অপূর্ণতা পর্ব-৫১

0
911

#গল্প_অপূর্ণতা
#Ritu_Bonna
#পর্ব_৫১

রুমের ভিতর থেকেই মা আর নিলয় ভাইয়ার সব কথা শুনতে পেলাম। ডয়িং রুমের পাশেই আমার রুম তাই শুনতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি। নিলয় ভাইয়ার গলার আওয়াজ শুনেই আমি তাকে চিনতে পারলাম।বেশি কিছু না ভেবেই আমি রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।রুম থেকে বের হতেই আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। চোখে যেন সবকিছু ঝাপসা দেখতে লাগলাম।হঠাৎই আমি মাথা ঘুরে পরে গেলাম।তার পরে কি হলো তার কিছুই আমার মনে নেই,,,,,,,

আন্টির সাথে কথা বলছি এমন সময় দরজা খোলার আওয়াজ শুনে সামনের দিকে তাকালাম।সামনে তাকাতেই আমি অবাক হলাম।অদ্রিতা দাঁড়িয়ে আছে,ওর সাথে কথা বলার জন্য আমি সামনে দিকে যাচ্ছি এমন সময় দেখি সে পরে যাচ্ছে।আমি দৌড়ে তাকে ধরে রুমে নিয়ে যাই।রুমে নিয়ে তাকে বিছানায় শুয়িয়ে ডাক্তারকে কল দেই।অদ্রিতার মুখের দিকে তাকিয়েই আমি অবাক হয়ে যাই।চোখ- মুখ পুরো লাল হয়ে আছে,মাথায় ব্যন্ডেজ করা,চোখের নিচে কালো হয়ে গেছে।যেইদিন তাকে প্রথম দেখছিলাম আর আজকের এই অদ্রিতার মাঝে কোন মিল নেই,,,,

অতীত,,,,,,,,,

আজ কলেজের নবীন বরণ উৎসব চলছে।সবাই যার যার মতো ইনজয় করছে।সবাই সেজে এসেছে।আমি স্টেজে দাঁড়িয়ে ভাষন দিচ্ছে, যদিও আমার স্টেজে উঠে কথা বলার কোন ইচ্ছে ছিল না তবুও স্যারের অনুরোধে রাজি হলাম।ভাষন শেষ করে স্টেজ থেকে নামতে যাবো এমন সময় হঠাৎই একটি মেয়েরে দিকে চোখ পরে যায়।সে বোরকা পরে এসেছে সাথে কালো হিজাব।আমার মনে হলো সে এতক্ষন মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছিল।তাকে প্রথম দেখেই কেন জানি আমার ভালো লেগে যায়। তার মুখটা অনেক মায়াবি, ওর মুখের দিকে তাকালেই হয়তো সব ভুলে থাকা যাবে।আর কিছু না ভেবে আমি চোখ সরিয়ে নিলাম।সেদিন আর দেখা হয়নি তার সাথে,আসলে আমি নিজেই আর তার সামনে পরতে চাইনি।কিন্তু ধীরে ধীরে কি করে তাকে পছন্দ করে ফেললাম তা আমি নিজেই বুঝতে পারি নি,,,,,
,,,,,,,,

“এই অদ্রিতা, তোর কি হলো উঠ?অদ্রিতার বাবা তাড়াতাড়ি আসো দেখো মেয়ের কি হয়েছে?”কান্না করছে আর এগুলো বলছে অদ্রিতার মা।ওনার কথা শুনে বাড়ির সবাই রুমে এসে পড়লো,,,,,,

ওনার কান্নার আওয়াজ শুনে ভাবনা থেকে বাহির হয়ে বলি,”আন্টি চিন্তার কোন কারণ নাই হয়তো অতিরিক্ত টেনশন করার ফলে অজ্ঞান হয়ে গেছে।আমি ডাক্তারকে ডেকেছি এখনি হয়তো এসে পরবে।”

অদ্রিতার মা আহাজারি করে বলে,”সব আমাদের জন্য হয়েছে।আমরা যদি ওকে জোর করে বিয়েটে রাজি না করাতাম তবে এমনটা হতো না।সব দোষ আমাদেরই।আমাদের জন্যই মেয়েটাকে এতকিছু সহ্য করতে হয়েছে।”

নিলয় ভরশা দিয়ে বলে,”যা হয়েগেছে তা ভেবে কষ্ট পেয়ে তো কোন লাভ নেই।এখন নিজেকে সামলান, ইনশাআল্লাহ একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।”

কিছুক্ষন পরেই ডাক্তার চলে আসে।অদ্রিতাকে চেক-আপ করে মুখ গম্ভীর করে বলে,”আপনারা এত কেয়ারলেস কেন?ওনার শরীররে এই অবস্থা তার উপরে দুই দিন ধরে না খাওয়া। ওনী মাথায় আঘাত কি করে পেলেন?”

ডাক্তারের প্রশ্ন শুনে ওনী বিপাকে পরে গেলেন।এখন কি বলবেন কিছুই ভেবে পাচ্ছেনা। আমতা আমতা করে বলেন সকালে ওয়াশরুমে পরে গিয়ে মাথায় ব্যাথা পেয়েছে।ডাক্তার ওর কিছু হয়নি তো, ও ঠিক আছে তো?ওর মা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেন।

ডাক্তার স্মিত হেসে বলে,” ওনী এখন সুস্থ আছেন।ওনার জ্ঞান এখনি ফিরে আসবে।আপনাদের আরও যত্নশীল হতে হবে।এই অবস্থায় এতটা টেনশন করা উনার আর ওনার বেবি কারও জন্যও ঠিক না।আর ওনার খাওয়া- দাওয়ার দিকে আরও বেশি নজর দিবেন।জানি এই সময় খেতে একদমই মন চায় না তবুও জোর করে খাওয়াবেন।”

নিলয় হতভম্ব হয়,বিস্মিত হয়ে বলে,” আপনি কি সিউর যে ওনী প্রেগনেন্ট?”

ডাক্তার স্মিত হাসি দিয়ে বলে,”হুমম,আমার এত বছরের ডাক্তারির অভিজ্ঞতা। এটা ভুল হতে পারে না।সি ইজ প্রেগনেন্ট।কেন আপনারা খুশি নন?দেখে তো মনে হচ্ছে ওনী বিবাহিত।তবে কি কোন পবলেব আছে?”

নিলয় মুচকি হেসে বলে,” নো ডক্টর, এটা তো খুশির খবর।জাস্ট একটু সিউর হলাম।চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।”

ডাক্তার সৌজন্যতা সূচক হেসে বলে,”দরকার নাই।আপনি এখন আপনার ওয়াইফের সাথে থাকুন। এখন ওনার আপনাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, আমি আসছি।এই বলে ডক্টর চলে যায়।ডাক্তারের কথা শুনে নিলয় চুপ করে যায়,সে আর কিছু বলে না।”

অদ্রিতার মা পরিস্থিতি বুঝে বলে,”কিছু মনে করো না,ডক্টর তোমাকে দেখে হয়তো ভুল বুঝেছে।”

নিলয় ওনাকে আশ্বস্ত করে বলে,” ঠিক আছে আন্টি,আমি কিছু মনে করি নি।” মনে মনে বলে,এটা যদি সত্যি হতো তবে আমার থেকে খুশি কেউ হয়তো হতো না।আর ডাক্তারের এই কথাটা আমি সত্যি করবো তা আজ হউক বা কয়েক বছর পর।আমি আগের বারে যেই ভুল করেছি তা আর করবো না।

জ্ঞান ফিরতেই ডাক্তারের কথা শুনে মনটা খুশিতে ভরে গেল। আমার কানে অন্য কোন কথা আসলো না।আমার হাত আপনা আপনি পেটে চলে গেলো।
মা হওয়ার অনুভূতি সত্যিই অনেক সুখের যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।আমার চোখ থেকে পানি পরতে লাগলো।এটা কোন কষ্টের পানি না,এটা সুখের পানি।এই একটা কথা শুনে আমি সব কিছু ভুলে গেলাম। এতটা সুখী হয়তো জীবনে আর কখনোই হয়নি।

অদ্রিতার মা চিন্তিত হয়ে বলে,” এখন কি করবি? আরিয়ানকে তো জানাতে হবে।সে বাবা হতে চলেছে আর তুই এখন প্রেগনেন্ট এই অবস্থায় কোর্ট তোর আর আরিয়ানের ডিভোর্স এপ্লাই কিছুতেই গ্রহন করবে না।তাই যদি আবারও একটু ভেবে দেখতি ডিভোর্সের বিষয়ে।তুই চাইলে এখনো তোর সংসারটা বাঁচাতে পারবি।”

মার কথা শুনে ভাবনা থেকে বের হলাম।আবারও ভেবে দেখবো কথাটা শুনেই মুখে হাসি ফোঁটে উঠলো,,,কিন্তু তাচ্ছিল্যের হাসি।এই সন্তান আমার আর ওনার ভালোবাসার প্রতীক নয়। ওনী তো আমাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে পরে বলছেন এটা ওনী ঘোরের মাঝে করেছেন।এটা নাকি ওনার জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। আমি চাই না আমার সন্তানকে কেউ ভুল বলে অবহেলা করুক। বাধ্য হয়ে তাকে মেনে নিক।আমি চাই না যতটা কষ্ট, অবহেলা আর অপমান আমি সহ্য করছি তার কিছু আমার সন্তান সহ্য করুক।আমিই তাকে মানুষ করার জন্য যথেষ্ট। এখানেই আমার পূর্ণতা।

নিলয় কন্ঠে কিছুটা গম্ভীর্যতা এনে বলে,” আন্টি আপনি এ কি বলছেন।যে আপনার মেয়েকে এতটা অপমান, অত্যাচার করেছে আপনি কি করে তাকে আবার তার কাছে ফিরে যেতে বলতে পারেন?”

অদ্রিতার মা করুন স্বরে বলে,”তুমি বুঝবে না বাবা এই সমাজে একা একটা মা কখনো তার সন্তানকে লালন- পালন করতে পারে না।সন্তানের দেখা- শুনার জন্য মা- বাবা দুইজনেরই প্রয়োজন।তাছাড়া মা-বাবার ডিভোর্স হলে সেই সন্তানকে সমাজ ভালো চোখে দেখে না।সমাজের মানুষ নানা কথা বলবে।”পরে করুন দৃষ্টিতে অদ্রিতার দিকে তাকিয়ে বলে,”তুই কিছু বল্ অদ্রিতা,আমি নিজে আরিয়ানের সাথে কথা বলবো।”

অদ্রিতা কন্ঠে কাঠিন্যতা এনে বলে,”আমি ওনার সাথে আর থাকবো না।এই সন্তান একা আমার এবং এই সন্তানের দেখা-শুনা করার জন্য আমি একাই যথেষ্ট আমার কাউকে প্রয়োজন নেই। ”

অদ্রিতার মা অনুনয় করে বলে,”তবুও আর একবার ভেবে দেখতি।একটা সংসার ভাঙা অনেক সহজ আর গড়া অনেক কঠিন।নিজের কথা না ভেবে নিজের সন্তানের কথা ভেবে পরে সিদ্ধান্ত নে।”

অদ্রিতা কন্ঠে গম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলে,”আমার সন্তানের কথা চিন্তা করেই আমি এই কথা বলছি।আমি চাই না আমার সন্তান কারও অবহেলা, অপমান সহ্য করে বড়ো হউক।কেউ বাধ্য হয়ে ওকে মেনে নিক তা আমি চাই না।নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে তো আর বেঁচে থাকা যায় না।অনেক চেষ্টা করেছি আরিয়ানের সাথে সম্পর্কটা ঠিক করার।ওনার মনের মতোন হওয়ার কিন্তু কোন কিছু কি আর একতরফা হয় বলো?ওপাশ থেকে কখনো পজিটিভ রেসপন্স পায়নি।যা পেয়েছি তা হলো অপমান,অবহেলা আর বিরক্তিকর মনোভাব। আমাকে তো ওনী সহ্যই করতে পারেন না।তবুও না হয় এই সব কিছু সহ্য করে থাকতাম কিন্তু বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ হলো বিশ্বাস। একদিন আমার বিশ্বাস ছিল ওনী হয়তো আমাকে মেনে নিবেন।আমি যেমন সেভাবেই আমাকে গ্রহন করবেন কিন্তু আমার এই বিশ্বাসও ভেঙে গেছে।ওনী অন্য কাউকে ভালোবাসেন আর আমি কারো পথের কাঁটা হতে পারবো না।জানো এই বিশ্বাস জিনিসটা অনেক নাজুক হয়।সম্পর্কে রাগ,অভিমান থাকাটা স্বাভাবিক এবং রাগ- অভিমান খুব সহজেই দূর করা যায় কিন্তু বিশ্বাস একবার ভেঙে গেলে তা আর দ্বিতীয়বার করা যায় না।আর কোন সম্পর্কে একজন যদি বিশ্বাস ভেঙে ফেলে,সে যদি বিশ্বাসঘাটকতা করে তবে অপর জনের উচিত সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা।সারাজীবন কষ্ট বয়ে বেড়ানো থেকে এটাই ভালো হবে সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসা।আর আমি বেরিয়ে আসতে চাই এই সম্পর্ক থেকে।”

অদ্রিতার মা আবারও বলে,”তবুও যদি আর একটু ভেবে দেখতি,,,,,”
.
..

চলবে,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে