#অপ্রিয়_প্রিয়জন
#Fiza siddique
#পর্ব-9
ট্রাকটা নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে এদিকে আসছে আর বৃষ্টির সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। মেঘ একমুহুর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলো, কি করবে কিছুই মাথায় আসলোনা। তারপর কোনোকিছু না ভেবে দৌড়ে গিয়ে বৃষ্টিকে ধাক্কা দিয়ে তাল সামলাতে না পেরে নিজেও বৃষ্টির উপর পড়ে যায়। ট্রাকটা পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার পর বৃষ্টিকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে নেয়, যেনো একটু বাঁধন আলগা করলেই হারিয়ে ফেলবে বৃষ্টিকে।
এদিকে বেশ অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টির সাড়াশব্দ না পাওয়ায় বৃষ্টির দিকে তাকাতেই রক্তে লেপ্টে থাকা নিজের হাত চোখে পড়ে মেঘের। মেঘ বৃষ্টিকে ধাক্কা দেওয়ার সময় একটা পাথরে গিয়ে লাগে মাথাটা, তারপর অজ্ঞান হয়ে যায় বৃষ্টি। তাড়াতাড়ি পালস চেক করে দেখে খুব ধীরে ধীরে চলছে। এক অন্যরকম ভয় যেতে বসে মেঘকে। কোনোকিছুর পরোয়া না করে বৃস্টিকে কোলে নিয়ে গাড়িতে বসায়। তারপর যতদ্রুত সম্ভব ড্রাইভ করে হসপিটালে নিয়ে যায়। একটা মুহূর্তের জন্যই বৃষ্টিকে নিজের কোল থেকে নামায়নি। এক অদ্ভুত আশঙ্কা, ভয় কাজ করছে আজ মেঘের মধ্যে।
হসপিটালে পৌঁছে তাড়াতাড়ি করে ওটির ব্যাবস্থা করতে বলেন সবাইকে। মেঘের পাগলের মতো ব্যাবহার দেখে বাকিদের কাছে সবটুকু পরিষ্কার হয়ে যায়। তবে মেঘের এখন এইসবে কোনো যায় আসেনা। একটাই কথা শুধু মেঘের মাথায় ঘুরছে, তার বৃষ্টিপাখিটা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে, ভীষন কষ্ট হচ্ছে ওর। অনেকটা রক্ত বেরিয়ে গেছে শরীর থেকে। বৃষ্টির রক্তে মেঘের পুরো শার্ট ভিজে গেছে। সামনের বেডে শোয়ানো বৃষ্টির দিকে তাকাতে পারছেনা মেঘ, বারবার চোখ ভিজে আসছে। তার দেওয়া সবুজ শাড়ীটার জায়গায় জায়গায় রক্তের ছোপ। সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করছে মেঘ। নিজেই বৃষ্টির অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেয়, সবাই অনেক বারণ করে, অপেক্ষা করতে বলে বড়ো সার্জেন আসার। কিন্তু মেঘ বৃষ্টিকে নিয়ে একটুও রিস্ক নিতে রাজি হয়, অন্য কেউ আসতে গিয়ে যদি দেরি হয়ে যায়, বৃস্টির কিছু হয়ে যায় তাহলে সে কিভাবে বাঁচবে?
স্যার প্লিজ আপনি একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আপনি এখন অপারেশন করার অবস্থাতে নেই। আপনি একজন ডাক্তার, আপনি খুব ভালো করে জানেন কাছের মানুষগুলোর অপারেশন কখনও আমরা নিজেরা করতে পারিনা। প্লিজ স্যার জেদ করবেন না। কিছুক্ষনের মধ্যেই ড: মিত্র আসছেন।
একজন কলিগ ডাক্তার এর এমন কথায় যেনো মেঘের রাগ আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। চিল্লিয়ে বলে ওঠে, আপনার কি মনে হয় আমার মধ্যে অপারেশন করার যোগ্যতা নেই? আমি পারবোনা বৃষ্টিকে বাঁচাতে? আমি আর একটাও কথা শুনতে চাইনা। আপনি ওর বাড়িতে খবরটা জানিয়ে দিন। এক্ষনি অপারেশন শুরু হবে।
দীর্ঘ আট ঘণ্টা অপারেশন চলার পর মাথা নীচু করে বেরিয়ে আসে মেঘ। সামনে আশরাফ হোসেন আর রাবেয়া বেগমকে সামনে দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা মেঘ। হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে তাদের সামনে।
মেঘ বাবা বৃষ্টি কেমন আছে? আমাদের তোমার উপর সম্পূর্ণ ভরসা আছে। তুমি থাকতে বৃষ্টির কিছু হবেনা আমরা জানি। বৃষ্টির গায়ে একটা আঘাতও তুমি আস্তে দেবেনা। বলোনা বাবা কেমন আছে আমার মেয়ে? কান্না করতে করতে বলেন রাবেয়া বেগম।
আণ্টি সব আমার জন্য হয়েছে। আমি যদি আজ বৃষ্টিকে নিয়ে ঘুরতে না বের হতাম তাহলে এসব কিছুই হতোনা। আমি যদি না বৃষ্টিকে ধাক্কা দিতাম বৃষ্টি আজ এই অবস্থায় থাকতোনা। তারপর অপরাধীর মত মাথা নীচু করে সব ঘটনা খুলে বলে মেঘ ওনাদেরকে।
এদিকে ড: মিত্রকে বেরিয়ে আসতে দেখে মেঘ ওনার কাছে যায়। তারপর ওনাকে উদ্দেশ্য করে বলে, থ্যাংক ড: মিত্র! আজ আপনি শেষ মুহূর্তে না আসলে অনেক বড়ো অঘটন ঘটে যেতো। আমরা বাঁচাতে পারতামনা হয়তো ওনাকে।
আরে নাহ নাহ ড: মেঘ আপনি এসব কি বলছেন। বরং আমার আপনাকে বাহবা দেওয়া উচিত। আপনি সঠিক সময়ে অপারেশন শুরু না করলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো। আমি তো ভাবতেই পারছিনা আপনি একজন হার্ট সার্জেন হয়ে এরকম একজন পেশেন্টকে নিয়ে এতটা ডেসপারেট হয়ে যাবেন। ড: মিত্রর কথায় একটু সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে মেঘ বলে, ড: মিত্র উনি আমার হবু স্ত্রী, আমার ভালোবাসা, আমার সবকিছু।
বুঝলাম ড: মেঘ। কিন্তু বিপদ এখনো কিন্তু যায়নি। আগামী 24 ঘণ্টার মধ্যে ওনার যদি জ্ঞ্যান না ফেরে তাহলে কোমাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর জ্ঞ্যান ফিরলেও শর্ট টাইম মেমোরি লসের সম্ভবনা থেকেই যাচ্ছে। এখন শুধু প্রে করুণ ওনার জন্য, আমাদের হাতে যতটুকু ছিল আমরা করেছি।
ড: মিত্রের কথা শুনে দুই কদম পিছিয়ে যায় মেঘ। নিজেকে কেমন ফাকা ফাকা লাগছে আজ। আর কোনোকিছু না ভেবে দৌড়ে চলে যায় নিজের কেবিনে। ওযু করে নফল নামাজ পড়ে, জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে বৃষ্টির সুস্থতা কামনা করে।
আল্লাহ তুমি তো রহমানের রহিম। তুমি তো সর্বেসর্বা, তোমার ইশারা ছাড়া একটা গাছের পাতাও নড়েনা। তুমি আমার বৃষ্টিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। তুমি তো বলেছো, তোমার বান্দারা চাওয়ার মত করে চাইলে তুমি তাদেরকে খালি হাতে ফিরিয়ে দাওনা। আজ আমি তোমার কাছে আমার বৃস্টির সুস্থতা কামনা করছি। আব্বু আম্মু মারা যাওয়ার পর একমাত্র আপুর জন্য আমি তোমার কাছে চেয়েছিলাম সবসময়। আজ বৃষ্টির জন্য চাইছি আমাকে ফিরিয়ে দিওনা। আমি কি দোষ করেছিলাম বলোতো? যার জন্য তুমি এত ছোট বয়সে আমার আম্মু আব্বুকে কেড়ে নিলে, আজ আমার ভালোবাসা, আমার বৃষ্টিকে এভাবে চোখের সামনে আমি দেখতে পারছিনা। তুমি আমার সহায় হও।
মেঘের আহাজারীতে কঠোর মানুষেরও মন গলে যাবে, সেখানে আল্লাহ তো রহমানের রহিম। আল্লাহ ওকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়নি। জ্ঞ্যান ফিরেছে বৃষ্টির। বিপদ অনেকটাই কেটে গেছে। তবে শর্ট টার্ম মেমোরি লসের ব্যাপারটাতে কিছুটা ভয় এখনও আছে।
___________________
সৃজার বিয়ে ঠিক হয়েছে, তাই ও চায় ওর কাছের সব পুরোনো বন্ধুদেরকে নিমন্ত্রণ করতে। তাই আজ ফারহান আর তন্নীর বাড়িতে এসেছে প্রথম বারের মতো। সৃজা অনেক খুজে খুজে একটা বস্তি এলাকার কাছে এসে থেমে যায়। সামনের একটা টিউবওয়েলে একটা বাচ্চা ছেলেকে স্নান করাচ্ছে তার বাবা। পরনে একটা লুঙ্গি আর একটা গেঞ্জি যেটার কয়েক জায়গায় ফুটো হওয়া। বাচ্চাটাকে স্নান করিয়ে একটা গামছা জড়িয়ে নিয়ে খুপড়ি মতো একটা ঘরে ঢুকে যায় ছেলেটি। এই দৃশ্য দেখে সৃজার চোখ থেকে টুপ করে কয়েকফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে।
তারপর আসতে আসতে ওই খুপড়ি মত ঘরের দরজায় গিয়ে কয়েকবার নক করে। তারপর সেই ছেলেটা এসে দরজা খুলে সৃজাকে দেখে ভীষণ খুশি হয়। আবার কিছু একটা ভেবে মুখটা ভার হয়ে যায়।
কেমন আছিস ফারহান? কতগুলো দিন পর তোদের সাথে কথা। সেই যে ওখান থেকে চলে এলি আর কখনো ফিরলিনা। (হ্যা সেই লোকটা ফারহানই ছিল)
সব কথা হবে, আগে ভিতরে আয়। জানি তোর এমন ঘরে বসতে প্রবলেম হবে। কিন্তু এটা ছাড়া যে আমার কাছে আর কিছুই নেই রে। ফারহানের এমন করে বলাতে সৃজা বলে ওঠে,
আরে নাহ নাহ ঠিক আছে। তন্নী কোথায়? ওকে দেখছিনা তো? কোথাও গেছে নাকি?
তন্নী চলে গেছে রে। বলেই বাচ্চাদের মত করে মুখে হাত দিয়ে কেঁদে ওঠে ফারহান।
চলে গেছে মানে? কি বলছিস এসব? কোথায় চলে গেছে?
আমরা বিয়ে করে চলে আসি এখানে। হাতে তখন খুব কম টাকা ছিল জানিস তো। অনেক জায়গায় কাজ খুঁজে বেড়াই, কিন্তু শহরে যোগ্যতা ছাড়া কেউ কাজ দেয়না। সবজায়গায় চেষ্টা করি কিন্তু কোনো লাভ হয়না। শেষে অনেক কষ্টে একটা রেস্টুরেন্টে ওয়েটার এর কাজ পাই। সেটাই করতে শুরু করি। কারন খাবার টাকাটাও ছিলোনা আমাদের কাছে। আর এখানে থাকতে শুরু করি। প্রথমে অনেক অসুবিধা হলেও পরে মানিয়ে নিই। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। এটাই ভাবি সবসময়। প্রথম কিছুদিন খুব ভালোই চলছিলো আমাদের দিন। তারপর সময়ের সাথে সাথে তন্নীর ব্যাবহার বদলাতে থাকলো, ওর চাহিদা বাড়তে থাকলো। ঠিকঠাক খাবার খেতনা, ওর নাকি এসব খাবার মূখে ভালো লাগতোনা। আমিও যতটা পারতাম এক্সট্রা কাজ করে বেশি টাকা পাওয়ার। অনেক পরিশ্রম করা শুরু করি, শুধুমাত্র তন্নীকে ভালো রাখার জন্য।
তারপর একদিন শুনলাম আমি বাবা হবো। জানিস সেদিন অনেক খুশি হয়েছিলাম, বাবা হওয়ার অনুভূতিটা যে কি সেটা আমি তোকে বোঝাতেই পারবোনা। খুশি হয়ে পুরো বাড়ি কোলে করে নিয়ে ঘুরি। ওকে পরেরদিন রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাই, আর ওর যা খেতে মন চায় আমি তাই তাই অর্ডার করতে বলি। জানিস সেদিন মোট বিল হয়েছিল 5000 টাকা। আর আমার মাসিক বেতন ছিল 6000 টাকা। মালিককে অনেক করে বলি জানো এটা আমার মাসিক টাকা থেকে না কাটে, এর জন্য আমাকে যা কাজ দেবে আমি করবো। তখন উনি বলেন ওনার ওয়াশরুম পরিষ্কার করার লোকটাকে একমাসের জন্য ছুটি দিয়ে সেই কাজ আমাকে করতে হবে। আমি সেটাতেও রাজি হয়ে যাই। তবে এটা ভেবে কষ্ট লাগে যে আমার অবস্থা জানার পরও কিভাবে এত দামী দামী জিনিস অর্ডার করতে পারলো তন্নী। তারপর ভাবি এইসময় অনেককিছু খাওয়ার ইচ্ছে হয় তাই হয়তো।
তারপর থেকে আমার দায়িত্ব বাড়ছে এটা ভেবে মালিককে অনুরোধ করে করে দুটো কাজই আমি করতে শুরু করি। সকাল 6 টায় বের হয়ে রাত 10 টায় বাড়ি ফিরতাম। তাও তন্নীকে আর আগের মতো পেতাম নাহ। সবকিছুতে কেমন খিটখিট করতো, একটু ঠিকঠাক ভাবে কথা বলতনা আমার সাথে। এমনকি বাচ্চাটাও রাখতে চায়না। আমার অনেক জোরাজোরিতে রাজি হয় বাচ্চাটা রাখতে। তারপর সেদিনের ডেলিভারির সময়ে হসপিটালে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বলে সৃজাকে।
সবই তো বুঝলাম। কিন্তু তাহলে তন্নীর তো থাকার কথা তোদের সাথে। কিন্তু ওকে তো দেখতে পাচ্ছিনা। সৃজার কথায় ফারহান মুচকি হেসে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে,
নিজের পাপের সাজা পেয়েছি। সেদিন হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরে বাবুকে রাখার জন্য একটা দোলনা কিনতে যায় বাজারে। এসে দেখি বাবু বিছানায় শুয়ে কান্না করছে, তন্নীকে কোথাও খুঁজে পাইনা। তারপর বিছানার কাছে একটা কাগজ পেয়ে সেটা পড়তে থাকি। সেটাতে লেখা ছিল, আমাকে বিয়ে করে তন্নী অনেক ভুল করেছে। আমি ওর আবেগ ছিলাম মাত্র। এরকম সংসারে আর থাকতে পারবেনা ও। তাই ওর ভালবাসার মানুষের কাছে চলে গেছে।
জানিস সেদিন বাবুকে কোলে নিয়ে সবজায়গায় খুঁজি ওকে কিন্তু কোথাও পাইনা। তারপর ভাবি এটা তো আমার ভাগ্যে লেখাই ছিল। বৃষ্টিকে যে কষ্টটা আমি দিয়েছি আজ তা হারে হারে টের পাচ্ছি।
চলবে?