#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ৬
“মেঘের পালক, চাঁদের নোলক
কাগজের খেয়া ভাসছে…
বুক ধুকপুক চাঁদপনা মুখ চিলেকোঠা থেকে হাসছে…
মেঘের বাড়িতে ভেজা ভেজা পায় তা-থৈ তা-থৈ বরষা…
কাকভেজা মন জল থৈ থৈ রাত্তির হলো ফরসা…
আমি তুমি আজ একাকার হয়ে মিশেছি আলোর বৃত্তে…
মম চিত্তে, নিতি নৃত্যে..কে যে নাচে….”
গান ভেসে আসছে বড় ভাবীর ঘর থেকে। কেমন ফুরফুরে লাগছে মনটা! ভাবীটা ভারি শৌখিন। গান শোনে আবার গাইতেও পারে, হাতের কাজ খুব ভালো পারে, দারুণ সুন্দর করে ছবি আঁকে। প্রায়দিন সকালের কাজ সেরে বিশ্রাম নেয়ার আধঘন্টা মৃদু শব্দে গান শোনে। আমাদের ঘর পাশাপাশি বলে আমি শুনতে পাই। আজ খুব ইচ্ছে হলো ভাবীর সাথে গল্প করতে।
ভাবী খাটে পা ঝুলিয়ে বসেছিল। আমাকে দেখে হেসে বলল, “ননদিনী, কী দরকার গো? ইদানিং তো কারো কথা মনেই পড়ে না তোমার!”
“ভাবী গল্প করতে আসলাম।”
“করো করো, তোমার তো দিন। রসিয়ে রসিয়ে বরের গল্প বলবা!”
“ধুর! করার মতো গল্প আছে আমার কোনো?”
ভাবী আমার হাত ধরে টেনে তার পাশে বসালো। “বরের সাথে কথা হয় না?”
“তা হয়। জানো, ওর মায়ের ভালো হওয়ার নাম নেই। ও অনেক মন খারাপ করে থাকে। আমার কেন জানি মনে হয় ওর বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়েছে।”
ভাবী আমার থুতনিতে হাত রেখে বলল, “চিন্তা করে চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। বর দেখলে কী বলবে, যত্ন নেই না আমরা একটুও। তুমি আগেই এত ভাবলে চলবে? দেখো না কী হয়।”
“কেমন করে বিয়েটা হলো, আমার ভয়ই করে।”
ভাবী হেসে বলল, “প্রেম তো কোনোদিন করোনি। এইযে বিয়ের প্রথম প্রথম মিষ্টি প্রেম, দূরে দূরে থাকার সুখের বেদনা এসব উপভোগ করো। টেনশন সারাজীবন থাকবে, কিন্তু একবার সংসারে ঢুকে গেলে এই সময়টা ফিরে পাবে না।”
“আচ্ছা ভাবী ওর মা মেনে না নিলে?”
“আবার! যা হবে পরে দেখা যাবে। সবাই আছি তো আমরা। আর তোমার মতো মিষ্টি একটা মেয়েকে কেউ না মেনে পারে?”
“ঠিক বলছ?”
“হ্যাঁ রে বাবা। এখন শক্তি সঞ্চয় করো পরবর্তীতে যা হবে সেটা সামাল দেয়ার জন্য। অকারন আশঙ্কা খুব খারাপ জিনিস, বিশেষ করে এমন ব্যাপারে যেটা হয়ে গেছে, শুধু ফলাফল দেখার বাকি। তোমার সাথে তো তোমার বর আছেই, তবে চিন্তা কী এত!”
“আচ্ছা।”
“তেঁতুল খাবে? কাল তোমার ভাই কাঁচা তেঁতুল এনেছে। চলো ভর্তা করি।”
ভাবী কাঁচা তেঁতুলের ভর্তা বানিয়ে এনে বারান্দায় বসে খেতে খেতে গল্প শুরু করলো! তার বেশিরভাগ গল্প বড় ভাইয়াকে নিয়ে। আজ কিছুদিন ভাবীকে একটু বেশি খুশি লাগছে। আজ যেভাবে টক খাচ্ছে! আমার মনে পড়ল গতকাল খাবার সময় ডালের চামচ পড়ে গিয়েছিল। ভাইয়া ভাবীকে নিচু হয়ে তুলতে দিল না কিছুতেই। তবে কী…
এ পর্যন্ত এমন অনেক দেখেছি, তবুও হঠাৎই ব্যাপারটা ভেবে আমার চোখে পানি চলে আসলো। বুকের কোথাও সুক্ষ্ম ব্যথা উঠলো। আচ্ছা এমন একটা দিন আমারও আসবে? একটা ছোট্ট নতুন মানুষ নিজের মধ্যে…! ভাবীর মতো সুখের সংসার আমার কপালেও আছে? আশা মানুষ অনেক কিছুই করে, তবে ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে? বিধাতা কত রকমের রঙতুলি নিয়ে বসে আছেন। একেকজনের জীবন একেকভাবে রাঙিয়ে দেবেন বলে। শুধু একটাই প্রার্থনা, সেই রঙটা যেন ফ্যাকাসে না হয়!
.
বিয়ের দুই সপ্তাহ পর তার সাথে দেখা হলো। কলেজে গিয়েছিলাম, বের হয়ে দেখি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে একেবারে। গলার হাড় বের হয়ে গেছে। আমি কাছে যেতে হেসে বলল, “আহারে, লোকে বিয়ের পর প্রতিদিন বউ এর মুখ দেখে ঘুম থেকে ওঠে। আমার কি কপাল! কতদিন পর দেখলাম!”
“বাদ দাও ওসব। তোমার এই চেহারা হয়েছে কেন?”
“ভালো নেই গো! মা অসুস্থ বলে বাবাও কাজে ঢিল দিয়েছে, অফিসে চাপ এত, তার ওপর মা’কেও সময় দিতে হয়। আমি না থাকলে খেতেও চায় না ঠিকমতো। তোমার সাথে দেখা করার সময়টা বের করতে পারি না বোঝো তবে!”
“আমি বুঝি। তুমি দায়িত্ব পালন করো ঠিক করে।”
সে আমার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলো। হাঁটতে থাকলাম ফুটপাথ ধরে। সে বলল, “তুমি এত ভালো কেন?”
“আমি ভালো নই। তোমার মনটা ভালো।”
সে অকারনে হো হো করে হাসলো। আমার জন্য কোথা থেকে একটা শুকনো বকুল ফুলের মালা এনেছিলো। সেটা পরিয়ে দিল গলায়। খুব বেশি সময় দিতে পারলো না। আমায় অনেক অনেক বার বুঝিয়ে, ক্ষমা চেয়ে সেদিন বিদায় নিয়েছিল সে। ইচ্ছে করছিলো ওখানেই বসে কাঁদি। কিন্তু পারিনি। বোধহয় শক্ত হয়ে যাচ্ছি দিন দিন।
বাবা মা আমাকে কিছুই বলেন না। ওর সাথে তাদের কথা হয়। কী বলে সেই জানে। আমি এমনভাবে থাকি যেন বিয়ে থা হয়নি। আগের মতোই আছে সব।
.
আগামীকাল আমাদের বিয়ের একমাস পূর্ণ হবে। রাতে সে ফোন করে বলল, “আমাদের বিয়ের কথাটা সবাই জেনে গেছে।”
আমি ঢোক গিলে গলা স্বাভাবিক করে বললাম, “তারপর কী হলো?”
“শুরু থেকেই কানাঘুষা চলছিলো। সবাই ভেতরে ভেতরে জানতো, তবে আজ একেবারে সামনাসামনি কথা হয়েছে। আমিও স্বীকার করেছি।”
“তোমাকে কেউ কিছু বলেছে?”
“নাহ।”
“তোমার মা?”
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “মায়ের ব্যাপারটা জানি না। আমাকে কিছুই বলল না। সুন্দরভাবে রাতে খেয়ে নিল আমার সাথে। অন্য কথাও বলল, তবে বিয়ের কথা তুলল না। যেন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার এটা। তবে এত সহজভাবে মেনে নেবেন না জানি। কী যে করবেন বুঝতে পারছি না।”
আমার বুকে কাঁপুনি ধরে গেল। খুব ইচ্ছে করছিলো তাকে বলব আগামীকাল দেখা করার কথা। কিন্তু বলতে পারলাম না শেষ পর্যন্ত। সে ফোন রাখার আগে বলল, “ভয় পেও না। আমি সামলে নেব সব।”
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো একটু দেরিতে। আজ আবার বৃষ্টি। ভারি বর্ষন হচ্ছে। ভাবীর কথামতো আমি চেষ্টা করছি চিন্তা না করতে। ভাবী সত্যি প্রেগনেন্ট। অসুস্থও খানিকটা। শুয়ে থাকে বেশিরভাগ সময়। তার ঘর থেকে গানের শব্দ শোনা যাচ্ছে–
“এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন..
কবে যাব কাছে পাবো ওগো তোমার নিমন্ত্রণ…”
গান শুনতে শুনতে আনমনা আমার তীব্র ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে তার কাছে চলে যাই..বিয়ের একমাস পূর্তিতে ভাবছিলাম কিছু করি। কী করব? বৃষ্টিতে ভিজে সব উত্তেজনা ছড়িয়ে দেব প্রকৃতিতে?
তাকে ফোন করব কি না ভাবতে ভাবতে সেই ফোন করে বলল, “শোনো বৃষ্টিতে ভিজো না আজকে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “তোমাকে কে বলল ভিজব?”
সে গলায় কৃত্রিম বিষ্ময় ফুটিয়ে বলল, “এইমাত্র কানে কানে বলে গেলে ভুলে গেছ?”
আমি হেসে ফেললাম। মাঝে মাঝেই সে বলে আমি নাকি তার সাথে বাতাসে ভেসে গিয়ে কথা বলে আসি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আমি যেসব কথা মনে মনে ভাবি সেসব কথাই সে পরে আমাকে শোনায়। আমি অবাক হলেও কখনো তাকে এই কথাটা বলে দেই না। তার সাথে আমার এত বেশি গভীর পরিচয়ও নেই মনের কথা বোঝার মতো। দুজনের ছোট ছোট স্বভাবগুলো পর্যন্ত দুজন ঠিকভাবে জানি না। অথচ সে আমাকে অন্তর থেকে বুঝতে পারে ভাবলেই অজানা শিহরন হয়। গর্ব হয় ভীষণ। সাথে ভয়ও!
দুপুরের পর ঘুমিয়েছিলাম। মায়ের অস্থির ডাকাডাকি শুনে উঠে গেলাম। “কী হয়েছে?”
“বেয়াইন সাহেবা এসেছেন।”
“মানে? কে এসেছে?”
“তোর শ্বাশুড়ি!”
আমার মাথায় বাজ পড়ল যেন। মা আলমারি থেকে শাড়ি বের করে বললেন, “তাড়াতাড়ি পরে নে। একটু সুন্দর হয়ে তার সামনে আয়।”
আমি বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি শ্বাশুড়ি মা দাঁড়িয়ে। মা হা হা করে উঠলেন, “আরে অসুস্থ শরীর নিয়ে আবার আপনি এলেন কেন? ও ই তো যাচ্ছিলো।”
শ্বাশুড়ি মা বললেন, “আপনারা ব্যস্ত হবেন না। আমি শুধু কিছু কথা বলে চলে যাব। আপনি একটু বাইরে যাবেন? আমি ওর সাথে একা কথা বলতে চাই।”
মা চলে গেলে শ্বাশুড়ি মা আমার পাশে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন, “জানো, আজ সকালেও উঠে মনে হয়েছিল বাঁচবো না। শ্বাস নিতে পারছিলাম না। শরীর এত দুর্বল যে মনে হয় ঘুরে পড়ে যাব যে কোনো মুহূর্তে। তার ওপর বুকে ব্যথা শুরু হয় যখন তখন। বেডরেস্টে থাকার কথা আমার। তবুও ছুটে এসেছে। কেন বলতে পারো?”
আমি মাথা নিচু করে রইলাম। উনি বলে গেলেন, “তুমি কী করে আমার ছেলেকে এত পাগল করেছ তা তুমিই জানো। এমন অবস্থা যে সে আমাকে না জানিয়ে বিয়ের মতে একটা কাজ করে ফেলল। প্রথম থেকে কখনোই তোমাকে আমার পছন্দ নয়। কিছু মনে করো না, একটা সত্যি কথা বলি, আমার ছেলের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতা তোমার নেই। তবুও সে তোমাকে এত ভালোবাসে কেন জানো? সে অনেক ভালো মনের মানুষ।
তোমার ইনিয়ে বিনিয়ে বলা দুঃখের কথাগুলো তার মন দুর্বল করে দিয়েছে। ছেলের এত রিকোয়েস্টে আমি তোমার সাথে তার বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু আমার এত অসুস্থতার মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের দিন যে আমার ছেলেকে ফুসলিয়ে বিয়ে করাতে পারে সেরকম ছলনাময়ী মেয়ে আমি আমার ছেলের পাশে সারাজীবন কিছুতেই দেখতে পারব না।”
আমার হাত পা থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো। চোখের পানিগুলো কখন বাঁধ ভেঙে বইতে শুরু করেছে! আচ্ছা, মানুষ সহজভাবে কেন ভাবে না?
উনি আমার দিকে ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “কান্না জমিয়ে রাখো। আসল কথা এখনো বলিনি।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ৭
শ্বাশুড়ি মা মোবাইলে একটা ভিডিও বের করে দেখালেন। একটা বাইশ তেইশ বছর বয়সী মেয়ে। লং ফ্রক পরা। কাঁধ পর্যন্ত সিল্কি, মেরুন রঙ করা চুল। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, চোখে পান্না সবুজ লেন্স৷ ফর্সা, তীক্ষ্ণ নাক আর চমৎকার ফিগার। আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে। সুন্দর করে হাসছে, কথা বলছে গুছিয়ে। সোফায় বসে মোবাইলে কী একটা বের করে পাশের জনকে দেখাচ্ছে। পাশের জনটি আমার সে। সে ও বেশ আন্তরিকভাবে হেসে কথা বলছে মেয়েটির সাথে। মনে হলো তারা খুব ভালো বন্ধু।
শ্বাশুড়ি মা বললেন, “মেয়েটি নোরা। আমার দূরসম্পর্কের বোনের মেয়ে। দেখেছ কেমন? আমাদের ফ্যামিলির স্ট্যান্ডার্ডের সাথে একদম মানিয়ে যায়। যে কোনো সময় যার সাথে প্রয়োজন মিশে যেতে পারে। আমি ও’কে কখনোই অগোছালো অবস্থায় দেখিনি। পড়াশুনাতেও খুব ভালো। নর্থ সাউথে পড়ছে। ইচ্ছে আছে হায়ার স্টাডিজের জন্য ইংল্যান্ড যাবে। তুমিই আমাকে বলোতো এই মেয়েটা আমার ছেলের জন্য পারফেক্ট নয় কি?”
আমি চুপ। চোখের জলধারা অতি সন্তর্পনে মুছে নিলাম ওড়না দিয়ে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মন চাইলো ছুটে পালিয়ে যাই এখান থেকে। বৃষ্টির সাথে মিশিয়ে দেই সব কান্না।
উনি বললেন, “তুমি নিজেকে আয়নায় ভালোভাবে দেখো? বামহাতের একটা নখ বড় হয়ে ভেঙে আছে, জামাকাপড় যেমন তেমন পরো, চুলের যত্নও নাও না বোধহয়। তুমি আমার ছেলের পাশে দাঁড়ালে ভালো লাগবে?
আমি তোমার ভালোর জন্যও বলছি, তুমি আমার ছেলের সাথে হয়তোবা মানিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু আমাদের বাড়ির অন্য কারো সাথে পারবে না। মূলত তুমি ওই পরিবেশের সাথে মানানসই নও। আমার ছেলে এখন ঘোরে আছে, সে যখন বুঝে যাবে তার সঙ্গীটিকে তার সাথে যায় না, তখন সেও আগ্রহ হারাবে। তখন তুমি নিজে কত কষ্ট পাবে ভেবেছ? আমি জানি তোমাদের মধ্যে তেমন কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক হয়নি৷ তাই এখনই আলাদা হয়ে যাও। কষ্ট কম হবে।”
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম৷ কেউ এত ভয়ানক কথা এত সহজে বলে ফেলতে পারে? গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করে বললাম, “আপনি নিজেই তো তখন বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।”
“হ্যাঁ। তবে এ বিষয়ে অনেক কিছু ক্লিয়ার করার আছে। মনে করে দেখো তো, আমি বিয়ে ঠিক হওয়ার পর তোমার সাথে কোনো কথা বলেছি?”
“না মা।” প্রথমবার উনাকে মা ডাকলাম। আশঙ্কা ছিল হয়তো উনি রাগ করবেন, ডাকতে নিষেধ করবেন। তবে উনি সেটা গায়েও মাখলেন না। বললেন,
“আমার ছেলে আমার কতটা আদরের তুমি হয়তো শুনেছ। একবারও মনে হয়নি সেই ছেলের হবু বউ এর সঙ্গে আমি কথাবার্তা বলিনি কেন? ছেলের প্রচুর জেদের জন্য আমি রাজি হয়েছিলাম। রাগ করে বিয়ের কথাও বলেছিলাম। কিন্তু আদতে রাজি ছিলাম না। চেষ্টাও করেছিলাম বিয়েটা আটকাতে তবু পারিনি।
হার্ট অ্যাটাকটাও এমনি এমনি হয়নি। অতিরিক্ত স্ট্রেসের কারনে হয়েছে। তাহলে বোঝো ছেলের মর্ম আমার কাছে কী!”
“তাহলে আমি এখন কী করব?”
“যেমন গোপনে বিয়েটা হয়েছে তেমন গোপনে যেন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আমার আত্মীয়রা এখনো কেউ জানে না। আমি চাই না জানাজানি হোক।”
“আপনি যেটা বলছেন সেটা সম্ভব নয়।”
“তুমি সম্ভব করবে। আমি তোমাকে বলে দেব কীভাবে কী করতে হবে। আর করতে না চাইলে মনে রেখো, আমার বাড়িতে যদি ঢোকো, একটা দিনও শান্তিতে থাকতে পারবে না।”
উনি চলে গেলেন। কি নির্লিপ্ত কন্ঠে হুমকি দিয়ে গেলেন! বাহ!
বাড়ির কেউ এখনো কিছুই জানে না। বাবা মা তাদের বেয়াইনের খুব খাতির করেছেন। এখনো জানেন না কি বিপদটাই না অপেক্ষা করছে!
.
সারারাত তুমুল ঝড় হলো। শুয়ে গড়াগড়ি করলাম শুধু। ঘুম এলো না। কান্নাও পেলো না৷ বিষ্ময়বোধটা কেটে গেলে হয়তো কান্না পাবে! খেই হারা অথৈ সমূদ্রে পড়ে যাওয়া মানুষের মতো লাগছে নিজেকে। বুকের ব্যথাটা ভয়ংকর তীব্র! লজ্জায় ইচ্ছে করছে কচ্ছপের মতো লুকিয়ে যাই খোলসে। এই সম্পর্কের শুরু থেকে অপমান ছাড়া কিছুই পাইনি।
অনেক চিন্তা করেও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। সাধে কি আর বলে, অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়!
শেষরাতে বৃষ্টি কমে এলো। নামাজ পড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মেঘ কেটে সকালের সূ্র্য উঁকি দিলো। অথচ আমার মনে হতে লাগলো অন্ধকার অতল সাগরে তলিয়ে যাচ্ছি।
ভোরের দিকে সে আচমকা ফোন করে বলল, “দরজা খোলো৷ আমি তোমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
তখনো বাড়ির কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। আমি চুপি চুপি দরজা খুলে দিলাম৷ আজ ঝিনু নেই, বেড়াতে গেছে। তাকে নিয়ে আমার ঘরে চলে গেলাম। খাটে বসে সে মাথা নিচু করে রইল। ক্লান্ত সে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাত জেগেছে। চুলগুলো বড় হয়ে ঘাড় বেয়ে নেমে যাচ্ছে। এই ছেলে যত্ন নেয় না নিজের? এই অবস্থাতেও কি মায়া হচ্ছে! আমি তার সামনে গিয়ে আলতো করে কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিলাম। সে আমার দিকে তাকালো। গর্তে বসা চোখদুটোর মায়াভরা দৃষ্টি। বুকে সূক্ষ্ণ পিনের মতো বিঁধে যায়। সে বলল, “আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি তাই না? আমার দোষ সব। অথচ শাস্তি পেতে হচ্ছে তোমাকে।”
“তোমার কোনো দোষ নেই। সব ভাগ্য।”
“ভাগ্য এবার বদলাতে হবে।”
“কী করে?”
“মা তোমাকে বলেছে না আমাকে ডিভের্স দিতে?”
আমি ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রাখলাম। কী বলব?
সে বলল, “আমি আমার মতো অনেক চেষ্টা করেছি উনাকে মানিয়ে নেয়ার। উনি যদি না বোঝেন আমার কিচ্ছু করার নেই। আমি উনার অবাধ্য হইনি। ভালোভাবেই চেয়েছিলাম। এখন বেশি বাড়াবাড়ির ফলও পাবেন।”
বুঝলাম মায়ের ওপর অনেক রাগ হয়েছে। কিন্তু ওর মা’ও তো সব ছেলের জন্যই করছে। কথাটা বলতেই সে কপাল কুঁচকে বলল, “মাদার তেরেসা সাজার কোনো প্রয়োজন নেই। নিজেরটা বোঝো।”
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “প্যাকিং করো। যা যা দরকারি জিনিস আছে সব নিয়ে নাও, আমরা এক্ষুনি বেরিয়ে যাব, তোমার কাছে আধঘন্টা সময়। কুইক!”
আমি বেকুব হয়ে গেলাম। “কোথায় যাব?”
“কোথায় যেতে পারি?”
“তোমার বাড়িতে?”
“নো মিসেস, আমরা পালাচ্ছি।”
“মানে? কোথায় পালাবো?”
“তা জানি না।”
.
ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমরা একটা বাসে উঠে সিলেটের দিকে রওনা দিলাম। এতক্ষণ কী হয়েছে কেউ বলতে বললেও পারব না। যেন রকেটের গতিতে সব হয়ে গেল! সে গোছগাছ করতে সাহায্য করল। তারপর আমায় নিয়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। আমি আবারও তার ওপর ভরসা করে পা বাড়ালাম নতুন রাস্তায়। সেটা ভুলে ভরা নাকি সঠিক পথ জানা নেই, শুধু এতটুকু জানলাম, ভাগ্যবিধাতা তার সঙ্গে আমাকে জুড়ে দিয়েছেন। এখন সে আমার সাথে যা করবে, তাই আমার জন্য সঠিক।
সকাল মাত্র। লোকজনের ভিড়, গরম সবই কম। বৃষ্টিভেজা স্নিগ্ধ একটা পরিবেশ। হাইওয়ে ধরে চমৎকার রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলল। শীতল বাতাস শরীরে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়ে গেলো। রাস্তার দু’ধারের বৃষ্টিজলে ধৌত হওয়া গাঢ় সবুজ গাছগাছালি চোখ জুড়িয়ে দেয়। পাশে বসে আসে জীবনের সবচেয়ে আকাঙ্খিত মানুষটি!
বাসে ওঠার পরপর তাকে দেখে মনে হলো সে সব দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়েছে। আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে। দু’ঘন্টা আগেও যে জীবনটা ব্যর্থ মনে হচ্ছিলো, এখন সেই জীবনটাই হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে করছে। যদিও ভবিষ্যতের কথা ভাবলে মাথা ভার হয়ে আসে, তবে আমি সেসব চিন্তা আপাতত ছুটি দিলাম। এতটুকু অবশ্য বুঝে গেছি, যত যাই হোক, সে আমাকে ছেড়ে যাবে না।
আমি তার হাতটা শক্ত করে ধরলাম। সে একবার ঘুমের মাঝে অস্পষ্ট কিছু বলে উঠল। আবার ঘুমিয়ে গেল। আমার হাতটা এখন তার হাতের মুঠোয়। আমারও চোখ বুজে এলো। ঘুমে নয়, আহ্লাদে!
একবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “পালিয়ে তো যাচ্ছি তারপর কী হবে?”
সে হাই তুলে বলল, “দেখা যাক। কিছু ভেবে করিনি। আমরা এডাল্ট। বিবাহিত। যা খুশি করার স্বাধীনতা আছে। শেকল পরিয়ে রাখতে চাইলেই হবে নাকি?”
“কিন্তু কাউকে না বলে…”
“আমার মায়ের আমাকে ট্রেস করতে একদিনও লাগবে না৷ সবাই জানবে। তবে ধরতে পারবে না।”
বিকেলের দিকে পৌঁছুলাম মৌলভীবাজার। সেখানে তার এক বন্ধুর বাংলো বাড়িতে উঠলাম। বাড়িটা ভাড়া দেয়া হয় ভ্রমণকারীদের জন্য। সেখানে ওঠার আগে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে সেখানে খেয়েদেয়ে এলাম৷ ভালোই লাগলো তাদের সাথে কথা বলে৷
বাংলোতে পৌঁছুলাম সন্ধ্যায়। দোতলা বাড়ি। ভেতরে আলো জ্বলছে না। চারপাশে অনেক গাছপালা, ঝোপঝাড়। অন্ধকার জমে ভুতুড়ে বাড়ি মনে হচ্ছে।
এদিকে নাকি এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ অবশ্য কম। ঘন ঘন মেঘ ডাকছে। বাতাসের সাথে হালকা বৃষ্টির ঝাপটা লাগছে চোখেমুখে। হঠাৎ আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। ছোটবেলায় পড়া রহস্য গল্পগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। কে জানতো আমার সাদাসিধা জীবনটা হুট করে এমন রোমাঞ্চকর হয়ে উঠবে?
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু