#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ১২
বাবুর সাতদিনের দিন ওর আকীকা দেয়া হলো। বাবা মা ভালো নাম রাখলেন। আমি নাম দিলাম খুশবু৷
তবে তাকে আমি মনে মনে অভাগী ডাকি। মা’কে তো হারিয়েছেই, বাবা এই পর্যন্ত ওর মুখ দেখেনি। যার জন্য প্রিয়তমাকে হারিয়েছে তাকে সে মানবে না কিছুতেই। কতো বোঝানোর চেষ্টা করেছি ভাইয়াকে! সে কিছুতেই খুশবুকে কোলে নেবে না। চেয়েই দেখে না! দেখলে নিশ্চিত মায়া হবে। চোখদুটো যে একেবারে ভাবীর মতো হয়েছে!
আমি ভাবি, ভাইয়া কতো ভালোবাসে ভাবীকে। ভাবীর সাথে যা হয়েছে সেটা আমার সাথে হলেই বরং আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষ খুশি হতো। সে ও হয়তো খুশি হতো। এর মাঝে সে আমাকে ফোন পর্যন্ত করেনি। মা’কে নাকি করে। আমি কোন দোষ করেছি যে কথাই বলা যাবে না। সদ্য সন্তান হারানো মায়ের কষ্ট কি সে জানে না? তার কি আমার প্রতি কোনো মায়া অবশিষ্ট নেই?
আকীকার দিন সারাদিন কাজ করে বিকেলে গোসল করতে গেলাম। খুশবু ঘুমাচ্ছিলো। আমার ঘরেই থাকে ও। এখানে দোলনা টানানো হয়েছে।
গোসল করে বের হয়ে দেখি সে বসে আছে খাটে। তার কোলে খুশবু। মেয়েটা মিটমিট করে হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। ও ও মেয়েটার সাথে আপনমনে খেলছে। আমি চোখের জল অনেক কষ্টে সংবরন করে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। সে বোধহয় কড়া মেজাজ নিয়ে এসেছিলো। খুশবুকে পেয়ে গলে গেছে। শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “বসো।”
আমি তার থেকে একটু দূরে বসলাম। বললাম, “হঠাৎ এলে যে? কী মনে করে?”
“মা আসতে বলেছিলেন অনেকবার করে।”
“তাই এসেছ? ভালো তো!”
“হুম। কেমন আছ?”
“তা জেনে কী করবে? তুমি ভালো আছ তো?”
“দেখে ভালো মনে হয়?”
“জানি না।”
“মা বললেন পেটে নাকি ব্যথা হয় এখনো?”
“হলে তুমি কী করবে?”
“এভাবে কথা বলছ কেন?”
আমার প্রচুর রাগ উঠলো। ন্যাকা সাজছে কেন এখন? জোরেই বললাম, “তুমি এমন করে কথা বলছ কেন? ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমার জন্য চিন্তায় মারা যাচ্ছো! এদিকে আমি মরি না বাঁচি সে খবর একবারও নেয়ার চেষ্টা করোনি?”
“কে বলেছে করিনি?”
“তাই বুঝি? কবে খবর নিলে?”
“মা’কে আমি প্রতিদিন ফোন করেছি।”
“আর আমাকে?”
সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “সত্যি বলব?”
“হ্যাঁ বলো।”
“ইচ্ছে হয়নি।”
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। হা করে চেয়ে রইলাম তার দিকে। সে এটা বলতে পারলো? এমন আচমকা চেঁচামেচি আবার সব নিরব হয়ে যাওয়ায় খুশবু বোধহয় ভয় পেয়ে তারস্বরে চিৎকার করে উঠলো। আমি তাকে কোলে নিয়ে কান্না থামাতে পারলাম না। নিজেরই মাথা আগুন হয়ে আছে, বাচ্চা কী করে সামলাবো? ছোট ভাবী কান্না শুনে এসে খুশবুকে নিয়ে গেলেন।
সে বলল, “কেন ইচ্ছে হয়নি শুনবে না?”
আমি চুপ করে রইলাম।
সে বলল, “তোমার প্রতি প্রচন্ড রাগ হয়েছিলো। তুমি কি কখনো আমার দিকটা ভেবে দেখেছ? শুধু নিজের মতো ঘটনাগুলো দেখে গেলে তো হবে না তাই না?
তুমি নিজের খেয়াল রাখতে পারোনি। যার ফলে বাচ্চাটা হারিয়েছ!”
তার গলা ধরে এলো। সে একটু চুপ থেকে বলল, “ওকে ঘিরে শুধু তোমার না, আমারও অনেক স্বপ্ন ছিল। যেদিন শুনলাম খবরটা, আমার পায়ের নিচ থেকে মনে হয়েছিলো মাটি সরে গেছে।
আমি তো তোমাকে দেখতে গিয়েছিলাম। তুমি সুস্থ ছিলে মোটামুটি। জ্ঞান ফেরার পর তোমার সাথে কথা বলতে আমার ইচ্ছে হয়নি। মনে হয়েছে তুমি আমার বাচ্চার খুনি।”
আমি হেসে বললাম, “আর কিছু?”
সে বলল, “শেষ কথাটা তখন মনে হয়েছিলো। এখন মনে হয় না। আমি তোমার দিকটাও বুঝি। তোমাকে কষ্ট দিতে আমার নিজেরও অনেক কষ্ট লাগে। আমি কী করব বলো? আমার নিজেরও একটা ভালোলাগা, মন্দলাগা, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে নাকি?”
“তোমাকে আমি কিছুই দিতে পারিনি তাই না?”
“সেটা কথা না। সমস্যা হলো তুমি আমাকে বোঝার চেষ্টাই করোনি কখনো। সিলেটে থাকাকালীন আমি তোমাকে বলেছিলাম আমাকে ভুল বুঝো না। অথচ তুমি আমাকে প্রতি পদে ভুল বুঝে গেছ। আমি তোমার কাছ থেকে এমনটা আশা করিনি।
আমি আমার ফ্যামিলির প্রত্যেকটা মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছি। তোমার জন্য দিনের পর দিন তাদের কথা শুনতে হয়েছে আমাকে। তোমাকে আমি আভাসও পেতে দেইনি। তোমার কাছে শুধু এতটুকুই চাওয়ার ছিলো, আমার মান সম্মানটা রক্ষা করা। আমি যে বড় মুখ করে তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম সেই মুখটা বজায় রাখা। কিন্তু তুমি সেরকম কোনো চেষ্টাই করোনি। উল্টে ভুল করে গেছ, ভুল বুঝে গেছ।”
“আমি ভুল বুঝিনি, তোমার মা তোমাকে ভুল বোঝাচ্ছে।”
“আমার মা’কে নিয়ে আর একটি কথাও বলবে না। মা তোমার জন্য শেষবার কী কী করেছে মনে নেই তোমার?”
“আছে। সেসব তার নিজের জন্য। তার নাতি নাতনির জন্য ছিল। যখন আমার বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেল, তার চেহারাটাও বেরিয়ে এল। আমার খবরও উনি নেননি। একটা ফোনও করেননি, দেখতে আসা তো দূরে থাক।”
ও যেন একবোঝা কষ্ট নিয়ে আমার দিকে তাকালো। বলল, “তুমি জানো, মা খবরটা শোনার পর স্ট্রোক করেছেন? উনি আজ সকালে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।”
আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল! হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। আমি কোনোমতে বললাম, “আমি জানতাম না।”
“আমিই তোমাকে জানাতে নিষেধ করেছিলাম।”
আমি ওর কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বললাম, “মা কেমন আছেন এখন?”
“মোটামুটি।”
“আমি যাব মা’কে দেখতে।”
সে কঠিন গলায় বলল, “না৷ তোমাকে এখন মায়ের কাছে নেয়া যাবে না।”
“কেন?”
“তোমাকে দেখলে মা আরও এক্সাইটেড হয়ে পড়বে। তাকে এখন বিশ্রাম নিতে হবে। কোনোভাবে প্রেশার দেয়া যাবে না। এ যাত্রায় বেঁচে গেলেও পরেরবার আর বাঁচবেন না।”
আমি কেঁদে ফেললাম। তার চোখদুটো লাল টকটকে হয়ে গেছে। সে বলল, “তুমি বলতে পারো এই অবস্থায় আমি কী করতাম? কোনদিকে যেতাম? কার কাছে থাকতাম?”
আমি তার হাতদুটো ধরে আমার কপালে ঠেকিয়ে বললাম, “তুমি আমাকে মাফ করে দিও।”
সে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। অনেকক্ষণ ধরে রাখলো। বলল, “আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার প্রতিটা মুহূর্ত কষ্ট হয়। আমার যেদিন সাধ্য হবে তোমাকে নিজের কাছে রাখার, সেদিন তোমাকে নিয়ে যাব। ততদিন এবাড়িতেই কষ্ট করে থাকো প্লিজ।”
সে আমাকে ছেড়ে আমার হাতে, কপালে, গলায় চুমু খেয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তারপর সোজা বাগান পেরিয়ে গাড়িতে উঠে গেল। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম।
অভাগীটা কাঁদছে। ছোট ভাবী ও’কে নিয়ে এসে আমার কোলে দিয়ে বলল, “আমাদের কারো কাছে থামলোই না। তুমি চেষ্টা করো তো।”
আমি কোলে নিতেই অভাগী চুপ হয়ে গেলো। হাত দিয়ে আমার গাল ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। আমি ওর নাকে নাক ঘঁষে বললাম, “তুই আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন রে। তোকে আমি অনেক যত্নে মানুষ করব দেখিস। মা বাবা কারো কথা মনেই করতে দেব না।”
অভাগী কাঁদলো না আর। তার চোখ দিয়ে জমে থাকা পানি গড়িয়ে পড়লো। আমিও তার শরীরে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকলাম। এ কান্না কত যন্ত্রণার সেটা কেউ কোনোদিন বুঝবে না।
.
খুশবুর দুই মাসের সময় আমি অনেকদিন পর কলেজে গেলাম। ফার্স্ট ইয়ার শেষ হয়েছে শুধু। সেকেন্ড ইয়ারে কয়েকদিন ক্লাস করেছি, ফাইনাল দেইনি। মাঝখানে প্রায় দুই বছরের মতো গ্যাপ হয়ে গেছে। নতুন করে সব ঠিক করে ভর্তি হয়ে এলাম। আবার পড়াশুনা শুরু করতে হবে৷ এভাবে চলবে না। পড়াশুনার সাথে সাথে অন্য সব কিছুতে মনোযোগ দিলাম। যেসব আমি করতে পারি না সেগুলো শিখতে শুরু করলাম।
একটা কম্পিউটার কোর্স আর হাতের কাজ শেখার কোর্সে ভর্তি হলাম। কলেজে ক্লাস তেমন থাকে না৷ আমি নোটগুলো জোগাড় করে বাড়িতে পড়া শুরু করলাম। আর সপ্তাহে তিনদিন করে কোচিং ক্লাস করতে যেতে শুরু করলাম।
এর মাঝে ফেসবুকে এক আপার সাথে খুব ভাব হয়ে গেলো। শেফালী আপা। মেসেঞ্জারে কল করে একদিন আমার সব কথা খুলে বললাম তাকে। উনি আমাকে সান্ত্বনা দিলেন, বোঝালেন অনেক কিছু। আর এগিয়ে যেতে অনেকটা শক্তি যোগালেন।
সময় ভালোই কেটে যেতে থাকলো। আপাতদৃষ্টিতে ভালো যাকে বলে। মনের ভেতরটা কতো পোড়ে তা কেউ দেখে না। আমার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া নিয়ে ছোট ভাবী মাঝে মাঝে কথা শোনালোও আর কেউ কিছুই বলে না। তারা ছেড়ে দিয়েছে সব অদৃষ্টের হাতে। যা হওয়ার হবেই। বড় ভাবী মারা যাওয়ার পর বাবা অসুস্থই থাকেন বেশিরভাগ সময়। ভাইয়ারও অবস্থা যাচ্ছেতাই। অফিসে যায়, রাত করে বাড়ি ফেরে। ভালো করে কথা বলে না কারো সাথে। স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হয়েছে সে। এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে কত সময় নেবে আল্লাহ-ই জানেন।
আমার মন সবসময়ই অশান্ত থাকে। মনে হয় কিছু করা দরকার যেটা পারছি না, যেটা হওয়া দরকার সেটা হচ্ছে না। মাঝে মাঝে অর্না ফোন করে আমাকে। কান্নাকাটি করে। ওবাড়িতে ফিরতেও বলে কখনো সখনো। তবে জোর দিয়ে বলে না। শ্বাশুড়ি মা নাকি বলে দিয়েছেন আমার মুখদর্শন করতে চান না।
ও কখনো হঠাৎ একবার আসে। আধঘন্টার মতো থেকে চলে যায়।
ওরও সেই করুন অবস্থা। সব থেকেও নেই। আমার কাছে তবু সুখের একটা উপাদান আছে- খুশবু। ওর তাও নেই। একাকী রাতগুলো কী করে কাটায় সে? ঘুম হয়? আমার তো হয় না। মোবাইল হাতে রোজ রাতে কতবার ভাবি তাকে ফোন করব। করা হয়ে ওঠে না। সব খাপছাড়া এলোমেলো হয়ে গেছে। উচ্ছল প্রেমের সময়গুলোর মতো এখন আর অনেক কথা জমে থাকে না। ফোন করলেও কয়েক মিনিট কথার পর আর কথা থাকে না। অধিকারের কথা, ভালোবাসার কথা, কষ্টের কথা গলায় আটকে আসে। বলতে পারি না।
.
শীতের শেষভাগ। হালকা গরম পড়ে গেছে। আমি বাইরে থেকে এসে হাত মুখ ধুয়ে মায়ের কাছ থেকে খুশবুকে নিয়ে এলাম। বিকেলবেলা তখন। ছাদে মিষ্টি রোদ উঁচু গাছের মাথায় ঝুলে আছে। ঝিনু কয়েকটা কবুতর পালতে শুরু করেছে ছাদে। মনে হলো একটু গিয়ে বসে থাকি ছাদে। ভালো লাগবে হয়তো। আমি খুশবুকে কোলে নিয়ে ওঠার হঠাৎ পা পিছলে গেল। পানি ছিল না কী কে জানে! আমিও পড়ে গেলাম, খুশবু আমার ওপর পড়লো। চিৎকার করে উঠলাম দুজনেই। মা, বাবা, ভাবী ছুটে এলেন।
আমি কোমরে ব্যথা পেয়েছি, খুশবুর তেমন কিছু হয়নি। তবে সে ভয় পেয়েছে ভীষণ। এমন কান্না যে আর থামেই না। বাড়ির সবাই কতো চেষ্টা করলেন কান্না থামাতে। শেষে রাতে বাবা মসজিদের হুজুরের কাছে নিয়ে গেলেন। উনি দোয়া পড়ে ফু দেয়ার পর একটু ঠান্ডা হয়েছে মেয়েটা। বাবা যখন খুশবুকে নিয়ে ফিরলেন, আমি কোলে নিতে চাইলাম ওকে। মা নিতে দিলেন না। নিজে কেড়ে নিয়ে গেলেন। বললেন, “তোর ওকে রাখতে হবে না। আজকে থেকে ওর কাছেও আসবি না। তোর সাথে থাকলে এই মেয়েও জানি কখন মরবে!”
আমি কিচ্ছু বললাম না। চুপ করে চলে এলাম নিজের ঘরে। অন্ধকারে শুয়ে রইলাম একা। ঝিনু পড়াশুনা শেষ করে এসে শুয়ে পড়লো। আমি গভীর রাত পর্যন্ত জেগে রইলাম। ঘড়ি যখন তিনটার কাটা ছুঁই ছুঁই, তখন নিঃশব্দে উঠে গিয়ে একটা ব্লেড নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম। ভেবে দেখেছি, আমার কাছের মানুষগুলো শুধু কষ্টই পেয়ে যায়। আমার অস্তিত্ব না থাকলে অনেক মানুষের জীবন নতুন করে শুরু হতে পারে। এই অপয়া জীবন রেখে কী লাভ?
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ১৩
ঘোরের মাথায় হাতের কব্জি ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে ফেললাম। অবাক হয়ে নিজেই তাকিয়ে রইলাম বিন্দু বিন্দু থেকে আস্তে আস্তে হওয়া রক্তের বন্যার দিকে। আমি এই কাজ করলাম? আমি তো একফোঁটা রক্ত দেখলেই কেঁদে ফেলতাম! এখন দেখো, আমি কাঁদছি না।
মাথা ঘুরছে। আমি কি মারা যাচ্ছি? চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো। আমার ভীষণ ইচ্ছে হলো একবার খুশবুকে দেখতে, একবার মাকে দেখতে, ওকে দেখতে…মারা গেলে ওদের কি আর কোনোদিন দেখতে পাব না? আমি কি জাহান্নামে যাব? আত্মহত্যা করলে তো সবাই জাহান্নামেই যায়…আমি মরতে চাই না। কষ্ট পেলেও বাঁচতে চাই। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে গেছে। আমি দরজা খোলার চেষ্টা করলাম, শরীরে শক্তি নেই। ধাক্কা দেয়ারও শক্তি নেই…
প্রচন্ড তৃষ্ণা, ভয়, অস্বস্তি আর যন্ত্রণা নিয়ে আমি পড়ে গেলাম মেঝেতে। সাদা মোজাইকের ফ্লোর রক্তে ভিজে আছে। কি ভয়ানক দৃশ্য! সব আমার রক্ত….আমার….আমি মারা যাচ্ছি! পৃথিবী…তুমি ভালো থেকো.…
.
মনে হলো বহু বছর পর চোখ মেলে তাকালাম। চারপাশে শুধু সাদা। পাশে তাকালে দেখতে পেলাম একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটাকে চেনা চেনা লাগছে, তবে চিনতে পারছি না। উনি কি জীবিত মানুষ? আমি কি পৃথিবীতেই আছি? মানুষটা আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “কেমন আছ?”
আমি অস্পষ্ট স্বরে বললাম, “আমি কি বেঁচে আছি?”
মহিলাটি হেসে বললেন, “হ্যাঁ।”
“আমি কোথায়?”
“হাসপাতালে।”
“আমার মা..খুশবু…”
“সবাই আছে। তুমি কেমন আছ বলো।”
“ভালো। আপনি কে?”
“চিনতে পারোনি আমায়?” মহিলাটি হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে রইলেন।
আমি তাকে চিনে ফেললাম। শেফালী আপা। ফেসবুকে ছবি দেখেছিলাম। বাস্তবে কখনো দেখা হয়নি। খুশি হলাম তাকে চিনতে পেরে। আস্তে আস্তে উঠে বসলাম তার সাহায্য নিয়ে। জিজ্ঞেস করলাম, “আপা আপনি এখানে কী করে এলেন?”
“তোমার বোন রক্ত চেয়ে ফেসবুকে তোমাকে ট্যাগ করে পোস্ট করেছিল। সেটা দেখে এসেছি।”
“ওরা কোথায়?”
“কারা? তোমার বাড়ির লোক?”
“হ্যাঁ।”
“তারা কেউ এই মুহূর্তে হাসপাতালে নেই। চলে আসবে। তোমার এখন সত্যি ভালো লাগছে?”
“জ্বি।”
“তাহলে আমাকে বলো তো তুমি সুইসাইড করতে গিয়েছিলে কেন? আর হ্যাঁ, যদি তোমার ইচ্ছে হয় তাহলেই বলো, নইলে বলো না।”
আমি খানিকটা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না৷ বললাম, “পরে বলব।”
আপা বললেন, “তাহলে বলো না। রেস্ট নাও।”
“খুশবু…”
“আসবে!”
শেফালী আপা চলে গেলেন।
আমি অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম৷ ঘুম ভাঙলে মা’কে দেখতে পেলাম। কোলে খুশবু। মা কাঁদতে কাঁদতে খুশবুকে আমার কোলে দিয়ে বললেন, “তুই এই কাজ করলি কেন? আমার মাথা খারাপ হয়েছিল তখন মা মরা বাচ্চাটার কান্না দেখে। তাই ভুলভাল বলেছি। তুই সেই বকা শুনে মরতে যাবি? মরা এত সহজ?”
আমি জবাব না দিয়ে খুশবুকে কোলে নিলাম। কিন্তু শরীর এত দুর্বল যে ওর ভার সইতে পারছে না হাত। তবু যথাসম্ভব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে নিলাম বুকে। কি শান্তি! যেন সব সুখ জড়ো হয়ে আছে খুশবুর মাঝে।
মা আরও অনেক কান্নাকাটি করলেন। আমি তাকে বোঝালাম তার জন্য কিছু হয়নি। আমি এমনিতেই ডিপ্রেসড হয়ে গিয়েছিলাম৷ মা বুঝলেন না। তার ধারনা তার বকার জন্যই এমন হয়েছে। উনি আবার তাড়াতাড়ি চলেও গেলেন। এক হাজার রাকাত নামাজ মানত করে রেখেছেন, আমার জ্ঞান ফিরলে আদায় করবেন বলে।
খুশবুকেও নিয়ে গেলেন৷ আমার কাছে রয়ে গেল ঝিনু। সন্ধ্যার পরপর শেফালী আপা আবার এলেন একজন মহিলাকে নিয়ে আমার কাউন্সেলিং এর জন্য। মহিলা না বলে মেয়ে বলাই ভালো। নাম সানজিদা আফরোজ। ত্রিশের ওপর হয়তো বয়স। দেখতে বেশ সুন্দরী আর স্মার্ট। শেফালী আপার বান্ধবী। মেয়েটি সাইকোলজিতে পড়াশুনা করেছে, কিন্তু ডাক্তার নন।
প্রথমেই আমাকে দেখে বিস্তৃত হেসে বললেন, “তোমার ঠোঁটদুটো ভারি সুন্দর! হাসো তো একটু।”
আমার তার কথা শুনে হাসি পেয়ে গেল। প্রশংসা আমি জীবনে কমই পেয়েছি। কখনো পরিপাটি হয়ে থাকলে, শাড়ি পরলে, হালকা সাজগোজ করলে কেউ সুন্দর বলেছে, মায়াবতীও বলেছে। তবে সেটা ক্ষুদ্রার্থে।
এই মেয়ের চোখ দেখে মনে হলো সত্যি তার আমার ঠোঁট পছন্দ হয়েছে। আমি হাসলাম। উনি জিজ্ঞেস করলেন, “শরীর ভালো?”
“জ্বি আপা।”
“আমার ডাকনাম মিতা। আমাকে মিতা বলেই ডেকো। বয়সে বড় আমি, তবে আমাকে বন্ধু ভাববে কেমন?”
“আচ্ছা।”
“এখন বলো তোমার মন ভালো?”
আমি চুপ করে রইলাম। মিতা বললেন, “তোমার এখন কী করতে ইচ্ছে করছে বলো তো?”
“জানি না।”
“তোমার জীবনে কোনো শখ আছে? মানে যেমন ধরো দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, অনেকের যেমন ইচ্ছে, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা ঘোরার, ফিলিপাইলের কোনো দ্বীপে হারিয়ে যাওয়ার। নেই তেমন স্বপ্ন?”
আমি হেসে বললাম, “আছে। আমার একসময় খুব ইচ্ছে ছিল কাশ্মীর যাওয়ার।”
“গেলে না কেন?”
“সুযোগই পাইনি।”
“সুযোগ পাওয়া যায় ঠিকমতো চাইলে। তুমি কখনো চেষ্টা করেছ যাওয়ার?”
“নাহ। বাড়ি থেকে এতদূরে যেতে দিতো না, কখনো বলিনি। ভাবতাম বিয়ে হলে বরের সাথে যাব…”
“উনাকে বলেছিলে?”
আমি হাসলাম। উনি বললেন, “বুঝেছি। বিয়ের পর তোমার ঝামেলার কথা আমি শেফালীর কাছে শুনেছি। তা এখন তুমি কী করছ?”
“তেমন কিছু না।”
“পড়াশুনা?”
“হ্যাঁ শুরু করেছি।”
“গুড। তোমাকে আমি এখন ছোট্ট একটা গল্প বলবো। মনোযোগ দিয়ে শুনবে ঠিক আছে?”
“শুনব৷ আপনি বলুন।”
“সুরমা নদীর নাম শুনেছ নিশ্চয়ই? সুন্দর না নামটা? অনেকদিন আগে সুরমার তীরে এক পরিবারে ছোট্ট একটা মেয়ে জন্ম হয়েছিল, যার চোখদুটো ছিল কাজল পরানো। বাবা নাম রেখেছিলেন সুরমা৷ খুব সুন্দর মেয়েটির জীবনটা অত সুন্দর হলো না। সে স্কুলে ক্লাস টেনে থাকাকালীন এক বখাটে ছেলের সাথে পালিয়ে গেল।
জানোই তো, স্কুলের একটা মেয়ে ঝোঁকের বসে কেমন ছেলে পছন্দ করে। তারপর শুরু হলো স্বামী, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার। আধমরা মেয়েটা যখন ডিভোর্সি হয়ে বাপের বাড়িতে ফিরলো, তখন তার বয়স পঁচিশ। কোলে একটা দুই বছরের বাচ্চা।
এটা ছিলো বাংলাদেশের কমন কাহিনী। এবার আনকমন কাহিনীটুকু শোনো। সেই মেয়েও তোমার মতো মরতে চেয়েছিল। একবার নয়, বহুবার। তারপর একসময় নিজেই ঘুরে দাঁড়ালো। তাকে রোড এক্সিডেন্ট থেকে বাঁচাতে গিয়ে এক তরুণ যখন নিজের জীবন বলি দিলো, তখন মেয়েটা উপলব্ধি করতে পারলো প্রতিটা মানুষের জীবন প্রকৃতপক্ষে অনেক দামী হয়ে ওঠে যদি সে সেটা অর্থপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারে। নিজেকে, নিজের ভেতরের শক্তিটাকে, মেধাটাকে কাজে লাগিয়ে যদি সে অন্যের সামান্য একটা উপকারও করতে পারে, দেশের জন্য, দশের জন্য অল্প কিছুও করতে পারে, তবে তার মানুষ হয়ে জন্ম নেয়া সার্থক।
সুরমা তখন শুরু করলো নার্সের কাজ করা। ট্রেনিং নিয়ে হাসপাতালে কাজ করতে শুরু করলো। মনপ্রাণ ঢেলে সে রোগীর সেবা করতে থাকে। প্রতিদিন তার প্রার্থনায় থাকে সে যেন অসুস্থ মানুষগুলোর জীবনে আশির্বাদ হয়ে আসতে পারে।
চারটা বছর এমনি পার করার পর এক ধনী নিঃসন্তান বৃদ্ধ মারা যাওয়ার আগে সুরমার নামে তার অনেকগুলো সম্পত্তি লিখে দিয়ে গেল। প্রায় এক বছর এই বৃদ্ধকে সুরমা প্রাণপণ চেষ্টায় সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রেখেছিলো।
তারপর জানো কী হলো? সুরমা সেই সম্পত্তির টাকা দিয়ে হাসপাতাল বানালো, দরিদ্র লোকদের ফ্রিতে সেবা দিতে শুরু করলো। হাসপাতালের সবকিছু সে নিজের তত্ত্বাবধানে নিয়ে দক্ষ হাতে পারিচালনা করতে লাগলো। অনেক চেনাজানা হয়েছিল তার। বিশ্বাসী, কর্মঠ লোক বেছে বেছে হাসপাতালে আনলো। যেন সবাই পর্যাপ্ত সেবা পায় সেটা নিশ্চিত করলো। মজার বিষয় কী জানো? সে নিজে কিন্তু নার্সই রয়ে গেল। সব সামলে যে সময় পেতো, নার্সের পোশাক পরে রোগীর সেবা করতো। টাকাও নিতো নার্সেরর বেতনের টাকাই।
এই দিয়ে সে ছেলে মানুষ করেছে, ভালো স্কুল কলেজে পড়িয়েছে। নিজেকেও ভুলে যায়নি। নিজের শখ পূরণ করেছে। তার বাড়ি কুকুর বিড়ালে ভর্তি। রাস্তা থেকে ধরে এনে তাদের আশ্রয় দেয়। ও ভালো আছে এখন। মানুষের দোয়ায়, ভালোবাসায় অন্য সংসারী দশটা মোয়েমানুষের চেয়ে অনেক বেশি ভালো আছে।”
মিতা কথা শেষ করে জোরে নিঃশ্বাস নিলেন। আমি এতক্ষণ তার কথা হা করে শুনছিলাম। চোখের সামনে সুরমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম।
মিতা বললেন, “আমি জানি তুমি ডিপ্রেশনে আছ। ডিপ্রেসড মানুষের মোটিভেশনাল গল্প শুনে কতটুকু প্রভাবিত হয় আমি জানি না। আমি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নই। তবে কথা বলে নাকি জটিল সমস্যা সলভ করতে পারি। হা হা। শেফালী তাই আমায় নিয়ে এলো।”
কিছক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “আমি অনেকটা প্রভাবিত হয়েছি! আমার এখন আফসোস হচ্ছে এই কাজটার জন্য। এমনকি আমার হাত কাটার পর এটাও মনে হয়েছিল যে আমি মরতে চাই না। মরা অনেক যন্ত্রণার মিতা!”
“তাহলে মরতে গেলে কেন? এতই কি কষ্ট ছিল তোমার? নাকি ঝোঁকের মাথায় শুধু?”
“কারন আমি অপয়া। আমার কাছের মানুষ শুধু কষ্টই পেয়ে গেছে সবসময়। তাই মরে গিয়ে পৃথিবী থেকে জঞ্জাল দূর করতে চেয়েছি।”
“এখনো তাই মনে হয়? অপয়া, অশুভ এসব বিশ্বাস করে কেউ? একজন সুস্থ মানুষ হয়েও কেউ এই কথা বলতে পারে? সৃষ্টিকর্তা কি তোমাকে এতটা আলো- বাতাস দিয়ে, খাবার দিয়ে, সুন্দর পৃথিবীতে শুধু শুধুই রেখেছেন?”
“আমি আর এসব ভাবব না।”
“এখন তাহলে তুমি কী করতে চাও?”
“বাঁচতে চাই, পৃথিবীর জন্য, মানুষের জন্য!”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু