অপূর্ব সমাপ্তি পর্ব-১৮+১৯

0
866

#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ১৮

আমার রেজাল্ট দেয়ার দিনটা সকাল থেকেই গুমট গরম। অস্থির ফাঁপর লাগছে যেন ভেতরটা। আকাশ জুড়ে গনগনে সূর্যটা শাসিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। বড় ভাইয়ার ভালো লাগছে না বলে অফিসে যায়নি আজ। ভাইয়া বাড়িতে থাকলে খুশবু তার সাথেই থাকে। আমি তাই একাকী চুপচাপ ঘরে বসে আছি। সময় যেন কাটছেই না। কলেজে যাব কি যাব না সেই নিয়েও দোটানায় আছি।

বেলা বারোটায় গোসল করে এসে এত ক্লান্ত লাগতে লাগলো যে শুয়ে পড়লাম। আর শুয়েই ঘুম৷ ঘুম ভাঙলো বিকেলে। প্রথমেই মনে পড়ল আজ রেজাল্ট! কী হলো? মোবাইলে অনেকগুলো মিসড কল। কয়েকজন ক্লাসমেট আর মৃন্ময় স্যারের। মেসেঞ্জারে এক বান্ধবী ছবি তুলে রেজাল্ট শীট পাঠিয়েছে। ভয়ে ভয়ে ছবিটা মেলে ধরলাম চোখের সামনে।

সিজিপিএ ৩.৫৮। ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট জঘন্য খারাপ না হলে ৪ এর কাছাকাছি থাকতে পারতাম। তবে সেটা নিয়ে আফসোস নেই। যা হয়েছে তাই ঢের। যে পরিস্থিতিতে শুরু করেছিলাম তাতে এরচেয়ে বেশি সম্ভব ছিল না। স্যারকে ফোন করতে যাব, তখনই একটা মেসেজ এলো। পরিচিত সেই ফেসবুক আইডি। পরিচিত নাম। বহুদিন কোনো মেসেজ যাওয়া আসা না থাকায় কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল!

সে লিখেছে- “অভিনন্দন।”

আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না। কতদিন পর? প্রায় তিন বছর! আহা! এতদিনে আজ মনে পড়ল? জানলো কী করে রেজাল্টের কথা? আমার খুব ইচ্ছে হলো তাকে কিছু লিখতে। বহুবার এলেমেলো শব্দ কীবোর্ডে টাইপ হয়ে মুছে গেল। তবু লেখা আসছে না। ধন্যবাদ দেব? না থাক। প্রয়োজন কী? আবার মনে হলো সে বুঝি অপেক্ষা করে আছে আমি কিছু বলব বলে।

এতদিন পর এই এক শব্দের মেসেজ আবার আমায় কতটা নাড়িয়ে দিয়ে গেল বলতে পারব না। একদম গোছানো জীবনের মাঝে কালবৈশাখীর মতো এসে ক্ষণেই সব ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিল।

রেজাল্টের কথা কাউকে জানালাম না বাড়ির। প্রথমে যে চিৎকার করে নিজের অর্জনটুকু সবাইকে বলতে ইচ্ছে করছিলো সেটা মরে গেছে কেমন করে। সব অনর্থক মনে হচ্ছে। এই পড়াশুনা দিয়ে কী হবে যদি মনে শান্তিই না থাকে?

অর্না ফোন করল এর মাঝে।

“ভাবী কংগ্র্যাচুলেশনস। অনেক ভালো করেছ।”

“থ্যাংস। আমার রেজাল্ট তুমি জানলে কী করে?”

“তোমাদের ভার্সিটির ওয়েবসাইটে দেখলাম।”

“ওহ।”

“জানো ভাইয়া তো খুব খুশি হয়েছে।”

তার মানে অর্নার কাছে সে শুনেছে। আমি আবার ভাবছিলাম সে বুঝি খোঁজ নেয়। জীবনের প্রতিক্ষেত্রে আশা দিয়ে সে কেন নিরাশ করে আমায়? অর্না কী কী যেন বলছিল। আমি ফোন কেটে দিলাম।

সন্ধ্যা হয়ে এলে ঘর অন্ধকার করে বসে রইলাম। গরমের মধ্যে ফ্যানটাও ছাড়তে ভুলে গেছি। বড় আপা হুট করে কোথা থেকে এসে আমার পেছন থেকে জাপটে ধরে কী একটা বলতে নিয়ে আবার সরে গেল। কপাল কুঁচকে বলল, “এই, তোর গা ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। এই গরমে বসে আছিস কেন?”

“এমনি।”

“এমনি মানে? ভাবখানা দেখো! তুই কি ফেল করেছিস? তোর স্যার ফোন করেছিল বাবাকে। বেশ তো ভালো হয়েছে রেজাল্ট। তাহলে? এদিকে মশায় টেকা যাচ্ছে না। এতক্ষনে সব তোর রক্ত খেয়ে হাতিঘোড়া হয়ে গেছে।”

“ভালো লাগছে না আপা। যাও তো!”

“কেন যাব? আগে বলবি কী হয়েছে।”

আপা ফ্যান লাইট জ্বালিয়ে আমার মুখোমুখি এসে বসল। আচমকা চোখে আলো পড়ায় ভয়ানক বিরক্তি হলো। আমি উঠে জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম।

আপা চেঁচিয়ে বলল, “গোসল করিস না। সিজন চেঞ্জ হচ্ছে। জ্বরে পড়বি কিন্তু।”

আমি বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। গরমের মধ্যেও ঠান্ডা পানি। বোধহয় মাত্র তোলা হয়েছে। গা জুড়িয়ে দিচ্ছে। গোসল করলে মনের ভার হালকা হয়। শরীরের ময়লার সাথে মনের কালো কালো কষ্টগুলোও ধুয়ে নিয়ে যায় পানি। চোখ বুজে বসে রইলাম। ভাবার চেষ্টা করলাম, ঝর্নার ধারে বসে আছি। চারপাশে শান্ত বনানী। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে আর পাখিগুলো মিষ্টি সুরে ডাকছে ক্ষণে ক্ষণে। মনটা ভালো লাগলো।

এদিকে বাইরে থেকে মা আর আপার ডাকাডাকি শুরু হয়েছে। পাত্তা দিলাম না। ঘন্টাখানেক পর বের হলাম। মা আপা বকছে একনাগাড়ে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি চোখমুখ ফুলে আছে। মা হঠাৎ আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। মায়ের উচ্চতা আমার চেয়ে কম অনেকখানি। আমার বুকের ওপর তার মাথাটা রেখে কাঁদতে কাঁদতে একেবারে ভেঙে পড়লেন।

তাকে ধরে বসিয়ে দিতেই চোখনাক মুছে বললেন, “তুই এমন হয়ে গেছিস কেন? আগের মতো নেই তুই। কেমন যেন শক্ত পাথর পাথর লাগে তোকে। তোর শরীর, তোর বুকের ভেতরটাও পাথর হয়ে আছে। এক স্বামীর সাথে থাকতে না পারলে কি জীবন চলে না কারো? তুই আরেকটা বিয়ে কর। ওকে বল, আরেক বিয়ের কথা শুনলে ও ঠিকই ডিভোর্স দেবে। তাও এমন হয়ে যাস না। আমার ফুটফুটে মেয়ে চোখের সামনে এমন হয়ে গেলে আমি সময়ের আগেই মরে যাব।”

আমার হাসি পেয়ে গেল। বললাম, “সময়ের আগে কেউ মরে না মা।”

মা রাগ হয়ে আপার দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখেছিস, ওর মধ্যে মায়াদয়া সব মরে গেছে। ও শক্ত ইট হয়ে গেছে। আমার মরার কথা শুনেও হসে।”

আমি বললাম, “একটু আগেই বললা পাথর হয়েছি, এখন বলো ইট। তুমি আগে শিওর হও আমি কী হয়েছি।”

মা বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। হেসে বললাম, “গরম লাগছিলো বলে গোসল করেছি। তাই জন্য এত কান্নাকাটির কী আছে বুঝি না তো।”

“কথা ঘোরাবি না।” তারপর মা আপার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বিয়ের কথা বললেই অমন কথা ঘুরিয়ে ফেলে। আমি কি ওর সাথে পারি বল? তুই দেখিস তো ভালো ছেলে পাস কি না। প্রথমবার তো নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে। এবার আমি বিয়ে দেব। দেখবি তখন সুখী হয় কি না।”

আপা বলল, “দেখব দেখব। আজ এসব কথা ছাড়ো। ও কত ভালো রেজাল্ট করেছে। ভালোমন্দ কিছু রাঁধো না আজ রাতে।”

মা আমার দিকে তাকালেন। আমি হেসে বললাম, “যাই রাঁধো, ক্ষীরের পায়ের যেন থাকে।”

ঝিনু কোথা থেকে উদয় হয়ে এসে বলল, “আমি চিংড়ির মালাইকারি খাব।”

আপা ঝিনুর কান টেনে বলল, “নিজে তো টেনেটুনে পাশ করিস। আবার আসছে এটা খাব, ওটা খাব।”

মা মুচকি হেসে চোখের কোণের পানি মুছে বলল, “সব রাঁধবো। তোরা মন ভরে খাস।”

.
দু’দিন পর অপূর্বর চিঠি এলো। এবারের চিঠি লম্বা চওড়া।

“শোনো মেয়ে, ভালো থাকো না কেন বলো তো? আমি কাছে থাকি না বলে? আমার কাছে থাকলে তোমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে অনেক যত্ন করে রাখতাম। রেজাল্ট তো দেখলাম। তুমি জানো, আমি সেদিন কত খুশি হয়েছি? অফিসের সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছি। আমার কোয়ার্টার থেকে কিছুদূর গেলে চাকমাদের বিরাট বস্তি। সব মেয়েগুলোকে শাড়ি কিনে দিয়েছি। ওদের কী একটা অনুষ্ঠান ছিল সেদিন। নাচগান হয়েছে প্রচুর। তোমার কথা তাদের প্রায়ই বলি। তারা তোমায় নিয়ে একটা গান বেঁধেছে। বলেছে তুমি যখন আসবে এখানে, তখন শোনাবে।

সকালের সূর্যটা পাহাড়ের মাথা থেকে যখন ওঠে, পূর্বাকাশ লাল হয়ে সিঁদুররঙা দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, প্রতিদিন সে দৃশ্য দেখে আমি দিন গুনি কবে তোমাকে আমার কাছে এনে রাখতে পারব, একসাথে সূর্যোদয় দেখব। পাহাড়ি নদীটার পাড়ে সুযোগ পেলে গিয়ে বসে থাকি। তোমার জন্য পাশে জায়গা থাকে। জায়গাটা প্রতিবার আমায় জিজ্ঞেস করে, এনেছ তাকে? আমি নিরাশ হয়ে বলি, না, সে আসেনি। জানো, পুরো প্রকৃতিটা তখন মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। তারপর চিৎকার করে বলে, তাকে নিয়ে এসো। সে ছাড়া সবকিছু অসম্পূর্ণ!

তোমার জন্য তিনটা শাড়ি কিনেছি। একটা বেগুনী পাড়ের, জমিন আকাশের মতো হালকা নীল। আমার কোয়ার্টারের বাইরে বুনোফুলের ঘন ঝোপে গাঢ় বেগুনী ফুল হয়। শাড়িটা পরে সেই ফুল খোঁপায় গুঁজে কোনো এক শরতের বিকেলে তোমায় নিয়ে ঘুরতে যাব। যাবে তো?

ঝকমকে শহুরে মেয়ে আমার কোনো কালেই পছন্দ নয়। আমার তো তোমার মতো শ্যামবর্ন গভীর চোখের স্বচ্ছ মনের মেয়ে পছন্দ। যাকে হুট করে পাহাড়ি পথের বাঁকে দেখতে পেলে মন ভরে যাবে। ঘন অরন্যের মাঝে যে মিশে যাবে অপরূপা প্রকৃতির সাথে!

প্রতীক্ষার প্রহর গুনে গুনে হাত ক্ষয়ে যাওয়ার আগে চলে এসো তুমি।

অনেক কিছু লিখে ফেললাম। আজকের মতো ঢের। শুধু আমার জন্য হলেও ভালো থেকো। ভালোবাসা রইল।”
– তোমার অপূর্ব

চিঠি পড়ে দুই ঘন্টা আমি নির্বাক হয়ে বসে রইলাম। এই লোক কে? এমনিতেই বাঁচি না, তার মধ্যে আরেকটা ক্যাচাল! ইচ্ছেমতো কতক্ষণ গালাগালি করলাম এই চিঠিদাতাকে। কঠিন গালি দিয়ে মনটা কেমন হালকা হয়ে গেল। হালকা মনে বসন্তের নতুন পাতার মতো কিছু একটা গজিয়ে উঠলো। কোথা থেকে একঝলক হাওয়া দোলা দিয়ে গেল মনে।

.
মাস্টার্সে ভর্তির পর লেখালেখি কমে গেল। শুধু পড়তে ইচ্ছে করে। পড়িও দিনরাত। ইদানিং একটা স্কুলে চাকরি নিয়েছি। বাড়ির পাশেই কিন্ডারগার্টেন স্কুল। ছোট ছোট বাচ্চারা আসে, বেশ লাগে তাদের পড়াতে। আমাকে সবাই ভালোবাসে, কথা শোনে। চুপ করে আমার ক্লাস করে। কেমন করে যেন প্রতিটা বাচ্চা আপন হয়ে গেছে। কাছে গেলে মনে হয় জড়িয়ে ধরে রাখি সবাইকে।

.
আপা এসেছে অনেকদিন হলো। আসার কয়েকদিন পর আবিষ্কার করেছি সে ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করে এসেছে। ভাইয়া তাদের সময় দেয় না। ভাইয়া প্রতিদিন ফোন করছে, কিন্তু আপা প্রতিবার ফোন ধরে ঝগড়া করছে। মিটমাটের লক্ষণ নেই। জানা কথা ভাইয়া আসলেই আপা চলে যাবে। কিন্তু উনি আসার সময় পাচ্ছেন না। আর তাতেই আপা রেগে আরো আগুন হয়ে আছে।

রোজ রোজ তাদের মিঠে খুনসুটি শুনে ঘুম ভাঙে। রাতে ঘুমানোর আগেও সেই ফোনে ঝগড়া। ঝাড়ি দিয়ে বলা কথার মধ্যেও ভালোবাসা লুকানো। ভাবি, এরা এতদিন আলাদা আছে কী করে? এতই যখন প্রেম তখন কষ্ট করে দূরে থাকার কী মানে?

একদিন সময় করে ভাইয়া এলো। তাও ঝড় তুফানের সন্ধ্যায়। বিদ্যুৎ নেই। বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। ভাইয়া আসার সাথে সাথে আপা ঝগড়া করতে শুরু করল। এই দুর্যোগের মধ্যে আসার জন্য চিৎকার করে আশেপাশের সবার মাথা খারাপ করে ফেলল। সেই সাথে নিজেই ভাইয়ার মাথা মুছে দিল। ভেজা শার্ট খুলে শুকনো জামা পরিয়ে দিল। তারপর খুব মন দিয়ে সরিষার তেল দিয়ে মুড়িমাখা আর মসলা দেয়া রং চা বানিয়ে ভাইয়াকে খাওয়ালো।

আমরা শুধু দেখি আর হাসি। আপা আমাদের হাসি দেখলে রেগে চেঁচামেচি করে। চোখমুখ গরম করে ভাইয়ার পাশ ঘেঁষে বসে থাকে।

তাদের দেখলে আমার আরো বেশি করে তার কথা মনে পড়ে। আজ একসাথে থাকলে কি এমন খুনসুটি আমাদের মধ্যেও হতো? একেকবার ভীষণ রাগ হয়। মা ঠিক তো বলে। নতুন জীবন শুরু করতে। কতদিন এমন একলা পড়ে থাকব? কিন্তু কাউকে বিশ্বাস হয় না যে! তারপর অপূর্বর কথা মনে পড়ে। ছেলেটা তার শেষ চিঠিতে ফোন নাম্বার দিয়েছে। বলেছে চট্টগ্রাম যেতে। তার সাথে দেখা করতে। অনেক কথা নাকি বলার আছে। আমারও তাকে অনেক প্রশ্ন করার আছে। সে কি ভালো মানুষ? সে কি আমায় সত্যি ভালোবাসে? আমিও কি তাকে ভালোবাসতে পারব? অনেক প্রশ্নেরা ঘুরপাক খায় মাথায়। একঘেয়ে জীবনটা অসহ্য লাগে এখন। একবার কি যাব সেখানে? দেখা করব অপূর্ব নামক অদ্ভূত চরিত্রটির সাথে?

পরদিন ঝকঝকে সকাল হলো। মেঘ কেটে সোনালী সূর্য উঠলো। আপা ভাইয়ারা বাড়ির পথে রওনা হবে। আপাকে গোছগাছ করে দিতে দিতে বললাম, “আপা, আমি তোমাদের সাথে যাব।”

আপা খুশি হয়ে বলল, “সত্যি যাবি?”

“ইচ্ছে করছে।”

আপা নেচে উঠে আরেকটা ব্যাগ নিয়ে এল তক্ষুনি। বলল, “গুছিয়ে ফেল কাপড়চোপড়।”

স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। হাতে আর কাজ নেই। কলেজও বন্ধ। সুযোগে ঘুরে আসা যায়। মজার ব্যাপার হলো আপার বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে। গেলে অপূর্বর সাথে দেখা করার সুযোগ পাব। সে যেই হোক, তাকে বলব পাহাড়ে বেড়াতে নিয়ে যেতে। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার তীব্র ইচ্ছে পেয়ে বসেছে আমায়।
(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব -১৯

আপার বাড়ি পৌঁছেই বিরাট এক ঘুম দিলাম। উঠতে উঠতে পরদিন বেলা এগারোটা। উঠে দেখি আপা একাই বকবক করতে করতে ঘরদোর গোছাচ্ছে। ভাইয়া একা মানুষ, অফিসের কাজকর্ম করে বাড়ির দেখাশুনা কী করে করবে! তাও যে বাড়ি বাসযোগ্য আছে এতদিনে সেই বেশি। আমি খেয়ে আপার সাথে কাজে লেগে গেলাম।

দুপুরের পর আয়াশের সাথে কার্টুন মুভি দেখে সময় কাটলো। সন্ধ্যার পর ভাইয়া চলে এল। ভাইয়ার গানবাজনার খুব শখ। একটা আলাদা ঘরই আছে তার। গানের ঘর। গিটার, তবলা, হারমোনিয়াম, আরো কিছু সরঞ্জাম আছে। ভাইয়া একাই গান করে একেক সময় একেকটা বাজিয়ে। আবার গান জানা কাউকে পেলে ধরে নিয়ে আসে বাড়িতে।

আজ ভাইয়ার সাথে আপাও গান গাইল। দুজনের কারোই গলা ততটা ভালো না, তবুও শুনতে বেশ লাগে!

“দূর হতে আমি তারে সাধিব
গোপনে বিরহ ডোরে বাঁধিব….
বাধনবিহীন সেই যে বাঁধন
অকারণ….
মায়াবন বিহারিনী…..”

মনে হয় যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে বেদনার সুর। কেউ একজন ডেকে যাচ্ছে একেবারে মনপ্রাণ দিয়ে। বুকের ভেতর কেমন হু হু করে ওঠে…সে ডাক উপেক্ষা করার সাধ্যি কোনো মানুষের নেই।

রাতে অপূর্বর নাম্বারে মেসেজ পাঠালাম- “আমি চট্টগ্রাম এসেছি।”

সে তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল- “দেখা করবে?”

“হ্যাঁ। আগামীকাল সকালে।”

সে ঠিকানা মেসেজ করে দিল। কীভাবে যেতে হবে তাও বলে দিল।

পরদিন ভাইয়া অফিসে গেলে আপাও বের হয়ে গেল আয়াশকে নিয়ে। আয়াশকে নতুন স্কুলে ভর্তি করবে। আগের স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার পর অন্য স্কুলে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ওই সময় ওই ক্লাসে সিট ফাঁকা ছিল না। তাই সামার সেকশনে ভর্তি করবে। মাঝখানে সুযোগে আয়াশ কিছুদিন নানুবাড়ি বেরিয়ে এল।

আপাকে বলেছিলাম যে আমিও বের হব এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে। আপা বের হওয়ার পরপর আমিও বেরিয়ে গেলাম। তার কোয়ার্টারে পৌঁছুতে এগারোটা বেজে গেল। প্রায় দুপুরে একেবারে মাথার ওপর সূর্যটা। ঘেমে একাকার হয়ে গেছি। বাড়িটা একতলা ছিমছাম দালান। সাদা রঙ করা। বাড়ির দুই পাশে দুটো আমগাছ ছায়া দিয়ে রেখেছে। ঢোকার পথে দুটো লম্বা সুপারি গাছ। আর চারপাশে প্রচুর ঝোপঝাড়। সন্ধ্যামালতি আর নয়নতারার গাছ সব। সাথে সে যে বেগুনী ফুলের কথা বলেছিল সেটাও আছে।দেখেই মনে হলে নিশ্চিত প্রচুর মশা হয়৷ থাকে কেমন করে?

বেল বাজাতে দরজা খুলে দিল এক মাঝবয়সী শুকনোমতো লোক। আমাকে দেখে একগাল হেসে সালাম দিয়ে বলল, “কেমন আছেন মা জননী?”

একটু হেসে বললাম, “ভালো। বাড়িতে আর কেউ নেই?”

“স্যার বাড়িতেই আছেন। আসুন ভেতরে।”

আমি ড্রইং রুমে বসলাম। কয়েকটা সাধারণ সোফাসেট আর একটা ছোট টিভি। বড় জানালার ঘেঁষে ঝোপালো গাছে বাগানবিলাস ফুটে আছে।

অপূর্ব নামক মানুষটি গলা খাকারি দিয়ে ঘরে এসে ঢুকলো। একগাল হেসে আমার মুখোমুখি সোফায় বসে বলল, “আসতে অসুবিধা হয়নি তো?”

আমি চুপ করে তাকে দেখে গেলাম। ছয় ফুট লম্বা, আদুরে মুখখানা, খাড়া নাক আর কপালের ওপর ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো। সেই চিরচেনা মানুষটি। চোখের কোল বসে গেছে, গায়ের রঙ রোদে পুড়ে বাদামি হয়েছে। আমায় চমকে দিতে পারার আনন্দে তার চোখদুটো ঝিকমিক করছে। যেন বুদ্ধির খেলায় জিতে বসে আছে।

আমি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বললাম, “না। কেমন আছ?”

সে খানিকটা ভড়কে গিয়ে বলল, “তুমি বুঝে গিয়েছিলে আমি অপূর্ব?”

সত্যি বলতে আমি ধারনা করেছিলাম আগে, তবে একেবারে নিশ্চিত ছিলাম না। তবুও মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললাম, “হ্যাঁ, এটা বোঝা কোনো ব্যাপার?”

সে একটু রাগ হয়ে বলল, “কী করে বুঝলে? আমি চট্টগ্রাম আছি সেটাই তো তোমার জানার কথা নয়।”

“সেটা জানতাম না। তবে চিঠিগুলো তুমি ছাড়া অন্য কেউ পাঠাবে না তা জানা ছিল।”

“ইশ্ আমি কোনো ক্লু রাখিনি। হাতের লেখাও অন্যরকম করে লিখেছি। গুল দিচ্ছ। তুমি বোঝোনি।”

“একশোবার বুঝেছি। তুমি ছাড়া অমন কাব্য করে চিঠি কে লিখবে? তুমি ছাড়া অমন করে কেউ বলতে পারে না।”

সে হাত দিয়ে নিজের কপাল থেকে চুল পেছনে সরিয়ে ভুরু উঁচু করে বলল, “তাই বুঝি?”

“হুম। তাছাড়া অপূর্ব বুঝি অন্য কেউ?”

“তা না। কেউ তো অপূর্ব ডাকে না। আর ভেবেছিলাম তুমি এই নামটা জানো না।”

“তিন বছরেই সব ভুলে গেছ? তোমার দাদীর গল্প কম শুনিয়েছ আমায়? যতবার শুনিয়েছ ততবার বলেছ দাদী তোমার নাম রেখেছিল অপূর্ব। যেটা এখন কেউ ডাকে না, এমনকি বেশিরভাগ মানুষ জানে না।”

“হায় হায়। মজাটাই মাটি!”

“তোমার কাছে কি পুরো জীবনটাই মজা? সত্যি করে বলোতো!”

“না তো, আমার তো মনে হয় আমার পুরো জীবনটাই বড়সড় একটা প্রহসন!”

“তোমার নাকি আমার?”

“দুজনেরই। আমাদের জীবন তো একই সুতোয় গাঁথা ।”

“আমাকে এখানে ডেকে নিয়ে আসার কারনটা জানতে পারি?”

“তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে আমার।”

“সেই সবকিছু বলার সময় বুঝি এতদিনে হলো? এতদিন তো তোমার জন্য কিছু আটকে থাকেনি। আশা করি ভবিষ্যতেও থাকবে না।”

সে আমার দিকে গভীর চোখে তাকালো। অনেক আগে প্রথম প্রথম যেমন তাকাতো, ঠিক তেমন করে। বহু সময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। আমার চোখ, নাক, ঠোঁট, চুল, মুখের প্রতিটা রেখা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের পর সে বলল, “তোমাকে আমি এমনভাবেই দেখতে চেয়েছিলাম। বিশ্বাস করো, এই সাহসী, সংগ্রামী তুমিকে দেখার জন্য আমি এতদিন অপেক্ষা করেছি। নয়তো এত কষ্টের জীবনটা কেন সহ্য করতাম বলো!”

“যা বলবে সোজাসুজি বলো।”

সে উঠে জানালার কাছে চলে গেল। গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমার বিয়ের শুরু থেকে আমাকে নিয়ে অনেক অভিযোগ, আমার আচরন নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে তাই না? সেসবের উত্তর আজ দেব তোমায়। শুনতে চাও?”

“চাই।”

“তার আগে কিছু খেয়ে জিরিয়ে নাও। গরমে একেবারে সেদ্ধ হয়ে গেছ মনে হচ্ছে।”

সে ‘সুবোধ’ নাম ধরে ডাকতেই মাঝবয়সী লোকটা এলো। সে আমার জন্য শরবত আর নাস্তা আনতে বলল।

সুবোধ মিনিটখানেকের মাথায় ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে হাজির হলো। আমি ঠান্ডার গ্লাসটা নিলাম।

সে আবার আমার মুখোমুখি এসে বসল। হাতদুটোর কনুই হাঁটুতে ঠেকিয়ে আঙুলের খাঁজে আঙুল ঢুকিয়ে যেন প্রস্তুতি নিল। তারপর বলতে শুরু করল-

“তুমি বাড়ি থেকে চলে আসার পর আমি শেলফে তোমার অংশে তোমার ডয়েরি পেয়েছি। তাতে ওই সময় পর্যন্ত তোমার সাথে ঘটা প্রতিটা ঘটনা তুমি তোমার মতো করে লিখে রেখেছিলে। সেখান থেকেই আমি তোমার অভিযোগগুলো জানতে পেরেছি। তোমার মনে প্রথম প্রশ্ন জেগেছিলো সিলেটে মা যাওয়ার পর। হঠাৎ তিনি কী করে উপস্থিত হলেন সেটা নিয়ে।

আমরা সিলেটে যাওয়ার পর মা প্রতিদিনই আমাকে ফোন করতো। একবার নয়, অনেক বার। কান্নাকাটি করতো, অনুরোধ করতো ফিরে যাওয়ার জন্য। মা আমাকে কথা দিয়েছিল তোমাকে মেনে নেবে। সেসব শুনে একসময় আমি গলে যাই। তাকে বলি যে ফিরে যাব। কিন্তু তার সিলেট আসার কথা আগের দিন রাত পর্যন্ত আমি জানতাম না। তুমি সেরাতে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর মায়ের ফোন আসে। আমাকে জানায় সে ভোরের ফ্লাইটে আসছে। ভোর হতেই তাই আমি বেরিয়ে যাই। অত ভোরে তোমায় ডাকতে ইচ্ছে হয়নি। এই ছিল মায়ের আসার কাহিনী।

দ্বিতীয় প্রশ্ন বাড়ি নিয়ে মিথ্যে কথা বলা।
এটা আমার ভুল আমি স্বীকার করছি। আসলে আমাদের তানজিমের বাড়িতেই ওঠার কথা ছিল। কিন্তু বাড়ির দেখাশুনা ওর চাচা করেন। সেটা যে অলরেডি পনেরো দিনের জন্য ভাড়া হয়ে গিয়েছিল তা তানজিম জানতো না। জেনেছিল শেষ মুহূর্তে। ওই সময় সন্ধ্যারাতে তোমায় নিয়ে কোথায় উঠতাম? তাই শেষে আমাদের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। বাড়িটা মায়ের, আর মায়ের সাথেই সমস্যা করে তার বাড়িতে ওঠার কথাটা তোমাকে বলতে ইচ্ছে হয়নি। ভেবেছিলাম বললে তুমি স্বচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবে না।”

জিজ্ঞেস করলাম, “পরে বলোনি কেন?”

“তোমাকে যে মিথ্যে বলেছি সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। তুমিও আর মনে করিয়ে দাওনি।”

“এতদিন পর কেন মিথ্যে কথা বলছ বলবে? তুমি সিলেটে গিয়েছিলেই মায়ের কথামতো। প্ল্যান করে। সিলেট মিশন! হাহ!”

“তোমাকে কে বলেছে আমি মায়ের কথায় গেছি?”

“তোমার মা নিজেই বলেছে।”

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিচের দিকে তাকিয়ে। আস্তে আস্তে বলল, “মা মিথ্যে কথা বলেছিল। আমাদের তেমন কোনো প্ল্যান হয়নি।আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম মায়ের সাথে ঝগড়া করে। মা সব জানতে পেরেছিল অনেক পরে। তোমাকে ওসব কেন বলেছে আমি জানি না। আর আমি যে তোমাকে সত্যিটা বলব সে সুযোগ তুমি দাওনি। তুমি কখনো আমার কাছে কোনো অভিযোগ করোনি। সবসময় মুখ বুজে থেকেছ। কেন বলোতো? আমার পক্ষে কি সম্ভব তোমার মনের সব কথা জেনে ফেলা? সাথে সাথে বলে দিলেই অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয় না। মা সিলেটে আসার দিন তাকে এতদিন পর দেখে এত খুশি হয়ে গেছিলাম যে অজান্তেই তোমাকে কষ্ট দিয়েছি সেটা নিজেও বুঝিনি। এসব আমি জেনেছি অনেক পরে, তোমার ডায়েরি থেকে।”

“তারপর?”

“ঢাকায় আসার পর তোমার সাথে আমার সম্পর্ক ক্রমাগত খারাপ হচ্ছিলো, যেটার কারন সময়ের অভাব। অফিসে এত কাজ সামলে উঠতে পারছিলাম না আমি। সময় পেতাম না। আর যাও বা পেতাম, বাড়িতে এসে মায়ের কাছে তোমার নামে গাদা গাদা নালিশ শুনতে হতো। সারাদিন পরিশ্রমের পর সেসব শুনলে কার মেজাজ ঠিক থাকে বলো? অকারনেই তখন তোমায় কথা শুনিয়ে ফেলতাম। আমি তোমাকে শুরুতেই বলেছিলাম মা আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। তাকে কষ্ট দিতে পারি না বলে সব রাগ তোমার ওপর ঝাড়তাম! পরে অবশ্য মনে হতো তোমার সাথে অন্যায় করছি, তখন সব মিটিয়ে নিতে চাইতাম, কিন্তু তার আগেই আবার নতুন করে ঝামেলা তৈরি হতো। দিন দিন একেবারে অসহ্য হয়ে উঠেছিল সব। তুমি যে কী করে ছিলে ভাবতেও আমার বিচ্ছিরি লাগে! আমি সবকিছুর জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাই। আমি জোর করে তোমায় বিয়ে করে সুখী করতে পারিনি, সেটা আমার ব্যর্থতা।”

সে আরও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখদুটো বিষন্ন, ম্লান হয়ে আছে। অনুশোচনার পাহাড় জমেছে তাতে। আমার মায়া হলো। ভাবলাম হাতদুটো ধরে বলব দরকার নেই এসব কৈফিয়তের। কিন্তু সবটা যে জানতে হবে! বললাম, “তারপর বলো।”
(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে