গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (১৭তম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
বিরাজের কথা শুনে আমি আমার মুখ চেপে কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম। ইয়াজ আমার পাশেই ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলো, এটা শুনে সে সেও হাঁ হয়ে গেলো। ভাইয়া এগিয়ে এসে বিরাজকে বললো,
___বিরাজ এসব কি বলছো? উনি তোমার আম্মু, তুমি তো আম্মুই ডাকবে।
আমার মা আর ইথিলা ভাবী ইব্রিয়ার সাথে কথা বলছিলো, এবার উনারা এদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন, ভাবী সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
___কি হয়েছে?
ভাইয়া ভাবীকে বললো,
___বিরাজ বলছে ওর মা একজনই। সে বিন্দিয়াকে আম্মু ডাকবেনা।
এটা শুনে ভাবী এগিয়ে এসে বিরাজকে ধমক দিলো, আর বললো,
___বিরাজ তুমি ভুলে গেছো উনি তোমার আম্মু। ছোটবেলায়ও আম্মু ডাকতে। এখনো ডাকতে হবে। যদি উনাকে ফুফি ডাকো তাহলে আমাকেও ফুফি ডাকবে। মনে রেখো!
অভিমান নিয়ে ভাবী মুখ ফিরিয়ে নিলেন। বিরাজ কিছু ভেবে ভাবীর গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
___ আচ্ছা আম্মু ডাকবো, কিন্তু মা ইরাজকে আমার ভালো লাগে না।
এটা শুনে আমরা অবাক হয়ে ওর তাকিয়ে আছি। ভাবী আবার বললো,
___কেন ভালো লাগে না ইরাজকে? সে তো তোমার ভাই! তোমাকে অনেক ভালোবাসে।
বিরাজ মুখ বাঁকা করে বললো,
___সে আমার মতো দেখতে হয়েছে কেন? ওর মা-বাবা আলাদা, আমার মা-বাবা আলাদা, সেখানে সে আমার মতোই হতে হবে কেন? আমি আমার মতো কাউকে দেখতে চাইনা। ওকে দূরে দূরে থাকতে বলো।
ভাবী কি বলবে বুঝতে পারছেনা। ওর গালে হাত রেখে বললো ,
___আল্লাহ বানিয়েছেন দুজনকে একরকম। এক রকম থাকলে তো ভালো। তুমি দেখতে কেমন সেটা আয়নাতে দেখতে হবে না, ইরাজকে দেখলেই বুঝে যাবে। আর ইরাজের বাবা আর আমি ভাইবোন ছিলাম না? আমরাও তো একরকম হয়েছি, কই আমরা তো ঝগড়া করিনি, মিলেমিশে থেকেছি এতো বছর!
বিরাজ ঠোঁট বাঁকাচ্ছে। তারপরই কিছু ভেবে বলে উঠে,
___তোমরা তো ছিলে আপন ভাইবোন। কিন্তু সে তো..
ভাবী বিরাজকে থামিয়ে দিলেন। বললেন,
___এসব বলোনা বাবা। চলো আমরা বাসায় যাই।
বলেই ওরা হাঁটছে, বিরাজ ইব্রিয়ার আঙুল ধরে এগুচ্ছে। আর ইরাজ পেছনে পেছনে। আর আমি এবং ইয়াজ দাঁড়িয়ে আছি। ইয়াজ আমাকে টানতেছে, কিন্তু আমি সামনে যেতে পারছিনা। ইয়াজ আমার দিকে তাকিয়ে ধির কণ্ঠে বললো ,
___বিরাজ এখনো কিছু বুঝেনা বিন্দিয়া। জানিনা সে এইরকম কেন হলো? সব ঠিক হয়ে যাবে, প্লিজ মন খারাপ করো না। আমি বুঝতে পারছি তোমার কতটা কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কি করবো বলো? সে তো ছোট বেলা থেকেই এমন! প্লিজ চলো এখন..
আমি ইয়াজের সাথে সামনে হাঁটছি, কিন্তু ভেতরটা কেন জানি ফেটে যাচ্ছে। ইয়াজ আমার কাঁধে হাত রেখে বারবার শান্ত করার চেষ্টা করছে।
বাড়িতে পৌঁছেই আমি শুয়ে পড়লাম।
অনেক্ষণ পরে ইব্রিয়া রুমে আমাকে শুয়ে থাকতে দেখে বললো,
___মা জার্নি করে খারাপ লাগছে? মাথায় হাত বুলিয়ে দেই?
আমি ওর কপালে চুমু খেয়ে বললাম,
___দাও মা।
ইব্রিয়া আমার পাশে শুয়ে হাত বুলাচ্ছে। তখনি বিরাজ হাতে একটা ফোন নিয়ে দরজা সামনে থেকে ডাকলো,
___ইব্রু আসো, তোমাকে একটা মজার গেইম দেখাই।
ইব্রিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
___ মা যাই? বিরাজ ভাইয়া ডাকে।
আমি কিছু বলতে যাবো তখন ইরাজ আসলো, দরজায় বিরাজকে দেখে বললো,
___বিরাজ আমাকেও দেখাও না?
বিরাজ মুখ ত্যাড়া করে বললো,
___তোমাকে না, ইব্রুকে দেখাবো।
ইব্রিয়াকে আমি যেতে বললাম। ইরাজ মন খারাপ করে এসে আমার পাশে বসলো। ওকে মন খারাপ দেখে আমিও উঠে বসলাম। ওর মাথায় হাত রেখে বললাম,
___মন খারাপ করো না বাবা। সে একদিন ঠিকি তোমায় ভীষণ ভালোবাসবে!
ইরাজ অভিমান নিয়ে বললো,
___তুমি মিথ্যে বলো মা, সে এখনো তো অনেক বড় হয়েছে তবুও আমাকে একটু ভালোবাসেনা।
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখি ইব্রিয়া আর বিরাজ আমার রুমের দিকে আবার আসছে। কাছে এসেই বিরাজ আমার কাছে বসে বললো,
___ইব্রু এখনি বললো তুমি অসুস্থ। কি হয়েছে তোমার?
বলেই আমার কপালে হাত রাখলো। আমি ওর হাতটা আমার ডান হাত দিয়ে ধরে আমার গালে স্পর্শ করালাম। ওর কপাল ছুঁয়ে আসা চুলগুলো পেছনে নিয়ে বললাম,
___কিছু হয়নি বাবা। আমি একদম ঠিক আছি!
বিরাজ তখন একটু তাড়ার সাথে বললো,
___তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। তুমি হাসিখুশি থেকো সবসময়, হ্যাঁ? এখন যাই।
আমি কৃত্রিম একটা হাসি দিলাম । বিরাজ ইব্রিয়ার হাত ধরে বের হয়ে গেলো। এদিকে সে যাওয়ার পরেই আমি ইরাজকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম । কিছুক্ষণের মধ্যে একটু শান্ত হওয়ার পরেই ইরাজ বললো,
___মা তুমি কাঁদো কেন? বিরাজ আমার সাথে ভালো করে কথা বলেনা বলে? বিশ্বাস করো আমার একদম মন খারাপ হয়না। তুমি সত্যি বলো, সে এখনো বুঝেনা, বড় হলে আমায় খুব ভালোবাসবে, তাইনা মা?
আমি মাথা ঝাকিয়ে বললাম,
___হ্যাঁ সোনা, তোমায় খুব ভালোবাসবে। তোমরা মিলেমিশে একসাথে থাকবে।
বিরাজ ইব্রিয়ার সাথে খুব মিশে। ইব্রিয়াও ভীষন খুশি। শুধু ইরাজ মন খারাপ করে থাকে। ভাবী আশেপাশে থাকলে বিরাজ আমাকে আম্মু বলে ডাকে। কিন্তু যতটা সম্ভব না ডেকে কথা বলার চেষ্টা করে। এগুলো কেন জানি সহ্য করতে পারতাম না।
তবে বুঝতাম সে এখন বুঝে সবার একটা মা হয়, তাই দুইজনকে মা ডাকতে তার অন্য রকম লাগে।
কিন্তু আমার নিজের চেয়েও আমি ইরাজের কষ্টটা বেশি অনূভব করি। এখন শুধু একটাই ইচ্ছে, ওরা মিলেমিশে থাকতো যদি! কিন্তু সেটা বোধহয় পূরণ হবে না। দেখতে দেখতে ওদের চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। এর মধ্যে ইরাজ তার বাবা ইয়াজের জন্য ভীষণ পাগল পাগল হয়ে গেছে। সে বলে বাবাকে আর ইব্রিয়াকে নিয়ে চলে যাবে। আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলে তোমাকেও নিবো। কিন্তু ওর মুখে ইরাজের কথা একদম আসেনা।
ওরা যেদিন চলে যাবে তার আগেরদিন ছাদে ঘুড়ি উড়াচ্ছিলো। ইরাজ আর আমি একসাথে, আর বিরাজ ইব্রিয়া আর ভাবী একসাথে। ভাবী কিছুক্ষণ পরেই আমার মা’য়ের কিছু লাগবে তাই চলে গেছে।
এদিকে ইরাজের ঘুড়ির উচ্চতা বিরাজের চেয়েও বেশি ছিলো। এটা দেখে বিরাজ রেগে যাচ্ছিলো। সে বেশি উড়াতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলো, এর মধ্যে ঘুড়ির সুতো কেটে গেলো। এটা গিয়ে পড়লো অন্য বাসার ছাদে।
এখন বিরাজ কাঁদো কাঁদো চোখে এদিকে তাকিয়ে আছে। ইরাজ এটা দেখে বললো,
___আসো আমরা নিয়ে আসি। মা তুমি আমারটা ধরো একটু, বিরাজের ঘুড়ি খুঁজে নিয়ে আসছি এখনি।
ওরা দুইজন একসাথে গেলো। এটা দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগছিলো। যাক শেষ পর্যন্ত দুজন তো একটু মিলেছে।
ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম কিন্তু আসছিলোনা।কিছুক্ষণ পরে নিচ থেকে ডাক আসলো ইরাজ ব্যথা পেয়েছে। আমি সুতো ছেড়ে এক দৌঁড়ে নিচে গেলাম।
গিয়ে দেখি ইরাজের পায়ে কিছুর আঘাত পড়েছে, চামড়া কষে গেছে, রক্ত বেড়ুচ্ছে। আমি তারাতাড়ি করে প্রাথমিক কিছু চিকিৎসা করলাম। ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে আমি বিরাজের দিকে তাকিয়ে বললাম,
___ তোমরা দুজন একসাথে গিয়েছিলে না? ও কি করে ব্যথা পেলো?
বিরাজ ভয়ে জুবুথুবু হয়ে গেছে। ভাবীও বিরাজকে জিজ্ঞাসা করছে কিন্তু সে কিছু বলছেনা। কিন্তু ইরাজ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
___মা আসলে ঘুড়িটা ওই নতুন বাসার ছাদে পড়েছে, ওদের বাসার ছাদে অনেকগুলো ইট রাখা। এর একদম ভেতরে চিকন ফাঁকা অংশে গিয়ে পড়েছে। বিরাজ নিচু হয়ে সেটা আনতে গিয়েছিলো৷ আমি দেখলাম ও সেটাতে টান দেওয়ার পরে উপরের ইটগুলো পড়ে যাচ্ছে, সেটা বিরাজের মাথায় পড়তো, আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে পারলেও নিজের একটা পা সরাতে পারিনি, তারপর আমার পায়ে দুটো ইট পড়েছে। বাকিগুলো একপাশে পড়েছে। বলো বিরাজের মাথায় পড়লে ওর কতো বড় ক্ষতি হতো!
ইরাজের কথা শুনে আমি কেঁদে ফেললাম। ওর এই কথা শুনে ওকে নিয়ে যেন আমার গর্ব হচ্ছে। খুশিতে আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। মনে মনে এটা ভাবলাম আমার এক ছেলেই আমার সব অপূর্ণতাকে সারিয়ে দিবে।
আমার কাছ থেকে ভাবী ইয়াজকে টেনে বুকে নিলেন। কেঁদে কেঁদে বললেন,
___ তুমি ঠিক ইয়াজের মতো হয়েছো, ইয়াজও আমার উপর একটা টুকা আসতে দিতোনা। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা ছিল ভালোবাসার, ভালোবাসা থেকে এসবকিছুই সম্ভব। অথচ তুমি আর বিরাজের সম্পর্কটা অন্তত খারাপ, তুমি একা ওকে ভালোবাসো, সে তোমাকে কতো ঘৃণা করে, তাও তুমি তার কথা ভাবো, নিজের ক্ষতি করে ওকে রক্ষা করো। এতো ভালো কেন তুমি? বিরাজও কেন তোমার মতো হলোনা?
বিরাজ চুপ করে সব শুনছে। ভাবী ইরাজকে ছেড়ে বিরাজকে টেনে বললেন,
___বিরাজ এতদিন শুধু এটাই ভাবতাম তুমি হয়তো কখনো বদলাবে, একদিন তোমার ভাইয়ের জন্য ঠিকি তোমার মনে ভালোবাসা আসবে, তোমরা একসাথে খেলবে, অনেক গল্প করবে। কিন্তু এসব কি? তোমার ভাই এতো বড় ব্যথা পেয়েছে, সেটাও তোমাকে অক্ষত রাখতে, আর তুমি কিনা একবারও ওর মাথায় হাত রেখে একটু অনুশোচনা করো নি!
কেন ভালোবাসো না তোমার ভাইকে?
এটা শুনে বিরাজ ওখান থেকে ধিরে ধিরে এগিয়ে আসলো। ইরাজের কাঁধে কাঁধ রেখে বললো,
___তোমার সাথে আর খারাপ ব্যবহার করবোনা ইরাজ। প্লিজ ক্ষমা করে দাও।
ইরাজ খুশিতে বিরাজকে জড়িয়ে ধরলো।
সেদিন প্রথমবার আমি ইরাজকে এতটা খুশি দেখেছি। ইরাজ খুশিতে কেঁদেই দিয়েছে। সেদিন থেকে পরেরদিন ওরা খুব ভালোভাবে মিলেমিশে থেকেছে। রাতে দুজন একসাথে থেকেছে। কিন্তু সন্ধ্যায় ছিল ইরাজদের চলে যাওয়ার ফ্লাইট।
তার জন্য বিরাজ ইরাজ দুজনেরই মন খারাপ।
বিরাজ বারবার বলছে,
___আগে কেন বুঝিনি আমি! ইরাজ তুমি আমায় ক্ষমা করেছো তো?
ইরাজের যেন কিছু মনেই নেই। সে তার একটু ভালোবাসায় সব ভুলে গেছে।
আমরা সবাই-ই খুশি মনে তাদের বিদায় দিলাম। আমার মাও আবার তাদের সাথে চলে গেছে।
‘
এবার যাওয়ার পরে বিরাজ ইরাজের সাথে প্রতিদিন কথা বলে। পড়ালেখার ব্যপারেও বিভিন্ন আলাপ আলোচনা করে। আর প্রতিদিন আমাদেরকে, ইব্রিয়াকে না দেখে বিরাজ ঘুমাতেই যায়না।
খুব সুন্দর করে আমাকে আম্মু আম্মু বলে ডাকে।
বছর পর বছর বিরাজের ভালো রেজাল্ট শুনে অন্য রকম তৃপ্তি অনূভব করতাম। ইরাজও ভালো রেজাল্ট করে। কিন্তু ইব্রিয়া পড়ালেখায় একদম মন দেয়না। ইয়াজ বলে ইব্রিয়া ভাবীর মতো হয়েছে, ভাবীও এমন অমনোযোগী ছিল।
‘
‘
এদিকে ভাবী বলে বিরাজ আমাদের সবার সাথে এখন ভালো করে কথা বললেও সবার সাথে সহজে মিশেনা। সে ভালো ছাত্র, সবাই-ই ইচ্ছে করে ওর সাথে মিশতে আসে কিন্তু সে কথা বলে না। এটা আসলে ওর মধ্যে একটা দূর্বলতা। আবার অল্প কিছুতে রেগেও যায়, মারামারিও করে। এরকম অসংখ্যবার করে এবং করছে। অনেকবার পুলিশে ঝামেলায়ও পড়েছে। তাই ভাবী বিরাজকে নিয়ে সবসময় আতঙ্কে থাকেন।
এটা নিয়ে ইয়াজকে কিছু বললেই ওর মুখ লাল হয়ে যায়, সে বলে… মনে ইরাজের রাগটাও ভুল করে সে একাই পেয়ে বসেছে। তাই বিরাজ অতিরিক্ত রাগী একগুঁয়ে হয়ে উঠছে।
এদিকে ওদের আবার ৫ বছর পরে ওদের আসার কথা ছিল। কিন্তু সেসময় বিরাজের ছুটি থাকলেও ভাইয়ার কাজের চাপ ছিল। তারপর তাদের কলেজে ভর্তি, ভালো ইউনিভার্সিটির প্রিপারেশন আসাকে থামিয়ে দিলো। দুই বছর পরে আবারও আসার কথা ছিল কিন্তু সেটা হলোনা আমার মায়ের শরীর খারাপের জন্য।
দেখতে দেখতে ওরা অনেক বড় হয়ে গেলো। ইব্রিয়াও এখন কলেজে পড়ে, ইরাজের পড়ালেখা শেষ পর্যায়ে।
আমার ভাইয়া ইতোমধ্যে অনেকগুলো ব্যবসা বাণিজ্যে নিজের বিস্তার করে নিয়েছেন। দেশেও কয়েকটা বিজনেস চালু করেছেন, আর এসবের দেখভাল করার দায়িত্ব ইয়াজকে দিয়েছেন।
একটা বিরাট ফ্ল্যাটও কিনেছেন, যেটাতে আমরা বর্তমানে অবস্থান করছি।
ভাইয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবার একেবারে দেশে চলে আসবেন। আর বিরাজ চাইলে বিদেশে থাকবে নয়তো ওর ইচ্ছেতে দেশেই থাকবে, এবং বাবার সাথে ব্যবসার দেখাশোনা করবে। ইরাজ এটাতেই রাজী ছিল। সে বললো, সে আর ইরাজ একসাথে কাজ করবে। দেশেই থাকবে এখন থেকে।
এটা আমাদের সবার জন্য ছিল অনেক ভালো আর খুশির সংবাদ। ইরাজ তো আসার কথা শুনেই বললো,
___এবার আসলে বিরাজকে একদম বদলে ফেলবো, সবার সাথে কি করে মিশতে হয় শেখাবো।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে পূর্ণতার হাসি ছুড়তাম। আমার বিশ্বাস হতো ইরাজ এটা পারবে।
কিছুদিনের মধ্যেই ওরা সবাই আসলো। বিরাজ পড়ালেখার পাশাপাশি টুকটাক কাজ করে নিজের রোজগারে আমার জন্য হাতের বালা আনলো, ওর বাবার জন্য দামী পোশাক আনলো, ইব্রিয়া আর ইরাজের জন্য ফোন আনলো। আর দি’মণির জন্য কানের ঝুমকা আনলো। আর ওর দা’ভাইয়ের জন্য কিছু খুঁজে না পেয়ে পাঞ্জাবীর জন্য কাপড় নিয়ে চলে আসলো।
মিলেমিশে আমার একটা সুন্দর পরিবার এখন।
কিছুদিন পর থেকে ওরা দুজন একসাথেই এক গাড়ীতে অফিসে যায়।
আর ইয়াজ আর ভাইয়া এক গাড়ী নিয়ে যায়।
ভাইয়া ওদের জন্য আলাদা করে একটা গাড়ী নিয়েছেন।
ওরা একসাথে অফিসে গেলে সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে থাকে। কারণ দুজনেই একরকম। আবার পোশাকও একরকম পরে যায়। তবে চুলের দিকে তাকিয়ে মানুষ তফাৎ বুঝে, বিরাজের চুল লম্বা আর ইরাজের চুল ছোট।
কিছুদিন যাওয়ার পরে ইরাজ এসে আমাকে বললো,
____মা বিরাজকে না বললে সে কারো সাথে কথা বলেনা। এমনিতে জরুরী কিছু বলার হলেও বলে না। কিন্তু কেউ কাজে ভুল করলে আবার ভীষণ ধমকায়। কেউ কেউ ইরাজ মনে করে কিছু বলতে আসলেও বিরাজ রেগে যায়।
আমি বললাম,
___তুমি জানো সে কতটা বদমেজাজি, এতো সহজে ঠিক হবে না। ধৈর্য্য ধরো একদিন বিরাজ সব বুঝবে।
ইরাজ আমার কথা শুনে আশাবাদী হয়। সেও বিশ্বাস করে বিরাজ বদলে যাবে।
চলে গেলো আরো কিছুদিন।
শীতের রাত,
অন্যসময় বিরাজ আর ইরাজ সন্ধ্যায় ফিরে আসে। কিন্তু সেদিন রাত বারোটা বেজে গেছে তারা ফিরেনি।
ভাইয়া আর ইয়াজ বললো, তারা সন্ধ্যায়ই বাসার উদ্দেশ্যে চলে আসছে।
ফোন করেও পাচ্ছিলাম না। ভাবী আর আমি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেছি। দুজন সারারাত বসে রইলাম। ঘরের কেউ-ই ঘুমায়নি।
অপেক্ষা করতে করতে ফজরের দিকে কলিং বেল বাজলো।
সবাই একসাথে দরজার দিকে দৌঁড় দিলো। দরজা খোলেই দেখি বিরাজের মাথায় ব্যান্ডেজ। ইরাজের হাতে পায়েও ব্যথার দাগ দেখা যাচ্ছে। আজকে প্রথমবার ইরাজ ছাড়া বিরাজকে ব্যথা পেতে দেখেছি। ইরাজের চোখেমুখে ভীষণ ক্লান্তি। কিন্তু বিরাজ এই অবস্থাতেও ভীষণ উত্তেজিত চেহেরায় আছে। ঘরে ঢুকে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললো,
___কেন আমাদের থেকে এতদিন সত্যটা লুকানো হলো?
সবার চেহেরা নিমিষেই অন্ধকার হয়ে গেলো। কারোই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছেনা বিরাজের প্রশ্নটা কি!
এবার ইরাজ বললো,
___মা তুমি কেন বলোনি আমরা দুই ভাই এক বাবা-মার সন্তান। আমরা জমজ!
ভাবী মাথায় হাত রেখে বসে পড়েছে। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। বিরাজ বললো,
___ বলো কে আমাদের আসল মা-বাবা? আমরা কি করে বুঝবো এটা? আমার মা আর বাবার মতো দেখতে আমি, ইরাজও ওর বাবা আর মা’র মতো দেখতে। কিন্তু ডক্টরের পরিক্ষায় আমরা একই মায়ের জমজ সন্তান! কেন আসলো এটা? কেন লুকালে এই সত্য তোমরা?
আমি কথার প্রসঙ্গ বদলাতে বিরাজের মাথায় হাত রেখে বললাম,
___কি করে আঘাত পেলে বাবা?
বিরাজ রাগ কমলোনা। সে রাগের সাথেই বলতে লাগলো,
___ চাঁদার জন্য বাড়াবাড়ি করে গতকাল ঝগড়া বাঁধিয়েছিলাম। তাই ওরা রাতে ফেরার পথে আমাকে আক্রমণ করতে এসেছিলো। ইরাজ আমাকে গাড়ী থেকে বের হতে মানা করেছিলো, বলেছিল সে বিরাজ হয়ে ওদের সামনে যাবে। কিন্তু আমি দেইনি, আর কতকাল সে আমার জন্য নিজে কষ্ট নিবে, সে আঘাত পাবে? কিন্তু সে আমার কথা শুনেনি। পুলিশের গাড়ী তৎক্ষনাৎ আসায় আমাদের তেমন কিছু হয়নি। কিন্তু তোমরা এখন বলো আমাদের মধ্যে কেন এই মায়া? আর আমিই কেন ছোট থেকে ১০ বছর পর্যন্ত ওর সাথে খারাপ আচরণ করেছি? কেন তখন বুঝতে পারিনি সব?
সবাই চুপ করে আছে। কেউ কথা বলছেনা। কিন্তু ইরাজ বিরাজ সত্যটা জানতে কান পেতে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবী বসা থেকে ধির কণ্ঠে বললো,
___আমার জন্য বিরাজ।
বিরাজ চুপ হয়ে গেলো। ভাবী থেমে বলতে লাগলো,
___আজীবনের জন্য নিজের দাবী করার মতো একটা সন্তানের জন্য। হ্যাঁ তুমি আর ইরাজ জমজ ভাই। তোমরা ইয়াজ বিন্দিয়ার সন্তান। আমি হলাম তার মধ্যে এক অভাগী, সন্তানলোভী। সন্তানের কাতরতায় মা হওয়ার ইচ্ছে পোষেছিলাম। কোথাও থেকে একটা বাচ্চা নিয়ে আসলে আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারতাম না সে আমার সন্তান! মিল অমিলের পার্থক্যে ঠিকি একদিন বুঝে যেতো। কিন্তু তোমাদেরকে দেখে আমি একজনের মা হওয়ার আকুলতায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। আর একটা বাচ্চাকে ছোট থেকে যে সবচেয়ে কাছাকাছি রাখে সে তাকেই বেশি ভালোবাসে, এমনটা বিরাজ তোমার ক্ষেত্রেও হয়েছে। তুমি আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতে শুরু করেছিলে, এতটাই ভালোবাসতে যে নিজের মা’কেও এতটা ভালোবাসতে না। আমি তোমাকে কখনো বলিনি তোমার ভাইয়ের সাথে খারাপ আচরণ করো, সেগুলো তুমি নিজে থেকে করতে, কিন্তু আমি তোমায় কোনো শাসন করতাম না। মায়ের সব সন্তান এক রকম হয়না। তুমি ছোট বেলা থেকেই ভীষণ বদরাগী, ইরাজকে পছন্দ করোনা। কিন্তু আমি চাইলেই সেটা পরিবর্তন করতে পারতাম, তোমাকে বুঝাতে পারতাম। কিন্তু বুঝাইনি কেন জানো? আমার মনে হতো তোমরা দুজনকে দুজন ভালোবাসলে আমি কখনোই তোমাকে আমার করে পাবোনা। তোমরা আলাদা হবেনা। আমার মনে হতো আল্লাহ মনে হয় তোমাকে আমার করে দেওয়ার জন্যই তোমার মধ্যে এমন রাগ দিয়েছেন। কিন্তু সেবার দেশে আসার পরে ইরাজের কষ্টগুলো আমাকে দাগ দিয়েছিল, আমি তোমাকে বলেছিলাম ওর সাথে মিশতে, ওকে ভালোবাসতে। তুমি আমার কথা শুনেছিলে। আমার মনে হয়েছিলো এবার আর সমস্যা নাই, আমার যে ভুল ছিল আমি শোধরে নিয়েছি। আমার সন্তান এখন আর কোথাও যাবেনা, সে আজীবন দুই পরিবারকে ভালোবেসেই আমাকে মায়ের অধিকার দিবে। কিন্তু ভাবতে পারিনি এখনো এমন দিন আসতে পারে, যখন তুমি বুঝবে তুমি আলাদা কোনো মায়ের সন্তান নও। আর এটাও ভুলে গিয়েছিলাম আমি আজীবন পূর্ণতার জন্য অপূর্ণ হয়েও এমন অভিলাষ করে আসছি। এসব বেশিদিন টিকবে না।
বলেই ভাবী কাঁদতে শুরু করে দিলো।
আমি আর ইয়াজ ভাবীর পাশে বসলাম। ইয়াজ কিছু বলার আগেই আমি বললাম,
___কেন এসব বলছো? তুমি কোনো ভুল করো নি। তুমি তো আর ওকে এসব করতে শিখিয়ে দাওনি, শুধু এইটুকুই চেয়েছিলে সে তোমাকে মায়ের সম্পূর্ণ অধিকার দিক, সে দিবেও। বিরাজ মা’কে বলো তুমি সারাজীবন উনার সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিবে!
বিরাজও নিচে বসে গেলো। প্রথম আমার মাথায় একটা হাত রাখলো এরপর ভাবীর মাথায় আরেকটা হাত রাখলো। কান্নাভেজা চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো,
___মা আমি তোমাকে অপূর্ণ করতে এসব বলিনি, শুধু জানতে চেয়েছি আমরা কার সন্তান? এই যে আমার দুটো হাত, দুই মায়ের মাথায় একসাথে রাখতে পারছি। বিশ্বাস করো আজীবন আমি এভাবেই রাখবো। তোমাদের দুজনের পদতলেই আমি আমার সুখ খুঁজে নিবো। আর আমি তো ভীষণ সুখী, আমার দুইটা মা! দুইটা বাবা! যারা আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে। আমার কিছু হলে আমার দুই মা-বাবা আমার জন্য কাঁদবে।
মা শুনো, আজ থেকে তোমার তিন সন্তান। ইরাজ ইব্রিয়াও তোমার সন্তান। কে বলে তুমি অপূর্ণ? তুমি তো পৃথিবীর সবচেয়ে পরিপূর্ণ মা । তাইনা বাবা?
ইয়াজ আর ভাইয়া মুচকি হাসলো। ইরাজ ইব্রিয়াও এসে আমাদেরকে জড়িয়ে ধরলো। আমার মা, শ্বশুর শাশুড়ীও হাসছে। ভাবীও বিরাজ আর ইরাজ আর ইব্রিয়ার মাথায় গালে হাত বুলিয়ে আদর করছে।
বলছে আর যেন এমন পাগলামো না করে। সবার সাথে যেন মিশে। বিরাজও কথা দেয় সে সব শুনবে।
হ্যাঁ উনি আজ পরিপূর্ণ। তবুও তো কখনো কখনো উনার মনে হবে উনার বিরাজ জানে সে তার পেটে ধরা সন্তান নয়, কিন্তু হৃদয় উজাড় করে এক পৃথিবী ভালোবেসেছে ঠিকি। তখন সব পরিপূর্ণতার মধ্যেও হয়তো উনি নিজেকে কিছুক্ষণের জন্যও অপূর্ণ ভাব্বেন। তবে নিজেকে শান্ত করবেন এই ভেবে যে সেগুলো অপূর্ণ হলেও আজ অভিলাষেরা ঠিকি সার্থকতার দুয়ারে দাঁড়িয়ে হাসছে! আর উনিও হাসছেন একজন মা হতে পেরে!
(সমাপ্ত)