#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ১৬
চওড়া ব্যস্ত সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে আছি৷ অনেক গাড়ি চলছে। কিছুতেই পার হতে পারছি না। অসহায়ের মতো চারপাশে তাকালাম। কোনো ফুটওভার ব্রিজ নেই। চারদিকে শুধু গাড়ি। হঠাৎ তাকে দেখতে পেলাম। সে পাশে এসে দাঁড়ালো। খানিক ফাঁকা রাস্তা পেয়ে সে আমার হাত টেনে নিয়ে গেল সামনে।
কিন্তু অর্ধেক পার হতেই একটা প্রাইভেট কারের সামনে পড়লাম। ব্যাস্ আরেকটু হলেই একসিডেন্ট হতো! আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠার আগেই গাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন আমার শ্বাশুড়ি মা। রুদ্রমূর্তি ধারন করে আমার সামনে এসে জোরে চড় দিলেন গালে। আমি টলে উঠলাম। এর মাঝে সে হারিয়ে গেছে। কোথাও দেখলাম না তাকে। চোখের জমা হওয়া জলের কারনে ঝাপসা হয়ে এলো চারদিক।
প্রাইভেট কারটা শা করে ছুটে গেল সামনে দিয়ে। মাঝ রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে আমি। দু’দিন দিয়ে ছুটছে গাড়ি। নড়তেও পারছি না, পা দুটো যেন কে আঠা লাগিয়ে দিয়েছে। ভারী হয়ে আসছে নিঃশ্বাস। বুকে আটকে থাকা যন্ত্রণা ঠিকরে বেরিয়ে এসে বলছে, মরে যাও তুমি! মরে যাও!
এর মাঝে হুট করে কোথা থেকে একটা হাত এসে আমার হাত ধরে ফেলল! উষ্ণ, শক্ত একটা ভরসার হাত। অতিযত্নে আমার হাতটা তুলে নিল তার হাতে। তারপর কেমন করে যেন গাড়ি বাঁচিয়ে আমায় নিয়ে যেতে থাকলো সামনে।
চারদিকে অনেক ধোঁয়া। আমি উদ্ধারকর্তার মুখ দেখতে পেলাম না। তার মাথা ঢাকা পড়েছে ঘন ধোঁয়ার আড়ালে। শুধু তার মুঠির ভেতর নিজের হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরলাম৷ চোখ বুজে পার হয়ে গেলাম রাস্তা। ওপরাড়ে পৌঁছে হাতটা ছেড়ে দিল সে আমার। আমি তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। সারা রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি নেই, মানুষ নেই, শুধু আমি৷
ঘুম ভাঙলো। ঘেমে গেছি একেবারে। এতদিন হয়ে গেল, তবুও তাকে স্বপ্নে দেখি, সাথে থাকে শ্বাশুড়ি মা। প্রায় একই রকম স্বপ্ন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দেখা। পাশ ফিরে খুশবুর দিকে তাকালাম। মেয়েটা বড় হয়েছে এখন৷ ছোট্ট শরীরটা একটু একটু করে বাড়ছে তার৷ এক বছর বসয় হয়েছে৷
কথা বলতে শেখেনি ভালো করে। ‘বাবা’, ‘দাদা’, ‘মা’ ইত্যাদি শব্দগুলো আধো আধো বলতে পারে। আমায় ডাকে ‘তাতা’। সে হামাগুড়ি থেকে হাঁটতে শিখছে অল্প অল্প৷ হাঁটে তো না, সুযোগ পেলে দৌড়ায়। কিছুদূর দৌড়ে গিয়ে পড়ে যায়৷ পড়েই হেসে ফেলে নিজেই ওঠার চেষ্টা করে। দুধদাঁত চারটা বের হয়ে ভারি মিষ্টি দেখায় তাকে। ইচ্ছে করে চুমুতে ভরিয়ে দিতে মুখ। বুকের সাথে জড়িয়ে রাখতে ছোট্ট তুলতুলে দেহখানি।
খুশবুকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঘুম এলো না। উঠে পড়লাম। রাত জাগলে এখন আগের মতো বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। তারচেয়ে পড়াশুনা করলে সময় কেটে যায় ভালো। ঝিনু অন্য ঘরে শিফট হয়ে গেছে। ঝিনুটা বড় হয়েছে। ছটফটে স্বভাব। আমার মতো বিষন্ন, গম্ভীর কারো সাথে থাকতে তার ভালো না লাগারই কথা। তার ওপর এই রাত জেগে আমার পড়াশোনার যন্ত্রণা!
রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের পানি চুলায় দিলাম। হঠাৎ একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। বিয়ের পরপর শ্বশুরবাড়িতে থাকার সময় একরাতে তার ঘুম আসছিলো না। একা একা জেগে থাকতে পারছিলো না বলে আমায় জোর করে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। আধঘুমো আমাকে টেনেটুনে যখন সরাতে পারলো না তখন কোলে তুলে নিল।
তার গলা জড়িয়ে নিলাম শক্ত করে। সে আমায় নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। চেয়ারে বসিয়ে কফি বানিয়ে আনলো দু’কাপ। তার ঘরেই ছোট একটা কফি তৈরির মেশিন আছে৷ নিজেই সবসময় বানিয়ে নেয়।
সেরাতে সারারাত গল্প হলো৷ ভোরের আজানের সময় গল্প শেষ হলো। সূর্য উঠলো আমাদের চোখের সামনে। ভোরের শীত শীত ঠান্ডা বাতাসে আমি তার বুকের মুখ গুঁজে তাকে জড়িয়ে উষ্ণতা খুঁজে নিলাম৷ সে আমায় আরো নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরে রাখলো।
সে সময় সে প্রতিজ্ঞা করেছিলো, কখনো চোখের আড়াল হতে দেবে না আমায়।
হাহ! এক বছরও প্রতিজ্ঞা পালন করতে পারলো না!
ভাবনার জগতে এত গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিলাম যে বাস্তবে যখন ফিরলাম, মনে হলো ঘুম ভেঙেছে। চায়ের পানি শুকিয়ে তলানিতে ঠেকেছে। আরেকটু হলে পাতিল পুড়তো!
পাতিল নামিয়ে ঘরে চলে গেলাম। একটা বই নিয়ে বসলাম। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ‘বিষবৃক্ষ’।
আগে ভাবতাম বাংলা অতি খটমটে একটা বিষয়। কিন্তু এখন মনে হয় এটা পড়ার জন্যই আমার জন্ম হয়েছে। যত পড়ি, ততই আশ্চর্য হই, মুগ্ধ হই!
.
থার্ড ইয়ারে ক্লাস করছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস হয় না। স্টুডেন্টরা যায়ই না। আমি তবুও শিডিউল অনুযায়ী প্রতিদিন যাই। লাইব্রেরিতে বসে পড়াশুনা করি। সিলেবাসের প্রতিটা বিষয় বিস্তারিত পড়ি। প্রতিদিনের খবরের কাগজ খুঁটিয়ে পড়ি। ভালো লাগে এসব। ইদানিং অল্প অল্প লিখতেও পারি। কোনো নতুন বিষয় জানতে পারলে সেটার ওপর যত বই, জার্নাল আছে সব পড়ি। সাথে ইন্টারনেট তো আছেই। তারপর সেই বিষয়ে নিজের মতো করে গুছিয়ে কিছু লিখে ফেলি। খারাপ লাগে না নিজের লেখা পড়তে। ডায়েরিতে জমা থাকে কথাগুলো।
আমি লেখাগুলো শুধু মৃন্ময় স্যারকে দেখাই। সেকেন্ড ইয়ারের শেষের দিকে স্যারের ক্লাসগুলো ঠিকমতো করায় তার নজরে পড়ে গিয়েছিলাম। পরীক্ষার সময় তার কাছে বিভিন্ন বিষয়ে বুঝতে গিয়েছিলাম, তখন থেকেই তিনি আমাকে বেশ পছন্দ করেন। অনেক আশাও করেন আমার থেকে। আমার লেখা প্রতিটা আর্টকেল মনোযোগ দিয়ে পড়েন, প্রশংসা করেন, ভুল ধরিয়ে দেন। তিনি বাংলা ভাষার ইতিহাসের শিক্ষক। স্যারের সাথে ইতিহাস নিয়ে কথা বলতেও স্বাচ্ছন্দ বোধ হয়।
আবার স্যার আমাকে বই ধার দেন। বই কেনার উৎসাহও দেন। সিলেবাসের বাইরে এই ক’দিনেই অনেক কিছু পড়েছি। সব মিলিয়ে অন্য একটা জগতে ডুবে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় আমি অনেকটাই সফল। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস দিন দিন বেড়ে চলেছে।
.
স্বপ্নময় বুকস্টোর নামক একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি কয়েকটা বই কেনা দরকার। কী বই কিনব নিজেও জানি না। কয়েকদিন ছাত্র আন্দোলনের জন্য কলেজে যাওয়া হবে না। বই না কিনলে সময় কাটবে না। বাড়িতে এত লোকের মধ্যে খুশবুকেও সবসময় ভাগে পাওয়া যায় না।
দোকানের ভেতর এক বৃদ্ধ লোক বসে আছে। লোডশেডিং চলছে। গরমের মধ্যে একটা পত্রিকা দিয়ে বাতাস করছে নিজের গায়ে। আমি দোকানের ভেতরে গিয়ে বই দেখতে শুরু করলাম। লোকটাকে চিনি না। যে লোক সবসময় থাকে তিনি নেই।
বৃদ্ধ লোকটি হুট করেই আমার হাত টেনে ধরলেন। আমি প্রচন্ড অবাক হয়ে হাত টেনে নেয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু লোকটার হাতে এত শক্তি যে আমার হাত তার থেকে ছাড়াতে পারলাম না। মধ্যদুপুরে চারপাশে লোকজন কম। দোকানটাও ফাঁকা। আমি আতঙ্ক নিয়ে তাকালাম। কিন্তু বৃদ্ধের মধ্যে খারাপ উদ্দেশ্য দেখতে পেলাম না। সে মনোযোগ দিয়ে আমার হাতের তালু দেখছে।
কিছুক্ষণ খালি চোখে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে দেখার পর একটা ম্যগানিফাইন গ্লাস বের করল। সেটা দিয়ে কী যেন ভালোভাবে দেখলো। আমি চুপচাপ দেখে গেলাম করেটা কী। কেন যেন মনে হচ্ছে বৃদ্ধ ভালো।
সে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “মা, তোমার বিয়েটা টিকলো না না?”
আমি কিছু না বলে হাতদুটো ভাজ করে দাঁড়ালাম। সে বলতে থাকলো, “তোমার সোয়ামীটা ভালা ছিল না, বড়ই খারাপ চরিত্র। তবে তোমার পরের সোয়ামী ভালা হবে। তার চরিত্র হবে একেবারে ফুলের মতোন। তোমারে রাজরানী বানায় রাখবে। তোমাদের একটা সন্তান হবে…”
আমি বের হয়ে এলাম দোকান থেকে। বদ্ধ উন্মাদ লোক। আজেবাজে বকবক করে যাচ্ছে!
রিকশায় উঠে বাসায় ফেরার পথে হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা ওই লোক এটা জানলো কী করে যে আমার প্রথম বিয়েটা টেকেনি? আন্দাজে বলল? তাও এত নিশ্চিত হয়ে? আজব!
.
আজ ছুটি। কলেজে যাওয়ার তাড়া নেই। ঘুম ভাঙলো দেরিতে। খুশবুও আমার সাথে সাথে দেরিতে উঠলো। ওকে খাইয়ে আমি নাস্তা করতে বসেছি। ও ফ্লোরে হামাগুড়ি দিচ্ছে। আমি খেতে বসেছি। তখনই ঘটলো ঘটনাটা।
বড় ভাইয়া কোথায় যেন যাবে, টুলে বসে জুতোর ফিতে বাঁধছিল। খুশবু তখনই এক দৌড় দিলো ভাইয়ার দিকে। ‘বাবা’ বাবা’ বলতে বলতে। ঠিক ভাইয়ার সামনে গিয়ে পড়ে যাওয়ার আগে ভাইয়া ধরে ফেলল তাকে। খুশবু খিলখিল করে হেসে ফেলল। মুখে বাবা ডাক রেকর্ডের মতো বাজছে। অথচ কেউ তাকে বলে দেয়নি এটা তার বাবা।
ভাইয়া জীবনের প্রথমবার খুশবুকে কোলে নিয়ে প্রথমেই খানিকটা ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে গেল। হা করে তাকিয়ে রইল খুশবুর দিকে। খুশবু তার স্বভাবমতো ভাইয়ার গালে আদর করে দিল। খুশবুর বড় বড় মায়া চোখদুটো হাসছে! ভাইয়া হঠাৎই কেঁদে ফেলল। একদম বাচ্চাদের মতো। খুশবুকে জড়িয়ে ধরল। ভাইয়ার কান্না দেখে খুশবুও কান্না শুরু করল। এরপর দেখা গেল দু’জন দু’জনের কান্না থামানোর চেষ্টা! ভাইয়া চুমুতে ভরিয়ে দিল খুশবুর মুখটি! কিছুক্ষণ পর ভাইয়াকে দেখা গেল সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। খুশবু তার বুকের ওপর চুপটি করে শুয়ে আছে। এই দুষ্টু মেয়ে জেগে থাকাকালীন একদন্ড চুপ হয়ে থাকে না। অথচ আজ বাবার আদর পেয়ে শান্ত হয়ে গেছে। সে কী অপূর্ব দৃশ্য!
আমরা স্থানুর মতো বসে আছি সবাই। খাবার ঠান্ডা হচ্ছে, কেউ দেখছি না। সবার চোখেই জল। বহুদিন পর মনে হলো খরতাপের শুস্ক মাঠে বৃষ্টির ফোটা পড়েছে। ভাবীর আত্মা যদি শান্তি পায় তো আজ পেয়েছে। আমি মনে মনে ভাবীর মিষ্টি মুখটি মনে করলাম। সে যেন ভেজা চোখে বাবা মেয়ের মিলন দৃশ্য চেয়ে দেখছে কোথাও থেকে।
ভাইয়া বর বের হলো না। খুশবুকে নিয়েই রইল। এতদিন পর তাকে মন খুলে হাসতে দেখা গেল। আমাদের সাথেও স্বাভাবিক হয়ে কথা বলল বহুকাল পর। তার মনটাও বদ্ধ ঘরে গুমরে মরছিলো। প্রাণটা ছটফট করছিলো সেই গুমোট অন্ধকার স্মৃতি থেকে বের হয়ে আসতে। আজ খুশবু তাকে টেনে আনলো ঝলমলে পৃথিবীতে। একদিনে আমি দেখলাম মেয়েটা কেমন আমায় ভুলে তার বাবার হয়ে গেল! তাতে অবশ্য আমার কষ্ট হলো না, হৃদয় প্রশান্তি পেলো।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ১৭
আমাদের বাগানজুড়ে অপরাজিতা ফুল ফুটেছে। নীল রঙ ছেয়ে আছে চারদিকে। সন্ধ্যা হতে বেশি দেরি নেই। গোধুলীবেলার লাল আলোয় চারদিক মায়াময় হয়ে আছে। এমন দিনে ইচ্ছে করে কোন ছোট্টবেলায় পড়া রূপকথার দেশে হারিয়ে যাই। সুয়োরানী-দুয়োরানীর দেশে, বীর রাজপুত্রের দেশে চলে যাই, বনের মাঝে থমকে গিয়ে শুনি ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর কথা!
আমি খুশবুকে কোলে নিয়ে বাগানে হাঁটছি। মেয়েটা ঘুমিয়েছিলো দুপুরে। মাত্র উঠলো। এখন না হাঁটলে যে কান্না শুরু করবে, তা থামতে থামতে রাত। আমি ছাড়া আর কারো কাছে যাবে না জেদ ধরেছে। বয়স তিনে পড়ল। তাও আহ্লাদ কমেনি।
এদিকে আমার পড়াশুনা আছে। আগামীকাল ফাইনাল পরীক্ষা শুরু। হঠাৎ কে যেন গেটের কাছে ডাকাডাকি শুরু করল। গিয়ে দেখি চিঠি এসেছে। আমার নামেই। সেটা হাতে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর ঘরে ঢুকতে নিলে আমার গেটে ধাক্কা। গিয়ে দেখি বড় আপা এসেছে। আমি চমকে চিৎকার দিয়ে উঠলাম।
সে বাড়িতে ঢুকেই খুশবুকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। ও আপাকে তেমন চেনে না। নতুন মানুষ দেখে তাই কাঁদো কাঁদো হয়েও বেশি আদরের চোটে কাঁদতে পারলো না। আয়াশও দুষ্টুমি শুরু করল। ছেলেটা বড় হয়েছে কতো! আমি তাদের ধরে ঘরে নিয়ে গেলাম।
“শুধু দু’জনেই এসেছ? ভাইয়া আসেনি?”
আপা ঠোঁট উল্টে বলল, “নাহ। তার কাজের যা চাপ!”
“তুমি না বলে এলে কেন?”
“সারপ্রাইজ দিতে!”
আপাকে নিয়ে কাটলো অনেকটা সময়। প্রায় নয়টার দিকে পড়তে বসলাম। মনে হচ্ছে হিমালয় পর্বতের মতো পড়া ঘাড়ে চেপে আছে। প্রস্তুতি এবার তুলনামূলক অনেক ভালো, আগে তো এর অর্ধেক পড়া হলেও মনে হতো যথেষ্ট। এখন সব কেমন বদলে গেছে। আমার চিন্তা ভাবনার দিকগুলোও অনেক পরিণত হয়েছে। নিজেকে গোছানো মনে হয় খুব। আগের মতো এলোমেলো, উদাসীন, একটা হলেই চলে ভাবটা আর নেই।
বসতে না বসতে অর্নার ফোন এলো। এই মেয়েটা এখনো নিয়মিত ফোন করে। সবসময় বলে, দেখো ভাইয়ার সাথে ঠিক ঠিক তোমার মিল হয়ে যাবে। আমি কথাটা হেসে উড়িয়ে দেই। তবু কি মনের কোথাও কি চিকন সলতেতে আবছা হয়ে একটা প্রদীপ অল্প সময়ের জন্য জ্বলে ওঠে?
তার সাথে আর দেখা হয়নি সেদিনের পর। রাস্তাঘাটে কতো পরিচিত লোকের সাথে দেখা হয়। তার সাথে হয় না কেন? সে কি ইচ্ছে করে আমাকে এড়িয়ে চলে? আমার তাতে ভালোই হয়েছে। একটা বিয়ের সম্পর্কের চিকন সুতো দু’জনকে এখনো জুড়ে রেখেছে। তবুও আমরা যোজন যোজন দূর। সে আর বিয়েও করেনি। নোরা ইংল্যান্ড চলে গেছে। ওবাড়িতে খুব একটা শান্তি আছে বলে মনে হয় না।
“বলো অর্না।”
“প্রিপারেশন কেমন?”
“মোটামুটি।”
“মানে কী! তুমি তো কবে থেকে পড়ছিলে!”
“তবুও মনে হয় কিছু পারব না।”
“খুব পারবে। রিলাক্স থাকো।”
“পারছি না তো।”
“কেন বলো তো, কিছু হয়েছে?”
“নাহ, এই পরীক্ষার জন্যই।”
“কোনো প্রবলেম হলে শেয়ার করতে পারো কিন্তু..”
“সত্যি কোনো সমস্যা নাই।”
“ওহ! বেস্ট অফ লাক। আর ডিসটার্ব করব না, রাখি।”
“ভালো থেকো অর্না।”
“তুমিও।”
ফোনটা রেখেই আমার মনে পড়ল আজ একটা চিঠি এসেছিলো। চিঠিটা নিয়ে দেখি তাতে প্রেরকের ঠিকানা সীতাকুন্ড, চট্টগ্রাম। ওখান থেকে কে চিঠি দিলো?
ভেতরে সাদা কাগজে লেখা ছোট্ট একটা চিঠি। সাথে একটা শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ। চিঠিতে লেখা মাত্র কয়েক লাইন-
“কেমন আছ? কাল থেকে ফাইনাল শুরু তাই না? জানি না চিঠি সময়মতো দিনে পৌঁছাবে কি না৷ প্রস্তুতি ভালো তো এবার? জানি তোমার খুব একা একা লাগে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি তোমার সাথে আছি। প্রতিটি মুহূর্ত তোমার মঙ্গল কামনা করছি। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তুমি সফলতার সিঁড়ি বেয়ে বিনা বাধায় উঠে যাও এই দোয়া করি। শুভকামনা ও অজস্র ভালোবাসা রইল।”
– তোমার অপূর্ব
চিঠি পড়ে আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। অপূর্ব! কোন অপূর্ব? তাও আবার আমার! গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এ কে? কী করে জানলো আমার আগামীকাল পরীক্ষা? আমার পরিবারের বাইরে কোনো ছেলের সাথে যোগাযোগ নেই। মহিলা কলেজে পড়ার সুবাদে ছেলেবন্ধুও নেই। তবে কি এটা….
বড় আপা এসে আমায় অস্থির দেখে বলল, “কী হলো তোর?”
আমি কাঁপা হাতে তাকে চিঠি দেখালাম। আপা চিঠি পড়ে হাসতে হাসতে বলল, “এইটার জন্য ভয় পাচ্ছিস কেন?”
“জানি না। কে পাঠালো বলো তো? আমার পরীক্ষার কথা কে জানলো? চট্টগ্রামের কাউকে আমি চিনি না।”
“সব জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা একসাথে হয়। এটা জানা কোনো ব্যাপার? মনে করে দেখ হয়তো ফেসবুকের কোনো বন্ধু।”
“আমার ফেসবুকে অচেনা কেউ নেই।”
“না থাকুক। পরীক্ষার আগে এসব উড়েচিঠি কেউ পাত্তা দেয় নাকি? কোন পাগল পাঠিয়েছে কে জানে! তবে অপূর্ব নামটা চেনা চেনা লাগছে।”
আমি ঢোক গিলে বললাম, “হয়তো উড়োচিঠিই। ঠিক বলেছ। এসব দেখার আগেই ফেলে দেয়া উচিত।”
আপা চিঠিটা নিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে চলে গেল। দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে বলল, “মনোযোগ দিয়ে পড় তুই। কেউ আসবে না আর।”
আমি উঠে চিঠিটা নিয়ে এলাম। মনে মনে কয়েকবার আউড়ে নিলাম- ‘অপূর্ব! অপূর্ব!’ চিঠিটাতে কী যেন আছে। মনে হচ্ছে ভরসার একটা হাত। স্বপ্নে দেখা হাতের মতো। একেবারে জাদুর মতো কেমন করে যেন আমার দুশ্চিন্তাগুলো টেনে নিল নিজের মাঝে।
বই খুলে দেখি পড়তে শুরু করলাম। একটু আগের ভয়টা আর নেই। আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। মনে হচ্ছে এবার পরীক্ষা ভালোই হবে। বেশ ভালো!
.
পরীক্ষার দিনগুলো বিভীষিকার মতো লাগে আমার। আবার একদিক দিয়ে ভালোও। একেকটা পরীক্ষা চ্যালেঞ্জের মতো। নিজের কাছে নিজের চ্যালেঞ্জ। প্রায় প্রতিটাতেই জিতে যাচ্ছি। তারপর নিজেকে ছোট ছোট গিফট দেই। আবার না পারলে শাস্তিও দেই ঠিক ঠিক। জীবনটা আমার কাছে যেন একটা খেলার অংশ হয়ে গেছে। উপরে ওঠার নেশা পেয়ে বসেছে। তবে জীবন উপভোগ করার ইচ্ছেটা মরে গেছে।
আমার কাছে এক টুকরো অক্সিজেন হলো খুশবু। ও ছাড়া আর কোনো পিছুটান নেই। হ্যাঁ, আমার কিছু হলে মা বাবার কষ্ট হবে, কিন্তু এই স্বামী ছেড়ে আসা কন্যার দায় থেকে মুক্তিও পাবেন। আমিতো হিসেবে তাদের বোঝা হয়ে রয়েছি!
তাই এখন মনে হয়, হয় জীবনে কিছু করব নয়তো মরব। তবুও ধুঁকে ধুঁকে বাঁচবো না। সুইসাইড করার ইচ্ছে কিন্তু নেই। এই মৃত্যু শরীরী মৃত্যু নয়। চলে যাব যেদিকে দু’চোখ যাবে। হয়তো কোনো আশ্রমে সন্যাসিনী হয়ে!
.
শেষ পরীক্ষার দিন আবার সেই স্বপ্নময় বুক স্টোরে গেলাম। সেই বৃদ্ধটিকে পেলাম না। তার কথা জিজ্ঞেস করলে দোকানী মনে করতে পারলো না কার কথা বলছি। বলল তার দোকানে নাকি সে ছাড়া অন্য কেউ বসে না। আমি জোর দিয়ে বললাম, সে বিশ্বাসই করল না। প্রায় দুই বছর আগের কথা কেই বা মনে রেখেছে! এতদিন খোঁজ নেয়ারও প্রয়োজন মনে করিনি আমি। এদিকটা মাড়াইনি আর। তবে এখন কিসের যেন হিসেব মনে খচকচ করছে। সেটা মেলাতে গিয়েছিলাম। তা আর হলো কই।
সেদিন আবার একটা চিঠি এলো। চট্টগ্রাম থেকেই।
“ভালো আছ? মনে হয় নেই। তুমি খুব দুঃস্বপ্ন দেখো তাই না? রাতের বেলা স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলে মনের কষ্টগুলো আকাশে ছড়িয়ে দিও। আমি ঠিক ঠিক সেগুলা খুঁজে নিয়ে নিজের কাছে জমিয়ে রাখব।”
– তোমার অপূর্ব
আমার এবার আগের মতো অবাক লাগলো না। মনে হলো এটা যেন পাওয়ারই ছিল। মানুষটা কে জানার প্রয়োজন নেই। সে থাকুক পাশে।
কয়েকদিন পর আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার লেখা আত্মিক উন্নতি সম্পর্কিত “প্রভা” নামের একটা ছোট প্রবন্ধ পত্রিকায় ছাপা হলো। কাজটা মৃন্ময় স্যার করেছেন। আমি স্যারকে ফোন করলাম। স্যার বললেন,
“কেমন সারপ্রাইজ দিলাম?”
“ভয়ানক! কিন্তু আপনি এটা কেন করলেন?”
“অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম পাঠাবো। তোমার লেখা আগের তুলনায় বেশ পরিপক্ক হয়েছে। এটাই তো সময়। আরো বেশি করে লেখো। সবাই চিনুক তোমাকে।”
“কিন্তু স্যার কেমন যেন লাগে। আমি তো এমনি লিখি…”
“যা লেখ, সেসব দেশের মানুষের পড়ার অধিকার আছে। প্রতিভা শুধু নিজের মধ্যে কেন রাখবে? ছড়িয়ে দাও সবার মাঝে। তাছাড়া তুমি তো বলেছিলে পৃথিবীর জন্য কিছু করতে চাও।”
“জি স্যার।”
“তাহলে এটাই তো সুযোগ। কলমের কত শক্তি তা নিশ্চয়ই জানো।”
“আমি কি পারব?”
“অবশ্যই পারবে মেয়ে। তুমিই পারবে।”
লেখা ছাপা হওয়ার ঠিক দু’দিন পর আবার চিঠি-
“লেখাটা পড়লাম। তুমি এত ভালো লিখতে কবে শিখলে? কথাই তো গুছিয়ে বলতে পারো না। অপেক্ষায় রইলাম পরের লেখার। ভালোবাসা নিও।”
– তোমার অপূর্ব
আমি অবসময় সময়গুলোতে আরও কয়েকটা লেখা লিখলাম। স্যারের কাছে সবগুলো পাঠিয়ে দেই। স্যার তার পছন্দমতো লেখা পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দেয়। কিছুদিন পর আবার পত্রিকায় ছাপা হলো আমার নতুন লেখা। এবারেরটা মনস্তাত্বিক ছোটগল্প৷ নাম ‘কাকের কুঁড়ে’। এটা বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেল। তার কিছুদিন পর আরেকটা- নাম ‘সুগন্ধী’।
এই দুটো গল্প ছাপা হওয়ার কিছুদিন পর একটা খুব প্রচলিত ম্যাগাজিনের সম্পাদক স্যারের সাথে যোগাযোগ করলেন৷ তাদের মাসিক পত্রিকার জন্য নিয়মিত লিখতে। আমি লোভীর মতো প্রস্তাবটা নিয়ে নিলাম। লেখালেখিটা এবার খুব জোর দিয়ে শুরু করলাম।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু