসল। ঘুম যে কিছুতেই চোখে ধরা দিচ্ছে না। তোহা দীর্ঘ’শ্বাস ফেলে মলিন ক’ন্ঠে বলল,
“না, ঘুমাইনি।
তোহার এমন মলিন কন্ঠ শুনে নাহিদের ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে এলো। হুট করে এমন করে কথা বলার কারণ বুঝতে পারল না। উ’দ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে তোহা? তোমার কন্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন?
তোহা দীর্ঘ’শ্বাস ফেলে এতো দিনে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা বলল। রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে ওই দিনের মি’থ্যে কথা বলাটা, আজকে তারেকুল দুজনকে একসাথে দেখা ফেলা সব কিছু বলল। বলতে বলতে তোহার চোখ দুটো আবারো ছল’ছল করে উঠল। কাতর স্বরে বলল,
“জানেন, আমি আব্বুকে খুব ভালোবাসি। আব্বু এমন ভুল বুঝে আছে দেখে আবার খুব ক’ষ্ট হচ্ছে। আমি কি করে আব্বুর ভুল ভা’ঙাবো?
সবকিছু শুনে নাহিদ স্ত’ব্ধ হয়ে গেল। তোহার ক’ন্ঠ শুনে ইতিমধ্যে বুঝে গেছে মেয়েটা তার আব্বুকে অনেক ভালোবাসে। এর মধ্যেই তোহার ফুঁপিয়ে উঠার শব্দ পেল। মেয়েটা কি তাহলে কাঁদছে? নাহিদ উ’দ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“এই তোহা কাঁদছো কেন? দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। আব্বু তোমায় আগের মতোই বিশ্বাস করবে। এভাবে কাঁদে না বউ।
নাহিদের অমন আ’হ্লাদী কথায় তোহার কান্নার গতি কমার বদলে আরো বেড়ে গেল। তা শুনে নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আবারো বলে উঠল,
“আহা, কান্না থামাও। দেখো এভাবে কান্না করলে কোনো সমাধান হবে না। কান্না থামিয়ে কোনো সমাধান বের করার চেষ্টা করো।
নাহিদের কথায় তোহার কান্নার গতি কিছুটা কমে এলো। নাহিদ স্ব’স্তির শ্বা’স ফেলে বলল,
“সারাদিন খাবার খেয়েছো নাকি খাবারের কথা ভুলে এমন মনমরা হয়ে ছিলে?
খাবারের কথা শুনে তোহা নাহিদকে আগে থেকেই সাবধান করে বলল,
“আপনি আমাকে এখন একদম খাওয়ার কথা বলবেন না। আমি কিছুতেই খাব না।
তোহার কথায় নাহিদ মুচকি হাসল। মেয়েটা ধরেই নিয়েছে নাহিদ এখন তাকে খাওয়ার জন্য জোর করবে। তবে নাহিদ জোর করল না। তোহাকে বলল,
“ঠিক আছে খেতে হবে না। অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমাতে হবে। দেখি চোখ দুটো ব’ন্ধ করো তো দেখি।
নাহিদের কথামতো তোহা চোখ দুটো ব’ন্ধ করল। নাহিদ আবারো বলে উঠল,
“একদম চোখ খুলবে না। চুপ করে চোখ বন্ধ করে রাখবে। দেখবে ঘুম চলে আসবে।
তোহা নাহিদের কথা শুনল। কোনো কথা বলল না। নাহিদ কল না কেটে তোহার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে লাগলো। ধীরে ধীরে যখন তোহার নিঃশ্বাসের শব্দ ভারী হয়ে আসতে লাগলো নাহিদ তখন বুঝতে পারল তোহা ঘুমিয়ে গেছে। তবুও নিশ্চিত হতে ডাকল,
“বউ।
ঘুমের ঘোরে তোহার আনমনে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,
“হুম।
তোহার কথায় নাহিদ হেসে উঠল। যখন বুঝল হাসির শব্দে তোহার ঘুম ভেঙ্গে যাবে তখনই কলটা কেটে দিল। হাসি থামিয়ে বলল,
“বউটা ব’ড্ড ভালো।
#চলবে