গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (৭ম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
কাঁধে কেউ চেপে বসলে মানুষ যেমনভাবে চোখের গোলা বের করে হাঁ হয়ে যায়, তেমন করে ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে!
ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছিলো কিন্তু সেটা না বুঝিয়ে মুখ স্বাভাবিক করেই বললাম,
___আরে ভাইয়া, তুমি আজকে কোথাও যাবে না। তোমার বোন আজ শ্বশুর বাড়ি থেকে আসছে আর তুমি কিনা চলে যাবে তোমার বাবার শ্বশুরবাড়িতে, এটা হয়না!
ইয়াজ এবার ভাইয়ার দিকে ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে কাঁধটা ছিটকে ছেড়ে দিলো, আর উনার উদ্দেশ্যেই রুক্ষভাষায় বললো,
___ আজ এখান থেকে কোথাও গেলে কাল পা দুটো আর জায়গামতো নিয়ে ফিরতে পারবেন না প্রিয় সমন্ধীমশাই । যাই হোক এখন পা বাড়িয়ে দিন, সালাম করবো।
ভাইয়া ভয়ে ভয়ে দু পা পেছনে গিয়ে বললো,
___ না না এসবের দরকার নাই। আচ্ছা আমি কোথাও যাবোনা, এমনি দোয়া করবো, সালামের কোনো দরকার নেই জামাই।
বলতেই বলতেই ভাইয়া পিছাতে পিছাতে ভাইয়ার রুমের দিকে যেতে লাগলো।
আর ইয়াজ তখনি আমার দিকে রাগী চেহেরায় তাকিয়ে বললো,
___আপনার সমস্যা কি? আমাকে যে অপমান করছে চোখে পড়েনি? পুরো ভাইটার মতোই হয়ছে! ব্যাগগুলো নিয়ে রুমে রাখেন, ভ্যা ভ্যা করে তাকিয়ে আছে। যত্তসব বিশ্রীর বংশ! মুখ দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়!
এবার ভাইয়ার মতো আমিও হাঁ হয়ে গেলাম । ইয়াজ হনহন করে রুমে চলে গেলো। ভাইয়ার আর রুমে যাওয়া হলোনা, উনি দরজার সামনে থেকে ফিরে কথাগুলো শুনে স্থির হয়ে রইলেন। আর সবাই এসে আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে একসাথে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো,
___জামাই এটা কেমন ব্যবহার করলো বিন্দিয়া? বংশ নিয়ে কথা বলছে! বিশ্রী বলছে, আবার বলছে দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়! কি এসব?
আমি সবাইকে কি জবাব দিবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার মা তো কেঁদেই দিলো। আর বাবা আমার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে শুনেছে এসেছে ইয়াজ সারারাত বাড়িতেই আসেনি। সেটাও এসে সবাইকে বলেছে, কারণ সবার গুনগুনানিতে আমার কান ব্যথা হয়ে যাচ্ছে ইতোমধ্যে , এর মধ্যে একেকজন এমনও বলতেছে,
___মেয়েটার জীবন শেষ, তার আর সংসার করা হবে না। জামাই যদি বিয়ের পরেরদিনই এমন ব্যবহার করে বাকিদিন কীভাবে সংসার ঠেকাবে?
এই কথার জবাবে তাচ্ছিল্য করে আরেকজন বলছে,
___সংসার করতে এই ছেলে বিয়ে করছে নাকি? দুইদিন ইচ্ছেমতো পুতুলের মতো খেলে ছেড়ে দিবে দেখো।
আমি কিছুটা রেগে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললাম,
___ মা সবাইকে বলো, এইটা আমার স্বামী আর আমার সংসার, সে কেমন ব্যবহার করবে আর কতোদিন সংসার করবে সেটা আশেপাশের মানুষ না ভাবলেও চলবে। তারা আমাকে কোনোদিন দু আনার সাহায্য করতে আসবেনা। অন্যের দিকে না তাকিয়ে নিজের চরকায় তেল দিলে ভালো হবে।
বলেই আমি হাঁটলাম, আর তখন সবাই আস্তে আস্তে ভীড় কমাতে শুরু করলো। মা আমার পাশ ধরে একটু আগাতে আগাতে বললো,
___তোর খারাপ লাগছেনা বিন্দিয়া? কালও খারাপ আচরণ করছে?এমনকি রাতে বাড়িতেও নাকি আসেনি!
আমি মা’র দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম,
___ মা এমনিতে খারাপ আচরণ করলে কি হয়েছে? ইয়াজ তো আর আমাকে মারধর করছেনা। এসব খারাপ লাগার কিছুনা। ভাইয়া তো ভালোভাবে ব্যবহারের পরেও ভাবীকে ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছিলো। আর শুনো, ছেড়ে যাওয়ার হলে সে হাজার ভালো ব্যবহার করলেও তুমি আমি কেউ আঁটকাতে পারবোনা, সে যাবেই। তবে কথা এটাই, আমার কপাল তো আমার ভাই নিজের কুকর্মে গড়ে দিয়েছে। আমার ভাই যা করেছে তার পরে আমার ভাগ্য গিয়ে কোথায় ঠেকবে সেটা কেউ বলতে পারবেনা।
বলতেই আমি চলে গেলাম। আর মা দাঁড়িয়ে গেলো।
আমার কথা শুনে মায়ের কষ্টটা হয়তো আরো বেড়ে গেছে।
কিন্তু আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিলো মাকে বলি, আমি খুব সুখে আছি! ইয়াজের এই রূপটাই আসল রূপ নয়। সে আমাকে ভীষণ ভালোবাসে!
কিন্তু আমার স্বামীর কথা রাখতে আমি সেটা পারলাম না। আমার ভাইকে বুঝানোর মূখ্য হাতিয়ার আমার মা’য়ের কষ্ট। মা কষ্ট পেলেই ভাই সহ্য করতে পারবেনা।
ধির পায়ে আমি রুমে গিয়ে দেখি ইয়াজ সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি মুখ বেঁকিয়ে ওকে পাশ কেটে ব্যাগটা রাখতে গেলাম।
ইয়াজ পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলেই আমি সরিয়ে দিয়ে বললাম,
___ বিশ্রীর বংশের সাথে মিশবেন না, এরপর দেখবেন এখানে আপনার বংশধরের মিশ্রণ হয়ে যাচ্ছে।
ইয়াজ জোর করে কোমরে দুইহাত আঁকড়ে ধরে বললো,
___বিশ্রী আর সুশ্রী মিলে তখন অন্য রকম প্রদীপ জ্বলবে। আচ্ছা তুমি কি চাও আমাদের প্রথম সন্তান হলে সে দেখতে কার মতো হোক?
এটা শুনে আমি ফিক করে হেসে দিলাম। রাগের মধ্যে হাসি আসলেই বিষয়টা লজ্জাজনক লাগে। আমারও ঠিক সেই অবস্থা। ভীষণ লজ্জা নিয়ে বললাম,
___ তার ফুফির মতো।
ইয়াজ আমার নাক টেনে বললো,
___কিন্তু তার ফুফি আর বাবা তো একরকমই দেখতে। সরাসরি বললেই হতো বাবার মতো হবে।
তখনি আমি হাত টেনে বললাম,
___ছাড়ুন ছাড়ুন বারান্দায় ভাইয়া।
ইয়াজ একবার তাকিয়ে আরো শক্ত করে ধরে বললো,
___গ্লাসের ভেতরে আমাদের দেখবেনা। তুমি চুপ করে থেকো হ্যাঁ, আর শুনো আমি কি বলি! রাগ করো না কিন্তু!
আমি মুখটা ঘুরিয়ে ইয়াজের দুষ্ট মুখের দিকে একবার তাকালাম। আমি তাকানোর সাথে সাথে ইয়াজ গালে গাল ঘেঁষে জোরে বললো,
___ছি! এমন একটা ঘরে আমি কি করে থাকবো? তোমরা মানুষ যেমন নোংরা, তেমন রুমের অবস্থাও। তোমার যে একটা ভাই আছেনা, ওইটা তো একটা হাতি, টাকা ইনকাম করে আর খেয়ে ভুড়ি বাড়ায়। ভালো একটা পরিবেশ বানাতে পারলোনা। তোমাদের ঘরের লোকজনকে দেখেলেই কেমন অরুচি অরুচি লাগে।
এটা শুনে আমি রেগে গেলাম। আমি ইয়াজের হাতটা টেনে সরানোর চেষ্টা করতে করতে রাগে ফুঁসতে লাগলাম। আর ভাইয়াকে দেখলাম অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কানটা এদিকে দিয়ে কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতেছে।
ইয়াজ আমাকে সরতে দিচ্ছেনা। যতো ছাড়াতে চাচ্ছি সে ততটা আঁকড়ে ধরছে। এখন গালে একবার ঠোঁট ছুঁয়াচ্ছে আর বলছে,
___তুমি আমার সামনে থেকে যাও তো।
এইটুকু বলে আবার ছুঁয়ে বলে,
___তোমাকে দেখলেই আমার বিরক্ত লাগে।
তারপর গাল ছেড়ে আবার গলায় ঠোঁট ঘঁষে বলে,
___আমার কথা শুনতে পাচ্ছোনা তুমি? যাও আমার সামনে থেকে।
বলেই সে হুট করে আমার কোমরে ধরে একটু উপরে তুলে এক চক্র ঘুরিয়ে আবার জায়গামতো দাঁড় করালো। সেটার সাথে সাথে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় আমার পা লেগে পাশে রাখা ছোট টি-টেবিলে রাখা জগ গ্লাস ফ্লোরে পড়ে বিকট আওয়াজের সাথে ভেঙে গেলো। আমি বুঝলাম সে ইচ্ছে করে এটা ভাইয়াকে শুনাতে করেছে। বুঝাতে চাইছে রাগে সে ভাঙচুর পর্যন্ত শুরু করেছে।
ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, উনি মুখে পেরাশানের সাথে হাত বুলাতে বুলাতে এখান থেকে সরে যাচ্ছেন। আমি এবার ইয়াজের দিকে তাকিয়ে কান টেনে ধরে বললাম,
___বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। এইগুলো যে ভেঙেছেন কিনে দিয়ে যাইয়েন!
ইয়াজ ভ্রু কোঁচকায়ে বললো,
___ বয়েই গেছে আমার!
___ তো ভাঙলেন কেন?
ইয়াজ ঠোঁটে আঙুল রেখে বললো,
___আমাদের সবার ভালো থাকার জন্য! তোমার ভাইয়ার যদি অন্য কোথাও এবার সম্পর্ক থাকে তাহলেও সেটার দিকে আগানোর কোনো রকম সাহস করবেনা। জানোতো কেন?
আমি আস্তে আস্তে বললাম,
___আমার জন্য!
ইয়াজ চোখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আমি ওর চোখে বারবার বোনের সুখের জন্য পূর্ণ প্রচেষ্টার প্রতিফলন দেখছিলাম। সে জানে ভাইয়া ইথিলা ভাবীকে পছন্দ করে না, তাও ইয়াজ তার জায়গায় স্থির। কারণ সে চাচ্ছে আমার ভাই তার বোনকে বিয়ে করেছিলো যেহেতু আর তার বোন আমার ভাইকে ভালোবাসে যেহেতু, তাহলে তার বোনকে নিয়েই সংসার করতে বাধ্য হতে হবে।
প্রথম আমার মনে এমন একটা ভাবনা এসেছিল যে ভাইয়া চাচ্ছেনা যেহেতু ভাইয়ার পছন্দ অনুসারেই জীবন গড়ুক, কিন্তু ইয়াজ বলে… আমার বোনও তো তার স্বামীকে ভালোবাসে, তাকে না পেলে সে এলোমেলো হয়ে যাবে। অন্য দিকে তার স্বামীও তাকে না চেয়ে অন্য কাউকে চায়। শুধু মেয়েটাই কেন ছেড়ে দিয়ে এখানে মহৎ হবে? বিয়ে যেহেতু হয়েছে, পবিত্র বন্ধনে যেহেতু আবন্ধ হয়েছে সেহেতু না চাইলেও তাকে নিয়েই সংসার করতে হবে। আর এমনটা না যে আমার বোন ছেড়ে দিয়ে ভালো থাকবে! এখন খারাপ থাকারই যদি হয় দুজন একসাথেই খারাপ থাকবে। তবুও দুজনকে একসাথে থাকতে হবে। একজনকে সুখী করে আরেকজন অসুখী হওয়ার মতো এতো ভালো মানুষির দরকার নেই।
ইয়াজ ভীষণ একগুঁয়ে, আমি জানি সে এটা করেই ছাড়বে। জোর করে হলেও আমার ভাইকে বাধ্য করবে ইথিলা ভাবীকে ফিরিয়ে আনতে।
আর আমিও এটাই চাই, তবে কেন ভাইয়ার ইচ্ছের চেয়েও আমার কাছে আমার স্বামীর ইচ্ছেটা এখন বড় মনে হচ্ছে জানা নেই।
আমি ইয়াজকে ছেড়ে বললাম,
___এসব ভেঙে ফেলার অভিনয় করে আমাকে চলে যেতে বলার অভিনয়টা যখন করলেনই তখন আমি একটু এলোমেলো চেহেরায় বাইরে গিয়ে বিষয়টা জানাই?
ইয়াজ হেসে বললো,
___অওও লক্ষী বউ আমার! যাও যাও জানাও গিয়ে। আমি একটু ঘুমাই।
আমি বের হয়ে আস্তে আস্তে ড্রয়িং রুমে ঢুকলাম। গিয়ে দেখি ভাইয়া এখানেই এসে অস্থির চেহেরায় বসেছে।
আমাকে দেখেই ভাইয়া অপরাধী চেহেরায় দাঁড়িয়ে গেলো, আর বললো..
___বিন্দিয়া তুই আমাকে ক্ষমা করে দিসরে।
মা রান্নাঘর থেকে উঁকি দিতে দিতে এসে বললো,
___কি হয়েছে?
ভাইয়া আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
___মা আমার বোন আমার পাপের শাস্তি পাচ্ছে। বিশ্বাস করো, আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
মা কাঁদো স্বরে রাগের মিশ্রণ করে বললো,
___ নে দেখ এবার কেমন লাগে? আরেকজনের বোনের বেলায় তো সহজেই পেরেছিলি, নিজের হলে কেমন লাগে বুঝ।
বলেই মা তাড়া করে রান্নাঘর ফিরে গেলো। হয়তো রান্না বসিয়েছে।
আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,
___ ভাইয়া তুমি বসো।
ভাইয়া বসলো আর আমিও বসলাম। আমি বসতেই ভাইয়া বললো,
___তুই আর যাস না প্লিজ। আমি তোকে এই ছেলের সাথে যেতে দিবোনা।
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
___না ভাইয়া ইথিলা আপু কালকেই যেতে বলেছে।
ভাইয়া আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললো,
___ইথিলা..আপু?
আমি একটু হেসে বললাম,
___হ্যাঁ ইথিলা আপু, আমার স্বামীর বোন। উনার বিয়ের ব্যপারে কথা হচ্ছে, তাই আমাদের তারাতাড়িই ফিরতে হবে।
ভাইয়া আমার কথা শুনেই কেমন আৎকে উঠলো। চোখগুলো কেমন যেন চিকচিক করে উঠেছে মূহুর্তেই। ভাইয়া চোখ লুকিয়ে থামা গলায় বললো..
___ ইথিলার বিয়ে!?
চলবে…..