অপূর্ব সমাপ্তি পর্ব-২৫+২৬

0
817

#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ২৫

পরীক্ষা শেষে পুরোপুরিভাবে ঘরের কাজে মন দিয়েছি। ভাবছি আবার স্কুলে জয়েন করব৷ ওই স্কুলেই খুশবুকে ভর্তি করলে আমার সুবিধা হবে। ওকে চোখে রাখা হবে, আবার চাকরিটাও হবে। এখন কাজকর্ম শেষ করে আমি পড়তে আর লিখতে বসি। একটা বিরাট উপন্যাস মাথায় ঘুরছে। একটু একটু করে লিখছিও, তবে কাউকে বলতে লজ্জা লাগে৷ লোকে বলবে, এর মতো মানুষ কী আর লিখবে! তবুও লিখতে ইচ্ছে করে।

লেখার জগতটাকে মনে হয় কোনো কল্পনার রাজ্য। আর খাতাটা তার দরজা। একবার ঢুকে গেলে বের হতে ইচ্ছে হয় না। সেই জগতের অন্যতম বাসিন্দা আমি। সবার সব কথা জানি। কারো কারো মনের কথাও জানি(!), তবে আমায় কেউ দেখতে পায় না। সবকিছু আমার পরিকল্পনা মাফিক হয়। কী দারুণ না?

আবার যখন একা থাকি, চট্টগ্রামের চারটা দিনের কথা খুব মনে পড়ে। ওই মানুষটার কাছে যেতে ইচ্ছে করে, তার স্পর্শ পেতে হাহাকার লাগে! সেই সময় চোখের সামনে সবকিছু অসহ্য লাগে। ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে হয় তার কাছে। এই সংসারটা বোঝার মতো লাগে। কিন্তু আবার তারপরেই মনে হয়, যখন সে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল, তখন এটাই একমাত্র আশ্রয় ছিল। আমার নিজের বাড়ি তো এটাই। এবাড়ির প্রতিটা মানুষের এত ঋণ জীবন দিলেও শোধ হবে না। বিশেষ করে খুশবুর। আমার স্বামীর সাথে আমি অন্যায় করতে পারলেও খুশবুর সাথে পারব না। এই একটি প্রাণ না থাকলে আজ আমিটা আমি থাকতাম না। বিষে জর্জরিত এই শরীরে সঞ্জীবনী গাছের স্পর্শের মতো প্রাণসঞ্চার করেছিল যে!

.
একদিন মার্কেটে গেছি কিছু বইপত্র কেনার জন্য। জুতোর দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কাচের ওপাশে চমৎকার একজোড়া জুতো দেখে থমকে গেলাম। বাচ্চা মেয়েদের জুতো। খুশবুর পায়ে দারুণ মানাবে। আমি ভেতরে গিয়ে জুতো কিনছি, সে সময় একটা মেয়েকে দেখি দোকানের একপাশে বসে আছে। মুখটা চেনা চেনা। তবে চিনলাম না। মেয়েটা খানিকটা এলোমেলো হয়ে বসে আছে। চোখদুটো ফুলে আছে। খুব কান্নাকাটি করেছে হয়তো। দোকানের ক্যাশ কাউন্টারে বসা লোকটা একটু পর পর মেয়েটাকে কী যেন বোঝাচ্ছে। আমি জুতো কিনে চলে এলাম। তবে মেয়েটার চেহারা মাথায় গেঁথে রইল।

সেদিন বেশ অনেকদিন পর বাড়ি থেকে বের হয়েছি বলে হেঁটে বাড়িতে ফিরলাম। রাস্তায় একটা বাড়ির দোতলায় ধুলোপড়া সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। লেখা-

ডাঃ যুলকারনাইন হোসাইন
এমবিবিএস, এফসিপিএস
সাইকিয়াট্রিস্ট
প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সাইকিয়াট্রি
জনতা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
রোগী দেখার সময়- শুক্রবার (সকাল ১০টা- বিকাল ৫টা), বুধবার (সকাল ১০টা- রাত ৮টা)

আমি কী মনে করে লেখাটার ছবি তুলে রাখলাম। মানসিক ডাক্তার কি সত্যি প্রয়োজন নাকি জানি না। তবে কখনো দরকার হলেও হতে পারে।

পরদিন ভোরে সে হঠাৎ ফোন করে বলল, “আমি চলে এসেছি।”

আমি শুয়েছিলাম তখনো। ঘুম ভাঙেনি পুরোপুরি। বুঝলাম না তার কথা। বললাম, “কোথায় এসেছ?”

“ঢাকায়।”

“হঠাৎ?”

সে রাগ হয়ে বলল, “এতদিন পর এসেছি, কোথায় খুশি হবে, না এসব বলছ!”

আমার তার জোরালো আওয়াজ শুনে ঘুম ভালোভাবে ভাঙলো। উঠে বসলাম। বললাম, “সরি। ঘুমে ছিলাম। তুমি কোথায় এখন?”

“কমলাপুর রেলস্টেশন। তোমাদের বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না। তুমি এখানে এসো এখুনি। সারাদিন একসাথে থেকে তারপর বাড়ি যাব।”

“কিন্তু আমার কাজ আছে। রান্নাবান্না করতে হবে।”

সে বিরক্ত হয়ে বলল, “একদিন তারা ম্যানেজ করতে পারবে না?”

“কে করবে বলো? ভাইয়ার অফিস, বাবা অসুস্থ, ঝিনু পারে না একা…”

“তুমি যদি এখন আমার বাড়িতে থাকতে তাহলে তারা কী করতো?”

“তেমনটা তো হয়নি তাই না? হলে কিছু একটা ব্যবস্থা হতোই। আর আমি তো বলিনি দেখা করব না। এখন বাড়ি যাও, বিকেলে দেখা করি। আর তুমি যদি আগে বলতে তাহলে আমি কালই রান্না করে রাখতাম…”

সে বলল, “হয়েছে থামো, আসলে তোমার আমার প্রতি এখন আর কোনো দায়িত্ববোধ নেই। এজন্য এত গা ছাড়া হয়ে আছ। থাকো তুমি। দেখা করতে হবে না।”

তারপর ফোন কেটে দিল।

আমি তারপর কয়েকবার তাকে ফোন করলাম। সে ধরলো না। এমন করার মানে কী? এতদিন তো কতো বুঝতো! বাড়ির সবার খবর নিতো, আমাকে সব কাজে সাপোর্ট করতো। আজ এটুকু নিয়ে এত রাগ?

সারাটা দিন বিরক্ত নিয়ে কাটলো আমার। তাকে আরও কয়েকবার চেষ্টা করে আর করিনি। বিচিত্র এক দুর্বোধ্য চরিত্র আমার কপালে জুটেছে!

বিকেলে খুশবুকে কোলে নিয়ে বাগানে বসে ওলে গল্প শোনাচ্ছি, তখন সে বিনা নোটিশে চলে এল। তাকে দেখে কে বলবে সকালে ঝগড়া করেছে? মুখভর্তি হাসি। চোখদুটো উজ্জ্বল। আমার দিকে এগিয়ে এল সে। আমি তখনো বসে। তার প্রতি অভিমান হচ্ছে খুব৷ মাথাটা নিচু করে রেখেছি। সে সামনে এসে আমার থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে বলল, “এই কেঁদে ফেলো না প্লিজ..সরি…”

আমি চুপ করে রইলাম। খুশবু ওকে চেনে না। জিজ্ঞেস করল, “কে এটা ফুপি মা?”

ও খুশবুকে একটানে নিজের কোলে নিয়ে বলল, “আমি তোমার ফুপি মায়ের বর হই।”

ও যেন খুশবু কতকালের চেনা! নির্দ্বিধায় ওর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি আমার কী হও?”

“আমি তোমার ফুপা হই।”

খুশবু মাথা দু’পাশে নেড়ে বলল, “আমার ফুপা তো অন্য। তুমি না।”

“আমি আরেকটা ফুপা।”

“না তোমাকে ফুপা ডাকব না।”

“কী ডাকবে তাহলে?”

“রাজকুমার ডাকব।”

“রাজকুমার?” আমি আর ও একসাথে বলে উঠলাম।

খুশবু আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। ওর গলা ধরেই ঝুলে ঝুলে বলল, “এই মাত্র ফুপি মা আমাকে গল্প শোনাচ্ছিলো। গল্পে যখন রাজকুমার এলো, তখনই তুমি আসলে। আমি তো মনে করেছিলাম সত্যিকারের রাজকুমার চলে এসেছে।”

বলেই খুশবু দাঁত বের করে হিহিহি করে একেবারে গড়িয়ে পড়ল ওর কাঁধে।

আমি খেয়াল করলাম ওর চোখ চিকচিক করছে। খুশবুকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। মুখে প্রশান্তির হাসি।

.
অনেকক্ষণ চলল আমার, তার আর খুশবুর খুনসুটি। আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় দুজন মানুষকে একসাথে পেয়ে মনে হচ্ছে যেন স্বর্গ পেয়ে গেছি! তবে…সেটা ক্ষণস্থায়ী!

তাকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার পর বাবার সাথে দেখা হলো। ও বাবাকে সালাম দিয়ে কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করলে বাবা ঠান্ডা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভালোই। বসো।”

সে বসল। বাবা বসল ঠিক তার মুখোমুখি। আমি খুশবুকে পাঠিয়ে দিলাম ঝিনুর কাছে। বাবা যে সোফায় বসেছেন সেটার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভয় ভয় হচ্ছে।

সে কী যেন বলতে চাইছিলো, বাবা থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আগে কিছু প্রশ্নের উত্তর দাও আমায়। সোজাসাপটাভাবে জবাব দেবে। আমার মেয়ের সাথে কী করতে চাও?”

সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি ওর সাথেই থাকতে চাই।”

“থাকতে চাও ভালো কথা, এতদিন কোথায় ছিলে?”

“একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছিলো..তাছাড়া আমার মা..”

“এবরশন কি পৃথিবীর কোনো মেয়ের হয় না? এখনকার যুগের ছেলে হয়ে একটা সামান্য কারনে তুমি স্ত্রীকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে? এটা তোমার শিক্ষা? আগেকার যুগের লোকজনও সন্তান না হওয়া বউকে সহজে বাপের বাড়িতে পাঠাতো না। মানবতাবোধ বলেও একটা কথা আছে। আর তোমার মাও তো মেয়ে। উনি কী করে পারলেন এই সামান্য করনে একটা মেয়ের সংসার ভাঙতে? এতকিছুর পর কোথা থেকে এসে হঠাৎ বলে বসলে আমার মেয়ের সাথে থাকতে চাও। চাইলেই হলো? এত সস্তা নাকি আমার মেয়ে?”

“বাবা আমি আপনাকে সব খুলে বলতে চাই। অনেক কিছুই আপনি জানেন না।”

বাবা বললেন, “বলো, তোমার কথাও শুনি।”

সে আমাকে যা যা বলেছিল, বাবাকেও সেসব বলল। বাবা শুধু শুনে গেলেন। ওর চোখেমুখে আত্মবিশ্বাস খেলা করছে। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে জোর দিয়ে কথা বলছে! আমার তবুও বিতৃষ্ণা এসে গেল। বিশাল প্রশ্নের পাহাড়ের কাছে নিতান্তই বেমানান জবাব৷ কিন্তু সে তার কথাগুলোকে বিশ্বাস করে। ওভাবেই জগতটা দেখে।

বাবা এবার একটু হেসে বললেন, “তুমি ভাবছ আজ আমার মেয়ে যা হয়েছে সেটা তোমার স্যাক্রিফাইজের জন্য হয়েছে? তুমি তাকে সে সুযোগ করে দিয়েছ?”

“তা নয় বাবা। তবে এমন না হলে ও হয়তো..”

বাবা আবার খানিকক্ষণ নিঃশব্দে হাসলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বললেন, “এই মেয়েটা আমার বড় আদরের। আমি কোনোদিন ওর ওপর চাপ দেইনি কিছু করার জন্য। চাইলে আমি ওকে ভালো স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে পারতাম। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর সামর্থ্য আমার ছিল। তবে ওর পড়ার তেমন আগ্রহ কখনো দেখিনি। তাই জোরও করিনি। আমার মেয়ে দেখতে খারাপ নয়। হয়তো আহামরি সুন্দরী, ফরসা নয়। তবে এমন মেয়েরাও পার্লারে যেয়ে, রূপচর্চা করে করে নিজেদের অতীব সুন্দরী করে তুলতে পারে। ও কোনোটাই করেনি। দরকার ছাড়া বাড়ির বাইরে যায়নি, মানুষের সাথে খোলাখুলিভাবে মিশতে সে পারে না। তাই আজ যে অবস্থানে ও আছে, যদি মধ্যবিত্ত একটা ঘরে বিয়ে হতো, ও তেমন থাকতো না। আগের মতোই অতি সাধারণ হয়ে থাকতো, এতদিনে বাচ্চা হতো, ছেলেপুলে স্কুলে ভর্তি করে তা নিয়ে থাকতো। তাই ওর এই জীবনটার জন্য তোমার অবদান আছে বৈ কী!

তবে কী জানো, মূদ্রার অপর পিঠও আছে। আর অনেক মেয়ের চেয়ে আমার মেয়ের মন সুন্দর। সে সবার মতো না। তাই তোমাকে এত সহজে ক্ষমা করে দিয়েছে। নিজেকে বদলালোও মনটা বদলাতে পারেনি। আফসোস, তুমি তার দাম দাওনি।

ও যখন চাইছে তোমার সাথে থাকতে, তখন থাকুক। এখন ওর সিদ্ধান্ত ও নিজে নেবে। আশা করি পরে যদি কোনোদিন আবার এমন ধাক্কা খায় জীবনে, তাহলে সামলে নিতে পারবে।”

সে এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার বলল, “বাবা আমি আর ওকে কষ্ট পেতে দেব না।”

“সে দেখা যাবে।” বলে বাবা উঠলেন। মাগরীবের নামাজের সাময় হয়ে গেছে। ভেতরে যেতে যেতে আমাকে ডেকে বললেন, “একটু এদিকে এসো তো..”

আমি গেলাম। বাবা বললেন, “ছেলেটা খারাপ না, তবে কেমন যেন৷ আর মা বলতে অজ্ঞান। তোমাকে সে আবারও কষ্ট দেবে। বাড়ি থেকে বের করেও দিতে পারে। কথার, কাজের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। তাই যা করবে, বুঝেশুনে করো। তোমার ওপর আমার জোর নেই কোনো। আর একান্তই আমার মতামত চাইলে বলব, দূরে থাকো এর থেকে।”

বাবা চলে গেলেও অনেকক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। পৃথিবীর যে কেউ আমাকে এই কথাই বলবে। সাদা চোখে তার সাথে আমার সম্পর্কটা ভাঙনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছুলেও তার প্রতি আমার যে মায়া, ভালোবাসা, প্রেম, আবেগ, অভিমান আছে সেসব মিলে আমাদের মাঝে শক্ত শিকলের বন্ধন তৈরি করেছে। সেই শিকল ভেঙে অন্য কোথাও যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।

রাতে বড় ভাইয়ার সাথেও ওর কথা কাটাকাটি হলো। ভাইয়াও তেমন খুশি হতে পারল না। তবে মেনে নিল আমার মুখ চেয়ে।

তবে খুশবুর সাথে খুব ভাব হয়েছে। খুশবু তো ওর কোল থেকে নামতেই চায় না। রাজকুমার ডেকে ডেকে অস্থির। সে চলে যেতে চাইলে বায়না ধরল যেতে দেবে না। রীতিমতো কান্না শুরু করল। ও শেষ পর্যন্ত রাতটা আমাদের বাড়িতেই রয়ে গেল। আমাদের এলোমেলো সৃষ্টিছাড়া বিয়ের পর ও এক রাতও এবাড়িতে থাকেনি। এই প্রথম।

খুশবু আমাদের মাঝখানে শুলো। দুই হাত দিয়ে আমাদের দুজনের হাত ধরে রাখলো। মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে তাকে একের পর এক গল্প শুনিয়ে যেতে থাকলো। এক পর্যায়ে হঠাৎ বলল, “জানো রাজকুমার, আমার মা অনেক সুন্দর ছিল।”

ও কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, “তাই নাকি?”

“হ্যাঁ। বাবার ঘরে মায়ের বড় একটা ছবি আছে৷ অনেক সুন্দর করে হাসতো মা। মা বাবার ঘরেই থাকতো। আমার মা তো মরে গেছে, যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে আমি বাবা আর মায়ের মাঝখানে এভাবে শুয়ে গল্প করতাম। মা অনেক আদর করতো তাই না বলো?”

আমি বললাম, “খুশবু! আমি তোমায় আদর করি না বুঝি?”

“করোই তো। তুমিই তো আদর করো সবচেয়ে বেশি। মা থাকলেও বেশি বেশি আদর করতো। তখন দুজনের আদর মিলে অনেক আদর হতো তাই না ফুপি মা?”

খুশবুর প্রশ্নের উত্তর কারো কাছে নেই। ও খুশবুর গালে চুমু খেয়ে বলল, “সোনামণি, এখন ঘুমাও। আবার সকালে গল্প বলো, ঠিক আছে?”

খুশবু লক্ষী মেয়ের মতো বলল, “আচ্ছা।”

খুশবু ঘুমিয়ে পড়ল একসময়। আমরা দুজন চুপচাপ। কথাগুলো অজানায় হারিয়ে গেছে। আমার খোলা জানালা দিয়ে বাতাস আসছে। এখন শ্রাবণ মাসের শেষভাগ। বাড়ির সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে বড় হওয়া লম্বা কদম গাছটা ফুলে ফুলে ছেঁয়ে আছে। গাছে একটা পেঁচা থাকে। রাতের বেলা করুণ সুরে ডাকে সেটা৷ এখনো ডাকছে। তবে এই ডাক শুনলে কেন যেন ভয় করে না। বিষাদ জেকে বসে মনে।

বারোটার একটু আগে দরজায় কে যেন কড়া নাড়লো৷ খুলে দেখি ঝিনু। বলল, “খুশবু ঘুমিয়েছে?”

“হ্যাঁ, কেন?”

“ভাইয়া বলেছে ওকে তার ঘরে দিয়ে আসতে।”

“এত রাতে?”

“আরো আগেই বলেছিল ও ঘুমিয়ে গেলে নিয়ে যেতে। এতক্ষণ তো শুধু ওর গল্পই শোনা যাচ্ছিলো। এখন চুপচাপ দেখে এলাম।”

“আচ্ছা নিয়ে যা।”

ঝিনু চলে গেলে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম। ও তখনই বলে বসলো, “আমারও ইচ্ছে করে খুশবুর মতো একটা মিষ্টি বাচ্চা আমাদের মাঝখানে শুয়ে গল্প করুক। আমাদের বাবুটা বেঁচে থাকলে ওর সমান থাকতো না?”

“হ্যাঁ!”

সে হাত দিয়ে আমার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, “এখন চাইলে আবার হতে পারে!”

আমি তার হাত সরিয়ে দিয়ে বললাম, “তুমি গাছে উঠিয়ে মই কেড়ে নেয়ার মতো কথাবার্তা বলবে না। আগে ক্যারিয়ার গোছাই, তারপর বাচ্চার কথা ভাবব।”

.
সকালে সে নাস্তা খাওয়ার সময় ভয়ানক খবর দিল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ফিরবে কবে?”

সে খেতে খেতে উত্তর দিল, “ফিরব না। ঢাকায়ই থাকব। চাকরি ছেড়ে দিয়ছি।”

আঁতকে উঠে বললাম, “মানে কী? এত ভালো চাকরি কেউ ছাড়ে? তাছাড়া তুমি নিজের ইচ্ছেতে গিয়েছিলে!”

সে গা ছাড়া ভাবে বলল, “আমার এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে ভালো লাগে না। এক কাজও বেশিদিন করতে পারি না।”

সে বাড়িতে চলে গেল কিছুক্ষণ পর। আমার মাথায় সারাটা দিন তার শেষ কথাগুলো ঘুরতে লাগলো।

.
আমার মাস্টার্সের রেজাল্ট দিয়ে দিল কয়েকদিনের মধ্যেই। আমি সারা বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম হলাম। রেজাল্ট পেয়ে এত অবাক লাগলো বলার মতো না। এতটাও আশা করিনি! তাও যে অবস্থায় পরীক্ষা দিয়েছি!

আমার রেজাল্ট শুনে বাবা এত খুশি হলেন যে সারা এলাকায়, কলেজের সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালেন। পারলে মাইক দিয়ে এনাউন্স করে! সেও অনেক খুশি হলো। সন্ধ্যায় গাড়ি ভর্তি করে এক হাজার গোলাপ নিয়ে উপস্থিত হলো! আমি লজ্জায় শেষ! রাতে আমাদের সবাইকে বাইরে খাওয়াতে নিয়ে গেল।

রেজাল্টের দিন কলেজে গিয়ে সেই জুতোর দোকানের মেয়েটাকে দেখতে পেলাম। দেখেই চিনে ফেললাম কেমন করে যেন। কথা বলে জানতে পারলাম মেয়েটার নাম ইভা। আমাদের কলেজেই থার্ড ইয়ারে পড়ে।

এর কিছুদিন পরেই আরও একটা খুশির ঘটনা ঘটলো। আমার চাকরি হয়ে গেল আমাদের কলেজেই। জানুয়ারিতে সবচেয়ে জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে কলেজে জয়েন করলাম আমি।
(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব-২৬

কলেজে জয়েন করার পর থেকে ইভার সাথে প্রায়ই দেখা হতে লাগলো। ভালো সম্পর্কও হয়ে গেল। মেয়েটা মিশুক, মিষ্টভাষী, তবে চোখেমুখে বিষাদ লুকিয়ে থাকে। দেখলে মনে হয় বুকে কষ্ট চাপা দিয়ে রেখে হাসছে।

একদিন আমি আমার রুমে বসে আছি, ইভা হঠাৎ উপস্থিত। চোখমুখ ফোলা। প্রচুর কান্নাকারি করেছে বোঝা যায়। আমি তাকে নিয়ে বসালাম। সে জানালো তাকে তার সৎ মা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, “বের করে কেমন করে?”

ইভা নাক টেনে চোখ মুছে বলল, “আমাকে বিয়ে দিতে চায়। বুড়ো এক লোকের সাথে। ওই লোকের আগের পক্ষে তিনটা বাচ্চাও আছে। একটা তো কলেজে পড়ে। টাকা দেখে মা লোভে পড়ে গেছে। আমাকে বিয়ে দিবেই। আমি রাজি না। তাই আজকে বের করে দিয়ে বলেছে বিয়েতে রাজি হলে বাড়ি ফিরতে, নয়তো কোনোদিন মুখ না দেখাতে।”

“তোমার বাবা কিছু বলেন না?”

“বাবা আমায় আর ভালোবাসে না…” বলে ইভা কেঁদেই ফেলল। ঢোক গিলে বলল, “আমি কোথায় যাব ম্যাম? আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই! ওই বাড়িতে ফিরলে লোকটাকে বিয়ে করতে হবে!”

“চলো, তোমার বাড়িতে যাব আমি।”

ও ইতস্তত করে বলল, “আমার সৎ মায়ের ব্যবহার অনেক খারাপ!”

“হোক, এভাবে তো চলবে না। তোমার বাবা জুতোর ব্যবসায়ী তাই না?”

“হ্যাঁ আপনি জানেন কী করে?”

“দেখেছি। চলো তুমি।”

.
ইভার বাড়িতে গিয়ে বড় বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলো। ওদের বাড়িটা ঘিঞ্চি এলাকায়। প্রচুর লোকের বাস। লম্বা ঘরের সারি। প্রতিটা ঘরে এক পরিবার বাস করে। ওদের ঘরে গিয়ে দেখি বাচ্চায় ভর্তি। ওর সৎ মায়ের চার ছেলেমেয়ে। সবাই ছোট। মহিলাকে দেখেই বোঝা যায় বেশ মেজাজ। আমাকে বসতে দিয়ে কথা বলেই গেল। সব তার অভাবের ফিরিস্তি। এক পর্যায়ে আমার কাছে এসে বসে বলল, “দ্যাখেন ম্যাডাম, এই মাইয়্যারে এমনিতেও ভালা ঘরে বিয়া দেওয়া সম্ভাব না। ওই অবস্থা আমগো নাই। আমার চাইরডা পোলাপানের দিকে চাইয়া দ্যাখেন। ইভারে বিয়া দিতে পারলে ওগোরে নিয়া আমার আর কষ্ট থাকব না৷ আপনেই কন, ওরে কষ্ট কইরা মানুষ করছি ও এইটুকু করতে পারব না আমগো লাইগ্যা?”

আমি প্রথমবার মুখ খুললাম, “তাই বলে একটা মেয়েকে তার বাবার বয়সী লোকের সাথে বিয়ে দেবেন? ওর জীবনের কোনে মূল্য নেই? ও কি বড়লোক বৃদ্ধের শখের বস্তু? আপনাদের ছেলেমেয়ের ব্যবস্থা আপনারা করবেন। ওকে কেন ওর জীবন নষ্ট করতে হবে সেজন্য?”

মহিলা কিছুক্ষণ শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমাকে আর কিছুই বলল না। আমার সামনে ইভার চুলের মুঠি ধরে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে চেঁচাতে শুরু করল, “তুই উকিল ধরছোছ? কী ভাবছোছ হেরে নিয়া আইলে আমি তোরে ঘরে তুইলা আদর করমু…..”

বকার এক পর্যায়ে মহিলা ডালঘুটনি নিয়ে এসে ওকে মারতে শুরু করল। আমি বহুকষ্টে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে বের হয়ে এলাম বাড়ি থেকে। বলে এলাম, মহিলার নামে কেস করব।

মহিলার তাতে কোনো ভাবান্তর নেই। চেঁচিয়ে শুনিয়ে দিল, “আমার মাইয়্যা, আমি মারছি, কেডা কী করে আমিও দেখমু।”

এরপর গেলাম ইভার বাবার কাছে। স্ত্রীর কথাগুলোই শান্তভাবে পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি। বুঝলাম, স্ত্রীরোগে পেয়েছে। একে কিছু বলে লাভ নেই।

আমি ইভাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গেলাম। আপতত সে আমার কাছেই থাকুক।

.
একদিন কলেজ শেষে বের হয়ে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা প্যাকেট। নেভি ব্লু শার্ট আর খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে কি সুন্দর যে লাগছে! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমায় বলল, “এবার সময় হয়েছে আসল বাড়ি ফেরার।”

“মানে তোমার বাড়ি?”

“হ্যাঁ।”

“এখন ফেরা সম্ভব নয়।”

“কখন সম্ভব?”

“ভাইয়াকে বিয়ে দিতে হবে, খুশবুকে ভালো একটা মা দিয়ে তবে আমি তোমার বাড়ি যাব।”

“আমার বুঝি কষ্ট হয় না? এটার কেমন কথা বলোতো? বিয়ের পর স্বামী ছেড়ে দিনের পর দিন বাপের বাড়িতে পড়ে থাকবে? যা হবে হবে, তুমি আমার সাথে খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে।”

“যত দ্রুত ব্যবস্থা হবে, আমি চলে যাব।”

“কিন্তু আমি কি অনন্তকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব?”

“করতে পারলে করবে।”

“না পারলে?”

“আরেকটা বিয়ে করে নাও।”

সে আশ্চর্য হয়ে একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলল, “তুমি এটা বলতে পারলে? আরেকটা বিয়ে করার হলে অনেক আগে করে ফেলতাম।”

“তাহলে আমাকে সময় দিতে হবে।”

এই একই কথা অসংখ্যবার আমাদের মধ্যে হয়েছে। বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত আমি। নরম স্বরে কিছু বললে তার এক ঘ্যানঘ্যান শেষ হতেই চায় না। তাই সোজা বলে দেই যা বলার।

সে আমার কথা শুনে লম্বা নিশ্বাস নিয়ে আমার হাতে প্যাকেটটা দিয়ে চলে গেল। বাড়ি ফিরে খুলে দেখি তাতে সুন্দর একটা ডায়েরী। ওপরের কভারে সাদার মধ্যে অসংখ্য নীল রঙের প্রজাপতি। ভেতরের প্রতিটা পাতার নিচে আমার নাম লেখা। ডায়েরীর সাথে ছোট্ট চিরকুট- “খাতায় লেখ কেন? এটাতে লিখবে এখন থেকে। তোমার লেখনীর সাথে যুক্ত হোক আমার অজস্র ভালোবাসা।”

ডায়েরী পেয়ে মন ভালো হয়ে গেল। নিজেকে অপরাধী লাগতে লাগলো তার সাথে ওভাবে কড়া কথা বলার জন্য। আমি তাকে ফোন করলাম, ধরলো না। সেদিন থেকে টানা অনেকগুলো দিন আমার সাথে কথা বলল না।

গুনে গুনে বিশদিন পর নিজেই ফোন করলো। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, “এমনটা কেন করলে? আমি নাহয় একটু খারাপভাবে কথা বলেছি, তাই বলে এমন করতে হবে?”

সে বলল, “ইচ্ছে হয়নি তোমার ফোন ধরতে।”

আমার কান্না পেয়ে গেল। তবে তাকে বুঝতে দিলাম না। সে তারপরেই একেবারে স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে কথা বলতে থাকলো। আমিও আর ওকথা তুললাম না।

.
অপরিচিত একটা মেয়েকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়াটা বাড়ির সদস্যদের কাছে বেশ বিব্রতকর আর বিরক্তির কারন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ইভার বেলায় সেটা হলো না। ও প্রথমদিন থেকেই সবার সাথে ঘরের মেয়ের মতো মিশে গেল।

কয়েকদিন থাকতে থাকতে সংসারের কাজগুলোও নিজের করে নিল। আমি ওঠার আগেই উঠে রান্নাঘরের কাজ শুরু করে দেয়। আমি বাঁধা দিলে বলে বাড়িতে সব কাজ ও করতো। এখন না কাজ না করলে ভালো লাগে না।

আমার সবচেয়ে ভালো লাগলো, ও যখন খুশবুর সাথে চমৎকার একটা সম্পর্ক গড়ে তুলল। খুশবুকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা, পড়ানো অনেকগুলো দায়িত্ব মেয়েটা নিয়ে নিল।

ইভা আসার পর ও আমাকে দেখিয়েছিল কেমন করে ওর মা ওকে মারতো। মেয়েটার পুরো পিঠ জুড়ে মারের দাগ। হাতে কয়েকটা পোড়া দাগও আছে৷ সেগুলো গরম খুন্তির ছ্যাকা। আমি প্রথমবার দেখলাম এমন নির্যাতনের চিত্র। পুলিশের কাছে কমপ্লেইন্ট করতে প্রায় চলেই যাচ্ছিলাম, ইভাই আটকে দিলো। বলল, “পুলিশ ধরলে বাবাকে ধরবে। তখন ছোট ভাইবোনগুলোর কী হবে?”

ওর অনেক বলার পর আমি তাই আর গেলাম না৷ বলে দিলাম, “বাড়ি ফেরার প্রয়োজন নেই, এখানেই থাকো।”

কিন্তু ও লজ্জা পায় আশ্রিত থাকতে৷ চলে যেতে চায়। বাবাও ওকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছেন। তাই বাবাকে দিয়ে বলিয়ে ওকে রাখলাম বাড়িতে।

একদিন বিকেলে আমি কলেজ থেকে ফিরে দেখি খুশবু আর ইভা ঘুমিয়ে আছে। খুশবু ইভার বুকে মুখ গুঁজে ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ইদানিং ও ইভা আন্টি বলতে পাগল। আমার হিংসেই হয় মাঝে মাঝে। আবার ভালোও লাগে।

এই দৃশ্য দেখে হঠাৎ আমার মনে হলো, ভাইয়ার সাথে ইভার বিয়ে দিলে কেমন হয়? আমি জামাটাও বদলালাম না। নতুন ভাবনাটা পেয়ে বসল একেবারে। অনেক চিন্তা করে দেখলাম এরচেয়ে ভালো আর কিছু হতেই পারে না। আমি দৌড়ে বাবাকে গিয়ে কথাটা বললাম। বাবাও এক কথায় রাজি। ঝিনুও শুনে লাফিয়ে উঠল একেবারে। ও ও ইভাকে দারুণ পছন্দ করে।

.
কিছুদিন পর কথাটা ইভাকে বললাম। আমার ভাবনা ছিল হয়তো রাজি হবে না। আবার খানিকটা অপরাধবোধও ছিল, ভাইয়া অনেক বড়। এক মেয়ের বাবা। ও হয়তো ভাববে আশ্রয় দিয়েছি বলে অন্যায় করছি ওর সাথে। কিন্তু কথাটা শুনে ইভা রাগ করল না, বা মন খারাপও করল না। উল্টো লজ্জা পেয়ে উঠে চলে গেল। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। এবার ভাইয়ার পালা।

ভাইয়া ইভাকে দেখতো, কিন্তু খুব একটা পাত্তা দিতো না। মাঝে মাঝে খুশবুর ব্যাপারে কথা বলতো। ভাইয়াকে বলতে সে প্রথমে খানিক চেঁচামেচি করল। তারপর খুশবু আর ইভার কেমিস্ট্রিটা তাকে আমি আস্তে আস্তে বোঝালাম। নমুনাও দেখালাম। একসময় নিমরাজি হলো। ব্যাস, আর কী লাগে!

ছোট ভাইয়া, ভাবী, আপার সাথে কথা বলে দিনক্ষণ ঠিক করে ঘরোয়াভাবে বিয়েটা হয়ে গেল। ইভার বাবা মাকে জানানো হলো না। কারন তারা মেয়েকে সেদিনই পরিত্যাগ করেছে।

বিয়ের পর খুশবুকে যখন বললাম, “ইভা আন্টিকে এখন থেকে মা ডাকবে। ও তোমার মা হয়ে গেছে।”, খুশবু খুশি হলো না অখুশি বুঝলাম না। বলল, ” কিন্তু আমার মা তো মরে গেছে না?”

“হ্যাঁ, এটা নতুন মা। এখন থেকে তুমি বাবা মায়ের মাঝখানে শুয়ে গল্প করতে পারবে। সবাইকে বলতে পারবে তোমারও মা আছে।”

খুশবু খাটের উপর উঠে চিৎকার করতে শুরু করল। সাথে লাফঝাঁপ তো আছেই। তার উত্তেজনা একটু কমে এলে লাফিয়ে গিয়ে ইভাকে জড়িয়ে ধরল। মুখে চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি সত্যি মা তো? পরে আবার আন্টি হয়ে যাবে না তো?”

ইভা ওকে বুকে টেনে কেঁদে ফেলে বলল, “না আমি মা’ই থাকব।”

.
বিয়ের একটু পর ভাইয়া একেবারে অস্থির হয়ে উঠল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কষ্টে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাকে বলল, “তোর জন্য আমি এই কাজটা করলাম। আমি কেমন করে আরেকটা মেয়ের সাথে থাকব?”

আমি তাকে আবার বোঝালাম। বহুকষ্টে আমি, আপা আর ছোট ভাবী মিলে তাকে বাসর ঘরে পাঠাতে সক্ষম হলাম। খুশবুকে আগেই ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলাম ভুলিয়ে ভালিয়ে। ইভা এদিকে টেনশনে ঘেমে একাকার হয়েছে। তবে আমার বিশ্বাস ছিল ইভা মানিয়ে নিতে পারবে।

সকালবেলা যখন দেখলাম ভাইয়ার মধ্যে গতকালকের অস্থিরতার চিহ্নও নেই, বেশ হাসিখুশি আছে, তখন স্বস্তি পেলাম। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি বলে নিজের ওপর খানিকটা গর্বও হলো! ইভা সকালে উঠে কাজে লেগে গেল। ভারি লজ্জা লজ্জা মুখ করে আছে আজ। আমি প্রথমবার তাকে ভাবী ডাকলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি খুশি হয়েছ তো ভাবী?”

ইভা আমার দিকে খুব ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “জানো আপু, আমি কোনেদিন ভাবিনি আমার কপালে এত সুখ, সম্মান আছে। এত ভালো একটা পরিবার, তোমার ভাইয়ার মতো এত ভালো বর আমি স্বপ্ন দেখতেও ভয় পেতাম। একটা গোপন কথা বলি, তোমার ভাইয়াকে আমার সেই প্রথম দিন থেকেই ভালো লাগতো। বিশ্বাস করো, খারাপ উদ্দেশ্যে না, নিজে কষ্টে থাকি তো, তাই কষ্ট পাওয়া মানুষগুলোকে অনেক আপন মনে হয়।”

তারপর ও আমায় জড়িয়ে ধরে বলল, “তোমার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না৷ দেখো, তোমার অনেক ভালো হবে।”
(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে