#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#অন্তিম মুহূর্ত
“আরিহান!এই আরিহান!কই গেলো বিচ্ছুটা!এই দুষ্টু ছেলেটা আমায় জ্বালিয়ে খাবে।আরিহান!”
করিডরে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে ছেলেকে ডাকছে মাহা।
একটু পর লিসা কোত্থেকে ধরে নিয়ে এলো আরিহানকে।সে বাইম মাছের ন্যায় ছটফট করছে নেমে যাওয়ার জন্য।সেই সাথে চেঁচামেচি তো আছেই।তাও লিসা তাকে ছাড়ছে না।বহু কষ্টে ধরে রেখেছে।
-‘মাহা আপু!তোমার গুনধর ছেলে কী করেছে শুনবে?
-‘আবার কী করেছে?আর ওর শরীরে এত মাটি লাগলো কী করে?’ ভ্রুকুটি করে আরিহানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল মাহা।
-‘তোমার শখের অপরাজিতা ফুলের গাছটার দফারফা করে এসেছে সে।এজন্যই শরীরে মাটি লেগে আছে।আসতে চায় না,বহু কষ্টে ধরে নিয়ে এসেছি!’ লিসা আরিহানকে মাহার কোলে দিয়ে বললো কথাগুলো।মাহার তো চোখ কপালে ওঠে গেছে লিসার কথা শুনে।
-‘কীই!আমার এত শখের ফুলগাছটা!আজকে এই ছেলেকে আমি আছাড় মেরে গোদা বার করবো!এই বয়সে এত দুষ্টামি কই থেকে আসে?’
আরিহান আদো আদো স্বরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,’মাম্মাহ,পুপ্পি তলেছে তব!আমি ভালু তেলে!’ আরিহানের কথা শুনে এবার লিসার আক্কেলগুড়ুম।বিস্মিত কন্ঠে বললো,’দেখলে তোমার ছেলে কী মিথ্যাবাদি!আমি নাকি সব করেছি।যা,আজকে তোকে মাহা আপু ধরে বেঁধে গোসল করানোর সময় কিন্তু আমি বাঁচাতে আসবো না।এই বলে দিলাম,হুহ!’
মাহা লিসার দিকে তাকিয়ে বললো,’তুই এই দুষ্টু ছোকরার সাথে কথা বলে সময় নষ্ট না করে তোর কাজে যা লিসা।আর হ্যা মামণিকে বলিস বাবাইকে ফোন করে বলতে যে ওর দুধ শেষ হওয়ার পথে।আসার সময় নিয়ে আসতে।’
-‘আচ্ছা আপু!’
লিসা চলে যেতেই মাহা আরিহানকে বকতে বকতে নিজের রুমে এলো।ছেলের শরীর মাটি দিয়ে মাখামাখি।গালে মুখেও লাগাতে বাদ রাখে নি।বয়স তার মাত্র উনিশ মাস,কিন্তু এই বয়সেই এত দূরন্তপনা কোত্থেকে যে শিখেছে আল্লাহ মালুম।আদো আদো কথা দ্বারা যে কাউকেই কুপোকাত করে ফেলে।আর নিজে দোষ করে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়ার টেকনিকটা সবসময় কাজে লাগায়।কিন্তু মাহা তো খুব ভালো করে চেনে নিজের ছেলেকে।তাই মায়ের কাছে এসব বলেও নিজেকে বাঁচাতে পারে না বেচারা।মিসেস মিনারা বলেন, আরিহান নাকি দুষ্টুমির দিক দিয়ে অবিকল মাহার মতো হয়েছে।ছোটবেলায় মাহাও নাকি এমন দুষ্টা ছিলো।
মাহা আরিহানকে ধরে বেঁধে গোসল করাতে নিয়ে গেল।ভালো মতো শরীর না ঘষলে মাটি যাবে না।আরিহান তো তারস্বরে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছে।গোসল করাতে গেলেই সে এমন চিল্লাফাল্লা জুড়ে দেয়।গোসল মানেই তার কাছে আতঙ্ক।মাহা তার শরীরে সাবান ডলে ঘষতে ঘষতে বকাঝকা করছে।ছেলেটা হাঁটা শেখার পর থেকে এমন কোনো শয়তানী নাই যা তার দ্বারা সংঘটিত হয় নি।সবসময় মাহার জন্য কাজ বাড়ায়।ছেলের বাপের জন্য ছেলেকে চাইলেও কিছু বলতেও পারে না সে।
আরিহানকে গোসল করিয়ে তাকে তোয়ালে মুড়িয়ে রুমে নিয়ে এলো মাহা।পিচ্চিটা হুউ হুউ করে কাঁদছে।এখন তার ঘুমানোর সময়।এজন্য আরও বেশি উজ্জত করছে।মাহা আরিহানকে লোশন,তেল মাখিয়ে কাপড় চোপড় পড়িয়ে দিয়ে চুপচাপ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে দুধ খাওয়াতে লাগে।একটু পর আরিহান শান্ত হয়ে গেলো।দু চোখ ঢুলুঢুলু করছে তার ঘুমে।একটু পরেই চোখ জোড়ায় নেমে আসবে ঘুমপাখি।
ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে বিছানায় ঠিকঠাক মতো শুইয়ে দিলো মাহা,তারপর নিজেও গোসল করতে চলে গেল ওয়াশরুমে।আরাফাত আসতে আসতে সন্ধ্যারাত হবে।এখন সবেমাত্র পড়ন্ত দুপুর!
__________
সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে বাসায় প্রবেশ করলো আরাফাত।ইদানিং অফিসের কাজ অনেক বেড়ে গেছে।প্রমোশন হওয়ায় দায়িত্বও বেশি পড়েছে ঘাড়ে।
আরাফাত আসার অপেক্ষাতেই হল রুমে এতক্ষণ বসে ছিলো যেন আরিহান।যেই বাবাকে দেখতে পেল অমনি দৌড়ে এসে আরাফাতের সামনে দাঁড়ালো সে।অনেক আনন্দ নিয়ে মুখ ভরে পাপা পাপা ডাকতে লাগে আরিহান।ছেলের মুখে পাপা ডাক শুনে আরাফাতের সমস্ত ক্লান্তি যেন এক নিমিষেই উদাও হয়ে গেছে।হাসিমুখে ‘আমার আব্বুটা’ বলে ছেলেকে কোলে নিয়ে নেয় সে।আরিহান আরাফাতের দুই গালে দুইটা চুমু খেয়ে হাত মেলে আদো আদো স্বরে বললো,
-‘এত্তুটা মিত কলেতি পাপা!এত্তুটা!’
-‘ওলে আমার সোনা বাবাটা!পাপাও তো তোমায় এত্তোটা মিস করছিলাম।আমার আব্বুটাকে তো এখন কয়েকটা উম্মাহ দিতে হবে তাই না?’
আরিহান ছোট্ট ছোট্ট ইঁদুরে দাঁত মেলে হেসে মাথা ঝাকায়।আরাফাতও হেসে ছেলের দুই গালে,কপালে,থুতনিতে,নাকে চুমু খেয়ে বলে,’আমার গুড বয় টা!’
মিসেস মুমতাহিনা হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে এসে বললেন,’কী রে বাপ এসেছিস?’
-‘হ্যা আম্মু!’
-‘তো যা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হো।আর আমার দাদুভাইটাকে আমার কোলে দিয়ে যা।তোর ছেলেটা এত দুষ্টু হয়েছে কী বলবো!খাবার তৈরি করে তাকে খুঁজছিলাম আর সে এখানে এসে বসে আছে চুপচাপ।’
-‘তাই নাকি আব্বু?তুমি এখনও খাও নি?যাও মনা,চটপট খেয়ে এসো।তোমার জন্য আব্বু মজা এনেছি।খেয়ে আসলে তারপর দিবো!’
আরাফাত আরিহানের গালে চুমু খেয়ে কথাটি বলতেই আরিহান আদো স্বরে আততা বলে সুড়সুড় করে কোল থেকে নেমে হেলেদুলে হেঁটে দাদীর কাছে চলে গেল।মিসেস মুমতাহিনা আরিহানকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে বললেন,’চলো দাদুভাই।তোমার রিহাদ ভাইয়ার সাথে বসে মজার মজার খাবার খাবে চলো।’
তিনি চলে যেতেই আরাফাতও নিজের রুমে চলে এলো।রুমে এসে দেখলো মাহা শরবতের গ্লাস টেবিলের ওপর রাখছে।আরাফাতকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে সে।আরাফাতের হাত থেকে জরুরি ডকুমেন্টসের ব্যাগ নিয়ে মৃদুস্বরে বলে,’তুমি একটু আরামে বসে লেবুর শরবতটা খেয়ে তারপর ফ্রেশ হতে যেও, কেমন?’
আরাফাত মুচকি হেসে ঠিক আছে বলে।মাহা অনেক মজার শরবত বানাতে পারে।যা আরাফাতের খুবই প্রিয়।আরাফাত বিছানার ওপর বসতেই মাহা লেবুর শরবত এগিয়ে দিলো।আরাফাত তৃপ্তি সহকারে পরাণ জুড়ানো ঠান্ডা পানির শরবত পান করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।আর মাহা আরাফাতের পায়ের জুতা মোজা খুলে নিয়ে র্যাকে গুছিয়ে রাখছে।
শরবত খেয়ে ওয়াশরুমে গেলো আরাফাত ফ্রেশ হতে।কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মাহার পিছনে এসে দাঁড়ায় সে।মাহা আরিহানের সদ্য শুকানো কাপড় চোপড় গুলো ভাঁজ করে বেবি ওয়্যারড্রোবের ড্রয়ারে রাখছে একের পর এক।আরাফাত সোজা মাহাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে থুতনি রাখে।মাহা একটুও চমকায় না।কারণ এতটাদিন ধরে এমনটাই হয়ে আসছে।আরাফাত এতটাই মশগুল হয়েছে মাহার প্রতি যে সে মাহাকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারে না।মাহার দিওয়ানা প্রেমিক পুরুষ।কথাটা মাথায় আসতেই মুচকি হাসে মাহা।
আরাফাত মাহার গলার ভাঁজে ঠোঁট জোড়া স্পর্শ করে নেশালো কন্ঠে বলে,’জান,এখন একটা শাড়ি পরো না?তোমাকে শাড়িপরিহিতা অবস্থায় দেখতে আমার ভীষণ মন চাইছে।প্লিজ!’
মাহা আরাফাতের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো,’মিনতি করতে হবে না।একটু পরেই পরবো।তবে কোন রঙের পড়তে হবে একটু বলে দিও।’
আরাফাত মাহার পেটে হাত দিয়ে স্লাইড করতে করতে বললো,’তোমাকে সুতির একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম না গতমাসে।ওটা তো পড়ো নি কখনো!আজকে এটাই পড়বে।ঠিক আছে?’
-‘ওকে!’
-‘এখন একটা চুমু দাও ঠোঁটে?’
-‘আসতে না আসতেই অসভ্যতামো শুরু হয়ে গেছে তোমার তাই না?ছেলে এসে পড়বে যেকোনো মুহূর্তে!এখন না।ছেলে ঘুমিয়ে যাক তারপর।’
-‘একটা,প্লিজ,একটা!’ আরাফাত মাহাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার মুখ চেপে ধরেছে চুমু খাবে বলে।এমন সময়েই আরিহানের আগমন ঘটে রুমে।সে ছন্দে ছন্দে পাপা পাপা বলে ডেকে আরাফাতের পায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়ে হাত মেলে দিয়েছে কোলে ওঠবে বলে।বেচারা আরাফাত শেষ পর্যন্ত আর চুমুটা দিতেই পারলো না।অসহায় ফেস নিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে ফ্যাকাশে হাসলো সে।মাহা মুখ টিপে হাসছে শুধু।ছেলের জন্য যে কত রোমান্সের ব্যাঘাত ঘটেছে আরাফাতের তা বোধ করি না বলাই বাহুল্য।
আরিহান মজা খাওয়ার জন্য বারবার বলছে আরাফাতকে।আরাফাত তাকে কোলে নিয়ে আগের প্যান্টের পকেট থেকে একটা ক্যাটবেরি চকোলেট বের করে ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,’নাও হ্যাপি আমার বাবাটা?’
-‘আমি তাবো,এতা তাবো,তুলে দাও!’ আরিহানকে চকোলেটের প্যাকেট ছিঁড়ে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিছানার ওপর বসিয়ে দিয়েছে সে।আরিহান চকোলেট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেই আরাফাত ঝট করে মাহাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ঠোঁটের ভাঁজে ঠোঁট স্পর্শ করে ফেলে।মাহা পাগল একটা বলে আখ্যায়িত করে মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।আর আরাফাত বুকে হাত দিয়ে স্ত্রীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।
__________
রাত প্রায় সাড়ে দশটায় রাতের খাবার শেষ করলো সবাই।একসাথে ডাইনিং রুমে বসে গল্প গুজব ও খোশগল্পে মেতে উঠে খাবার খাওয়ার মজাটাই আলাদা।জয়েন ফ্যামিলিতে থাকলে এই আনন্দ সকলেই উপভোগ করে থাকেন।খাওয়া দাওয়া সেড়ে যে যার রুমে চলে গেছে ঘুমাতে।
মাহা খাবার খাওয়ার পর পরই রুমে এসে শাড়ি পড়ে নিয়েছে।শাড়ি পড়াতে অতি দক্ষ হওয়ায় দশ মিনিটও লাগে নি তার।সাজগোজ বলতে চোখের নিচে একটু গাঢ় করে কাজল আঁকলো।আর ঠোঁটে ম্যাজিক পিঙ্ক,চুল হাত খোঁপা বাঁধা।ব্যস এই তো।বাঙালি মেয়েদের আর সাজা লাগে না।এতটুকুই এনাফ।
আরাফাত আরিহানকে কোলে নিয়ে রুমে এসে মাহাকে দেখে স্ট্যাচু হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।লেভেন্ডার রঙের সাদা ব্লকপ্রিন্টের সুতির শাড়িতে মাহাকে ভীষণ ভালো মানিয়েছে।আরাফাত মাহাকে দেখে মুগ্ধ,বিমোহিত।মাহা সলজ্জ হেসে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আয়নার দিকে তাকায়।আরাফাতের চোখের পানে তাকালে তৎক্ষনাৎ হারিয়ে যেতে হবে।দুজনের ধ্যান ভাঙে আরিহানের হাততালির শব্দ শুনে।আরিহান আরাফাতের থুতনিতে হাত দিয়ে বারবার তার মাকে দেখিয়ে বলছে,
-‘মাম্মা তুন্দর,মাম্মা নাইত!’
মাহা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে ছেলের মুখ থেকে কমপ্লিমেন্ট শুনে।আরিহানও তার ইঁদুরে দাঁত বের করে হি হি করে হাসছে।হাসলে পিচ্চিটার দুই গালে একসাথে টোল পড়ে।গড়ন আর স্বভাব মাহার হলেও গায়ের রঙ সে তার বাবার থেকে পেয়েছে।চুলও আবার বাপের মতো স্টাইল করে ছাঁটা।কাপড় চোপড়ও স্টাইলিশ না হলে পড়ে না।এই বয়সেও বাচ্চারা এত এডভান্সড তা ওকে না দেখলে বোঝা যাবে না।
আরাফাত মাহার কাছে এগিয়ে এসে তাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে আদুরে কন্ঠে বললো,’আমার বউটাকে অন্নেক মায়াবী লাগছে দেখতে।কি কিউটটাই না লাগছে তোমাকে সোনা!’
মাহা কিছু বলার পূর্বেই আরিহান আদো স্বরে বলে,’চুনা মাম্মা।পাপা বলে চুনা মাম্মা!’
আরাফাত মৃদু হেসে বললো,’ধ্যাত বেটা,সে তোমার মাম্মা, আর আমার তো ওয়াইফি!’
মাহা হাসতে হাসতেই আরাফাতের কোল থেকে আরিহানকে নিয়ে বললো,’তুমি একটু অপেক্ষা করো।আমি ওকে ঘুম পাড়াই।নয়তো শুধু উল্টাপাল্টা বকতে থাকবে।’
আরাফাত আচ্ছা বলে বিছানার ওপর বসলো।মাহা ফিডারটা আরিহানের মুখে দিয়ে সস্নেহ স্বরে বললো,’আমার বাবাটা কত ভালো না?হুম?চুপটি করে দুধটুকু ফিনিশ করে ঘুমিয়ে যাও তো সোনা।না ঘুমালে এক্ষুনি ভাউ আসবে!’
আরিহান ভাউকে ভীষণ ভয় পায়।সে সঠিক জানে না ভাউটা আসলে কী জিনিস!কিন্তু এমনিতেই ভয় পায়।তাই তো গুড বয়ের মতো ফিডারের দুধটুকু খেতে লাগলো চপাচপ।আরাফাত বসে বসে মা ছেলের মধুর সম্পর্কটা প্রত্যক্ষ করছে একমনে।এরথেকে সুন্দরতম দৃশ্য বোধহয় পৃথিবীতে আর কিছু হয় না।
ফিডার খেতে খেতেই ঘুমে মাতাল হয়ে গেছে আরিহান।মাহা সহাস্যে আলতো ভাবে ঘুমন্ত ছেলের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।আরাফাত এগিয়ে এসে আরিহানকে নিজের কোলে নিয়ে বিছানার একপাশে শুইয়ে দেয় বালিশে যত্নসহকারে।অতঃপর নিজেও চুমু খায় ছেলের কপালে ও দুই গালে।
_____________
“দেখো,দেখো!আজকে মাত্র চিকন একফালি চাঁদ উঠেছে আকাশে।” মাহা আরাফাতের বুকে মাথা রেখে বিরাট জানালার দিকে মুখ করে আকাশের পানে দৃষ্টি মেলে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো কথাটা।
আরাফাত মাহার বাতাসে এলোমেলোকৃত চুলগুলো গুছিয়ে মাথার ওপর চুমু খেয়ে বললো,’তোমার আমার প্রেম ভালোবাসা দেখে লজ্জা পেয়ে চাঁদটাও লুকিয়ে গেছে বুঝলে?তাই নিজের দেহ একটুখানি বের করে উঁকি দিয়ে আমাদের মধুরাতি লক্ষ করছে।’
মাহা আরাফাতের লোমশ বুকে চুমু খেয়ে বললো,’লামিয়ার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ!সেদিন যদি সে তোমাকে ছেড়ে না যেতো,তবে কী আজকে আমি তোমার বুকে মাথা রেখে এভাবে জানালাবিলাশ করতে পারতাম বলো?’
-‘এভাবে বলো না জান!আমার ভাগ্যে শুধু তুমিই ছিলে,এজন্যই তো এত প্রতিকূল মুহূর্ত পেরিয়ে দুজন একসাথে আছি।একটাসময় তোমাকে আমি বোন ছাড়া কখনোই অন্য নজরে দেখতে পারতাম না।সবসময় ভাবতাম,লিসা-নিসার মতো তুমি আর নওশিনও আমার বোন।কিন্তু এখন আমি তোমাকে প্রিয়তমা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না।তুমি আমার সন্তানের মা,আমার মনের প্রেমানুভূতির সঞ্চারিনী।আমার চোখের তারা তুমি।আমার সব তুমি!’
-‘সেই কিশোর বয়সের প্রথম আবেগ ছিলে তুমি!সবসময় তোমার দিকে স্বপ্নীল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতাম।মনে মনে তোমাকে নিয়ে এক কল্পনার জগৎ সাজাতাম।সবসময় তোমাকে নিয়েই ভাবতে থাকতাম।আল্লাহর কাছে তোমাকেই চাইতাম প্রত্যহ।এই আবেগটা কখন যে ভালোলাগা থেকে ভালোবাসায় রূপান্তর হলো বলতে পারবো না।আমার ডায়েরি গুলোর প্রতিটা পাতার পঙক্তিই ছিলো তোমাকে নিয়ে লেখা।এত ভালোবাসতাম তোমাকে।যাক,আল্লাহ আমাকে নিরাশ করেন নি।আমি পেয়ে গেছি তোমায়।বাকিটা জীবনও এভাবে তোমার বুকে মাথা রেখে কাটাতে চাই,তোমার হাতে হাত রেখে চলতে চাই।’
আরাফাত মাহার ঠোঁটের ওপর আলতো করে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো।গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,’আমার জীবনের প্রথম ভুল ছিলো তোমার অনুভূতি না বোঝা,আর দ্বিতীয় ভুল ছিলো লামিয়াকে ভালোবেসে বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়া।কিন্তু তৃতীয় ভুল আর করবো না আমি।আমি আমার জীবনের সব প্রাপ্তিটুকু পেয়ে গেছি।আর কিছু দরকার নেই আমার।এখন তোমাকে সাথে নিয়ে আমাদের সন্তানকে মানুষ করার দায়িত্বটুকু পালন করতে পারলেই দুজন শান্তি।কী বলো?’
-‘হুম!আমার ছোট্ট সংসারটা পরিপূর্ণ করতে একটা মেয়ে লাগবে?দিবা?’ অনেক আগ্রহ নিয়ে কথাটা বলে মাহা।
আরাফাত মাহার নাকের সাথে নাক ঘষে হাসিমুখে বলে,’তাহলে তো আজকেই ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতেই হয়!’
-‘যাহ দুষ্টু লোক!’ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে মাহা।আর আরাফাতের মুখে দুষ্টুমির হাসি।আরাফাত মাহার লজ্জা পাওয়াটা ভীষণ উপভোগ করছে।মাহাকে বুকের সাথে চেপে ধরে আদুরে স্বরে বলে,’জানি না,হয়তো কখনো কোনো নেকির কাজ করেছিলাম,নয়তো তোমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পেতাম না।অনেক ভালোবাসি তোমায় প্রিয়াঙ্গিনী।অনেক ভালোবাসি।সবসময় আমার বুকের সাথেই এভাবে লেপ্টে থেকো!আমার বুকটা তৃপ্তিতে ভরা ভরা লাগে তুমি মাথা রাখলে।লাভ ইউ মাই কুইন!’
মাহার নিজেকে ভীষণ সুখী মনে হচ্ছে।এত সুখ এত শান্তি স্বামীর বুকে মাথা রাখলে পাওয়া যায় তা হয়তো অনেকের ভাগ্যে থাকে না।আরাফাত অনেক ভালো একটা ছেলে।সে নিজের বউ বাচ্চাকে প্রচুর প্রায়োরিটি দেয়।অনেক ভালোবাসে সে মাহাকে।আর যারা ভালোবাসতে জানে,তারা আগলে রাখতেও জানে।মাহা পাশেই শোয়া ঘুমন্ত ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আরাফাতের বুকে নাক ঘষে নেশাভরা কন্ঠে সুর করে বললো,
-‘এ প্রণয়ে কথা দিলাম,
সূর্য,চন্দ্র, তারা
সাক্ষী থেকো মরন যেনও
হয়না তোমায় ছাড়া!’
“ভালোবাসার কোনো রঙ হয় না।ভালোবাসা হয় পানির মতো টলটলে স্বচ্ছ।এই যে আমার মনের মধ্যে সৃষ্ট এক অন্যরকম অনুভূতির প্রতিফলন ঘটেছে তোমার কাছে এসে,একমাত্র তোমায় ভালোবেসে।এই ভালোবাসার মেয়াদ কভু ফুরাবে না।নিঃশেষ হবে না তোমার আমার প্রেম।এই অনুভূতির রঙ মনের মাঝে গাঢ় করে মাখিয়ে নেবো দুজনে।মিশে যাবো গভীর অনুরণনে,তুমি আমি একসাথে!”
মাহা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তার বেঁচে থাকার অবলম্বনকে।আরাফাত আবেশে চোখ বন্ধ করে বুকে নিয়ে শোয় প্রিয়তমাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে।এই অনুভুতির মায়াজাল কখনো ছিড়বে না।কারণ এটা এক অন্যরকম অনুভূতির সংমিশ্রণ।যেই অনুভূতির ডালপালা তাদের দুজনের মনে সংযুক্ত আছে।এবং থাকবে মৃত্যুর আগ অবধি।
____ সমাপ্ত ____
পরিশেষ:-লামিয়া ২ বছর পরেই জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে।কিন্তু আশফার বাবার দাপটের জন্যে আলভির জেল হয়েছিলো ৬ বছরের।দুজনেই তাদের প্রতারণার শাস্তি পেয়ে গেছে।অতঃপর আর কোনো উপায় ও কোথাও কোনো ঠাঁই না পেয়ে দুজন বিয়ে করে নিয়েছে একসাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার জন্য।আরাফাত খুবই নরম মনের মানুষ,তাই তাদের দুজনকে সে ঢাকা থেকে অন্য জেলায় চলে যেতে সাহায্য করেছে।হাজার দোষ করুক,বরং তাদের বদৌলতে সে মাহাকে পেয়েছে।এজন্য সে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।এবং আলভিকে চলার মতো একটা চাকরিও জুটিয়ে দিয়েছে।এখন টানাটানির সংসার হলেও দুজন কিছুটা হলে ভালো আছে।দুজনেই হারে হারে টের পেয়েছে কাউকে ঠকানোর ফল।দুজনে তওবা করেছে,আর কখনো এসব প্রতারণার কাজে জড়াবে না।খেয়ে না খেয়ে সম্মানের সহিত বেঁচে থাকবে।
আরাফাত আর মাহার সুখের সংসারে দুই বছর পর আরিহানের ছোট্ট একটা বোন এসেছে।তারাও অনেক সুখে আছে।সুখের কোনো কমতি নেই তাদের সংসারে।অনেক অনেক অনেক বেশি ভালো আছে দুজন তাদের সন্তানাদি নিয়ে।কারও কোনো অভিযোগ নেই ভাগ্যের প্রতি।বরং সবসময় শুকরিয়া আদায় করে আল্লাহর দরবারে এত ভালো জীবনসঙ্গী-জীবনসঙ্গিনীকে উপহার দেয়ার জন্য।