#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব -১০
মানুষ তখন কতটা অসহায় হয়ে পড়ে যখন তার চারপাশে একটা বলয় তৈরি হয়? তার পরিচিত গন্ডিটা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসে? আর সে তার অত্যন্ত কাছের মানুষদের কাছেও দিন দিন অপরিচিতের মতো ব্যবহার পেতে থাকে?
আমার জীবনটাও তেমনি হয়ে উঠছে। দিন দিন বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে আবহাওয়া। প্রতিটা নিঃশ্বাস নিতে এখন আমার কষ্ট হয়। সিলেটের মিষ্টি দিনগুলোর পর এই দুঃসহ দিন অপেক্ষা করছিলো তা আমি কখনো কল্পনাও করিনি।
খুলে বলা যাক। সেদিন সিলেটে ওর মায়ের আসার পর আবহাওয়ার রঙ বদলে গেল। প্রথম দিনটা সে মা’কে নিয়েই রইল। তাকে আমি একটুও পেলাম না কিছু বলার জন্য। রাতে যখন শুতে এলো, তখন সে ভীষণ টায়ার্ড। কাল রাতে নাকি ঘুম হয়নি, এক্ষুনি ঘুমাবে। আমি বললাম, “কিছু কথা শুধু জিজ্ঞেস করব।”
সে হাই তুলে বলল, “পরে।”
“পরে কখন?”
“সকালে বলো প্লিজ। আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না। এখন কথা বলতে পারব না।”
সে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি চাইলে তখন চিৎকার করে সিনক্রিয়েট করতে পারতাম। পারতাম ঝগড়া বাঁধাতে। কিন্তু কেন যেন পারিনি। আমার বিবেক বাঁধা দিয়েছিলো। যে মানুষটা এতকিছু করেও এত স্বাভাবিক থাকতে পারে তাকে কী বা বলব! আমাকে সে যদি দুই পয়সার দামও দিতো তবে অন্তত কৈফিয়ত দেয়ার চেষ্টা করতো পুরো ঘটনার। তার মানে এটাই ছিল, এতদিনের ভালোবাসাটা শুধুই নাটক। সে শুধু আমাকে ব্যবহার করে গেছে। কিন্তু সেই প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত সবই কি নাটক? কী করে হতে পারে? আর নাটকে আমার ভূমিকা কী? আমি কেন জড়িয়ে গেলাম? সেই প্রতিবার আমার কাছে এসেছিলো। আমি তো যাইনি তার কাছে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার আজও অজানা। আমি তাকে এখনো কিছু বলিনি। দেখা যাক জল কতদূর গড়ায়। ঢাকায় চলে এলাম সেই সপ্তাহেই।
তাদের বাড়িটায় প্রথমবার প্রবেশ করে আমার মনে হলো একটা দুর্গ৷ বিশাল পাচিলে ঘেরা বড় জায়গা নিয়ে করা একটা বাড়ি। বাড়ির সবকিছুতে আভিজাত্য উপচে পড়ছে, যেন এটি একটি সিনেমার সেট। সব সাজানো হয়েছে, এখন শ্যুটিং শুরু হবে।
বাড়িতে তার মা বাবা আর দুই ভাই বোন থাকে। প্রত্যেকেই বিশাল বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যার যার মতো করে থাকে। শুধু সবাই খাওয়ার সময় একসাথে হয় আর কেউ বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মায়ের অনুমতি নিয়ে যায়। আমার এই স্বাধীন রাজ্যে সত্যি মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়ে গেলো। সারাদিনে কোনো কাজকর্ম নেই, শুধু পায়ের ওপর পা তুলে রানী হয়ে থাকা। কথা বলারও কোনো মানুষ নেই। সবাই ব্যস্ত। সিলেটেও অবশ্য ছিল না, তবুও সেটা অন্যরকম ব্যাপার ছিল। কাজ দিয়ে মা বাবার মন জয় করার ব্যাপারটাও এখানে সম্ভব না।
আমার শ্বশুড়কে প্রথমবার দেখলে অতি সাধারণ মানুষ মনে হয়েছিলো, তবে খেয়াল করলাম স্ত্রীর ওপর তার বেশ প্রভাব। এরকম ভয়ানক মহিলাও স্বামীকে ভয় পায় এবং বেশ সমীহ করে চলে। আমারও তখন বাবার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল। আমাকে অবশ্য বাবা পছন্দ করলেন কি না সেটা জানা যায়নি। সামনে থাকলে হাসিমুখে কথা বলেন। কখনো ছোটখাটো গল্প করেন। তবে তার চোখ দেখে ভালো খারাপ বোঝার উপায় নেই।
বাকি সদস্যদের কথা বলার মতো নয়। তারা তাদের মতো। পৃথিবীতে নিজেকে ছাড়া অন্য কোনো দিকে মনোযোগ নেই। ভাই বোনের মধ্যে যেমন সম্পর্ক থাকে, তাদের মধ্যে সেটা নেই বললেই চলে। একে অপরের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলে না।
তার সাথেও আমার কথা হয় কম। এখানে আসার পর এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে সময়ই পায় না। সেই সকালে যায়, রাত দশটা বাজে ফিরতে। এসেই ক্লান্তির ঘুম! দুটো কথা বলার সময় নেই। প্রথমবার দিনে কয়েকবার ফোন করলেও এখন সেই সময় হয় না। আমি ফোন করলে একটু কথা বলে, নয়তো না। ছুটির দিনেও অর্ধেক দিন ঘুমিয়ে কাটায়। বাকি অর্ধেকের বেশিরভাগটা শ্বাশুড়ির দখলে থাকে।
এর মাঝে তাদের বাড়িতে ননদের জন্মদিনের অনুষ্ঠান হলো। দুনিয়ার আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব এলো। শ্বাশুড়ি মা আমাকে একগাদা গয়নাগাটি দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে গেলেন। আমাদের বিয়ের খবরটা চাপা ছিল এতদিন। যেটা প্রকাশ হয়ে গেল।
কাহিনী যে হবে সেটা জানা ছিল, তবে যা হলো তা অত্যন্ত বিশ্রী। হাই প্রোফাইলের স্টাইলিশ মাঝবয়সী মহিলাদের নোংরা মনের আবর্জনাগুলো তারা নিজেরাই প্রচার করতে শুরু করলো! আমার সাথে তাদের নিজেদের মেয়ে বা ছেলের বউয়ের তুলনা! রুপে গুণে তারা কতো অতুলনীয়া আর আমি কতটা সাধারণ সেটা বুঝিয়ে দেয়া হলো। অনেকে আমার শ্বাশুড়িকে ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে একটা কথা বুঝিয়ে দিলেন, তার ছেলেকে বিয়ে করিয়ে তিনি ঠকে গেছেন। আমার দিকে তাদের দৃষ্টি যেন বলে দিচ্ছিলো, অমন রাজপুত্রের মতো ছেলের কপালে শেষ পর্যন্ত এই জুটলো!
অবাক করা বিষয় হলো এসব নিয়ে মা আমাকে কিছুই বললেন না। তার ব্যবহার সিলেট থেকেই অবিশ্বাস্য রকমের পাল্টে গেছে।
সেসব নারীমহলের কথা তার কানে অবশ্য গেল না। সে বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত৷ তার বন্ধুরা আমার কথা জানতো। তারা আমাকে সাদরে গ্রহণ করলো। তাদের প্রিয় বন্ধুর বউ হিসেবে যতটুকু প্রাপ্য ছিল, পুরোটুকুই দিল।
সেদিন প্রথমবার আমার নোরার সাথে দেখা হলো। মেয়েটা সত্যি অনেক সুন্দর। সেই সাথে আমার স্বীকার করতে হলো, মেয়েটা খুব ভালো মনের মানুষ। খোলা মনে অনায়েসে অপরজনের সাথে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমার সাথে এমন করে কথা বলল যেন আমি তার বহুদিনের পরিচিত।
সেদিন শেষে সবাই চলে গেলে ও ঘরে ঢুকে বলল, “তোমাকে এত সাজতে কে বলেছিল?”
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সে বলল, “এত মেকাপ কেউ করে? ভূতের মতো লাগছিলো। তুমি নরমালি সুন্দর। এরকম করে সাজবে না আর কখনো।”
“মা সাজিয়ে দিয়েছে। আমি কি তাকে বলব আমি সাজবো না?”
“কেন বলবে না? তোমার মুখ নাই? নিজেরটা নিজে ডিসাইড করবে এখন থেকে। ইচ্ছে না হলে বলবে আমি করব না। কথা শেষ।”
এটা বলে সে গোসল করতে ঢুকে গেল। আমিও তার কথা মাথায় ঢুকিয়ে নিলাম। সত্যি তো উনার সব চাপিয়ে দেয়া বিষয় আমি মেনে নেব কেন? কিন্তু পার্টিতে ভূতের মতো লাগার কথা বলাতে এত লজ্জা লাগছিলো যে তার সাথে সেরাতে আর কথাও বলতে পারলাম না।
এই ঘটনার কিছুদিন পর একদিন সকাল সকাল মা এসে বললেন, “রেডি হয়ে নাও, একটা দাওয়াতে যাব।”
তখন বাড়িতে ও, বাবা কেউ নেই। আমি মা’কে বললাম, “শুধু আমরা দু’জন যাব? কিসের দাওয়াত?”
“আমার বান্ধবীর ছেলের বউয়ের বাচ্চা হবে, সাত মাসের সময় ঘরোয়া প্রোগ্রাম হবে। শুধু মহিলাদের দাওয়াত দিয়েছে।”
আমার একটুও ইচ্ছে হলো না যেতে। আবার সেই মহিলাদের আড্ডা! আমি মা’কে সোজা বলে দিলাম, “আমি যাব না।”
উনি খানিক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, “সত্যি যাবা না?”
“না।”
“কেন?”
“শরীর ভালো না।”
উনি আর কিছু বললেন না। একাই গেলেন দাওয়াতে। রাতে ও বাড়ি ফেরার পর মায়ের ঘরে ডাক পড়লো। আমার নামে বিশাল নালিশের তালিকা দেয়া হলো। এই পর্যন্ত বাড়িতে আসার পর আমি কী কী ভুল করেছি সেসব তো জানানো হলোই, আর সবচেয়ে বড় অপরাধ, আমি অযুহাত দেখিয়ে তার সাথে যাইনি, তার কথা অমান্য করেছি।
সে ঘরে আমার সাথে ইচ্ছেমতো চেঁচামেচি শুরু করলো। আমি কৈফিয়ত দিলাম, “সেদিন তুমি বলেছিলে আমার কিছু ইচ্ছে না হলে মা’কে যেন সরাসরি বলি।”
কথাটা শুনে সে আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন আমার মনে হলো মাটির সাথে মিশে যাই। বলল, “তোমার কমনসেন্সের অভাব? তোমার নিজের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে সেটা তোমাকে নিতে বলেছিলাম। আর এটা ফ্যামিলির সম্মানের বিষয়। দাওয়াত রক্ষা করার ব্যাপারে তোমার জানা নেই কিছু? উনারা মা’কে কত প্রশ্ন করেছে, কত কথা শুনিয়েছে কোনো ধারনা আছে?”
ঝগড়াটা অনেকদূর গড়ালো। একটা সময় আমি ক্ষান্তি দিয়ে বললাম, “ঠিক আছে, আমার ভুল হয়েছে। আর হবে না।”
সে তাচ্ছিল্য করে বলল, “দেখা যাবে। পারলে নিজেকে একটু আপডেট করার চেষ্টা করো।”
দিনে দিনে এসব ছোটখাটো ব্যাপারে ঝগড়া চলতে থাকলো। যেগুলো সময়ের অভাবে ঠিকভাবে মিটমাট করাও হলো না। দূরত্ব বাড়তে লাগলো আমাদের। প্রতিদিন যেন একটু একটু করে দূরে সরে গেলাম একে অপরের থেকে। সে আমাকে অপছন্দ করতে শুরু করলো, আর আমার তার প্রতি বিশ্বাস, সম্মান কমে যেতে থাকলো।
প্রথমদিকের মিষ্টি ভালোবাসাটা কোথায় হারিয়ে গেল! যেন সেটা মুঠোয় বন্দি গ্যাসবেলুন ছিল। মুঠি আলগা হতেই উড়ে পালিয়ে গেছে দূরে কোথাও!
এখনকার একসাথে থাকাটা ভালো থাকার জন্য নয়, থাকতে হবে বলে থাকা। সেও হয়তো বোঝে কথাটা। মাঝে মাঝে বলে, “দূরে কোথাও ঘুরে আসবো।”
তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে যায় কাজে। সময়ই হয় না তার।
সাথে শ্বাশুড়ি মায়ের আছে কড়াকড়ি নজর। মনে হয় আমার ওপর সর্বক্ষন তার দুটি চোখ লাগিয়ে রেখেছেন। কে যে আমার বলা প্রতিটা কথা তার কান পর্যন্ত নিয়ে যায় আল্লাহ মালুম। আমি বাপের বাড়ির কারো সাথেও শান্তিমতো ফোনে কথা বলতে পারি না। বাড়ির সব ভৃত্যই তার কেনা। তাই আমি এখানে একটা পুতুল ছাড়া কিছুই না৷ অধিকারবোধের কোনো বালাই নেই। তাকে তার মায়ের ব্যাপারে বললে সে শুধু বলে একটু কষ্ট করে মানিয়ে নাও।
দেখতে দেখতে ছয়টি মাস চলে গেল। আমার পড়াশুনা এখনো বন্ধই আছে। সে অবশ্য এখন বলে কলেজে যেতে, পড়তে। আমার ভালো লাগে না। যদিও বন্দি জীবন থেকে মুক্তি পাবো কলেজ শুরু হলে, তবু কেন যেন মন টানে না সেদিকে৷ কী হবে পড়ে? এইতো এমনই থাকবে জীবনটা। বাড়তি ঝামেলা করে কী লাভ? তার ওপর আমার শ্বাশুড়ি উচ্চশিক্ষিতা বউমা প্রথমদিকে খুঁজলেও এখন আমাকে পড়ানোর ব্যাপারে একটি কথাও বলেন না। কথা উঠলে এমন ভাব করেন যেন সেটা তার কর্নকুহরের আশেপাশেও যায়নি!
একদিন দারুণ খুশির একটা ঘটনা ঘটলো। তপ্ত মরুভূমিতে ঘুরতে ঘুরতে আমি হঠাৎই সবুজ মরুদ্যানের দেখা পেয়ে গেলাম! একেবারে প্রাণ জুড়িয়ে গেল তৃপ্তিতে!
কয়েকদিন ধরেই সন্দেহ হচ্ছিলো, তাই লুকিয়ে এক কাজের মেয়েকে দিয়ে প্রেগনেন্সি টেস্ট কিট আনালাম। পরীক্ষা করে দেখা গেল পজিটিভ! আমি অনেকক্ষণ অবিশ্বাস নিয়ে বসে রইলাম। ঘটনাটা সত্যি আমার জীবনে ঘটছে এটা আমার যেন ভেতরে যাচ্ছিলো না। সারাটা দিন অতি আনন্দে পাথর হয়ে বসে রইলাম আমি।
সে সেদিন অফিস থেকে ফিরলো আগেই। আমাকে অস্বাভাবিক আচরন করতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কী হয়েছে?”
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে অনেকবার কথাটা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বলতে পারলাম না। সে কয়েকবার আমার হাত ধরে ঝাকি দিয়ে বলল, “ওই…কী হলো তোমার?”
আমি পরে প্রেগনেন্সি কিটটা এনে তাকে দেখালাম। সেও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেটার দিকে। প্রায় পাঁচ মিনিটের মতো স্তব্ধ হয়ে থেকে বলল, “আমি বাবা হব? সত্যি?”
আমি চুপ করে রইলাম। তার চোখের দিকে লজ্জায় তাকাতে পারছি না। সে আমাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে একে অপরকে জড়িয়ে আমরা কেঁদে গেলাম। মনে হলো আমার হারানো সব আবার ফিরে পেয়েছি। পৃথিবী ভর্তি রঙ ছেয়ে গেছে। স্বপ্নের বর্ণিল রঙ!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব-১১
শ্বাশুড়ি মা ফলের ঝুড়ি নিয়ে আমার ঘরে এসে বসলেন। আমি শুয়েছিলাম। মা বললেন, “উঠো না, শুয়ে থাকো। ভালো লাগছে না?”
আমি উঠে বসে বললাম, “একটু মাথা কেমন করছিলো।”
উনি হেসে বললেন, “এমন হবেই একটু। তুমি কিন্তু নিজের অযত্ন করো না। এমনিতে যাচ্ছেতাইভাবে থাকো, সেসব চলবে না।”
“জ্বি মা।”
“আর এত মন খারাপ ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াবে না। হাসিখুশি থাকবে, যা খেতে ইচ্ছে হয়, যা করতে ইচ্ছে হয় আমাকে বলবে। ঠিক আছে?”
“জ্বি মা।”
“এত মিনমিনে হলেও চলবে না। স্পষ্টভাষায় কথা বলবে। আমার নাতি-নাতনিকে হতে হবে স্পষ্টভাষী।”
আমি হেসে ফেললাম। মা বললেন, “এরকম হাসিখুশি থাকবে।”
আমি আবার হাসলাম। উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
একটা বাড়িতে শিশুর আগমনের ঘটনা কতটা সুখের সেটা এখন খুব ভালোমতো উপলব্ধি করতে পারছি। হবে নাই বা কেন? এতটি নতুন প্রাণ, নতুন জীবন! আমার শ্বাশুড়ি মা খবরটা শোনার পর থেকে কেমন অন্যরকম হয়ে গেছেন৷ একেবারেই ভালো। সত্যিকারের ভালো। এতদিন আমাকে পছন্দ করতেন না বলে হয়তো অমন করতেন, কিন্তু এখন নিজের নাতি-নাতনির কথা ভেবে মন গলে গেছে৷ শুধু যে যত্ন নেন তাই না, অনেক সাহস দেন আমাকে। আসলেই লোকে বলে যে বাচ্চা হলে সব ঠিক হয়ে যায়, আমিও সব ঠিক হওয়ার আভাস পেয়ে স্বস্তির জীবন শুরু করলাম।
নতুন অতিথির খবর পেয়ে বাড়ির অন্য সদস্যরাও অনেক খুশি। বিশেষ করে আমার ননদ অর্না। সে আগে তেমন কথাই বলতো না। এখন দিনে একবার হলেও আমার কাছে আসে। কিছুক্ষণ বসে খোঁজখবর নেয়, গল্প করে। বেশ লাগে!
ওর সাথে সম্পর্কও আগের চেয়ে কত ভালো! ও আগে আগে অফিস থেকে ফেরে। একটু পর পর ফোন করে খোঁজ নেয়। ছুটির দিনে আমার কাছছাড়া হয়ই না। আগের মতো কতো কতো ভালোবাসায়, ভালোলগায় ভরিয়ে রাখে! আমি শুধু মনে মনে দোয়া করি, সব যেন শেষ পর্যন্ত ঠিক থাকে।
এভাবেই চলতে চলতে কখন দুই মাস হয়ে গেল টেরও পেলাম না। আমার বিবাহিত জীবনের সবচেয়ে ভালো দুইটি মাস।
হঠাৎ একদিন খবর এলো বড় ভাবীর অবস্থা ভালো না। প্রসব বেদনা উঠেছে, তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। ভাবীর সাথে ইদানিং প্রায়ই কথা হতো। খুব একটা শরীর ভালো ছিল তার। আমি খবরটা শুনে থাকতে পারলাম না। ছুটে গেলাম হাসপাতালে। যাওয়ার সময় দেখি মা বাড়িতে নেই, অর্নাও নেই। ও’কে ফোন করলাম, ধরলো না। সম্ভবত মিটিং এ আছে। মাও ফোন ধরলেন না। আমি তাদের মোবাইলে মেসেজ দিয়ে চলে গেলাম।
হাসপাতালে গিয়ে দেখি ভয়ানক অবস্থা। কাছেই কোথাও রোড এক্সিডেন্ট হয়েছে৷ প্রচুর মানুষ আহত হয়েছে। একের পর এক এম্বুলেন্স ভর্তি রক্তাক্ত লোক আসছে। আমার গা গোলাতে শুরু করলো।
ভাবীর অপারেশন তিন তালায়। সেখানে গিয়ে দেখি সবার মুখ শুকিয়ে আছে। ভাইয়া পাগল হয়ে একের পর এক ফোন করে যাচ্ছে রক্তের জন্য। ভাবীর রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। পওয়াই যাচ্ছে না। আগে যাদের বলে রেখেছিল তাদের করোরই খবর নেই।
বাবার এদিকে প্রেশার হাই হয়ে আছে। উনি চেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন অতিকষ্টে। তাকে বাড়িতে দিয়ে আসার মানুষটাও নেই। মেজো ভাইয়া চট্টগ্রাম গেছে।
বড় ভাইয়া কোথায় যেন রক্তের খবর পেয়ে চলে গেল সেখানে। আমি বাবার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। মা একপাশে বসে কাঁদছেন। তার বড় বউমাটি তার মেয়ের চেয়ে কম নয় কোনো দিক দিয়ে। ভাবীর কথা ভেবে আমারও কান্না পেয়ে গেল।পেটে হাত দিয়ে একবার অনুভব করার চেষ্টা করলাম আমার অস্তিত্বটিকে। মনে মনে বললাম, “তুইও পৃথিবীতে আসার সময় আমাকে এত কষ্ট দিবি?”
এক নার্স সে সময় অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে বলল ইনজেকশন এনে দিতে। ইমার্জেন্সি। নিচে যেতে হবে আনতে। মা অতকিছু বোঝেন না, কী থেকে কী আনবেন। অগত্যা আমিই গেলাম। লিফটে ওঠার জো নেই। সিড়ি ভেঙে নামতে হবে। তিনতলা থেকে দোতলা নামতে পারলেও তারপর মানুষের ভিড়ে একচুল নড়তেও কষ্ট হচ্ছে। হতদন্ত হয়ে ছুটতে থাকা মানুষ যেন পাগল হয়ে গেছে। ভেসে আসছে স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ। কেউ একটুও সরে জায়গা দিচ্ছে না।
আমি ভিড় ঠেলে নামার চেষ্টা করলাম। কেমন যেন উৎকট একটা গন্ধে বমি চলে এলো প্রায়। অনেক কষ্টে নাক চেপে নিচে নামছি, কে যেন পেছন থেকে আমাকে ঠেলে দ্রুত নেমে গেল। আমার মাথাটাও সে সময় চক্কর দিয়ে উঠল। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। পড়ে গেলাম সিঁড়িতেই। কপালে রেলিং এর সাথে বাড়ি লাগলো। উপুড় হয়ে পড়ে যাওয়ায় পেটে প্রচন্ড চাপ লাগলো।
ভীষণ যন্ত্রণায় আমার মুখ দিয়ে মা শব্দটা বেরিয়ে এল। চোখ বেয়ে একফোঁটা তপ্ত পানি বেয়ে পড়ল। আর ঘোলাটে চোখে শেষবারের মতো কিছু একটা খুঁজে নিলাম।
.
জ্ঞান ফিরলো তীব্র পেটব্যথা নিয়ে। সহ্য হয় না এত ব্যথা। কিসের ব্যথা? কী হয়েছে আমার? মনে করতে করতে অনেক সময় লেগে গেল। যখন মনে পড় তখন আরও ভয়ানক ব্যথা গ্রাস করে নিল আমায়। আমি চিৎকার করে উঠলাম। এক নার্স দৌড়ে এসে বললেন, “আপনি ঠিক আছেন? কী হয়েছে?”
“আমার বাচ্চা…আমার বাচ্চা…”
আমার মুখ দিয়ে আওয়াজও বের হচ্ছে না। যেন পাথর আটকে গেছে গলায়। শুধু আকুতিভরা চাহনি দিয়ে জানতে চাইলাম আমার বাচ্চা ঠিক আছে তো?
নার্স আমার পাশে বসে আমার হাত ধরে বলতে থাকলেন, “সব ঠিক আছে। একটু শান্ত হোন। একটু..”
আমি কী করে শান্ত হব? যতক্ষণ না উত্তর পাচ্ছি। আমার বাচ্চাটা…
কিছুক্ষণ পর বোধশক্তি কমে আসতে শুরু করলো। ডাক্তার সম্ভবত ঘুমের ইনজেকশন দিলেন। অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকলাম। ঘুমের মাঝেও একটা বাচ্চাকে খিলখিল করে হাসতে শুনলাম। আমি যেন গভীর কুয়ার ভেতর পড়ে যাচ্ছি আস্তে আস্তে। ওপর থেকে বাচ্চাটা এবার হাসি থামিয়ে কাঁদছে। বলেছে, “আমাকে নিয়ে যাও মা..আমি তোমার সাথে যাব…”
.
আমার ঘুম ভাঙলো কোনো এক বিকেলে। আসরের আজান শুনলাম। মা পাশে বসে আছেন। আমাকে বললেন, “ভালো লাগে এখন?”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আমার বাচ্চা ভালো আছে তো?”
মা একটু চুপ করে থেকে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আস্তে আস্তে বললেন, “তোর তো একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিলো..বাচ্চাকে বাঁচানো যায়নি। তুই চিন্তা করিস না মা। আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে গেছে। সব তার ইচ্ছা।”
আশঙ্কা করা এক জিনিস, সত্যি হলে আরেক। আমি যখন জানলাম বাবু আর আমার সাথে নেই, আমার পুরো শরীরে যেন আগুন জ্বলে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো মরে যাই এক্ষুনি। কেন বাবুকে নিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে খোদা!
দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করার চেষ্টা করলাম। এরকমটা কেন আমার সাথেই হলো? সৃষ্টিকর্তা কি আমার ভাগ্য লেখার সময় সুখের ভাগটা সরিয়ে তাতে আরো দ্বিগুণ পরিমানে দুঃখ লিখে দিয়েছিল? কেন তবে? কী অপরাধে এত শাস্তি?
আমার হঠাৎ তাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে হলো। প্রচন্ড পিপাসার মতো ইচ্ছেটা তীব্র। বুকটা শুকিয়ে আছে। তাকে দেখলে হয়তো একটু ভিজবে। কোথায় সে? কতদিন দেখি না! সে কি খবর পায়নি?
“মা! ও মা!”
মা পাশেই বসা ছিলেন। আমার ডাক শুনে চমকে বললেন, “কী হয়েছে?”
“ও আমায় দেখতে আসেনি মা?”
“এসেছিলো।”
“কখন?”
“কাল সকালে।”
“আমি কতদিন হাসপাতালে আছি?”
“তিনদিন।”
“ও কখন আসবে? আমি ও’কে দেখব।”
“আসবে। তখন দেখিস।”
“আমার শ্বাশুড়ি মা আসেনি?”
“নাহ।”
“ফোন করেনি?”
“নাহ।”
স্বার্থপর! স্বার্থপর! পৃথিবীর সব স্বার্থপর। এইযে দু’দিন আগেও আমায় চোখে হারাতো সে তো আমার জন্য নয়। সেসব নিজেদের জন্য। বংশধরের জন্য। আর আমি বোধহয় দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম বোকা মেয়ে। যে সব জেনেও অন্ধ হয়ে ছিল। যে ভাবের ভালোবাসাকে সত্যিকারের ভালোবাসা ভেবে মিথ্যে সুখের সাগরে ভাসছিলো। বোকার স্বর্গ আর কাকে বলে! আচ্ছা বোকা নাহয় হলাম। এতটাই কি তুচ্ছ যে এই অসু্স্থ আমিকে একটা বার দেখতেও এলেন না উনি!
আমিই বা এত আশা করি কী করে? উনি তো কোনোদিন বললেননি আমাকে ভালোবাসেন। আর ও? ওর তো আমার কাছেই থাকার কথা ছিল। সিলেটে একবার জ্বর হয়েছিল। পুরো তিনদিন সে আমার পাশে বসেছিল। রাত জেগে মাথায় জলপট্টি দিয়েছিল। আর সেই গতকাল নাকি একবার দেখে গিয়েছিল আর আসেনি। কি দারুণ প্রেম!
এত দুঃখের মাঝেও বিদ্রুপের হাসি এলো আমার। পেল না তো তারাও। যার জন্য দুটি মাস এই নগন্য মেয়েটিকে সময় দিয়েছে সেই কারনটি মরে গেছে। তাদের কষ্ট বিফলে। ভালো হয়েছে নিষ্পাপ প্রাণটি বেহেশতের বাগানে আছে হয়তো। এই বিচ্ছিরি পৃথিবীর খারাপ মানুষগুলোর মাঝে আসতে হয়নি তাকে।
পরক্ষণেই মনে হলো কী ভাবছি এসব? আমার বাবু! আচ্ছা হোক না সব মিথ্যে! মিথ্যে নিয়েই কাটুক জীবন। তবু কি একটি বার আমার বাচ্চাকে ফিরিয়ে দেয়া যায় না আমার কাছে? আর একটুও অযত্ন করব না রে। ফিরে আসবি…?
.
আমাকো রিলিজ দিলো আরও দু’দিন পর। শরীর বেশ দুর্বল। বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই চোখ পড়ল ঝিনুর কোলে ফুটফুটে শিশুটিকে দেখে। আদুরে গোল মুখ, ঘন কালো বড় বড় দুটো শান্ত দিঘীর মতো চোখ। তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। আমি ছুটে গিয়ে কোলো তুলে নিলাম তাকে। প্রাণভরে চুমু খেলাম মুখে।
তাকে বুকে জড়িয়ে শূন্য বুকটা ভরে গেল তৃপ্তিতে। এইতো আমার বাচ্চা! ইশ্ কি সুন্দর হয়েছিস তুই! চোখ বেয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে গেল। আমি ছলছল চোখ নিয়ে মেয়েটির দিকে চেয়ে রইলাম।
হঠাৎ খেয়াল করলাম বাড়ির পরিবেশ কেমন যেন থমথমে। নতুন শিশুর আগমনে যেমন আনন্দে ঝলমল করার কথা সবাই, তেমন কোনো অবস্থা নেই। সবাই নিষ্প্রাণ যেন! প্রথমে ভাবছিলাম আমার জন্য হয়তো। কিন্তু পরে জানতে পারলাম, আমার কোলের শিশুটি আমার চেয়েও হতভাগী। সে জন্মের সময়ই তার মা’কে হারিয়েছে!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু