#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব-১৪
বাবা আমাকে দেখতে এসে কেঁদে ফেললেন। অনেকক্ষণ মুখ লুকিয়ে কাঁদলেন। আমিও কাঁদলাম মাথা নিচু করে। এই কান্ডের পর তার সাথে চোখ মেলাব কী করে? বাবা সময় নিয়ে স্থির হয়ে বসে বললেন, “তোর সাথে যা হয়েছে সেসব আমার জন্য। তোর ওই বিয়েটা দেয়াই উচিত হয়নি। ওই জোচ্চোর ফ্যামিলির সাথে সম্পর্ক করেই ভুল করেছি। ছেলেটা এত ভালো ভালো কথা বলল যে ভুলে গেলাম একেবারে। ও যে এরকম হবে ভাবিনি আমি..”
“বাবা তোমার কোনো দোষ নেই। আমারই ভুল, আমি লড়াই করার আগেই হেরে বসে আছি। কিন্তু আর হারতে চাই না। আমি আবার বাঁচবো বাবা। ভালোভাবে বাঁচবো।”
বাবার বুকে মাথা রেখে আমি নতুন করে শক্তি পেলাম। অক্সিজেনের সাথে সাথে শুদ্ধ ভালোবাসা ঢুকে গেল মগজে। এইতো এই ভালোবাসার মানুষগুলোই তো বাঁচার অবলম্বন। এদের আঁকড়ে নিয়ে জীবনটা হেসে খেলে কাটিয়ে দেয়া যাবে।
হাসপাতালে আমি রইলাম আরও এক সপ্তাহ। এর মাঝে আরও দু’দিন এলেন মিতা। কিন্তু শোফালী আপা প্রতিদিন এলেন৷ যেদিন আমাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেবে তার আগের দিন শেফালী আপা বললেন, “তোমার কি বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে?”
“জানি না কিছু।”
“বাড়ি গেলে আবার সেই আগের জীবনে ফিরে যাবে। প্রতিদিনের এক রুটিন, এক পরিবেশ! সাময়িক ভালো থাকলেও কিছুদিন পর আবার ডিপ্রেশন তোমাকে ঘিরে ধরবে। তোমার একটা ঝামেলাহীন পরিবেশে সময় কাটানো দরকার। প্রয়োজন নিজেকে নিয়ে ভাবার।”
“কী করব তাহলে আমি?”
“আমার সাথে যাবে? আমার বাড়িতে? তুমি তো জানোই আমি একা থাকি। পরিবারের ঝামেলা নেই। ক’টা দিন আমার বাড়িতে সাচ্ছন্দ্যে কাটাতে পারবে।”
অর্ধপরিচিত একটা মানুষের বাড়িতে গিয়ে থাকাটা অস্বস্তিকর হলেও এই মুহূর্তে আমার প্রস্তাবটা খুব ভালো লাগলো। বাড়িতে যেতে তেমন মন টানছে না। নতুন একটা স্নিগ্ধ পরিবেশের জন্য মন ছটফট করছে। আর তাছাড়া শেফালী আপাও এই কয়েকদিনে অনেক আপন হয়ে গেছেন। তার বাড়িতে থাকতে খারাপ লাগবে না হয়তো। আমি রাজি হয়ে গেলাম। এদিকে অবশ্য বাড়ির মানুষগুলোর জন্যও খারাপ লাগতে লাগলো। খুশবুকে ছাড়া থাকব? বাবা মা ও অস্থির হয়ে আছেন। তবে তাদের বোঝাতে হবে। বোঝাতে হবে নিজেকেও। আমার সময় প্রয়োজন। সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে একটা মুক্ত পরিবেশ, কিছুটা একান্ত সময় দরকার নিজেকে টেনে তোলার জন্য।
.
শেফালী আপার ফ্ল্যাটটা বেশ বড়। সাদা টাইলস, সাদা দেয়াল আর হালকা নীল রঙের পর্দা। ফার্নিচারও সব হালকা রঙের। দশতলার ওপর প্রচুর আলোবাতাস আসে। দুটো ঘরেরই বড় বড় বারান্দা। কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব সর্বত্র।
আমাকে যে ঘরটা দেয়া হলো সেটার পূর্বদিকে বড় জানালা। দক্ষিণে বারান্দা। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ালে অনেকদূর পর্যন্ত চোখে পড়ে। প্রথমেই বড় একটা খেলার মাঠ। তারপর একটা ছোট পুকুর। তার ওপাশে কয়েকটা একতলা বাড়ি৷ তারপর বড় দালান৷ এতখানি খোলা জায়গার কারনে নিঃশ্বাস নিতে পারা যায় বুকভরে।
বারান্দায় একটা রকিং চেয়ারও আছে। সেখানে বসে চোখ বন্ধ করলাম। ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলো। এখনো সুস্থ হইনি পুরোপুরি।
ঘুমিয়ে গেছিলাম। উঠলাম শেফালী আপার ডাকে। আপা চা নাস্তা নিয়ে এসেছেন। ছোট টি টেবিলে খাবার রেখে বেতের চেয়ার টেনে বসলেন। একটা নোনতা বিস্কুট মুখে দিয়ে বললেন, “কেমন লাগলো আমার ছোট্ট বাসা?”
“খুব ভালো। ছোট কোথায়? কত্তো বড়! আমি তো একা থাকতেই পারব না। আপনার একা একা লাগে না?”
“নাহ। অভ্যাস হয়ে গেছে।”
“আপনার পরিবারের বাকিরা কোথায় থাকে?”
“মা, বাবা, ছোট বোন মারা গেছেন রোড এক্সিডেন্টে।”
“ওহ! আর স্বামী?”
“বিয়েই করিনি!”
“কেন?”
“ইচ্ছে হয়নি রে। সারা জীবনেও এমন কাউকে পাইনি যে আমাকে বুঝবে, সাপোর্ট করবে।”
“অসুবিধা হয় না একা থাকতে?”
“তা তো হবেই। আমি নিজের মতো মানিয়ে নিয়েছি। কেউ কিছু বলতে আসলে আমিও ছাড়ি না। আমার কথার জন্যই লোকে সামনে কিছু বলে না। পেছনে বলে, বলুক! জানো, ঠেকে শিখেছি, যারা সামনাসামনি দরদ দেখাতে আসে, আমার ভবিষ্যতের চিন্তায় যাদের রাতে ঘুম হয় না, তাদেরই বিপদের সময় খবর পাওয়া যায় না।”
এক ঝলক হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেল আমাদের। ব্যস্ত শহরের মাঝে উঁচুতে বসে নিরবতায় ডুবে গেলাম দুজনে। অনেক প্রশ্ন এসে মাথায় জমা হতে লাগলো। এলোমেলো চিন্তা, জীবনের অন্যরকম একটা দিকের সাথে নিজের জীবনটাকে মিলিয়ে কেমন একটা হাহাকার সৃষ্টি হলো বুকের মাঝে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কখনো কাউকে ভালোবাসোনি আপা?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে আপা বললেন, “ঠিক ভালোবাসিনি রে। সেই পর্যন্ত যেতেই দেইনি নিজেকে। তবে কখনো কখনো পছন্দ হয়েছে, চোখে লেগেছে। কখনো বা সেটার মাত্রাটা একটু বেশিই ছিল। কিন্তু এগুতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছি বার বার। নিজেকে সামলে ফিরে এসেছি আগের পথে। কাউকে কাউকে ভুলতে কষ্ট হয়েছে, তবে সেসব আবেগকে সংযত করার সামর্থ্য আমার আছে। সংসার সকলকেই করতে হবে এমন কোনো কথা আছে নাকি? এত ঝামেলা আমি নিতে পারব না রে। তারচেয়ে এই বেশ আছি!”
“আসলেই ভালো আছ? কখনো অসুখ হলে, একা একা লাগলে ইচ্ছে করে না কেউ ভালোবাসুক?”
“করে। খুব করে। কিন্তু কী জানিস, কাউকে ভালোবাসতে ভয় হয়। কাছের মানুষ হারানোর যন্ত্রণা নতুন করে সহ্য করার মতো ক্ষমতা নেই। তারচেয়ে একাকিত্ব ঢের ভালো!”
অল্প সময়ের মনখোলা আলাপে আপা আমার ‘তুমি’ হয়ে গেল, আর আমি হয়ে গেলাম ‘তুই’। কতো মানুষ সারাজীবন একসাথে থাকলেও আপন হতে পারে না, কেউ কেউ আপন হয় অতিদ্রুত।
.
আপা অফিসের জন্য বের হয়ে গেলো এগারোটার দিকে। হাফ ডে ছুটি নিয়েছিলো আমার জন্য। আমি একা রয়ে গেলাম।
সেই বারান্দায় ফিরে রকিং চেয়ারে শুয়ে চোখ বন্ধ করলাম। একটা কথাই পেড়াচ্ছে আমায়, সে একটাবারও আমায় দেখতে আসলো না কেন? মা তো খবর দিয়েছিল তাকে। নাকি তার এখন আর গায়ে লাগে না এসব? আমি মরি কি বাঁচি কোনো কেয়ার নেই?
ভাবতে ভাবতে ফোন এলো। অবাক হয়ে দেখলাম অর্নার ফোন।
“কেমন আছ অর্না?”
“ভালো ভাবী। তুমি কেমন আছ?”
“ভালো।”
“তোমার ফোন দুইদিন বন্ধ ছিল কেন? কতবার ট্রাই করলাম। ফেসবুকেও পেলাম না।
“একটু অসুস্থ ছিলাম।”
“কী হয়েছে?”
“তেমন কিছু না। আচ্ছা অর্না তোমার ভাইয়া কোথায়?”
“কোথায় আর, অফিসে।”
“মা?”
“মা বাড়িতেই।”
“তোমার ভাইয়া কি ভালো আছে? মানে কয়েকদিনের মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখেছ?”
“না তো। কেন ভাবী?”
“এমনি। তারপর তোমার খবর বলো।”
“জানো ভাবী সেদিন ভার্সিটিতে…”
অর্নার গল্প করার তেমন কেউ নেই। সে ফোন করলে প্রচুর গল্প করে। আমার জন্য জমিয়ে রাখে অনেক কথা। আমিও আগ্রহ করে শুনি সবসময়। কিন্তু আজ কিচ্ছু মাথায় গেলো না। আমাকে অন্যমনষ্ক দেখে অর্নাও বোধহয় আর কথা বাড়ালো না। রেখে দিল ফোন। আমার মাথায় তখন ঘুরছে অন্য কথা, সে সব জেনেও স্বাভাবিক ছিল! ফোন করব একবার তাকে? না থাক। ভালো থাকুক সে। আমার তাকে আর প্রয়োজন নেই!
.
দু’দিন সময় নিয়ে ভেবে ভেবে আমি কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাকে উঠে দাঁড়াতে হলে সবার আগে এই ফোঁড়াটা কাটতে হবে। তাকে ডিভোর্স দিতে হবে। আমার মতো ঘরকুনো স্বাভাবের অতি আবোগী সাধারণ মেয়ের জন্য সিদ্ধান্তটা সহজ ছিল না। তবে আমার আর উপায় নেই। এতদিন আশায় আশায় ছিলাম, এখন আশার আর কোনো জায়গা নেই। আমার জীবনেরও দাম আছে। তিলে তিলে মরার জন্য পৃথিবীতে আসিনি।
সবার আগে আমি কথাটা শেফালী আপাকেই বললাম।
রাতে খাওয়ার পর আমরা দুজনে বারান্দায় গিয়ে বসি। অনেক গল্প হয়। রাতের বেলা ঢাকা শহরটা অন্যরকম সুন্দর লাগে। ঝাঁঝালো দিনের শেষে আঁধারের স্পর্শে সব অন্যরকম হয়ে যায়। চারপাশে কৃত্রিম আলোরা খেলা করে। আকাশের তারারা দূরের বাড়িগুলোর জানালার টিমটিমে আলোর সাথে এক হয়ে যায়।
আমার কথাটা শুনে আপা খানিক্ষন চুপ থেকে বলল, “তোর মন থেকে ইচ্ছে হলে তুই এটাই কর।”
“কিন্তু আপা আমি ঠিক করছি তো?”
“তোর জীবন। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। নিজের সিদ্ধান্ত যদি ভুলও হয় তবুও ভালো। জীবনে এতটা পস্তাতে হয় না। তবে আমার মতামত চাইলে বলব তুই ঠিকই করছিস।”
“থ্যাংক য়্যু আপা!”
“ওয়েলকাম! চল পার্টি করি।”
“কিসের পার্টি?”
“কিসের আবার? তোর সুবুদ্ধির জন্য!”
“এখন?”
“হু। বস। আমি আসছি।”
আপা দুটো কাচের গ্লাস আর একটা লম্বা বোতল নিয়ে এলো। আমি হা হয়ে গেলাম। “ছি! এটা কী?”
আপা হেসে বলল, “কেন খাবি না।”
“জীবনেও না।”
আপা খিলখিল করে হেসে ফেলল। বলল, “এইটা কোকাকোলা। বোতলটা জোগাড় করেছি এক বন্ধুর থেকে। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে এসব খেতে। তখন মদের বোতলে সফট ড্রিংক খেয়ে পাগলামি করি। ভান করি মাতাল হয়েছি। হি হি।”
“এরকম করলে কী হয়?”
“মজা লাগে। তুই এত বোরিং কেন? নে ধর গ্লাস…চিয়ার্স…”
আমি অবাক হয়ে দেখলাম আপা এক চুমুকে খেয়ে নিল তরলটা। সিনেমাতে দেখা মদ খাওয়ার স্টাইল নকল করে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল৷ তারপর আরেক গ্লাস ঢেলে খেয়ে ঢুলু ঢুলু চোখে তাকিয়ে বলল, “কি সুন্দরী? খাচ্ছ না কেন?”
এরকম বাস্তববাদী একটা মানুষের সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্র দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। আমিও তার মতো চেষ্টা করলাম, কিন্তু হলো না বোধহয়। আমায় দেখে আপা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেল।
রাত বাড়তে থাকলো। দালানগুলোর জানালার আলো একটা একটা করে নিভতে থাকলো। বাতাসের বেগ বেড়েছে। বোধহয় বৃষ্টি হবে রাতে। আপা চুপ হয়ে বসে আছে। কিছুদিন ধরে মনে খচ খচ করতে থাকা একটা প্রশ্ন হঠাৎ করে ফেললাম, “আপা, তুমি আমার জন্য এতকিছু কেন করছ?”
আপা হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছু করে না রে! তুই দেখতে অবিকল আমার ছোট বোনের মতো। আমি নিজের জন্যই তোকে আমার কাছে এনে রেখেছি।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ১৫
শেফালী আপার বাড়িতে দুই সপ্তাহ থাকলাম। অনেক কিছু নতুন করে শিখলাম এর মাঝে। আপা ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল ছুটির চারদিন। অনেক কথা বলেছে, পরামর্শ দিয়েছে, মোটিভেট করেছে। আমার মনটা অনেকটা স্থির হয়েছে এখন। জোয়ারের মতো উথাল পাথাল করে না, শান্ত নদীর মতো নিরব থাকতে পারে।
যেদিন নিজের বাড়িতে ফিরলাম, সেদিন আপা দরজা থেকে বিদায় দিয়ে দিলো। আমি ভেবেছিলাম কাঁদবে হয়তো। আমার নিজেরই কান্না পাচ্ছে। ক’দিনে অনেক আপন হয়ে গেছি যে! কিন্তু সে হাসিমুখে আমায় চলে যেতে দিল। পরে বুঝলাম আপা অমন মানুষই নয় যে আমার সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে দেবে।
আজকের আশাকটা ঝকঝকে নীল। মেঘের দেখা নেই। বাসের জানালা দিয়ে রোদ ঢুকে চোখেমুখে লাগছে। আমি বাইরের কর্মব্যস্ত অজস্র লোককে দেখছি অতি আগ্রহ নিয়ে। সবাই ব্যস্ত। তারা নিশ্চয়ই মনের কষ্ট নিয়ে বসে থাকার সময় পায় না। আমারও ব্যস্ত হতে হবে। সকালবেলা আকাশপানে তাকিয়ে বুকভরে শ্বাস নিয়ে দিন শুরু করব, রাত কাটবে খুশবুকে নিয়ে। কি দারুণ! আহা!
বাড়িতে ঢুকতেই খুশবুকে পেয়ে গেলাম। এতটুকু বাচ্চা কী বোঝে! আমার দেখে কেঁদে আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার মুখে হাত দিয়ে আদর করে দিল যেন! ও’কে রেখে মরতে গেছিলাম কেমন করে?
রাতে মা বাবাকে ডিভোর্সের কথা বলতে তারা বললেন ওর সাথে কথা বলে নিতে। শেষবারের মতো ভালোভাবে জেনে নিতে যে সে ঠিক কী চায়। তারাও কথা বলবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ইদানিং সে কারও ফোন ধরে না। আমার তো না ই, মা বাবারটাও না।
আমি ঠিক করলাম তাদের বাড়িতে যাব। আমার শ্বাশুড়ির সাথেও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। তাকে একবার দেখেও আসা হবে।
শেষবারের মতো শ্বাশুরবাড়িতে যাওয়ার জন্য গোছগাছ করে নিলাম। বড়সড় একটা ব্যাগ হলো। ঝিনু চোখ বড় করে বলল, “তুই চলে যাচ্ছিস শ্বশুরবাড়ি? এই না বললি ছাড়াছাড়ি করে নিবি?”
“ছাড়াছাড়ি হলে ভালো হবে?”
“একটুও না।”
“কেন?”
“ভাইয়া অনেক ভালো মানুষ।”
“ভালো মানুষ হলে কষ্ট দেয় কেন?”
“তুই-ই ভাইয়ার সাথে থাকতে পারিসনি। ভাইয়া তোর চেয়ে অনেক ভালো।”
আমি ঝিনুর কথা শুনে অবাক হয়ো রয়ে গেলাম। নিজের বোনের চেয়ে বোনের বরের জন্য বেশি দরদ তার!
ঝিনু আবার বলল, “তুই কি একেবারে যাচ্ছিস? এত বড় ব্যাগ কেন?”
“ওদের বাড়ির দেয়া সবকিছু ফেরত দিতে যাচ্ছি।”
ঝিনু একটু হতাশ হয়ে বলল, “ভাইয়ার সাথে আরেকটু কথা বল। ও তোকে অনেক ভালোবাসে।”
“তোর ইচ্ছে হলে তুই কথা বল। এখন আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ!”
ঝিনু তার বেনী দুলিয়ে চলে যেতে যেতে বলল, “তাহলে আমি বলি, আমাকে বিয়ে করে নিক।”
“যা বল।”
“তোর শ্বাশুড়িটা মরলে আমি সত্যি বিয়ে করতাম।”
“ঝিনু!”
“আপি আমি মজা করতেছি। সব তো তোর শ্বাশুড়ির কারসাজি। ওইটা না থাকলে তোর সংসারটা ঠিকই টিকে যেতো।”
ওবাড়ি থেকে যা যা দেয়া হয়েছিলো সব নিয়েছি৷ গয়নাগাটি, শাড়ি, জামাকারপড়। শুধু একটা জিনিস- তার এনগেজমেন্টের আগে দেয়া দাদীর আংটিটা। সেদিনের পর থেকে একবারও খুলিনি বলে হাত থেকে খুলছে না৷ কসরত করলে হয়তো খুলবে, কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে না। থাক না একটা চিহ্ন। কী আর হবে তাতে! বুকের ভেতর মস্ত এক ক্ষত তো থেকেই যাচ্ছে।
আসলে কিছু কাটা চাইলেও উপড়ে ফেলা যায় না। কিছু জিনিস ভুলে যেতে হলে মৃত্যু ছাড়া উপায় নয়। বেঁচে থাকতে হলে সেই স্মৃতি নিয়েই বাঁচতে হবে, তা সে যত দুঃখই দিক না কেন।
.
শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়ে মনে হলো বুঝি একটু আগেই বেরিয়েছিলাম কোথাও। কাজ সেরে ফিরছি। যেভারে দেখে গিয়েছিলাম, সব তেমন। মালী বাগানে পানি দিচ্ছে, সুমনা বুয়া ঘর মুছছে, নজর আলী বাজার থেকে ফিরে সবজিগুলো তুলে রাখছে।
ঢুকে শুনলাম শ্বাশুড়ি মা বাড়িতে নেই। এই সাত সকালে কোথায় গেছেন কেউ জানে না। আমি হঠাৎ কেন এসেছি কেউ জিজ্ঞেস করলো না। এবাড়ির কর্মচারীদের বাড়ির লোকের বিষয়ে নাক গলানো নিষেধ। সবাই অবাক হলো, কেউ কেউ খুশি। ভাবছে হয়তো চলে এসেছি।
আমার ঘরটা আমায় ডাকছে। আমি নিজের অজান্তেই সেদিকে পা বাড়ালাম৷ অনেকগুলো দিন তো ছিলাম এখানে।
ঘরে ঢুকে একটা ধাক্কা খেলাম। আমার জিনিসগুলো সব তেমনই আছে। ড্রেসিং টেবিলের ওপর পাউডার, ক্রিম, পারফিউমের বোতল, কসমেটিকস সব। আলমারির অর্ধেক অংশে আমার শাড়িগুলো আগের মতো গুছিয়ে রাখা।
বই নিয়ে প্রথম প্রথম অনেক ঝগড়া হতো তার সাথে। দেখা যেতো বই কেনার পর সেটা কার তা নিয়ে যুদ্ধ। আবার আমি যেটা পড়ছি, সেও সেটা পড়ছে। কেউ কাউকে পড়তে দিচ্ছি না। তাই সে একটা বুকশেলফ বানিয়ে এনেছিলো। যার একটা অংশে আমার নাম খোদাই করা, অপর অংশে তার। যার যার পার্টে তার তার বই থাকবে। যে আরেকজনের বই নিয়ে পড়বে, সে একটা চিরকুট লিখে শেলফে জমা দিয়ে রাখবে। ছেলেমানুষী ব্যাপারগুলো বেশ মজার ছিল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমার অংশে অনেকগুলো চিরকুট জমে আছে। তারিখগুলো এই কয়েক মাসের। সে কার জন্য এগুলো লিখেছে? আমার জন্য? সে কি আশা করে আমি ফিরে আসব? কেন করে? ভালোবাসে বলে? উফ! মাথা ধরে আসে ভাবতে গেলে। বুকে বিশ্রী ব্যথা হয়!
এবার আমার ভয়ানক এক ইচ্ছে হলো। থেকে যাই এখানে। যা হয় হবে, যে যা খুশি বলবে। আমি দিনশেষে তার মুখটা দেখতে পাব। তার বুকে মুখ গুঁজে ঘুমাতে পারব রাতে। আমার ইমসমনিয়া রোগটা সেরে যাবে।
ঘুমের কথা ভাবতেই ঘুম পেলো। কাল সারারাতও একটু ঘুম হয়নি। এই বিছানায় তার গায়ের গন্ধ লেপ্টে আছে। আমি কি একটু শোব? ভাবতে ভাবতে শুয়েই পড়লাম। বহুদিন পর নাকে এসে লাগলো রজনীগন্ধার মতো সুবাস! আমি কখন ঘুমিয়েছি নিজেও জানি না।
ঘুম ভাঙলে দেখি শ্বাশুড়ি মা আমার দিকে বড় চোখ করে তাকিয়ে আছেন। আমি ঝট করে উঠে বসলাম। বহুদিন পর এমনভাবে তাকে দেখে আমার বুক কাঁপতে থাকলো। উনি আগের মতোই আছেন। তবে চোখের দৃষ্টি বুঝি ধারালো হয়েছে আগের তুলনায়।
খানিক বাঁকা হাসি দিয়ে উনি বললেন, “কেমন আছ?”
“ভালো।”
“দেখে তো ভালো মনে হয় না। শুকিয়ে পাটকাটির মতো হয়ে গেছ। খাও না নাকি?”
উনি আমার জবাবের অপেক্ষা না করে গৃহকর্মী মনসুরাকে ডাকলেন। মনসুরা যেন দরজার ওপাশেই ছিল। ডাক শুনে ভেতরে এলো।
উনি বললেন, “যা ভাবীর জন্য ফলের জুস নিয়ে আয়।”
আমি ঢোক গিললাম। এটা কোন নাটক আবার? উনি এবার জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মা বাবা কেমন আছেন?”
“ভালো।”
“শুনেছি তোমার ভাবী মারা গেছেন৷ আহারে কত কম বয়স মেয়েটার! ওর বাচ্চাটা নাকি তুমিই পালছো?”
“হ্যাঁ।”
“এখানে যে চলে এলে, বাচ্চাটার কী হবে?”
আমি জবাব দিলাম না। দেখা যাক কী করে। মনসুরা ততক্ষণে কয়েক রকমের ফলের জুস নিয়ে এসেছে। শ্বাশুড়ি মা ট্রেটা নিজের হাতে আমার সামনে রাখলেন। একটা গ্লাস হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “নাও৷ খেয়ে নাও।”
আমি গ্লাস হাতে বসে রইলাম। উনি বললেন, “এরপরের বার সুইসাইড করতে গেলে ঘুমের ঔষধ খাবা। মরার যন্ত্রণা কম হবে। এইযে বোকামি করে রক্ত ঝরালে, রক্ত যা বেরিয়েছে সেসব তো পূরণ করা দরকার এখন। বেশি করে খেও কিন্তু।”
কথা শুনে আমার হাত থেকে ছলকে কিছুটা জুস বিছানায় পড়ে গেল। উনি এবার কৌতুকের সুরে বললেন, “তোমার অবশ্য জুস খেতে হবে না। চীনা জোঁক চেন? তুমি হচ্ছো তেমন। সেই কতদিন ধরে জোঁকের মতো লেগে আছ, আর রক্ত চুষে যাচ্ছো! কেন বাপু, আমার ছেলেকে ছেড়ে দিলে তোমারও শান্তি, আমাদেরও। ভেবেছিলাম তুমি ফিরবে না। নোরার বিয়ে অন্য কোথাও ঠিক হওয়ার আগে আমিই ওকে রেখে দিতাম! সে আর হলো কই। তা তোমায় আমার ছেলে বলেকয়ে এনেছে না নিজেই এসেছ?”
আমি এবার উঠে স্যুটকেসটা নিয়ে এলাম। তার সামনেই সেটা খুলে সব জিনিস বুঝিয়ে দিয়ে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম, “আমি এসেছি আপনাদের দেয়া জিনিসগুলো ফেরত দিতে। আর আপনাকে শেষবারের মতো দেখে যেতে। আপনার ছেলেকে আমি খুব শীঘ্রই ডিভোর্স দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, মরার উপায়ের আর দরকার নেই। আপনার সাথে থাকলে অবশ্য ভিন্ন কথা ছিল! কিছুদিন পর দেখা যেতো সত্যি ঘুমের ঔষধ খেয়ে মরে আছি। তখন ঔষধটাও আপনিই যুগিয়ে দিতেন। যাহোক, ভালো থাকবেন। আশা করব আর কখনো যেন দেখা না হয়।”
.
বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছুদূর গিয়ে বাস ধরতে হয়। রাস্তায় হঠাৎ নোরার সাথে দেখা। সে আমায় দেখেই দৌড়ে এলো। হাত ধরে গালে হাত দিয়ে বলল, “কেমন আছ তুমি?”
“এইতো। তুমি ভালো আছ?”
“হুম।”
আমার প্রথমবার খুব হিংসে হলো ওকে দেখে। কি ফুরফুরে আছে সে! চুলগুলো ঝিলমিল করছে, চোখে দীপ্তি আর সদা প্রফুল্ল থাকা!আর আমি এদিকে আধমরা হয়ে বেঁচে আছি। আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, “চলি।”
সে টেনে ধরে বলল, “তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
আমি হাতটা আবারও ছাড়িয়ে নিয়ে স্মিত হেসে বললাম, “আমি কিছুই শুনতে চাই না। তুমি ভালো থেকো নোরা। ওকে ভালো রেখো।”
নোরার অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে চলে এলাম সামনে থেকে। আমার কথায় এমন কিছু ছিল, সে আর কিছু বলতেও পারলো না।
.
পরের সপ্তাহে উকিলের সাথে কথা বলে ডিভোসের নোটিশ পাঠিয়ে দিলাম তার কাছে। এর মাঝে সে ফোন করেনি একবারও। সেদিনের এত কান্ড দেখেশুনেও সে কেমন করে চুপ আছে মাথায় ঢোকে না। তার সাথে একবার দেখা করা দরকার। খোলাখুলি কথা বলতে হবে। সে কি সারাজীবন আমার জন্য দুর্বোধ্য চরিত্র হয়েই থাকবে? যে প্রতিদিন নতুন নতুন রঙে দেখা দেয়?
অর্নার সাথে কথা হয় প্রায়ই। ওকে ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে সবসময়ই বলে ভালো আছে, ঠিক আছে। ডিভোর্স লেটার পাওয়ার পর অর্না ফোন করে কান্নাকাটি করলো। জানালো, তার ভাই কাগজটা পাওয়ার পরপরই ছিঁড়ে সোজা ডাস্টবিনে ফেলেছে। মানে কী এসবের?
আমি তারপর তার অফিসে গেলাম। সে মিটিং এ ছিল। বের হয়েই আমার সামনে পড়ে গেল। আমি এতদিন পর তাকে দেখে একটা হার্টবিট মিস করলাম! ফরমাল ড্রেস, চুলগুলো জেল দিয়ে পেছনের দিকে আচড়ানো, জ্বলজ্বলে চোখদুটো আর ব্যস্ত ভঙ্গি! আমি চোখ সরিয়ে ফেলতে চেয়েও পারলাম না। তাকিয়ে রইলাম। সে ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল। সামলে নিয়ে বলল, “রুমে এসো।”
আমি তার সাথে গেলাম। রুমের একপাশে সোফাসেটে নিয়ে বসালো আমায়। অনেকক্ষণ কেটে গেল। কী বলব নিজেও জানি না। সব কথা গুলিয়ে গেছে। কী জিজ্ঞেস করব ভেবে পেলাম না। বলতে গেলে তো অনেক কিছুই বলতে হয়। সেই প্রথম বলল, “ডিভোর্স চাও?”
আমার ইচ্ছে হলো চিৎকার করি। তার কলার চেপে বলি, স্বার্থপর কোথাকার! আমি ডিভোর্স দিতে চেয়েছি? তুমি বাধ্য করেছ। কেন করলে আমার সাথে এমন? একটুও মায়া হয় না তোমার?”
বলতে পারলাম না। বললাম, “তুমি কী চাও সেটা পরিষ্কার করে বললে ভালো হয়।”
সে বলল, “আমি চাই তুমি ভালো থাকো।”
আমার খুব হাসি পেলো। হেসে ফেলে বললাম, “সিরিয়াসলি! হাসালে সত্যি।”
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফা থেকে নেমে মেঝেতে বসে পড়ল। শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “জানো তো, সীতাকে যখন বনবাসে পাঠিয়ে দিলো তখন রামের কিছু করার ছিল না। সে তো জানতো সীতা নির্দোষ। কিন্তু তার সত্যি উপায় ছিল না তখন।”
আমি এবার রেগে গিয়ে বললাম, “ফাজলামি কথাবার্তা বলবা না। রাম সীতা আসে কোথা থেকে? আমি কোন দেশী সীতা আর তুমি কিসের রাম? তুমি হচ্ছো মায়ের বাধ্য বাচ্চা। যে তার কথায় উঠবা, বসবা। নিজের মেরুদন্ড তোমার মা হতেই দেয় নাই। পাবা কোথায়! কিছু করার নাই তো ডিভোর্স দাও৷ জাস্ট সাইন করে উকিলের সাথে কথা বললেই শেষ। মুক্তি দিয়ে দাও। ঝুলিয়ে রাখবা কতদিন?”
“তুমি কি বিয়ে করতে চাও আবার?”
“ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়।”
“তাহলে ডিভোর্সের কী জরুরি দরকার? এমনিতেই থাকো না।”
“তুমি তো বিয়ে করবে। দিয়ে দিলে তোমারই ভালো।”
“আমারটা আমি বুঝি প্লিজ? তুমি এ বিষয়ে কথা বাড়িও না। তোমার যা ইচ্ছে হয় তুমি করো। শুধু এই কাজটা করতে বলো না।”
আমি আর দাঁড়ালাম না। চলে এলাম। কেন তার সাথে মতের মিল হয় না? কেন সে এমন করে? পারতো তো আজও একবার আমাকে বলতে, বাড়ি ফিরে চলো। আবার সব ভুলে একসাথে থাকি। বলল না তো! না বলুক। আমি আর যাব না তার কাছে। সম্পর্কও রাখব না। ঠিকই বলেছে সে। লিখিত ছাড়াছাড়ির সার্টিফিকেট দিয়েই বা আমি কী করব? তার মায়ের চাপে সময় হলে সে নিজেই আমায় মুক্তি দেবে!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু