অপূর্ব সমাপ্তি পর্ব-৩২ এবং শেষ পর্ব

1
1063

#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ৩২ ( শেষ পর্ব)

বাইরে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। আমি আর অপূর্ব হোটেল রুমে বসে গল্প করছি। পরিবেশটা অসম্ভব ভালো লাগছে। যদিও আমরা এসেছি ঘুরতে, কিন্তু ঘরে বসে থাকতে হচ্ছে হাত পা গুটিয়ে। তবুও আমার খারাপ লাগছে না। ইচ্ছে ছিল দূরে কোথাও চলে যাব..বহুদূরে…নিজেকে সময় দিতে। অপূর্বকে বোধহয় বলেও ফেলেছিলাম সেটা কোনেভাবে ঘুমের ঘোরে। ও ঠিক ব্যবস্থা করে ফেলেছে কয়েকদিনের মধ্যে।

এই বর্ষার মৌসুমে কক্সবাজারে ভিড় মোটামুটি কম। আমাদের হোটেলটা সৈকতের কাছেই, তাই সমূদ্রের গর্জন স্পষ্ট শোনা যায়। বারান্দায় দাঁড়ালে সাগরের লোনা বাতাস গায়ে লাগে। আমি চোখ বুজে উপভোগ করি সেটা।

আমার প্রথম বিয়ের পর সে একবার বলেছিল কক্সবাজার আসার কথা। সেটা আর হয়নি। আমি কখনো এখানে আসিনি বলে সে অনেক গল্প করতো। আজ যাই দেখছি, তার কথা মনে পড়ছে।

সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো, সেটা আমি অপূর্বকেও বলছি। নিজেও বুঝতে পারছি কারো স্ত্রী তার পুরানো স্বামীর গল্প করলে সে মানুষটির অবশ্যই খারাপ লাগে। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারছি না। অপূর্বর মাঝে মাঝে ম্লান হয়ে আসা মুখটি দেখে কষ্ট হচ্ছে।

দুটো দিন এই বৃষ্টি হয়েই কাটলো। আমরা সমূদ্র দেখলাম হোটেলের বারান্দায় বসেই। পরদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সেদিন বের হলাম। সাগর পাড়ে অপূর্বর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হলো এটা কি ঠিক হচ্ছে? আমার তো তার হাত ধরে হাঁটার কথা ছিল। ফট করে আমি কথাটা অপূর্বকে বলেও দিলাম। ও আমার হাত ছেড়ে দিল। তখনই আমার কষ্টটা দ্বিগুণ হয়ে গেল। আমি কিচ্ছু না বলে হোটেলে চলে এলাম। কী ভীষণ কান্না পাচ্ছে!

মনে হবে হয়তো মেয়েটার বাড়াবাড়ি এসব। কিন্তু আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে সে অনুভব করতে পারতো কতটা অসহনীয় এই পরিস্থিতি।

অপূর্ব একটু পর ফিরে এলো৷ এসে আমার সাথে কথাও বলল না৷ আমি তখনো কাঁদছি। ওর সামনে বসে কাঁদতে ভালো লাগে না বলে বারান্দায় এসে বসেছি। দুপুর হয়েছে এখন। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল।

দুপুরের দিকে বৃষ্টি থেমে গেল। এতক্ষণে অপূর্ব এলো। আমি ফ্লোরে বসেছিলাম, পানির মধ্যে। ও ও পানিতে বসে পড়ল। বলল, “ঠান্ডা লাগাতে চাও?”

আমি ঠোঁট শক্ত করে বসে রইলাম। এতক্ষণ আসেনি কেন? বড্ড অভিমান হয়েছে। ও আমার মুখটা তুলে বলল, “তোমাকে কয়েকটা শক্ত কথা বলব।”

“শক্ত কথা?”

“হ্যাঁ।”

“বলো।”

অপূর্ব আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, “তুমি কি জানো তুমি একটা মেন্টাল প্রবলেমে ভুগছো?”

“জানি।”

“ভালো করে জানো না। তোমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অন্ধ প্রেম। তুমি ওই লোকটাকে অন্ধের মতো ভালোবাসতে, বিশ্বাসও করতে। লোকটা তোমাকে নিজের অনুগত করে রাখতে চেয়েছিলো। তোমাকে সবসময় কষ্ট দিতো এটা জেনেই যে তুমি তার কাছেই ফিরে যাবে। আর যেতেও। প্রতিবার গেছো। সে একটা স্যাডিস্ট ছিল, তোমাকেও সেরকম করে দিয়ে গেছে। শেষবার যখন তাকে ছেড়ে এলে, সে বুঝে গেল তুমি আর ফিরবে না। না ফেরারই কথা ছিল। সে তখন নিজের কাছে হেরে না গিয়ে সুইসাইড করল। তোমাকে এমন একটা মেসেজ দিয়ে রাখলো যেটা দেখলে তুমি দুর্বল হয়ে যাও। তার শোক থেকে কোনোদিন বের হতে না পারো। সে সফল হয়েছে। তুমি পারোনি তাকে ভুলতে। উল্টো নিজের মতো একটা জগত তৈরি করে নিয়েছ, যেখানে ওই লোকটা বসবাস করে, তার মতামত দেয়। তুমিও বাস্তবিক চিন্তা না করে অবাস্তবিক চিন্তা করা শুরু করো।”

অপূর্ব আমার মুখোমুখি বসলো। আমার দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, “সমাপ্তি! তুমি বোঝার চেষ্টা করো। আমি জানি, পারবে। তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। একটু ট্রাই করলে ট্রমা থেকে বের হয়ে যাবে তুমি। এমন একটা মানুষকে কেন মনে রাখা যা তোমার ভালো চাইতো না?

আমি এসব বলতে চাইনি, কিন্তু আজ বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। তুমি নিজেই ভালো থাকছো না। তোমার মনে আমাকে আর তাকে নিয়ে যে দ্বন্দ্বটা আছে, সেটা দূর করো প্লিজ?”

“কিন্তু…”

“কী বলো?”

“কিছু না। তুমি ঠিকই বলেছ। আমি নিজেও সেটা জানি। কিন্তু মানতে পারি না!”

“মানতে হবে, সমাপ্তি। পারতে হবে তোমাকে। তোমার জন্য, আমাদের বেবীর জন্য!”

আমি চমকে তাকালাম অপূর্বর দিকে। ও জানলো কেমন করে? অপূর্ব ঠোঁট টিপে হেসে বলল, “তোমার মনে হয় তুমি এত বড় একটা কথা লুকিয়ে যেতে পারবে?”

আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। অপূর্ব বলল, “আচ্ছা লজ্জা পেও না প্লিজ। এখন ওঠো, ঠান্ডা বাঁধিয়ে সর্বনাশ করবে নাকি?”

ও আমাকে টেনে উঠিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। আমি কাপড় পাল্টে নিলাম। দুপুরে খেলাম চুপচাপ। দুজনের কেউ আর কথা বললাম না।

খেয়ে অপূর্ব ঘুমিয়ে গেল। আমি আস্তে করে বের হয়ে হেঁটে সোজা হোটেল থেকে বের হয়ে এলাম। সমূদ্রের দিকে যেতে শুরু করলাম। বিকেল শেষের দিকে। আকাশটা ফ্যাকাসে। চারপাশ এ সময় লোকজনে ভর্তি। আমি একটা মোটামুটি ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার হাতে সেই আংটিটা। অপূর্ব সমাপ্তির আংটি। সেটার দিকে তাকাতেই হঠাৎ টের পেলাম পাশে বাতাসের সাথে মিশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। হালকা তার অবয়ব। সে ধীরে ধীরে বলল, “অপূর্ব ঠিক বলেছে। তুমি আমাকে কেন এখনো ভাবো বলোতো? আমি তো নেই, মরে গেছি। তুমি ভাবো বলেই আমি বার বার আসি। আমাকে ভুলে যাও। অপূর্বর সাথে সুখী হও। প্লিজ সমাপ্তি। তোমার বেবীটাকে আমার ছায়া পড়তে দিও না। ও যেন ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বড় না হয়। ভালোবাসার একটা দৃঢ় সম্পর্কের মধ্যে বেড়ে ওঠ। কথা দাও আমাকে ভুলে যাবে?”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “কথা দিলাম।”

সে মিলিয়ে গেল তারপর। মৃদু বাতাস গায়ে লাগার সাথে সাথে আমার মনটাও আমি মুক্ত করে দিলাম। ভাবব না আর আমি তার কথা। কক্ষনো ভাবব না। আমি বর্তমান নিয়ে বাঁচবো। অপূর্ব নামক অসাধারণ মানুষটাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচবো। আমার ভেতরের কথাগুলো নিজের মনেই বার বার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। আমি চোখ বুজে সাগরের বিশালতার সাথে নিজের মনটাকেও মিলিয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় যুক্ত হয়ে গেলাম। একটু চেষ্টাতেই ভেতরটা শান্ত হয়ে এলো।

আবার পাশে কেউ একজন দাঁড়ালো। আবার সে? কেন এলো? আমি তো আর ভাবছি না!

না সে নয়, কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝলাম, অপূর্ব এসেছে। কথা বলল না, একটা কবিতা বলতে শুরু করলো-

তুমি জানো?
তোমার চোখের মাঝে আমার স্বপ্নগুলো
আলতো পায়ে হেঁটে বেড়ায়।
তুমি জানো?
মেঘেদের পালকি তোমার চুলের গভীরতায়
হারিয়ে যায়।
তুমি জানো?
রুপালী চাঁদ তোমার দেখা পেয়ে
মুখ লুকিয়ে যায়।
হয়তো জানো না।
তুমি ভাবো তুমি অযোগ্য।
তুমি মানো তুমি অপয়া।
আমি ভাবি তুমি কল্পনায় গড়া এক মুগ্ধ সকাল;
যার প্রতি পাতায় এঁকে দিতে পারি নিজেকে!
যাকে ঘিরে কাটাতে পারি পুরো একটা জীবন!
তুমি জানো?
তোমার জন্য একটা আকাশ খালি পড়ে আছে?
সে আকাশে তোমার বড্ড প্রয়োজন!
বলো মেয়ে,
তুমি কি আমার হবে?
পুরোপুরি আমার?
শুধুই আমার?

আমি অপূর্বর দিকে তাকালাম। সন্ধ্যার লালচে আলো ওর মুখে পড়ছে। মায়া চোখ দুটোয় প্রতিফলিত হচ্ছে অস্তগামী সূর্যের প্রতিবিম্ব! ঠোঁটের সীমানায় জড়ো হয়েছে পৃথিবীর সব স্বস্তি। কী সুন্দর লাগছে তাকে! আমার মনে হলো বহুকাল পর নিজের সাধনার মানুষটির সাথে দেখা হয়েছে। সাগরের ঢেউ পায়ের ওপর দিয়ে বয়ে যেতেই কেঁপে উঠলাম একবার। চোখ ফেরাতে পারলাম না অপূর্বর দিক থেকে। সেই সন্ধ্যের আলোয় মৃদু বাতাসে, সাগরকে সাক্ষী রেখে আমার আবার প্রেম হয়ে গেল! অপূর্বর সাথে!

অপূর্ব অবাক হয়ে বলল, “এভাবে তাকিয়ে আছ যে?”

আমি ওর হাত ধরে ওর কাছ ঘেঁষে কাঁধে মাথা রাখলাম। অপূর্ব আরও অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে তোমার?”

আমি এবার সংকোচ করলাম না। চোখ বুজে বললাম, “আমি তোমাকে ভালোবাসি অপূর্ব!”

অপূর্ব কিছু বলতে নিলে ওর গলাটা ধরে এলো। আমি ওর হাতটা আরও শক্ত করে ধরে রাখলাম। সূর্যটা ডুবে গেল। আঁধার হয়ে এলো চারদিকে। তবে আমার জীবনের আঁধারগুলো কেমন হঠাৎ বাষ্পের মতো উবে গেল!

অপূর্ব আর সমাপ্তি মিলে নতুন একটা অধ্যায় শুরু হলো!

(সমাপ্ত)

সুমাইয়া আমান নিতু

1 মন্তব্য

  1. অসম্ভব ছিলো গল্পটা,,,,,, গল্প পড়লে সবসময় একটা কথা খুব মনে পরে,,,,,,লেখক লেখিকারা খুব বুদ্ধিমান,, মাশাল্লাহ। কত্তো সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে গল্প লিখে,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে