অপূর্ব সমাপ্তি পর্ব-২২+২৩+২৪

0
874

#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ২২

রাত দশটা। ঝড় থেমে গেছে, এখন শুধু ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। আমি অনেকক্ষণ এই ঘরটাতে বসে আছি। বাসায় শুধু আমি আর সে। সুবোধ রাতের রান্না করে দিয়ে বিকেলে চলে গেছে।

রান্নাঘরে শব্দ শুনে ঘর থেকে বের হলাম। দেখি সে টেবিল সাজাচ্ছে। আমায় দেখে বলল, “খেতে বসো।”

আমি চুপচাপ গিয়ে বসলাম। খাওয়ার সময় সে এটা ওটা এগিয়ে দিল, সাধারন কথাবার্তা বলল। দেশের কথা, রাজনীতির কথা। এমনটা সবসময় বলতো আগে। তার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। আমরা একসাথে থাকি। প্রতিদিন এভাবে খেতে বসি।

খাওয়া শেষে সে ঘরে গিয়ে মশারি টানিয়ে দিল। যা ভেবেছিলাম এখানে তারচেয়ে অনেক বেশি মশা। একেকটা বিরাট সাইজ! সন্ধ্যার আগে আগে কয়েল না জ্বালালে টেকা অসম্ভব।

মশারি টানানো শেষ হলে সে ড্রইং রুমে বসে টিভি অন করল। মনোযোগ দিয়ে নিউজ দেখতে থাকলো। আমি তার সামনে গিয়ে বললাম, “আমি শুতে যাচ্ছি। ভোরবেলা চলে যেতে হবে।”

সে টিভি থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, “যাও।”

আমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ঠিক দুই মিনিটের মাথায় সে দরজা ধাক্কাতে শুরু করল।

খুলে দিতেই বলল, “দরজা বন্ধ করছ কেন? আমি আসব তো।”

“তুমি অন্য ঘরে শোবে।” বলেই মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিলাম।

আবার ধাক্কা। টিকতে না পেরে খুললাম। খুলেই বললাম, “প্লিজ যাও, রাতদুপুরে কাহিনী করো না।”

সে কাতর গলায় বলল, “আমরা স্বামী- স্ত্রী! আলাদা শোবো কেন?”

আমি একটু হেসে বললাম, “এতদিন তোমার ইচ্ছে হয়নি আমার সাথে থাকতে, এখন আমার ইচ্ছে নেই।”

তারপর আবার দরজা বন্ধ। বাইরের বৃষ্টির শব্দের সাথে কেমন হু হু শব্দ আসছে। বড় ঘরটাতে ভয় ভয় লাগছে। আমি পাত্তা দিলাম না। শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে ক্রমাগত কান্না পেতে থাকলো। সব কথা মনে পড়ে আর কাঁদি। বাইরে বৃষ্টি থেমে গেল একসময়। অনেকক্ষণ কেঁদে মাথা ব্যথা করছে। আমি উঠে দরজা খুললাম ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য।

দরজা খুলেই শুনে ওপাশে ড্রইং রুম থেকে টিভির শব্দ আসছে। সে এখনো টিভি দেখছে নাকি? ক’টা বাজে?

গিয়ে দেখি সে ঘুমিয়ে আছে। সোফায় গুটিশুটি হয়ে। এত লম্বা মানুষটার জায়গা হয়নি। পা দুটো বেকায়দাভাবে রাখা। মাথার নিচে সোফার শক্ত কাঠ। কয়েলটা শেষ হয়ে নিভে গেছে। চারদিকে মশাদের কনসার্ট চলছে। এভাবে একটা মানুষ ঘুমায় কেমন করে?

সিনেমায় দেখতাম প্রেমে ব্যর্থ ছেলেরা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকে। আরেকজন এখানে আজ বউ সাথে ঝগড়া করে মশাদের খাবার হচ্ছে! কি আজব!

আমি তাকে ডেকে তুললাম। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, “কী হয়েছে?”

“তুমি এভাবে শুয়ে আছ কেন?”

“তুমি তো জায়গা দিলে না।”

“তোমার আরেকটা ঘর আছে সেখানে কী হয়েছে?”

সে উঠে বসে ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল, “ব্যথা হয়ে গেছে, উফ! হঠাৎ ঘুমিয়ে গেছি তো। ওই ঘরে আবার ফ্যান নষ্ট।”

আমি প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বললাম, “দুনিয়ার সমস্যা আজকেই হবে। আর সব বিষয়ে তোমার অযুহাত তৈরি থাকবে। যাও তোমার ঘরে গিয়েই শোও।”

সে হেসে বলল, “আচ্ছা।”

তারপর উঠে হাই তুলতে তুলতে ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে নাক ডাকতে শুরু করল। সেই ভয়ানক শব্দের নাক ডাকা!

আমি মাথায় পানি দিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ ড্রইং রুমে বসে থাকলাম, কিন্তু থাকা যায় না। কয়েল কোথায় আছে কে জানে! খুঁজে পেলাম না। পাশের ঘরে গিয়ে দেখি ফ্যান সত্যি নষ্ট।

আমি ওর ঘরের দিকেই গেলাম। খাটটা বড়। অন্যপাশে শুয়ে পড়লাম। এখনো ঘুম আসছে না। বৃষ্টিশেষে ভ্যাপসা গরম পড়ছে। ঘরটার আবহাওয়া অস্বস্তিদায়ক হয়ে উঠছে। একটু পর দেখি সে উঠে জানালা খুলে দিল। জিজ্ঞেস করলাম, “ঘুমাওনি?”

“ঘুমিয়েছিলাম। ইদানিং ঘুম গাঢ় হয় না। ছাড়া ছাড়া হয়। আশেপাশে যা হয় সব বুঝতে পারি।”

“ওহ।”

সে খাটে বসে বলল, “তুমি সত্যি কালকে চলে যাবা?”

“হ্যাঁ।”

“তারপর?”

“তারপর আমি যা বলেছি তাই।”

“তার মানে আমরা আর একসাথে থাকব না?”

আমার এবার ভীষণ কষ্ট হলো কথাটা শুনে। আমি তার দিকে তাকালাম। বাইরে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। চাঁদের আলোয় ভরে গেছে চারপাশ। তারই একটা অংশ জানালা গলে তার মুখে এসে পড়েছে। বিষন্নতা আর আকুতি মিশে আছে তার মুখজুড়ে। আমি কিছুই বলতে পারলাম না।

সে বলতে থাকলো, “আমি তোমার ক্ষতি চাইনি, তোমার সাথে খেলতেও চাইনি। আমি জানি আমার সমস্যা আছে খানিকটা, আমার চিন্তা ভাবনাগুলোই এমন। তার জন্য এত বড় শাস্তি দেবে? আমি নিজেও তো কষ্টে থেকেছি। এতগুলো বছর তোমারই অপেক্ষা করেছি। ভালো না বাসলে করতাম? তোমার সাথে বিয়ের পর অন্য কারো দিকে চোখ তুলেও তাকাইনি। শেষ সুযোগটা অন্তত দিতে পারতে!”

“তুমি চুপ করবে প্লিজ? আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে।”

আমি অন্যদিকে ফিরে মুখ লুকিয়ে চোখের জল মুছে নিলাম। ভয়ানক ইচ্ছে করছে তাকে ক্ষমা করে দিতে। সত্যি বলতে সন্ধ্যার পর থেকে চাইলেও রাগ করতে পারছি না। সে আমায় ভালোবাসে এটা আমি অস্বিকার করতে পারি না। আমার এই তিন বছরে একটা একা মেয়েকে যতটা সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তার কোনোটাই সে আমার হতে দেয়নি। আড়ালে থেকে আগলে রেখেছে সবসময়। এই আমায় নিয়েই পড়ে থেকেছে। তাকে সুযোগ দিতেই পারি আমি। হয়তো যত্ন নিলে, পাশে থাকলে সে আর এমন থাকবে না। আবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে উল্টোপাল্টা কিছু করেও বসতে পারে।

আমি তার দিকে তাকালাম। সে বসেই আছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, “কী হয়েছে?”

সে কিছু বলল না। চেয়েই রইল।

আমরা আমাদের জীবনটা যেরকম চাই সেটা কি তেমন করে হয়? কখনোই না। কোনো ঘটনাই পরিকল্পনামাফিক হয় না। হয় কল্পনার চেয়ে সুন্দর, নয়তো ভয়াবহ কুৎসিত। আমার বিবাহিত জীবনের প্রথম অধ্যায়টা সেরকম কুৎসিত ছিল। আমি চাইলে বাকি জীবনটা সাহসিকতার নামে একা কাটিয়ে দিতে পারি। তাতে হয়তো বাইরে দিয়ে অনেক আলো থাকবে, লোকে অনেক বাহবা দেবে। সফল একটা মানুষ হয়ে বাঁচবো। কিন্তু সুখী হতে পারব না।

আমি তাই সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি আরেকটা সুযোগ তাকে দেব। যদি সে ঠিক থাকে, তবে আমি পৃথিবীর একজন সুখী নারী হব, নয়তো বাকিটা পরে দেখা যাবে।

এটুকু হলো নিজের কাছে নিজের একটা জবাবদিহি। সত্যি বলতে তাকে সামনে দেখে আমি নিজেই স্থির থাকতে পারছি না। পতঙ্গের মতো ছুটে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে আগুনে। মরলে মরব, তাতে কী?

আমি হঠাৎ করেই শোওয়া থেকে উঠে তাকে জাপটে ধরলাম। সে কেঁপে উঠল একেবারে। আমার মাথাটা চেপে ধরল নিজের বুকের সাথে। তারপর খেয়াল করলাম আমার চোখের পানিতে যেমন তার জামা ভিজে একাকার হচ্ছে, তেমনি আমার মাথায়ও টপটপ করে জল ঝরছে! কি আশ্চর্য সে রাতটা! বাইরের আকাশে ফুটে থাকা লক্ষ লক্ষ তারকারাজি তাদের শুভকামনা পাঠিয়ে দিচ্ছে আমাদের ছোট্ট ঘরে। আমরা বহুদিনের বিবাদ ভঞ্জন করে পুরোনো কথা ভুলে একে অপরের সাথে মিশে যাচ্ছি!

.
মাঝরাতের পর ঘুমালেও ঘুম ভাঙলো একেবারে ভোরে। মাত্র সূর্যটা উঠব উঠব করছে। আমি তার বুকে মাথা দিয়ে তখন শুয়ে আছি বেড়ালছানার মতো। সে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে আমায়। আস্তে আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। উঠে জানালার পর্দা টেনে দিলাম।

তারপর গায়ে কাপড় জড়িয়ে ছাদে উঠলাম। পূর্বাকাশে লাল আলোয় উদ্ভাসিত করে সে জানান দিল নিজের। প্রথম আলোটুকু মেখে নিলাম শরীরে। গ্রীষ্মের দিনে সূর্যিমামা উঠেই রোদ ছড়িয়ে দিতে থাকে। মিঠে রোদ গাল ছুয়ে দিয়ে গেল আমার। গতকালকের বৃষ্টিতে ধুলো মুছে সবকিছু ঝলমল করছে। গাছের পাতায় জমে থাকা জলে রোদ পড়ে মুক্তোদানার মতো ঝিলিক দিচ্ছে! কি নির্মল বায়ু! নিঃশ্বাসের সাথে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায় বহুগুন! একবার ভাবলাম তাকে ডেকে এনে দেখাই। কিন্তু আর গেলাম না। থাক ঘুমিয়ে নিক।

এতদিন সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন আমি বাড়ির কোনো কাজই করতাম না। রান্নাবান্না করি না কতকাল! আজ সংসারী হতে ইচ্ছে হলো। ঘরদোর গোছালাম। গোসল করে একটা শাড়ি পরলাম। ওইযে সে যেই বেগুনি পাড়ের আসমানী শাড়িটা কিনে রেখেছিল, সেটাই। সে অবশ্য এখনো ঘুমে। উঠলে ভারি খুশি হবে।

সুবোধ এলে তাকে বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দিলাম। আর আজকের মতো বাকি দিনটা ছুটিও দিয়ে দিলাম। সব কাজ নিজে করব।

সকালের নাস্তা বানিয়ে তাকে ডেকে তুললাম।সে জেগে কতক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি সকালে উঠে চলে যাবে।”

“মানে কেন যাব?”

“ওইযে বলেছিলে যাবে যে…আহ রে! কতদিন এত ঘুমাই না। আজ একেবারে রিলাক্স লাগছে।”

সে বাথরুমের দিকে গেল। আমার শাড়ির কথা কিছুই বলল না। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এর মধ্যে মায়ের ফোন এলো। আমার বুক কাঁপতে শুরু করল। মাকে তো কিছু বলে আসিনি। এতকিছু হয়ে গেল এর মাঝে। মা কী বলবে শুনলে? কেমন লজ্জা আর অস্বস্তি ঘিরে ধরল। বেজে বেজে একবার ফোন কাটলো। দ্বিতীয়বারে ধরলাম। ওপাশ থেকে মিঠে সুর ভেসে এলো, “ফুপিমা, তুমি কোথায়? তাড়াতাড়ি চলে আসো তো, আই মিস ইউ!”
(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ২৩, ২৪

২৩.
খুশবুর সাথে কথা বললাম অনেকক্ষণ। কী যে মিষ্টি করে কথা বলে! বাচ্চাটা এখন সব বোঝে। আমি না থাকলেও কান্নাকাটি করে না তেমন। শুধু একটু মন খারাপ করে আছে তার সাথে খেলার কেউ নেই বলে। দাদু কাজ করছে, বাবা অফিসে, ছোট ফুপি কলেজে! বেচারি তাই ফোন করেছে আমাকে। আমি তাকে বুঝিয়ে ছবি আঁকতে বলে দিয়েছি। ছবি আঁকতে আর নাচতে বললে তার আর কিছু লাগে না।

ওর সাথে কথা শেষ করে আপাকে ফোন করে গতকালকের ঘটনা সংক্ষেপে বললাম। আর আমি কিছুদিন এখানে থাকব সেটাও জানিয়ে দিলাম।

ফোনে কথা বলতে বলতে এতক্ষণ তার কথা খেয়ালও ছিল না। গেলো কোথায়? সারা ঘর খুঁজে দেখি কোথাও নেই। একটু পর হঠাৎ উদয় হয়ে আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। একহাতে আমার চোখ ঢেকে অন্য হাত দিয়ে আমার কানের পাশে ফুল গুঁজে দিল। তারপর টেনে আয়নার সামনে নিয়ে গেল। চোখ খুলে দিতে দেখি সেই বেগুনী ফুলগুলো। খোলা চুলে সুন্দর লাগছে।

সে বলল, “দেখো তো ভালো করে তুমি বেশি সুন্দর না আমি?”

এই কাজটা আমি আগে প্রায়ই করতাম। দুজন একসাথে আয়নার সামনে দাঁড়ালে বলতাম, “দেখো তুমি কত সুন্দর, আমি কতো কালো।”

সে উত্তর দিত না। আজ বলল, “আমার চেয়ে তুমি বেশি সুন্দর। একেবারে নদীর মতো।”

“নদীর মতো মানুষ কেমন করে হয়?”

“হয় হয়। তুমি হচ্ছো শান্ত বয়ে চলা নদী। যার ঘাটে বসলে প্রশান্তিতে প্রাণ জুড়িয়ে যায় আর এই নদীর পানি ভারি মিষ্টি!”

আমি খিলখিল করে হেসে সরে গেলাম। বললাম, “কবি কবি ভাব ছাড়ো, খেতে এসো।”

“তুমি বানিয়েছ নাস্তা? আহ কতদিন পর তোমার রান্না খাব!”

.
দুপুর পর্যন্ত কাজ করলাম। এমন ছিমছাম সংসার আমার পছন্দ। বিরাট বাড়ি, অনেক কাজের লোক অসহ্য লাগে। এমন যদি হতো, এখানেই থাকতাম, শ্বাশুরবাড়িতে আর যেতে হতো না, তবে বেশ হতো!

কিন্তু সব তো এখন অগোছালো হয়ে আছে। আমি এখানে থাকলে খুশবুর কী হবে? আবার আমার পড়াশোনা, স্কুল সব ওখানে পড়ে আছে। পাহাড়ী এলাকার সুবাস উপভোগ করার মতো সুযোগ যে নেই! আবার সেও চাকরি ছেড়ে এখন ঢাকা যেতে পারবে না। এসব গুছিয়ে উঠতে অনেক বেগ পেতে হবে।

দুপুরে খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। সে দেরিতে উঠেছে বলে ঘুমালো না। আমার পাশে বসে মাথায় বিলি কেটে দিতে লাগলো। বললাম, “একটা কবিতা শোনাও।”

সে একটু ভেবে বলল, “আসে না কবিতা।”

“তাহলে গান শোনাও।”

সে কী একটা মৃদু লয়ের পুরানো ইংরেজী গান ধরলো, আমার ঘুম পেয়ে গেল।

উঠলাম তার ডাক শুনেই। আমায় জাগিয়ে দিয়ে বলল, “জলদি ওঠো, ঘুরতে যাব।”

সেই শাড়িটা পরে আছি তখনও। সে চোখে কাজল পরিয়ে দিল। আর একটা ছোট্ট ঝুমকা। হাত ধরে নিয়ে পাহাড়ের ঢালে। চারপাশে বিস্তৃত সবুজ আর আকাশটা আশ্চর্য নীল! পথের পাশে বুনোফুলের মাতার করা ঘ্রাণ! দূরে বন বনানীর নিবিড় ছায়া! মনে হলো যেন কল্পলোকের পথ ধরে এগিয়ে চলেছি, গন্তব্য অজানা।

সন্ধ্যার আগে আগে চাকমাদের গ্রামে গেলাম। সেখানে তার খুব খাতির। মাঝবয়সী কিছু মহিলা আমাদের অভ্যর্থনা করল সাদরে। আমার গালে মাথায় হাত বুলিয়ে কী কী যেন বলল তাদের ভাষায়, বুঝলাম না। কয়েকটা সুন্দরী তরুণী চমৎকার বাংলা বলতে পারে। তারা বাংলায় পড়াশুনা করে। আমাদের বুঝিয়ে দিল কী কী হচ্ছে।

তাদের ওখানে উৎসব চলছে। চৈত্রসংক্রান্তিতে চাকমারা বিজু উৎসব পালন করে। আজ তাদের প্রথম দিন। ঘরবাড়ি একেবারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চারদিকে ফুল, কাগজ দিয়ে সাজানো। খাবারের গন্ধে ম ম করছে। আমাদের নাম না জানা কিছু খাবার খেতে দিল।

পরদিন পহেলা বৈশাখে মূল উৎসব হবে। নাচগান আর অনেক খাওয়াদাওয়া হবে। আমাদের দাওয়াত দিল তারা। আমরা কথা দিলাম, যাব।

ওখান থেকে ফিরে একটা টং দোকানে বসে চা খেলাম। তাকে এভাবে অতি সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যেতে দেখে খুব ভালো লাগলো। আমি তার ডানহাত জড়িয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, “তোমাকে আমি কখনো ভালোমতো বুঝতে পারি না।”

সে কেমন ধীর গলায় জবাব দিল, “আমি নিজেও বুঝি না।”

“আমরা কি আবার আগের মতো থাকতে পারব?”

সে একটু চুপ থেকে বলল, “তোমাকে কিছু বলব ভাবছি।”

“বলে ফেলো।”

“তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, তবুও বলি, তোমার সাথে আমি যা যা করেছি সেসব ইচ্ছে করে কষ্ট দেয়ার জন্য করিনি।”

“আমি বিশ্বাস করেছি। এই টপিকে আর কথা না প্লিজ।”

“ঠিক আছে।”

সন্ধ্যার দিকে ফিরে এলাম কোয়ার্টারে। তারপর….তারপর টিভি দেখা হলো, ছাদে গিয়ে তারা দেখা হলো, অনেক নতুন স্বপ্ন দেখা হলো। তাকে আমি এখন নতুন করে চেনার চেষ্টা করছি। আর যতই সময় যাচ্ছে, আমার নিজের সিদ্ধান্তের ওপর ভরসা বাড়ছে। অনেক কিছুরই এখনো শেষ পর্যন্ত যেতে বাকি।

যদিও তাকে কিছু বুঝতে দিলাম না। এই আমিটা যে আগের মতো নই, সবকিছু অন্ধের মতো আঁকড়ে ধরি না সেটা সে বুঝল কী না বলতে পারব না।

তবে সময় ভীষণ ভালো কাটলো। অনেকদিক পর একে অপরকে পেয়ে কাছছাড়াই করতে চাইলাম না। কথা, গল্পেরা শেষ হয়েও হয় না। রাতেও ঘুম আসে না। ইচ্ছে হয় চেয়ে থাকি তার দিকে।

পরদিন সন্ধ্যায় আমরা আবার চাকমাদের গ্রামে গেলাম। আজ মেতে উঠেছে পুরো জায়গা। ছেলে বৃদ্ধ সবাই নেশায় মত্ত। চাকমা মেয়েরা মাথায় ফুল গুঁজে শাড়ি পরে ছুটোছুটি করছে। মেলা মতো বসেছে। খাবার দাবার, বিভিন্ন খেলা কতো কী!

একটু পর নাচ শুরু হলো। আগুনের কুন্ডলী ঘিরে দুলে দুলে নাচ। অদ্ভূত এক সঙ্গীত। মনে হলো পাহাড়ি পরিবেশের সাথে মিলে সঙ্গীতের ধ্বনি এক হয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে।

উৎসবে সবাই দেদারসে মদ খেতে পারে। আমাদেরও পরিবেশন করা হলো! আমি তাকে কড়া গলায় বলে দিলাম খাওয়া চলবে না।

উপরের গাঢ় নীল আকাশ, আগুনের উত্তাপ আর তার আলোতে আদিবাসী নৃত্য ভারি ভালো লাগলো। স্বপ্নের মতো রঙ ছিটিয়ে গেল চারপাশে। সে আমার হাত নিজের হাতে নিয়ে রেখে বলল, “মাতাল হতে সবসময় মদ খাওয়া জরুরি নয়, উষ্ণ স্পর্শেও সেটা খুব হওয়া যায়!”

আজ আবার জোরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। রাতে বৃষ্টি হতে পারে। ফেরার সময় আঁধার পথে তার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখ বুজে প্রার্থনা করলাম, এই অপরূপ সুন্দর প্রকৃতির মতো তুমি আমাদের জীবনটাও মাধুর্যে ভরে দিও। আমি শুধু এই হাতটি ধরে পৃথিবীর বাকি আয়ুটুকু নিশ্চিন্তে পার করতে চাই। কষ্ট দিও, তবুও বিচ্ছেদের যাতনা দিও না প্রভু!”

২৪.
মানুষের জীবনটা একটা আশ্চর্যবোধক চিহ্নের মতো। পদে পদে চমকে উঠতে হয়, ভয় পেতে হয়, অবাক হয়ে বসে থাকতে হয় আর ভাবতে হয় এ কী হলো! আশ্চর্যবোধক চিহ্নের লম্বা লাইনটা কষ্টে ভরা। আর নিচের ছোট্ট বিন্দুটা সুখ। অল্প সুখ আর অধিক কষ্ট!

এইযে যেমন আমি এখন বাড়ি যাচ্ছি, গাড়ি করে ছুটে চলেছি ঢাকার পথে, এই যাওয়াটা ঠিক কষ্টের নয়, ভয়াবহ এক আতঙ্কের। আপা যখন হঠাৎ ফোন করে বলল, “মা অনেক অসু্স্থ হয়ে গেছে, হাসপাতালে ভর্তি করেছে।”
আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো উড়ে চলে যাই, মা’কে এখুনি জাদু করে ঠিক করে দেই। আমি ছুটে চলে এসেছিলাম আপার বাড়িতে। কিন্তু রওনা হওয়ার পর মাঝপথে যখন খবর পেলাম, মা আর বেঁচে নেই, তখন আর কষ্ট লাগলো না। পুরো পৃথিবীর বিশাল ধাক্কায় আমার নিজেকে পাথর মনে হলো। এইযে বিশমনী হয়ে ওঠা ভারী শরীর আর ভারী মন নিয়ে আমি ঢাকা ফিরছি, কেমন করে নিজেও জানি না। আমার মা মারা গেছে, আমি কেন জীবন নিয়ে, জীবনের সুখ-দুঃখ নিয়ে ভাবছি তাও জানি না। শুধু মনে হচ্ছে পৃথিবীটা গোলমেলে হয়ে গেছে। আর কিছু কোনোদিন স্বাভাবিক হবে না। আমার অনন্ত যাত্রাও কোনোদিন ফুরাবে না। আমি কি মারা যাচ্ছি?

মারাই গেছিলাম হয়তো, আপার ডাকে উঠলাম। আপা আমার পাশেই বসা। সেই কখন থেকে একটানা কেঁদে যাচ্ছে! আমার জামা ধরে টানতে টানতে বলল, “তুই কাঁদিস না কেন, তোর কষ্ট হয় না?”

আমি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। কষ্ট কী জিনিস জানা নেই। তবে বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। নেভানোর ব্যবস্থা নেই।

বাড়ি ঢুকে দেখি লোকে ভর্তি। মা তার ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে। চোখদুটো বন্ধ। শরীর স্থির। এত স্থির মাকে কখনো দেখিনি। কাজ ছাড়া একদন্ড বসতো না সহজে। ঘুমের মাঝেও নড়াচড়া করতো অনবরত। আমাকে আপা টেনে মায়ের কাছে বসালো। ঝিনুও বসে আছে। চিৎকার করে কাঁদছে ও। আছড়ে পড়ছে বড় ভাইয়ার বুকে। আমি তাকিয়ে দেখলাম সবাই কাঁদছে। বাবা চেয়ারে বসে চোখ মুছছে। তার চোখদুটো গর্তে ঢুকে গেছে। দেখাই যাচ্ছে না! ছোট ভাইয়া ঘরের এক কোণে বসে আছে হাঁটুতে মুখ গুঁজে। সে কখন এলো কুমিল্লা থেকে? খুশবু ছোট ভাবীর কোলে বসে মুখ কুঁচকে কাঁদছে। আমি তাকাতেই কান্নার ভলিউম বাড়িয়ে দিল। তবে ছুটে এল না আমার কাছে।

আমি মায়ের হাতটা ধরলাম। ঠান্ডা হাতের স্পর্শে বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার শরীরে। শরীর ভেতর থেকে কেঁপে উঠল। আমি জ্ঞান হারালাম।

জ্ঞান ফিরল ঠিক দুদিন পর। ততক্ষণে মায়ের কবর দেয়া হয়ে গেছে৷ আত্মীয়রাও বেশিরভাগ বিদায় নিয়েছে। মনে হলো ভালোই হয়েছে। মায়ের মৃত মুখটা আমার সহ্য হচ্ছিলো না।

আমার কানে শুধু মায়ের একটা কথা বাজছিলো, “আমার ফুটফুটে মেয়েটা চোখের সামনে এমন হয়ে গেলে আমি সময়ের আগে মরে যাব!”

আমায় সুখী দেখতে না পারার আফসোস নিয়েই মা মরে গেল!

অনেকগুলো ভাইবোন থাকায় ছোটবেলা থেকে মাকে আলাদা করে তেমন পাইনি আমি। ভাইবোনের কাছে থেকেই বড় হয়েছি। মা সংসার সামলেছে। তবে বিয়ের পর যখন এবাড়িতে এলাম, বিশেষ করে আত্মহত্যা করতে যাওয়ার পর থেকে মা আমাকে অনেক সময় দিতো। ভালো রাখার চেষ্টা করতো। মায়ের সাথে অনেক ফ্রী হয়ে গেছিলাম। মা তার নিজের সুখ-দুঃখের কথা, যেগুলো কাউকে বলতো না, সেগুলো আমাকে বলে দিতো। সব নারীর জীবনেই এমন কিছু সময় থাকে যখন তাকে অনেক ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। ত্যাগ করতে হয় বহু কিছু। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেসব অজানাই থেকে যায়। মা আমাকে শেষ সময়ে তার জীবনের গল্পগুলো বলতো। আচ্ছা মা কি জানে, আমি তাকে কতো ভালোবাসি? মা কি জানে, আমি তাকে মানুষ হিসেবে কতটা শ্রদ্ধা করি?

দীর্ঘশ্বাসের সাথে প্রশ্নেরা মিশে যায়। উত্তর দেয়ার মানুষটি মাটির সাড়ে তিন হাত নিচে শুয়ে আছে। হুট করে ঘুম থেকে উঠে যখন মনে পড়ে মা নেই, তখন বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। সারাটা দিন শরীর কাঁপে।

বাড়ির পরিবেশ রাতারাতি বদলে গেল। আপা চলে গেল, ছোট ভাইয়া চলে গেল, তবে ছোট ভাবীকে রেখে গেল আমাদের কাছে কিছুদিনের জন্য।

এই ছোট ভাবীই একমাত্র মানুষ যাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে অল্পস্বল্প কথা হতো। তার বেশি কথা বলা আর কথা লাগানো স্বভাবের জন্য কেউই তেমন পছন্দ করতো না। ছোট ভাইয়ার কুমিল্লা ট্রান্সফার হওয়ার পর ঝিনু তো বলেই বসেছিল, “আপদ বিদায় হলো!”

সেই ছোট ভাবী কেমন আপন হয়ে গেল সবার। মায়ের কাজগুলো নিজের কাঁধে নিয়ে নিল। তার ছেলেমেয়ে নেই। খুশবুকে নিজের মেয়ের মতো আদর করে। তার যত্ন নেয়। আমি কেমন যেন হয়ে গেছি। ঠিকমতো কিছু করতে পারি না, আনমনা হয়ে থাকি। বুঝতে পারি সব, তবে নড়তে ইচ্ছে করে না।

ছোট ভাবী বাবাকে, ঝিনুকে, আমাকে সামলে রেখেছে দু’হাতে। তবে সেও তো বেশিদিন থাকবে না। তখন কী হবে? ভাবলে আমার মাথাটা ঘুরে ওঠে।

.
মায়ের খবর শুনে সে এসেছিল বাড়িতে। দাফন কাফনের সময় ছিল। বাবার সাথে টুকটাক কথা হয়েছে। বাবার মনটা অস্থির হয়ে আছে, তাকে সেদিন তাই দু’চার কথা শুনিয়ে দিয়েছে। সে আর আসেনি এবাড়িতে, চট্টগ্রাম চলে গেছে। তবে কথা হয় নিয়মিত। একদিন ছোট ভাবী তার কথা জিজ্ঞেস করল। আমি সব বলে দিলাম৷ ভাবী বলল, “মিটমাট হয়ে গেলে তো তোমার শ্বশুরবাড়িতেই চলে যাওয়ার কথা। এখানে পড়ে থাকবে কেমন করে স্বামী ছেড়ে? আবার তুমি না থাকলেও হবে না। ঝিনু একা মেয়ে বাড়িতে, এদিকটা সামলাবে কে?”

আমি বললাম, “এখনই যাব না। দেখি কী হয়৷ ব্যবস্থা তো করতে হবে।”

ভাবী বলল, “বড় ভাইয়াকে বিয়ে করাতে পারলে একমাত্র ব্যবস্থা হবে। খুশবু মা পাবে, সংসারটা সামলে উঠবে।”

আমি আঁতকে উঠে বললাম, “ওই কথা বড় ভাইয়ার সমানে বলো না, তোমার ছিঁড়ে ফেলবে।”

“আরে তখন এক পরিস্থিতি ছিল, এখন অন্য। বুঝিয়ে বললে বুঝবে। আমি কথা বলব।”

বললাম, “তুমিই বলো, আমি এর মধ্যে নেই।”

সত্যি দেখা গেল ভাবী কী বলেছে, ভাইয়া হালকা রাজি হয়েছে। মূলত আমি চলে গেলে খুশবুটা মায়ের আদর ছাড়া বড় হবে, তাই জন্যই হয়তো রাজি হয়েছে। ভাইয়াও কেমন কেমন হয়ে গেছে। হাসে না, কথা বলে না। শুধু খুশবুর সাথে একটু খেলে।

ভাবী তখন জোরেশোরে বউ খোঁজা শুরু করল। আত্মীয়স্বজনকে জানালো, ঘটকের সাথে কয়েক দফা কথাবার্তা বলল, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দিয়ে দিল। তবে যোগ্য পাত্রী পাওয়া গেল না।

এমন বিরুপ পরিস্থিতির মধ্যে আমার মাস্টার্স পরীক্ষার ডেট দিয়ে দিল। ভাবীও এর মধ্যে চলে গেল। ছোট ভাইয়া ওদিকে একা থাকছে বলে। আমায় সংসার সামলে কলেজে যেতে হয়। আমি স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। কাজকর্ম করে খুশবুকে রেখে যতটা পারি, পড়ি। সময়ের অভাবে ঘুম হয় না, তার সাথে কথাও হয় না। সে বুঝতে পারে আমার ব্যস্ততা। তাই ফোন করলেও কথা বাড়ায় না। সবসময় সাহস দেয়।

বাবা রিটায়ার করার পর থেকে নিয়ম করে রোজ সকালে হাঁটা শুরু করেছিল। মা মারা যাওয়ার পর সেটা বন্ধ করে দিল। বুঝিয়ে কাজ হলো না। সারাদিনই প্রায় ঘরবন্দি থাকতে শুরু করল।

আমি ভোরবেলা উঠে পড়ি। খুশবু তখনো ঘুমিয়ে থাকে। এক সকালে আমি উঠে খুশবুকেও উঠিয়ে দিলাম। ও উঠে ওর অভ্যাসমতো আমায় জ্বালাতন করতে থাকলো। আমি বাবাকে গিয়ে বললাম, “ওকে নিয়ে একটু বের হও, হেঁটে আসো। নয়তো আমি পড়তেও পারব না, নাস্তাও বানাতে পারব না।”

বাবা খুশবুকে নিয়ে হাঁটতে চলে গেলেন। আর এটা হয়ে উঠল প্রতিদিনের রুটিন। বাবা দেখা গেল আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। বাইরে যায়, লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলে, তার সময় কেটে যায়। খুশবু সারাদিন আমাকে তেমন পায় না। বিকেলে আমি ওকে নিয়ে বাগানে বসি। ওর চুল বেঁধে দেই, গল্প শোনাই, ওর গল্প শুনি। ও তখন সারাদিনের কথাগুলো হাত নেড়ে নেড়ে বলে। কী যে ভালো লাগে তখন!

আমি ক’দিনের অভিজ্ঞতা থেকে দুটো বিষয় শিখলাম-

এক.একটা সংসার মায়ের ওপরই টিকে থাকে। মেয়ে থেকে মা হয়ে ওঠাটা খুব সহজ নয়। অনেক কিছু স্যাক্রিফাইজ করতে হয়, নিজেকে ভেঙে অন্য ছাঁচে গড়ে নিতে হয়।

দুই.একটা বাচ্চা একটা ভেঙে পড়া পরিবারকে সামলে নিতে পারে। তার মমতার বাঁধন অনেক জোরালো।

আমার পরীক্ষা খারাপ হলো না। ভালোই হলো। শেষ পরীক্ষা দিয়ে নিজেকে হাত পা ছাড়া মুক্ত পাখির মতো মনে হতে লাগলো। কিন্তু তারপরেই লক্ষ্য করলাম ওই জীবনটায় অভ্যাস হয়ে গেছিলো। পড়ার জন্য বরাদ্দ সময়টুকুতে টেবিলে না বসলে ভালো লাগে না। রাতে ঘুম আসতে চায় না৷ ভেবেছিলাম পরীক্ষা শেষে খুব ঘুমাব৷ তা আর হলো কই।

খুশবু ঘুমিয়ে যাওয়ার পর অনেকদিন পর কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসলাম। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, আগের চেয়ে আমি ভালো লিখতে পারছি। অভিজ্ঞতার সাথে জীবনবোধের সংমিশ্রণে চমৎকার একটা গল্প লিখে ফেললান। গল্পের নাম দিলাম ‘খুশবু’। যদিও সেটা ভেতরের কথার সাথে মেলে না, তবুও দিলাম। লেখাটা পরদিন পাঠিয়েও দিলাম এক প্রকাশকের কাছে।

আগের লেখাগুলোর কোনোটাতে আমি নিজের নাম দেইনি। ছদ্মনামে লিখেছি। নামগুলো মৃন্ময় স্যার ঠিক করে দিতেন। এবার নিজের নাম দিয়ে দিয়েছিলাম ভুলে। প্রকাশক আমায় ফোন করে বললেন, “এবার আপনার নামেই গল্প প্রকাশ হবে?”

আমি জিভ কেটে বললাম, “না। অন্য নাম দিন।”

“কী দেব?”

আমি কিছু ভেবে পেলাম না। বললাম, “আপনার যা ইচ্ছে হয় দিন। নয়তো আগের নাম থেকেই একটা দিয়ে দিন।”

কিছুদিন পর প্রকাশক ফোন করে জানালেন, আমার গল্প একটা গল্প সংকলনে ছাপা হচ্ছে। প্রথম ও শেষে সবচেয়ে ভালো গল্পগুলো দেয়া হয়। সবার শেষে স্থান পেয়েছে আমার গল্পটা। তাই প্রকাশক বুদ্ধি করে আমার নাম দিয়ে দিয়েছে ‘সমাপ্তি’।
আমি শুনে বললাম, “বেশ তো নামটা! এখন থেকে এই নামেই আমি লিখব।”
(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে