অবশেষে তুমি আমি পর্ব-০৬

0
2080

#অবশেষে তুমি আমি~৬,
#Chhamina Begam

ভালোবাসা -ছোট্ট একটা শব্দ। কিন্তু এর পরিধি এতটাই বিস্তৃত যে এর জন্য লোকে কত কিছুই না করে । কেউ নিজের জীবন বিসর্জন দিতে পারে , কেউ ভালোবাসার মানুষটিকে পাওয়ার জন্য সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধে যেতে পারে , আবার কেউ ভালোবাসার মানুষটির ভালো থাকার জন্য নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে বিসর্জন দিতে পারে । এই যেমন রোজা বসে আছে দুটো অপরিচিত ব‍্যক্তির সামনে । তাদের মধ্যে একজন প্রবীণ আর একজন মধ‍্যবয়স্ক । দুজনের পড়নে সাদা পাঞ্জাবী। প্রবীণ লোকটির চুল দাড়ি সব সাদা আর মধ্য বয়স্ক জনের চুল দাড়িতে সদ‍্য পাক ধরেছে । নিজের ঘর থেকে বেরিয়েই একনজর দেখে সেই যে মাথা নামিয়েছে আর তোলেনি । মনের মধ্যে একধরনের পবিত্রতার রেশ অনুভব করছে রোজা । তবুও মনের কোণে খচ খচ করে বিধছে দাদাভাইয়ের কথা গুলো । ওর একটা ভুল সিদ্ধান্তে শাওনের পুরো পরিবারের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাবে । লোক দুটি ওর সাথে সুন্দর ব‍্যবহার করছে ‌। কথা শুনেই শ্রদ্ধা চলে আসে তবুও মনের কষ্টটা এতটাই প্রবল যে “হু, হা “ছাড়া মুখ দিয়ে তৃতীয় কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। লোক দুটিকে একটু ভালো করে খেয়াল করলে হয়তো খারাপ লাগাটা নিমেষে উড়ে যেত ।

কিছুক্ষণ কথা বলে , খাওয়া দাওয়া করে লোক দুটি বিদায় নেয়। যাওয়ার আগে বৃদ্ধ লোকটি রোজার মাথায় হাত দিয়ে আশির্বাদ স্বরূপ দুই হাজার টাকার দুটো নোট ধরিয়ে দেয় । পাথরের মূর্তির মতো রোজা চুপচাপ মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকে ড্রয়িং রুমে । অনুভূতি গুলো মনে হয় ভোতা হয়ে গেছে । নাহলে কিছু অনুভব করছে না কেন ? চাবি দেয়া পুতুলের মতো নিজের রুমে এসে জানালার গ্লীল ধরে শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে থাকে । শাওন কি করছে কে জানে ? ওর আব্বু কি ওকে বকেছে ?এরকম অগোছালো কিছু ভাবনা অবশ করে দেয় রোজাকে ।

বিকেলে টিয়া আসে রোজাদের বাড়ি । রুবিনার সাথে টুকটাক কথা বলে রোজার কথা জিজ্ঞেস করে। ‌ রুবিনা জানায় রোজা বাড়ির সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করা দিয়েছে। দুপুর থেকে নিজের ঘর থেকে বেরোয়নি । মেয়েটা যেভাবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে তাতে মেয়ের চিন্তায় চিন্তায় রুবিনা নিজে অসুস্থ বোধ করছে । তবুও সামসুল সাহেবের কড়া ভাবে নিষেধ করেছেন রোজাকে যেন কিচ্ছু জানানো না হয় । টিয়া রোজার ঘরে ঢুকে দেখে ঘরের জিনিস পত্র সব এলোমেলো হয়ে আছে । অথচ রোজা খুব গোছালো স্বভাবের মেয়ে । মেঝেতে কতকগুলো কাগজের টুকরো পড়ে আছে। টিয়া কাছে গিয়ে দেখে ওগুলো দুই হাজার টাকা নোটের ছেড়া টুকরো । রোজা বিছানায় শুয়ে আছে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে । গালে জলের দাগ পড়েছে । বোঝাই যাচ্ছে খুব কান্না করেছে রোজা । রোজার এলোমেলো চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে গালে হাত রাখে টিয়া । রোজা ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে টিয়াকে । তার পর উঠে বসে টিয়াকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ওঠে । প্রিয় বন্ধুর এই অবস্থা দেখে টিয়াও নিজের চোখের জল সামলে রাখতে পারে না । চোখের কোণ বেয়ে আসা জল খুব সন্তপর্ণে মুছে রোজার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ।
-“রোজা নিজেকে সামলা প্লিজ । এত কাঁদে কেউ ? দেখ তো কি হাল করেছিস নিজের ? প্লিজ লক্ষ্মীটি, চুপ কর । ”

-“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে টিয়া । আমার ….আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে এখানে । আমি আর এসব নিতে পারছি না । আব্বু আম্মু সবাই কেমন যেন হয়ে গেছে ? আমার কথা কেউ শুনছে না ! সবাই নিজের নিজের ইচ্ছে আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে । ওই লোকটা… ওই লোকটাকে কক্ষনো আমি শাওনের জায়গায় বসাতে পারব না টিয়া। ঐ লোকটার কথা শুনলেই মনে হয়ে আমার শরীরে কেউ আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে । পারিনা সহ‍্য করতে । সবাই এমন কেন করছে টিয়া ? কি এমন ক্ষতি হতো যদি শাওনকে মেনে নিত ? এই টিয়াপাখি, আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল না । প্লিজ ।আমি শাওনের কাছে যাব ।আমি এই বিয়ে করব না টিয়া । প্লিজ আমাকে নিয়ে চল …”

-“রোজা ,পাগলামি করিস না । এখনও সময় আছে । চাচুকে বোঝানোর চেষ্টা কর । তুই তো জানিস শাওন তোকে কত ভালো বাসে ? তুই যদি এমন পাগলামি করিস তাহলে ও নিজেকে সামলাবে কি করে ? রোজা, একটু বোঝার চেষ্টা কর । ”

-“কি বুঝবো আমি ? আমি কিচ্ছু বুঝতে চাই না ! আর কাকে বোঝানোর কথা বলছিস ? আব্বুকে ? তিনি তো আমার কথা শুনতেই চান না । ”

বাড়ির সামনে উঠোনে শাওনের ভাইবোনেরা ক্রিকেট খেলছে। একটা বড়ো আম গাছের গুড়িতে বসে ভাইবোনদের খেলা দেখছে শাওন । আর বারবার হাতে ধরা ফোনটার দিকে তাকিয়ে দেখছে । অধীর আগ্ৰহে অপেক্ষা করছে টিয়ার কলের । এতক্ষণ তো পৌঁছে যাওয়ার কথা ! তাহলে কল করছে না কেন ? আচ্ছা রোজা ..ও ঠিক আছে তো ! খুব অস্বস্তি হচ্ছে শাওনের । সারাক্ষণ বুকের ভেতর একটা চিনচিনে ব‍্যাথা অনুভব করছে। এতটা অসহায় আগে কখনো মনে হয়নি নিজেকে ! সেদিন রোজাকে নিয়ে পালিয়ে গেলে ঠিক হতো হয়তো ? কিন্তু তার পর ? আব্বুর সম্মান ? লোকে নানান কথা শোনাবে আব্বুকে । না না ,এতটা স্বার্থপর তো শাওন নয় । নিজের খুশির জন্য আব্বুর মাথা নিচু হোক এটা ও কখনোই মেনে নিতে পারবে না । কিন্তু রোজা, ওকে ছাড়াও তো … না আর ভাবতে পারে না শাওন । মাথাটা যন্ত্রণায় ছিড়ে যাচ্ছে ! চোখ লাল হয়ে আসছে । গাছে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে শাওন । রোজার পাশে অন্য কাউকে কল্পনা করতেও মনের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায় । মন বারবার অবাধ্য হয়ে ওঠতে চায় । যে করেই হোক রোজাকে তার চাই । কিন্তু মস্তিষ্কের যুক্তির কাছে বারংবার হার মানতে হয় মনকে । নিজের জন্মদাতা পিতার অসম্মান করে ও ভালো থাকবে কি করে ? নিজের বিবেকের কাছে কি জবাব দেবে তখন ?

– “দাদা ..ও দাদা “..ছোট ভাই রিজওয়ানের ডাকে ভাবনার সুতো ছিড়ে মাথা তুলে তাকায় শাওন ‌,
-” বলটা দে , তাড়াতাড়ি …. ওই তো , তোর পায়ের কাছে ”

শাওন বলটা কুড়িয়ে রিজওয়ানের দিকে ছুড়ে দেয় ।
আবার বসতে যাবে তাতেই ফোনের রিংটোন শুনে উঠে দাড়ায় । হাটতে হাটতে বাড়ির ডানপাশের পুকুর পাড়ে এসে বসে । বুকের ভিতর কেউ হয়তো হাতুড়ি পেটাচ্ছে ? “দ্রীম, দ্রীম ” শব্দে বুকের ভেতরটা তোলপাড় করছে। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে শাওন কল রিসিভ করে । কারো মুখে কোনো কথা নেই । শাওন বুঝতে পারে অপর পাশের ব‍্যক্তিটি রোজা । একে অপরের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে দুজনে । গভীর ভাবে অনুভব করার চেষ্টা করে সেই ক্ষীণ শব্দ ।

ভালোবাসার অনুভূতি এত অদ্ভুত কেন হয় ? ঘন্টার পর ঘন্টা যেই মানুষটাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করে , যার গলায় স্বর একবার শোনার জন্য দিনরাত অস্থিরতায় কেটে যায় তাকে সামনে পেয়ে ,তার গলার স্বর শুনে কেন মানুষ তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না ? বন্ধ দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রোজার দিকে তাকিয়ে এই প্রশ্ন গুলোই ঘুরতে থাকে টিয়ার মনে । অবাক হয়ে দেখে প্রিয় বান্ধবীকে । যে এতক্ষণ কতটা ছটপট করছিল ! অথচ এখন শাওনের ফোন পেয়ে কতটা শান্ত হয়ে গেছে ! নিরবে চোখ দুটি দিয়ে নদী বইছে । কেউ কাউকে এতটা ভালোবাসে কি করে ? এই বাড়ির লোকদের কি এই ভালোবাসাটা চোখে পড়ছে না ? নাকি দেখেও না দেখার ভান করছে ? রোজার বাবামায়ের ওপর খুব রাগ হয় টিয়ার । বিয়ে যদি দেবেই তাহলে সেই ছেলেটি শাওন নয় কেন ? কিন্তু এই কথাটা সামসুল সাহেবকে জিজ্ঞেস করার মতো সাহস নেই টিয়ার । ভাগ্য মনে করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে টিয়া ।

দুটো দিন চোখের পলকে পালিয়ে গেল । আজ রোজার আঁকদ । পুরো বাড়ি আত্মীয় স্বজনে ভরে গেছে । তবে অনুষ্ঠান হবে কমিউনিটি সেন্টারে । মুক্তা কাল রাতে এসেছে । এসে থেকেই বকবক করেই যাচ্ছে । রোজার বিরক্ত লাগছে সবকিছু । চোখ বন্ধ করে বিছানার হেড়বোর্ডে হেলান দিয়ে বসে থাকে । কত স্বপ্ন সাজিয়েছে ও আর শাওন ওদের বিয়ে নিয়ে । চোখ বন্ধ করেই মলিন হাসি হাসে রোজা । হ‍্যাঁ , আজ ওর বিয়ে হচ্ছে । স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে রোজার । তবে স্বপ্নের কোথাও শাওন নেই । এমনটা কি হওয়ার ছিল ? মুক্তা বিছানায় বসে রোজার হাতে মেহেন্দি পরিয়ে দিচ্ছে, সাথে কথার ফুলঝুরি ছুটছে । পাশে আর এক মামাতো দিদি শিউলি রোজার জন্য আনা শাড়ি গহনা দেখতে ব‍্যস্ত । মুক্তা মেহেন্দি লাগানোর মাঝেই জিজ্ঞেস করে ,

-“রোজা জিজুর নাম লিখব হাতে ? ”
রোজা এখনো চোখ বন্ধ করে বসে আছে । মুক্তা রোজার গায়ে একবার ঝাকি দিয়ে আবার প্রশ্ন করে ,
-“এই রোজা ,জিজুর নামের ফাস্ট লেটার কি ?”
-” এস “..

মুখ ফসকে নামটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় । মুক্তা আর শিউলি দুজনেই বিস্মিত হয়ে তাকায় রোজার দিকে । ওদের জানা মতে রোজার হবু বরের নাম ‘এস’ দিয়ে আসে না । তাহলে এই ‘ এস’ টা কে? চারপাশে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রোজা চোখ মেলে তাকায় ।ওদের দুজনকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা সংকুচিত হয়ে যায় রোজা ।

-“এস ফর কে রোজা ?” শিউলি প্রশ্ন করে । রোজা প্রশ্নটা স্বযত্নে এড়িয়ে যায় । বলে,
-“আপু , আমি একটু একা থাকতে চাই । প্লিজ কিছু মনে করিস না । ”
-“না না । ইট’স ওকে । আমরা যাচ্ছি । তুই রেস্ট কর ”

শিউলি আর মুক্তা বেরিয়ে যায়। জানালা গলে শেষ বিকেলের আলো এসে ঘরের মেঝেতে আয়তাকার প্রতিবিম্ব ফেলেছে । রোজা বাইরে তাকায়। সূর্য তার আলোর রেশ সরিয়ে দিয়ে পৃথিবীর অন্য পাশটায় উদিত হওয়ার পায়তারা করছে। আকাশের বুকে ধূসর মেঘ মুখ গোমরা করে ভেসে বেড়াচ্ছে । হয়তো রোজার মতোই ওদেরও মন খারাপ । বৃষ্টি হবে হয়তো । হাওয়ার দাপটে জানালার পর্দা গুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে । রোজার খুব জানতে ইচ্ছে করে বিষন্নতার নির্দিষ্ট কোনো ভাষা আছে কিনা ? যদি থাকে তাহলে রোজা নিজের সমস্ত বিষন্নতা গুলোকে কাগজে বন্দি করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিত ।

কমিউনিটি সেন্টার থেকে ফিরে সামসুল সাহেব নিজের ঘরে যাওয়ার সময় রোজার ঘরের দরজায় টোকা দেন । ভেতর থেকে রোজা আওয়াজ দেয় ,
-“দরজা খোলা আছে ..”
সামসুল সাহেব ঘরে প্রবেশ করে দেখেন জানালার পাশে রোজা বসে আছে । রোজা আব্বুকে দেখে বিছানায় কিনারায় এসে পা নামিয়ে বসে ।
-“তুমি নাকি খাওনি কিছু ? ক্ষিদে পায়নি ? তোমার আম্মুকে বলি খাবার নিয়ে আসতে ? ”
-“আমার ক্ষিদে নেই আব্বু ..”
-“কিন্তু এভাবে থাকলে তো চলবে না !তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে !আম্মুকে বলছি খাবার নিয়ে আসতে । খেয়ে নিও ”
-“আর শরীর ! চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছ বলে কনসার্ণ দেখাচ্ছ । আর মনটা ? তার খবর কেন রাখছ না আব্বু ?” মনে মনে ভাবে রোজা । সামসুল সাহেব মেয়ের কাছ থেকে জবাব না পেয়ে চলে যেতে উদ‍্যত হন । রোজা পেছন থেকে ডেকে ওঠে,
-“আব্বু , এমন কেন করছ তুমি ? ”
-“যা করছি তোমার ভালোর জন্য করছি রোজা । বোঝার চেষ্টা কর ”
-“আব্বু , এখনো তো সময় আছে ‌ । প্লিজ ,তুমি বিয়েটা ভেঙে দাও । আমি মিরাজ কে বিয়ে করতে পারব না আব্বু । ”

বলতে বলতে রোজা সামসুল সাহেবের পা জড়িয়ে ধরে কেদেঁ ওঠে ।

-“প্লিজ আব্বু , বিয়েটা আটকাও ”

মেয়ের কান্নায় সামসুল সাহেব বিচলিত হয়ে পড়েন । মেয়েকে সামনে দাড় করিয়ে মাথায় হাত রেখে বলেন ,
-“রোজা মা , আব্বুর ওপর বিশ্বাস রাখ । তুমি ভালো থাকবে । কিন্তু বিয়ে ভেঙে দেওয়া কোনো মতেই সম্ভব নয় ”

বলেই সামসুল সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে যান । মেয়ের কান্না দেখে তিনি দূর্বল হয়ে পড়তে চান না । আজ তার মেয়ের জীবনের এত বড়ো একটা দিন । কোনো কমতি রাখলে তো চলবে না ।

সারাবাড়িতে শাওনকে খুঁজে না পেয়ে রিজওয়ান ছাদে এসে দেখে ওর দাদা ছাদে শুয়ে আছে । দৃষ্টি উপরে নিবন্ধিত । সূয‍্যি মামা তার কাজ শেষ করে অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে । সেই সুযোগে চাঁদ রুপালি আলো ছড়িয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করতে ব‍্যস্ত ।
” দাদা , এখানে শুয়ে আছিস কেন?নিচে চল । সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে ।”

রিজওয়ানের গলার আওয়াজ পেয়েও শাওন নিঃশ্চল হয়ে পড়ে থাকে । রিজওয়ান আবার তাড়া দেয় ,
-“এই দাদা। উঠছিস না কেন ? ওঠ । তাড়াতাড়ি চল, সবাই রেডি হয়ে বসে আছে তো ।”
-” কেন ?আমার সাথে কি ? আর রেড়ি হয়েছে কেন ? কোথায় যাবে সবাই ?”শুয়ে শুয়েই প্রশ্ন করে শাওন ।

রিজওয়ান অবাক হয়ে তাকায় দাদার দিকে ।
-“কেন মানে কি ? যার বিয়ে সেই যদি না যায় তবে বিয়ে হবে কিভাবে ?”
রিজওয়ানের কথা শাওনের কানে বজ্রপাতের মতো শোনায় । চকিতে উঠে বসে । চোখ দুটো বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে ,
-“কার বিয়ে ? ”
-” আমার !”হতাশ হয়ে বলে রিজওয়ান। তারপর আবার বলে,
-“অবভিয়াসলি ,তোর । আমাদের বাড়িতে বড় এবং অবিবাহিত বলতে একমাত্র তুই আছিস । অবশ্য তুই জানবি কি করে ? সারাদিন তো দেবদাসের মতো পড়ে থাকিস । একটু চোখ কান খোলা রাখলেই বুঝতে পারতি কি হচ্ছে বাড়িতে ? ”
– “কিন্তু কার সাথে বিয়ে ? আর এসব কখন ঠিক হল ?”
-“আমি এত কিছু জানি না । শুধু এটুকু জানি যে দাদু মেয়ে পছন্দ করেছে ।এখন চল , নিচে সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে । গাড়িও এসে গেছে । ”

হঠাৎ করে শাওনের কি হয় কে জানে , রিজওয়ানকে রেখেই খটখট শব্দ করে নিচে নেমে যায় ।ড্রয়িং রুমে মেহেতাব সাহেব ওনার বাবার সাথে কিছু নিয়ে আলোচনা করছেন । শাওন ভনিতা ছাড়াই মেহেতাব সাহেবকে ডাকে ,
-“আব্বু ?”
মেহেতাব সাহেব কথা থামিয়ে শাওনের দিকে তাকায় ।
-“কিছু বলবে ?”
-“এসব কি হচ্ছে আব্বু ? ”
-” কোথায় কি হচ্ছে ?”
শাওন অধৈর্য হয়ে পড়ে । বলে,
-” আমি রোজগার করি না বলে তোমরা রোজাকে মেনে নিতে পারছ না । ঠিক আছে । আমিও মেনে নিয়েছি সেটা । কিন্তু এখন তোমরা এসব কি শুরু করলে ? রোজাকে আমি রোজগার করে খাওয়াতে পারব না ফলে নাকচ করে দিলে আর এখন অন্য আর একটা মেয়েকে আমার সাথে বেঁধে দিয়ে তার জীবনটা কেন নষ্ট করতে চাইছ ? এখানেও কি তুমি তোমার পলিটিক্স নিয়ে আসছ আব্বু ?”

মেহেতাব সাহেব সহ বাড়ির বয়োজৈষ্ঠোরা সবাই বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেছে। যে ছেলে তার বাবার মুখের ওপর একটা কথাও কখনো বলে না আর তার মুখে খই ফুটছে কিভাবে ?

মেহেতাব সাহেব মুচকি হেসে বলেন ,

-“শাওন , একটা কথা কি বলতো ? আমাদের পুরো জীবনটাই পলিটিক্সের প্রিন্সিপলস দিয়ে ঘেরা । কখনও সেই প্রিন্সিপল গুলো সহজ সরল হয় আবার কখনও তা জটিল হয় । ডিপেন্ড করে কে কিভাবে সেই প্রিন্সিপল গুলো এপ্লাই করবে ? যাই হোক আমরা যাকে পছন্দ করেছি তার এই বাড়ির বউ হওয়ার সব যোগ্যতা আছে । আশা করি , তুমি আমাদের সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করবে না । ”

ব‍্যাস আর কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না । নিজের ইচ্ছে থাক আর না থাক সম্মতি দিতেই হব। আজ শাওনের সত্যি সত্যি আফসোস হচ্ছে কেন সে বাড়ির বড় ছেলে হল ? বাড়ির বড় ছেলে হওয়া মানেই তুমি দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছ কি নেই তা জানার আগেই একঝাঁক দায়িত্ব এসে কাধেঁ চড়ে বসবে । বাড়ির প্রত‍্যেকটা মানুষের ভালোখারাপের খবর তোমাকে রাখতে হব । সবাইকে ভালো রাখার দায় টা যেন শুধু তারই । শুধু তার ইচ্ছেটার কথাই কেউ একবার ভালো করে জিজ্ঞেস করবে না । কেউ ভাববে না মানুষ টা আসলে কি চায় ? শাওনের মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে একটু স্বার্থপর হতে । খুব বেশি ক্ষতি হবে কি যদি ও একটু স্বার্থপর হয়ে শুধু নিজের ইচ্ছেটার কথা ভাবে , শুধু নিজের স্বপ্ন গুলোর কথা ভাবে , সেগুলো পূরণের জন্য পদক্ষেপ নেয় । বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চায় । পাছে কেউ বুঝতে পারে শাওন খুশি নয় , তাই সেই দীর্ঘশ্বাসটাকেও নিজের ভিতর মাটি চাপা দিয়ে দেয় শাওন । হোস্টেলে থাকলে হয়তো কষ্ট গুলো জল হয়ে গড়িয়ে পড়ত কিন্তু এখানে কান্না করলে অপরাধ হয়ে যাবে । হয়তো শুনতে হবে ,’ছেলে মানুষ হয়ে আবার কান্না করে !’ মানে কষ্ট পেলে চোখের জল শুধু মেয়েরাই ফেলতে পারে । ছেলেদের সেই অধিকার নেই । তাদের সব অনুভূতিকে মনের ভেতরেই দাফন করে দিতে হবে । তাতে যত কষ্টই হোক না কেন ?

To be continue…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে