#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব – ২০
“তোমার প্রেগনেন্সির সময়টা আমাদের সবচেয়ে সুন্দর সময় ছিল। ওই দিনগুলোতে আমরা ভালো ছিলাম তাই না?”
আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম, “হুম।”
“তুমি জানো, আমি তখন তোমার সাথে হওয়া অন্যায়গুলো পুষিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। ব্যস্ততার মধ্যেও কষ্ট করে সময় বার করতাম তোমাকে দেয়ার জন্য যাতে তুমি ভালো থাকো। মা’ও কেমন তোমায় আপন করে নিয়েছিল। বেশ তো ছিলাম! তারপর…
সেই দিনটার কথা কী করে ভুলব! সেদিন আমার মিটিং ছিল। বারোটার পর আমি তোমার মেসেজ দেখেছি৷ ভাবীর খবর শুনে আমি তখনই অফিস থেকে বের হয়ে যাই। কিন্তু এক্সিডেন্টের জন্য সেদিন পুরো রাস্তা জ্যাম হয়ে ছিল। আমি যখন পৌঁছেছি, তখন অলরেডি অঘটন ঘটে গিয়েছিল!’
সে উঠে পকেটে হাতদুটো ঢুকিয়ে ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করতে শুরু করল। একসময় আবার বলতে লাগলো-
“তুমি তখন অপারেশন থিয়েটারে। ডাক্তার এসে বলল আমাদের বাচ্চাটা মারা গেছে…
আমার তখন কেমন লেগেছে বলতে পারব না। এটা কি ভাষায় প্রকাশ করার মতো কোনো ব্যথা? মায়ের অনবরত ফোন আসছিলো। তাকে সত্যিটা বলে কেঁদে ফেলেছিলাম আমি। আর তার কিছুক্ষণ পরই অনুভবের ফোন আসে। সে জানায়, মা স্ট্রোক করেছে। আবার অন্য হাসপাতালে ছুটে গেলাম। মায়ের অবস্থা সত্যি খুব খারাপ ছিল। দু’দিন সেন্স ছিল না। অনেক কিছু ভুলে গিয়েছিল। অস্বাভাবিক আচরন করতো, আর শুধু আমাকে খুঁজতো।
সে সময় তোমার ওপর সবচেয়ে বেশি রাগ হয়েছিল। এত ঝামেলার মধ্যেও যখন একটু সময়ের জন্যও একা হতাম, ভাবার সময় পেতাম, মনে হতো তুমি সবকিছুর জন্য দায়ী। আজ আমার বাচ্চা মারা গেছে, মাও যদি মারা যায়, সেটা হবে শুধু তোমার জন্য।
তারপর একসময় বুঝলাম, তোমার তো দোষ নেই, ইচ্ছে করে কেউ কি সন্তান হারা হয়? তোমারও এখন আমাকে প্রয়োজন। তোমার হয়তো মনে হয়েছে কেন তোমাকে দেখতে যাইনি আমি। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। শহরের এমাথা থেকে ওমাথা প্রতিদিন ছুটে যাওয়া সম্ভব ছিল না। মায়ের আমাকে ছাড়া চলছিলো না তাই তোমাকে নিয়মিত দেখতে যেতে পারিনি।
তোমাকে যেদিন রিলিজ দিলো, তার পরদিন মাও একটু সুস্থ হলো, বাড়ি নিয়ে গেলাম। তার জ্ঞান ভালোভাবে ফিরেছে। মা প্রথমেই বলে দিল তোমাকে যেন ওবাড়িতে আর না নেয়া হয়। মায়ের ওপর তখন প্রেশার দেয়া নিষেধ। ভয়ও হচ্ছিলো খুব, তাই তাকে কথা দিয়েছিলাম তোমাকে সে সময় ওই বাড়িতে নিয়ে যাব না। পরে ধীরেসুস্থে মাকে বুঝিয়ে তারপর নেব।
তোমার সাথে খুশবুর আকীকার দিন দেখা করার সময় এগুলোই বলেছিলাম। সাথে হয়তো খারাপ ব্যবহারও করেছি কিছু। সত্যি বলতে আমার মাথার ঠিক ছিল না। কী বলেছি, কী করেছি নিজেও জানি না।”
“এই পর্যন্ত আমি মানতে পারি। কিন্তু এরপর তোমার অবহেলার কোনো কারন তুমি দেখাতে পারবে না। নিছকই ছেলেখেলা করে গেছ আমার সাথে।”
“শোনো আগে…”
“বলতে থাকো!”
“মায়ের স্ট্রোকের পর অনুভব অফিসের অনেক কাজ বুঝে নিতে থাকে। আমিই ওকে জোর করে বিজনেসে ঢুকিয়ে দেই, যাতে আমার ওপর চাপ কমে যায়। আমি মা’কে সময় দিতে থাকি। মায়ের সাথে সমঝোতা করে নেয়ার চেষ্টা করতে থাকি। এ সময়টাতে আমার সামনে মায়ের সাইকোলজিটা পরিষ্কার হয়। মা তোমাকে কেন পছন্দ করেন না সেই ব্যাপারগুলো আমি ধরে ফেলি।
প্রথমত, তুমি অনেক বড়লোক পরিবারের নও, যার কথা তার বন্ধুমহলে বড় গলায় বলা যাবে। দ্বিতীয়ত, তথাকথিত রূপসী নও, আর ঘষামাজা করে সুন্দরী হওয়ার প্রবণতাও তোমার নেই। মায়ের মতে তুমি আনকালচার, যুগের তুলনায় নিতান্তই বেমানান। তৃতীয়ত, তুমি পড়াশোনায় পিছিয়ে এবং তোমার তেমন কোনো গুন নেই যেটা তোমাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে তুলবে। আর তাছাড়া আরেকটা কারন যেটার কোনো ভিত্তিই নেই!
“কোনটা?”
“মায়ের বদ্ধমূল ধারনা হয়ে যায় তুমি আমাকে তার কাছ থেকে আলাদা করে দিচ্ছ। আমার তাকে না জানিয়ে বিয়ে করা, তোমাকে নিয়ে সিলেট যাওয়া এসবে সে আমার দোষ একটুও না দেখে পুরোপুরি তোমাকে দোষারোপ করে গেছে একাধারে। আমি যতই বোঝানোর চেষ্টা করেছি, বোঝেনি, উল্টো আরও বিগড়ে গেছে। তাছাড়া আমি ছোটখাটো বিষয়ে যখনই তোমার সাপোর্ট করতাম, মা তখনই মনে করতেন তার ছেলে পর হয়ে যাচ্ছে। আর সে এটা হতে দিতো না। তাই একের পর এক ঝামেলা করে গেছে। অবশ্য আমাদের সন্তানকে নিয়ে তার স্বপ্নগুলো মিথ্যে ছিল না, তবে ও মারা যাওয়ার পর মা তোমার প্রতি আরও অনেক এগ্রেসিভ হয়ে যায়। তোমাকে তোমার বাড়িতে রেখে দেয়ার জন্য সে যে কী পরিমানে খুশি হয়েছিল, তা যদি দেখতে!
আমি তখন উভয় সংকটে পড়ে গিয়েছিলাম। কী করব? মাকে দেখব নাকি তোমাকে? আমি তোমায় নিয়ে অন্য কোথাও সংসার করতে পারতাম, কিন্তু বিশ্বাস করো, তাতে আমার মা মরে যেতো। সে যত খারাপই হোক, মা তো আমার!
আমি ভাবতে লাগলাম কী করা যায়। তোমার সাথেও দেখা করতে যেতাম দুই একবার। কিন্তু তোমাকে মায়ের ব্যাপারটা বলতে পারতাম না তুমি কষ্ট পাবে ভেবে। তোমার কাছাকাছি গেলে পরে বাড়ি ফেরার পর যে শূন্যতা ঘিরে ধরতো, একাকিত্ব চেপে বসতো, সেজন্য তোমার কাছে যাওয়া কমিয়ে দিতে থাকলাম।
কিন্তু এর মধ্যে তুমি সুইসাইড করতে গেলে…
জানো, তোমার মা যখন ফোন করে বলল, আমার কয়েক মুহূর্তের জন্য দমবন্ধ হয়ে গেছিল। আমি অন্ধের মতো আল্লাহর কাছে তোমার জন্য প্রার্থনা করতে করতে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলাম।”
“তুমি আমাকে দেখতে গিয়েছিলে কবে? মিথ্যে কথা বলছ আবার?”
“সেদিনের ঘটনা সম্ভবত তোমার কাছে লুকানো হয়েছে।”
“কোন ঘটনা?”
“আমি যাওয়ার পর তোমার বাবা, ভাইরা আমাকে অনেক কথা শুনিয়েছিলো, অপমানও করেছিল। থাকতে দিতে চায়নি। আমি জোর করে ছিলাম। এর মধ্যে আমার মা সেখানে যায়। তারপরই তোমার বাবা ভাইদের সাথে আমার মায়ের প্রচুর কথা কাটাকাটি হয়। একসময় আমি বাধ্য হই মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে। তোমার ভাইরা বলেছিল আর যদি হাসপাতালে যাই আমার নামে কেস করবে তারা। আমার অত্যাচারে তুমি মরতে গিয়েছিলে সেজন্য পুলিশে দেবে। আমি শুধু তাদের রিকোয়েস্ট করেছিলাম এই ঘটনা যেন তোমাকে জানানো না হয়। তাতে ওই সময় আরো ভেঙে পড়তে তুমি।
ঝিনু সব দেখেছিল। আমি যখন মাকে বাড়িতে রেখে আবার হাসপাতালে গিয়েছিলাম, তখন ওই একমাত্র আমাকে সাপোর্ট করেছিল। বাড়ির সবার থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে বলেছিল সে সব খবর দেবে। আমি যেন সামনে না যাই। ও তোমার ছবি তুলে এনে দেখায় আমাকে। তোমার জ্ঞান ফিরলে, তুমি সুস্থ হলে তারপর আমি বাড়ি ফিরেছিলাম।
তবু তোমাকে নিয়ে যখন নিশ্চিত হতে পারছিলাম না, তখন শেফালী আপাকে পাঠিয়েছিলাম তোমার দেখাশুনার জন্য।”
তার প্রতিটা কথায় আমার মাথায় একেকটা বজ্রপাত হচ্ছিলো! আমার অগোচরে এতকিছু! এজন্যই ঝিনু তার হয়ে কথা বলে সবসময়। ও জানতো সব! কিন্তু শেফালী আপার কথাটা হজম করতে আমার কষ্টই হলো। চেঁচিয়ে উঠে বললাম, “শেফালী আপা তোমার কথায় গেছিলো মানে? সে তো আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড ছিল।”
“হ্যাঁ, সেটাও আমিই বলেছিলাম বলে। আমার মনে হয়েছিল তোমাকে সাহস জোগানোর জন্য একটা মানুষ প্রয়োজন। তাই শেফালী আপাকে তোমার ফেসবুকে এড করে দিয়েছিলাম। আপাকে আমি অনেক আগে থেকে চিনি। উনি এমনিতেও দুঃস্থ, অসহায় মেয়েদের নিয়ে কাজ করেন৷ তাছাড়া তোমাকে দেখার পর উনি বলেছিল তুমি দেখতে তার মৃত ছোট বোনের মতো। তোমার জন্য যা করতে হয়, উনি সব করবেন। আর মিতা আমার ইউনিভার্সিটির পরিচিত সিনিয়র। আমাকে খুব পছন্দ করেন। তোমার কথা শুনে উনি তখনই রাজি হয়ে যান তোমার কাছে যেতে।
আমি শেফালী আপাকে বলেছিলাম তোমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যেতে। কারন তোমার বাপের বাড়িতে গেলে তুমি আবার সুইসাইড করতে যাবে না তার কী নিশ্চতা ছিল? আমি তোমাকে চোখে চোখে রাখতে চেয়েছিলাম। শেফালী আপার বাড়িতে তুমি যে ঘরটায় থাকতে সেটাতে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো ছিল। আমি সবসময় তোমাকে নজরে রাখতাম। তাছাড়া যেদিন যেদিন তোমরা ঘুরতে বের হয়েছিলে, আমি আশেপাশেই থাকতাম, তোমাকে একটু দেখার জন্য।
যখন মনে হলো আর ভয় নেই, তখন আপাকে বললাম তুমি বাড়ি যেতে চাইলে যেতে দিতে।”
সে থামলো। আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। মাথার ভেতর সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ঘটনাগুলো জট পাকিয়ে গেছে একটা আরেকটার সাথে। খুলতে গিয়ে মাথায় প্রচুর যন্ত্রণা দিচ্ছে!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “শেফালী আপাই কিন্তু আমাকে সাপোর্ট করেছিল তোমাকে ডিভোর্স দেয়ার কথা বলার সময়।”
“হ্যাঁ, কথা ছিল উনি তোমার সব ডিসিশনে তোমাকে সাহস দেবে। তুমি নিজে এই স্টেপটা নিতে পেরেছিলে সেটা প্রমান করেছিল তুমি মেন্টালি স্ট্রং হতে শুরু করেছ। আমি সেটাই চাচ্ছিলাম। তবে তাই বলে কি সত্যি সত্যি ডিভোর্স দিয়ে দেব নাকি!”
“ফাইন! কিন্তু তারপর আমাকে সব খুলে বললা না কেন? সেদিন তোমার অফিসে তো তোমার মা ছিলেন না। তখন বলে দিলে আমার এত কষ্ট থাকতো? না থাকতো ভুল বোঝাবুঝি?”
“কারন আমি চেয়েছিলাম তোমার কষ্টটা থাকুক। আমি সেদিন তোমাকে সব বলে দিলে তুমি দুর্বল হয়ে যেতে। কষ্ট পেয়ে যে শক্তিটা তোমার জন্মেছিলো সেটা হারাতে। আজকের অবস্থানে তুমি আসতে পারতে না। নিজেকে খুঁজে পেতে না তুমি।”
“তাই বলে…”
“আমি বিয়ের পর থেকেই দেখেছি তুমি অন্যের ওপর বরাবরই খুব বেশি ডিপেন্ডেন্ট। বিয়ের পর পড়াশুনা পর্যন্ত ছেড়ে দিলে। আমি অনেকবার বলতে চেয়েছি তোমায় পড়তে, কিন্তু তারপর ভেবেছি তোমার ইচ্ছেতেই সব হোক। চাপিয়ে দিতে চাইনি কিছু। কিন্তু সে সময়টায় আমি বুঝেছিলাম, তোমার এই পর্যন্ত যতকিছু কষ্ট হয়েছে তার সবই তোমার এই দুর্বল মানসিকতার জন্য। কেউ অকারন কথা শুনিয়ে গেলেও একটা জবাব দিতে পারতে না। নিজের কোনোকিছু প্রয়োজন হলে মুখ ফুটে বলতে পারতে না। সহজে কারো সাথে মিশতে পারতে না।
জীবনে অনেক মানুষকে তোমার ফেস করতে হবে, যার মধ্যে খারাপ মানুষই বেশি। তারা তোমার সাথে যা খুশি করে যাবে, তুমি প্রতিবাদ করতে পারবে না যদি না তুমি সেই নির্ভরতার জীবন থেকে বের হয়ে আসতে পারো।
আমি তাই চেয়েছিলাম তুমি ইন্ডিপেন্ডেন্ট হও। সাহসী হও। আজকের তুমি যে কাউকে মোকাবিলা করতে পারবে। তিন বছর আগে হলে তুমি পারতে অচেনা কোনো চিঠিদাতার কাছে এভাবে একা চলে আসতে? পারতে না। তখন এটাও বুঝতে না যে কাজটা আমি করছি। তুমি সেদিন কলেজের বাইরে ইভটিজিং করতে থাকা এক বখাটেকে আচ্ছামতো ধোলাই দিলে, সেদিন বুঝেছি, তুমি পরীক্ষায় পাস করেছ।”
তার কথাগুলোতে আমার মনের বহুদিনের চেপে থাকা কষ্টগুলো একটু একটু করে সরে যেতে থাকলো। বুকে চাপা পাথরের ভার ধীরে ধীরে কমে গেল। মুঠো মুঠো শান্তিরা যেন হৃদয়ে ভর করতে থাকলো, তবুও বুকটা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠতে থাকলো। বার বার মনে হতে লাগলো, যা হচ্ছে সত্যি হচ্ছে? যা হয়েছে তাতে আমার ভালো ছিল? নাকি এটাও জীবনের কোনো নোংরা পরিহাস?
আমি চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ। কেন যেন কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। ক্লান্ত লাগছে। বহু পথ পাড়ি দেয়ার ক্লান্তির মতো বহু সত্য একসাথে জেনে ফেলার ক্লান্তি।
একসময় জিজ্ঞেস করলাম, ইভটিজারের ঘটনা কে বলল তোমায়?”
“আইডিয়া করো তো?”
“অর্না?”
“হুম। ওই তো আমার এজেন্ট ছিল। তোমার সাথে ওর বলা কথাগুলোর কল রেকর্ড সবগুলোই আছে। তোমার গলা শুনেই রোজ ঘুম আসে জানো?”
“আর আমি এতদিনেও বুঝলাম না এটা।”
“ওকে দিয়েই তোমার খোঁজ নিতাম। শেফালী আপাকে তো আর সবসময় বলা যায় না তাই।”
“কিন্তু আমার সাথে এত বড় গেম খেললা তোমরা? কেমনে করে পারলা?”
“এটা গেম ছিল না! তুমি বোঝার চেষ্টা করো, যা করেছি, তোমার ভালোর জন্য।”
“তো এখন কি তোমার মা আমাকে মেনে নেবে?”
“সে ব্যবস্থা করে রেখেছি। দেখতেই পাবে কী করি। আমি ছুটি ম্যানেজ করে ঢাকা গিয়েই এবার সব ঠিকঠাক করে ফেলব।”
“আচ্ছা তুমি এখানে কেন?”
“বলব। আগে চলো খাবে। দুপুর গড়িয়ে গেল যে! সুবোধ কতবার তাড়া দিয়ে গেল। আমারও ক্ষুধা লেগেছে। তুমি আসছ সেই খুশিতে সকাল থেকে না খেয়ে আছি।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ২১
খেতে খেতে বললাম, “মাংসটা ভালো হয়েছে।”
“হুম। সুবোধ খুব ভালো রাঁধে। ওর জন্যই এখানে থাকতে কষ্ট হয় না।”
খাওয়া শেষে ঘরদোর ঘুরে দেখলাম। দুটো বেডরুম, ডাইনিং, ড্রইং। ঘরগুলো বড় আর জানালাগুলোও বড় বড়। ছাদ অনেক উঁচুতে। বাড়ির পেছনের দিকে পেঁচিয়ে উঠে গেছে ছাদে ওঠার সিঁড়ি।
“ছাদ আছে নাকি ওপরে?”
“হ্যাঁ। খুব সুন্দর। সুবোধ কয়েকটা ফুল, সবজির গাছ লাগিয়েছে। ছাদ থেকে পাহাড় দেখা যায়। রোদ কমলে যেও।”
আমি হেঁটে ওর ঘরে গিয়ে বসলাম। খাটের পাশে সাইড টেবিলে ছোট্ট ফ্রেমে আমার আর ওর ছবি বাঁধানো। ও আমার কাঁধ জড়িয়ে রেখেছে। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছি। মিষ্টি ছবিটা!
ও এসে আমার পাশে বসল। বলতে থাকলো, “ঢাকায় আমি টিকতে পারছিলাম না। মা একপ্রকার অত্যাচার করছিলো আমার ওপর। তোমায় ডিভোর্স দেয়ার জন্য। আমার মেয়ে দেখাও শুরু করেছিল। রোজ রোজ এক কথা শুনতে আর ভালো লাগছিলো না। এই চাকরির জন্য অনেক আগে অ্যাপ্লাই করে রেখেছিলাম। হঠাৎ এই নভেম্বরে লেটার এলো চাকরি হয়ে গেছে। আমিও আর সুযোগ না ছেড়ে চলে এলাম।”
“মা আসতে দিলেন?”
“আটকানোর তো সব চেষ্টাই করেছিল, পারেনি।”
“এখন যদি তোমার চিন্তায় আবার অসুস্থ হয়?”
“হবে না। যথেষ্ট ভালো আছে এখন। স্ট্রোকের পর থেকে স্বাস্থ্যসচেতন হয়েছে অনেক। আর মাও এখন বুঝতে পারে, আমার ওপর চাপ যাচ্ছে, আমি মুক্তি চাচ্ছিলাম।”
“ও!”
এরপর নীরবতা। জায়গাটা আশ্চর্য রকম শান্ত। গাড়ির শব্দ নেই, মানুষের কোলাহল নেই। তবে গুমোট গরম। বাইরে একটা পাতাও নড়ছে না। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে টুনটুনি পাখি গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “আচ্ছা, এই তিন বছরে তোমার আমাকে একবারও দেখতে ইচ্ছে করেনি?”
“করেছে। যখন যখন তীব্র ইচ্ছে হতো আমি তোমার কলেজের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে তোমায় দেখে এসেছি।
হঠাৎ মনে হতে জিজ্ঞেস করলাম, “অপূর্ব সেজে চিঠি কেন দিতে? সরাসরি বলে দিতে পারতে তো।”
“এখানে ফেরার পর খুব মন চাইতো চিঠি লিখতে। তোমায় সব বলার সুযোগ পেতে হবে তো! তার আগে চিঠি দিলে তুমি পড়বে কি না তারও নিশ্চয়তা ছিল না। আবার ঝামেলাও করতে পারতে। তাই অপূর্ব হয়ে লিখতাম। অবশ্য আইডিয়াটা অন্য জায়গা থেকে এসেছে..
মনে আছে, অনেকদিন আগে কোনো এক বুড়ো লোক তোমাকে বলেছিল, প্রথম স্বামীর চরিত্র ভালো না, দ্বিতীয় স্বামী ভালো হবে?”
“হ্যাঁ, তুমি কী করে জানলে?”
“ওইটা মা করিয়েছিল। লোকটাকে টাকা দিয়ে বলেছিল তোমাকে এসব বলতে। যাতে তুমি সত্যি ভেবে অন্য একটা বিয়ে করে নাও। হা হা।”
“কী বলো এসব!”
“হুম। আমি পরো জেনে গিয়েছিলাম। মাকে কিছু বলিনি অবশ্য। বললেই আরেক কান্ড করবে! তবে এখানে এসে মনে হলো তোমার সেই জ্যেতিষীর কথামতো তোমার জীবনের দ্বিতীয় পুরুষ সেজেই দেখি কেমন লাগে!”
আমি চুপ করে রইলাম। সে হাসতে লাগলো। কেন যেন মনে হলো বহুদিন পর হাসছে। চোখের কোণে তার পানি জমে আছে। আমার বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগতো লাগলো।
ও উঠে এসে আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে চুলে হাত বুলিয়ে বলল, “তুমি আমার কাছে থাকবে তো এখন থেকে?”
আমি হাসলাম। সে বলল, “হাসছ কেন?”
“এমনি। আমার যেতে হবে। আপা না জানি কতবার ফোন করেছে!”
আমি ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করতে নিলে সে আমার হাত ধরে আটকে দিল। বলল, “বড় আপাকে আমি সব বলেছি।”
“মানে কবে?”
“এইতো এখানে আসার পরই। তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।”
“আপা কী বলেছে?”
“আপা বলেছে তোমার সাথে কথা বলতে। আর কিছু না।”
“আমাকে কিছুই বলেনি আপা।”
“আমি নিষেধ করেছিলাম।”
“কিন্তু আজ আমি এখানে এসেছি সেটা বলে আসিনি। চিন্তা করছে হয়তো।”
“আমি বলে দিয়েছি ফোন করে যে তুমি আজ এখানে থাকবে।”
“আমি এখানে কেন থাকব? আমি আপার বাসায় যাব।”
সে আমার হাতদুটো ধরে বলল, “প্লিজ থাকো। আমি তো ক্ষমা চেয়েছি বলো, তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না আর।”
আমারও মনে হলো আজ রাতটা থাকা প্রয়োজন। হিসেব এখনো পুরোপুরি মেলেনি যে! বললাম, “থাকব।”
সে ভীষণ খুশি হয়ে গেল। একেবারে বাচ্চাদের মতো। বলল, “তাহলে ছাদে চলো। আমার ছাদ থেকে সূর্যাস্তের চমৎকার ভিউ পাওয়া যায়। মনে হয় পাহাড়টা টুপ করে সূর্যটাকে গিলে নিলো!”
আমরা ছাদে গেলাম। সন্ধ্যের আগে আকাশ কত রঙেই না নিজেকে সাজায়! আজ যেমন গাঢ় নীল। মনে হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীটা নীলে চুবিয়ে দিয়েছে। দূরের পাহাড়গুলো স্থির, শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে প্রহর গুনছে রাত হওয়ার। থম ধরে আছে যেন! দূরের মেঘগুলো ধোঁয়ার মতো সরে যাচ্ছে উত্তর দিকে। দক্ষিণা বাতাসে পাতাগুলো দুলছে অল্প অল্প। পুরো পরিবেশ ঘোর লাগা। দিনের উত্তাপ শুষে নিয়ে ভূপৃষ্ঠ প্রকৃতিকে শীতল করার চেষ্টায় রত। সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসতে খুব বেশি দেরি নেই।
সে হঠাৎ আমার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল। আমি অবাক হয়ে সরে গেলাম। সে আমার হাতদুটো ধরে তার সামনে টেনে দাঁড় করালো। বলতে শুরু করল,
“অনেকগুলো দিন আগে এক বসন্তের দিনে প্রথম তোমার দেখা পাই। তোমার কাজল চোখের মায়ায় পড়ে যাই। তোমার শান্ত দৃষ্টি, সরল মন আর তীব্র ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা আমায় পাগল করে দিয়েছিল। মনে হয়েছিল তোমায় পেলে পৃথিবী পাওয়া হবে। অতঃপর আমি পৃথিবী পেলাম। বহুকষ্টে পেয়েছি এই পৃথিবীটা। তুমি কি আমার সাথে বাকি জীবনটা কাটাবে, প্লিজ?”
আমি ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রাখলাম। কি আজব ঘটনাই না ঘটে পৃথিবীতে! এই একটু ভালোবাসার জন্য কতদিন আমি কেঁদেছি। কত কত নির্ঘুম রাত পার করেছি! আর আজ সেটা আমার পায়ের কাছে এসে ধরা দিয়েছে, অথচ সব অর্থহীন মনে হচ্ছে!
আমার নিরবতা দেখে সে কী বুঝল জানি না, আমার হাতদুটোতে মাথা ঠেকিয়ে রাখলো। হাতে চুমু খেল। তারপর বসে থেকেই হুট করে আমার কোমর জড়িয়ে ধরল। আমার শরীর রীতিমতো কাঁপতে শুরু করলো। এতগুলো দিন পর এভাবে তার স্পর্শে ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগলো।
আমি তাকে কোনোমতে ছাড়িয়ে নিচে চলে গেলাম। ততক্ষণে বাইরে পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেছে।
তার ঘরেই গিয়ে বসেছিলাম আমি। সে এসে জিজ্ঞেস করল, “অমন করে চলে এলে কেন?”
আমি যথাসম্ভব শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, “তোমাকে আমারো কিছু বলার আছে।”
“হ্যাঁ বলো।”
“বসো বলছি।”
সে পাশে এসে বসলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা আমি তোমার কে হই?”
সে একটু অবাক হয়ে বলল, “বউ।”
আমি হেসে বললাম, “বউ বলতে ঠিক কী বোঝায়? দাসী বাদী? প্রাচীনকালের দাস প্রথার মতো তুমি আমায় কিনে নিয়েছ? যে যা খুশি করবে?”
“তোমাকে আমি সব খুলে বলেছি, তারপরেও এভাবে বলছ কেন?”
“তুমি কি চাও, তুমি আমাকে সারাদিন ধরে যেগুলো শোনালে সেগুলো আমি বিশ্বাস করব? সিরিয়াসলি?”
“মানে?”
“মানে কী করে বুঝবে বলো, তোমার আয়নাটা ভেঙে গেছে। সেটা জুড়ে আগে তোমাকে তোমার নিজের চেহারাটা দেখাই!”
“পাগল হয়েছ?”
আমি তার কথার পাত্তা না দিয়ে বলতে থাকলাম,
“বিয়ের পর থেকে যা যা হয়েছে তাতে না আমার দোষ ছিল, না তোমার মায়ের। পুরোটাই তোমার কথার দোষ। তুমি সহজ একটা বিষয়কে ইচ্ছে করে জটিল করে তোলো। আর এটা তোমার একটা ম্যানিয়া।
আমি গত এক বছর ধরে প্রচুর সাইকোলজিক্যাল বই পড়েছি। সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা চিন্তা করেছি তোমার সাথে ঘটে যাওয়া মুহূর্তগুলোর কথা। আস্তে আস্তে নিজেই নিজের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে নিয়েছি।
প্রথম থেকে শুরু করি, তোমার ভাষ্যমতে, তোমরা যেদিন আমাকে দেখতে এলে, সেদিন তোমার আমাকে পছন্দ হয়েছিল। তাহলে তারা যখন আমাকে অপছন্দ হয়েছে বলল তখন তুমি কোথায় ছিলে? তুমি তাদের সেকথা জোর দিয়ে জানালে তারা সহজে সম্বন্ধ করতে না করে দিতো না। তারপর তুমি আমাকে ফোন করলে। দেখাও করতে এলে। আবার সেদিনই অমন একটা প্রেমপত্র দিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে এক বছরের জন্য। সেটার কারন কী বলেছিলে, মাকে রাজি করাতে! একটা বছর!
নেক্সট, আমাদের বিয়ে ঠিক হলো। বিয়ের দিন অসুস্থ মা’কে রেখে এসে মাঝরাতে আমায় বিয়ে করলে। যেখানে তুমি ভালো করেই জানতে তোমার মা এটা জানতে পারলে কতটা কষ্ট পাবেন। তবুও করলে।
তারপর, তোমার মা বিয়ের কথা জানার পর তাকে তুমি মোটেও বোঝানোর চেষ্টা করোনি কিছু। উনি আমার বাড়ি এসে আমায় অপমান করে গেলেন, কোথায় তুমি সম্পর্কগুলো ঠিক করবে, না উল্টো আমায় নিয়ে সিলেট রওনা দিলে। তখন আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম। তুমি যা বলছিলে, যা করছিলে সবই ঠিক মনে হচ্ছিলো। সম্পর্ক ঠিক হবে কী করে?
বাড়ি নিয়ে মিথ্যেটাও ইচ্ছে করে করেছিলে, রহস্য করার জন্য। তোমার মা সত্যি অসুস্থ ছিলেন, উনাকেও তুমি কষ্ট দিয়ে গেছ।
ঢাকায় ফেরার পরের কথা! একটা ছেলে চাইলেই মা আর বউ এর মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারে। পুরোপুরি না পারুক, অন্তত চেষ্টা তো করে। তুমি করোনি। অনেক কথা শোনানোর পরেও সহজে সরি বলতে না আমায়। মায়ের সামনে এক কথা, আমার সামনে অন্য কথা বলতে। যার কারনে আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতো অনেক বেশি।
তোমার মা ভাবতেন আমি তোমাকে বশ করছি। তাই উনি আমাকে আরও অপছন্দ করতে শুরু করেন, কড়াভাবে চোখে রাখতে থাকেন।
বাবু মারা যাওয়ার ঘটনার পর তুমি পারতে আমায় একবার ওবাড়িতে নিয়ে যেতে। আমার ধারনা আমি মায়ের কাছে গিয়ে তাকে বুঝিয়ে বললে তিনি বুঝতেন। কিন্তু তুমি নাওনি।
আমি সুইডাইড করতে যাওয়া পর্যন্ত যা হয়েছে, সেসব আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু তারপর এই শেফালী আপার সাথে মিলে নাটকটার কী প্রয়োজন ছিল? এটার কথা অবশ্য আমি জানতাম না। তবে এইটুকু জানতাম যে সেদিন একবার তুমি আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে যদি বলতে সব ঠিক আছে, তুমি আমার পাশে আছ; তাহলে আমার আর কোনো মোটিভেশন, নজরদারি, কিচ্ছুর প্রয়োজন হতো না। তুমি সেটা জেনেও আমার কাছে আসোনি।
তিনটে বছর আমাকে একা রেখে রেখে কষ্ট দিয়েছ। হ্যাঁ, নজরবন্দি করতে পেরেছ ভালোভাবেই, কিন্তু ভালো কি রেখেছ? আমি প্রতিটা রাত যে শূন্যতা নিয়ে ঘুমাতে যেতাম, দুঃস্বপ্ন দেখে ভয়ে জেগে উঠতাম, পাশে কেউ থাকতো না। আমি তখন আবার মরতে যেতে পারতাম, অনেকবার ইচ্ছেও হয়েছে। পড়াশুনা তো করেছি স্রেফ নিজেকে ধরে রেখার জন্য। বেঁচে থাকার জন্য। সেই বাঁচাটাকে সত্যিকার বাঁচা বলে না, আত্মা শুকিয়ে গেলে শরীরটাকে চালিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা বলে।”
সে চুপ করে আছে। ঠোঁটদুটো চেপে মুখ শক্ত করে রেখেছে। চেয়ে আছে আমার দিকে। সেই দৃষ্টি দুর্বোধ্য।
আমি আবার বলতে শুরু করলাম, “তুমি ঢালাওভাবে মায়ের দোষ দিয়ে গেছ আমার সামনে। যেখানে তোমার মায়ের তেমন কোনো দোষ নেই। উনি অহংকারী বটে, তবে খারাপ নন। তার ভালো মনটার দেখাও আমি তোমার বাড়িতে থাকতে পেয়েছিলাম।
তুমি সেই বৃদ্ধ ভবিষ্যতবানী করা লোকটার বিষয়েও মায়ের দোষ দিলে, অথচ ওটা তুমি করেছিলে। আমাকে পরীক্ষা করার জন্য যে আমি নতুন কারো সাথে সম্পর্কে জড়াই কী না। তোমার মায়ের জানার কথা নয়, আমি কখন কী করি, কোন দোকানে বই কিনতে যাই ইত্যাদি বিষয়। তারপর অপূর্ব সেজে চিঠি দিয়েছ আমাকে বিভ্রান্ত করে দেয়ার জন্য!
আমি সবসময় ভাবতাম, নোরার মতো এত চমৎকার একটা মেয়ে আশেপাশে থাকার পরেও তোমার আমাকে কেন পছন্দ হলো? সেটা আমি এখন বুঝি। আমার সাথে যেগুলো করতে পেরেছ সেগুলো নোরার সাথে পারতে না। প্রথমদিনই তুমি বুঝে গিয়েছিলে আমি বোকাসোকা, সাধারন, ইমোশনাল ফুল! তাই যা মনে হয়েছে করতে পেরেছ।
তুমি আসলে একটা ম্যানিয়াক। বড়লোকের ছেলেদের অনেক রকম ফ্যান্টাসি থাকে। তুমিও তেমনি ফ্যান্টাসি থেকেই আমার জীবনটা নিয়ে খেলে গেছ! তোমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্নটাই খেয়ালি কাজকর্মের ফল। যার কারনে আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে।
এবার বলোতো, আমি কথাগুলো ঠিক বলেছি?”
একনাগাড়ে এতগুলো কথা বলে হাঁপিয়ে উঠলাম একেবারে। তবে কথাগুলো বলতে পেরে শান্তি পেলাম। ভেবেছিলাম পারবোই না হয়তো।
সে উঠে চলে গেল জানালার কাছে৷ লোহার শিক শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুমি নিজের মতো করে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করালেই ঘটনা সেরকম হবে? তুমি ভুল ভাবছো। সরল জিনিসটাকে জটিল করছ। তোমার মনটাই জটিল হয়ে গেছে।”
আমি চিৎকার করে বললাম, “যদি হয়ও মন জটিল, তোমার কারনে হয়েছে!”
সে আবারও একই কথা বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকলো। আমার সামনে এসে আমার দুই কাঁধ ধরে সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “তুমি কেন বিশ্বাস করছ না আমাকে? আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমায় আমি কেন কষ্ট দেব?”
আমি হাত ছাড়িয়ে নিলাম। বাইরে প্রচন্ড বাতাস বইছে। ঝড় শুরু হয়েছে। গাছের ডাল আছড়ে পড়ছে একটা আরেকটার ওপর। দমকা বাতাসে ঘর ধুলোয় ভরে গেছে। আমি জানালা বন্ধ করে দিলাম। জানার কাচে আছড়ে পড়তে লাগলো হাওয়ার দমক। প্রকান্ড শব্দে বজ্রপাত হতে লাগলো।
সে আমার কাছে এসে বলতে লাগলো, “আমার ব্যাপারে তোমার যা ভাবার তুমি ভাবো, হ্যাঁ, হয়তো আমি খেয়ালি, আমি অনেক উল্টোপাল্টা করি, জীবন নিয়ে সিরিয়াস নই, তোমাকে নিয়েও অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু সেসব আমি সজ্ঞানে ইচ্ছে করে করিনি। আমি এমনই। আমি সত্যি বলছি আর সব যদি মিথ্যেও হয়, এটা সত্যি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমার ভালো চাই। আই লাভ ইউ!”
বজ্রপাতের শব্দে তার কথাগুলো ভালোমতো শোনা যাচ্ছে না। আমি হতাশ হয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। মাথা ভারী হয়ে গেছে। আমি আর নিতে পারছি না। সে আমার সামনে এসে ফ্লোরে বসে পড়ল। একঘেয়ে সুরে তার সেই একই কথা।
আমি তার হাতদুটো ধরে বললাম, “তোমার জীবনে তুমি নাটক ভালোবাসো, তুমি থাকো সেসব নিয়ে। আমি চাই না আর কষ্ট পেতে। তুমি আমাকে মুক্তি দাও। তুমি যদি আমাকে সত্যি ভালোবেসে থাকো, তাহলে মুক্তি দাও। প্লিজ, আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। আমার জীবন থেকে চলে যাও। প্লিজ।”
তার মুখ শুকিয়ে গেল। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে উঠে অন্য ঘরে চলে গেল।
আমি তখন আর পারছি না। এলোমেলো হয়ে নিচে বসে পড়লাম। বুক ফেটে কান্না আসতে লাগলো। কান্নার শব্দগুলো মিশে যেতে থাকলো বাইরের উত্তাল ঝড়ের সাথে। মনে মনে বললাম, “তুমি যেমনই হও, যাই হও, আমি তবুও তোমায় ভালোবাসি। কিছুতেই যে ঘৃণা করতে পারি না! এই না পারার কারনেই আমার এই অবস্থা। আজও তোমার সামনে এলে, তোমার চোখের দিকে তাকালে আমি স্থির থাকতে পারি না। তোমাকে ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে হয়। এই ভালোবাসার বোঝা আমি আর টানতে পারব না। তুমি আমায় রেহাই দাও এখন!”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু