অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -২২

0
1970

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_২২

মিসেস মুমতাহিনা নিজের রুম থেকে বেরিয়ে হেলেদুলে হেঁটে এলেন এদিকে।আর নিসা আরাফাত যে রুমে আছে সে রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছিলো চিন্তিত ভঙ্গিতে।ওনাকে আসতে দেখে নিসা ফাঁকা ঢোক গিলে মেকি হাসলো।যত যাই হয়ে যাক না কেন,এখন মাকে এসব ব্যাপারে কিছুই জানানো যাবে না।আগে মাহাআপু আসুক তারপর তাকে জানিয়ে যা করার তা করা যাবে।মনে মনে ভাবলো নিসা।

মিসেস মুমতাহিনা নিসাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করলেন,’তুই এখানে কী করিস নিসা?আর আমার ছেলে কই?’

-‘ইয়ে,আম্মু,আসলে ভাইয়ার ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলো তাই আমি ভাইয়াকে এইরুমের ওয়াশরুমে দিয়ে এসেছি।’ নিসা মিথ্যা একটা কথা বানিয়ে বলে দিলো।মিসেস মুমতাহিনা যাতে কোনো সন্দেহ না করেন তাই এত লুকোছাপা আরকি।

-‘সেকী কথা।তাকে একা ছাড়লি কেন?আমাকে ডাকতে পারলি না।যদি আমার ছেলে পড়ে গিয়ে ব্যথা পায়?’ মিসেস মুমতাহিনা চেহারায় উদ্বেগ প্রকাশ করে উক্ত কথাটি বললেন।ছেলের জন্য অনেক চিন্তা তাঁর।নিসা তাকে আশ্বস্ত করে জবাব দিলো,

-‘না আম্মু।তুমি হুদাই টেনশন করছো।ভাইয়ার কিচ্ছু হবে না।একটু পর ভাইয়া যখন ডাকবে আমায় তখন গিয়ে নিয়ে আসবো আমি।’

-‘আচ্ছা তুই থাকিস আরাফাতের সাথে।তোর আব্বু একটু আগে ফোন দিয়ে বললো অফিসের কী যেন দরকারী কয়েক তা কাগজ বের করে রাখতে।সেটাই এখন গিয়ে খুঁজতে হবে বুঝলি!তোর বাপের তো আবার কোনো টাইম নেই।এসেই তাড়াহুড়ো করে কাগজ নিয়ে চলে যাবে।আমি বরং যাই, তুই তোর ভাইয়ার খেয়াল রাখিস।মাহা একটু পরই চলে আসবে হয়তো।’

-‘তুমি মোটেও চিন্তা করো না আম্মু।আমি আছি ভাইয়ার সাথে।তুমি যাও গিয়ে আব্বুর কাগজগুলো ঝটপট বের করে ফেলো।’

-‘হুম যাই।না জানি কোথায় রেখেছে,এখন আমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হতে হবে।কেন যে জরুরি ডকুমেন্টস সব সামলিয়ে রাখে না।বিরক্ত লাগে আমার।এই বয়সে এত খোঁজা খুঁজি ভাল্লাগে না।’

বিরক্তিতে গজগজ করতে করতে তিনি আবারও চলে গেলেন তার কাজে।নিসা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।সত্যি জানলে এখুনি ভেজাল লেগে যেত।মাহা কখন বাসায় আসে সেই অপেক্ষায় প্রহর গুনতে লাগলো নিসা।আজ এমন একটা ঘটনা ঘটেছে যেটা মাহাকে না জানালে অনেক বড় সমস্যা হবে।জানানোটা বাধ্যতামূলক।কারণ লিপি এখনও বুঝতে পারে নি যে সে কার স্বামীর দিকে নজর দিয়েছে।আজকে খুব ভালো করে টের পাবে বাছাধন।কত চালে কত ভাত আজকেই তিনি ঠাহর করতে পারবেন।
__________

লিপি শয়তানী হাসি হেসে সারারুম জুড়ে চরকার মতো ঘুরছে।খুশি যেন তার আর ধরে না।একমাত্র সম্পত্তির লোভে ওই ল্যাংড়াটাকে নিজের করা ভীষণ প্রয়োজন।একবার কোনো অঘটন ঘটিয়ে বিয়ে করে ফেললেই কেল্লাফতে।তখন আরাফাতের টাকা পয়সা,সয় – সম্পত্তি সব নিজের নামে করে ছেড়ে দেয়া যাবে।এখনের যুগে টাকা ছাড়া কিছু হয় নাকি?টাকাই তো মূল তুরুপের তাস!

-‘আজ চুমু পর্যন্ত চলে যেতে পেরেছি,ক’টাদিন পর সোজা বিয়েই সেড়ে ফেলবো।তুমি কিচ্ছুটি করতে পারবে না মাহা।অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া তুমি আর কিছুই করতে পারবে না।হা হা!’
কথাগুলো নিজের মনে বলে পাগলের মতো হেসে উঠে লিপি।চোখের সামনে নিজের রাজত্ব দেখতে পাচ্ছে সে।আরাফাতরা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো সাধারণভাবে চলাফেরা করলেও তারা যে কোটিপতি তালিকার মধ্যে রয়েছে তা খুব ভালো করেই জানে লিপি।এদের সম্পত্তির অভাব নেই।শুধু এটাই যে এই পরিবারের কেউ বেশি বিলাসিতা করতে পছন্দ করে না।আর ওরা এত টাকার মালিক যে ৪-৫ টা ডুপ্লেক্স বাসা একসাথে কিনে নেয়ার ক্ষমতা রাখে।কিন্তু দেখলে তা মনেই হয় না।

অতি লোভের কারণে চকচক করছে লিপির চোখ।তবে আজকের চাল টা একটু উল্টো হয়ে গেছে।নিসা সামনে না থাকলে সমস্ত দোষ আরাফাতের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতো লিপি।কিন্তু বেশি এক্সাইটেড হয়ে নিসার সামনে এই কাজটা করে ভুল করে ফেলেছে সে।যদি নিসা সবাইকে কথাটা বলে দে,তাহলে তো মহা সর্বনাশ!লিপি তড়াক করে একদৌড় দিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।যে করেই হোক নিসার মুখ বন্ধ করতেই হবে।

নিসা তখনও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।লিপিকে এদিকে দৌড়ে আসতে দেখে নিসার ভ্রু কুচকে এলো।বিরক্তি ও রাগের চোটে চোখ ফিরিয়ে নিলো সে।লিপি নিসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,

-‘তুই এখানে কী করিস নিসা?’
-‘দেখছো না দাঁড়িয়ে আছি!’ প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে জবাব দেয় নিসা।
-‘যাইহোক,শুন আজকে যা হয়েছে তা জাস্ট একটা মিস্টেক ছিলো।আমার ভুল হয়েছে।তারজন্য আ’ম সরি।তুই প্লিজ এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলিস না।নয়তো সবাই আমাকে খারাপ ভাববে।’ লিপি কাতর গলায় অভিনয় করে বললো।

নিসা তাতে একটুও গললো না।বরং রণচণ্ডী রূপ ধারণ করে ধমক দিয়ে বললো,’চুপ করো তুমি।আর একটা কথাও বলবে না।ছি আমার ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে যে তুমি আমার খালাতো বোন।আজকে তুমি এটা কী করলে?হাউ চিপ গার্ল ইউ আর।তুমি এত খারাপ আগে জানলে আমাদের বাসায়ই তোমাকে কখনো আসতে দিতাম না।আর আজকে আমার সামনে তুমি আমার ভাইয়ের সাথে যা করলে না,সেটার একটা বিহিত আজকেই হবে মাইন্ড ইট।সবাই জানুক তোমার কুকর্মের কথা।আজকে আসুক মাহা আপু।তাহলে আজকেই তোমার শেষ দিন হবে এই বাসায়।’

নিসার কথা শুনে লিপির মাথায় আগুন জ্বলে গেল যেন।রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে নিসাকে আঘাত করে ফেললো সে।তারপর হিড়হিড় করে টেনে আরাফাত যে রুমে আছে সে রুমের অপজিটের খালি রুমটাতে নিয়ে গেল।নিসার মুখ চেপে ধরে রেখেছে সে যাতে ও কোনো আওয়াজ না করতে পারে।রুমের ভেতর ঢুকে দরজা লাগিয়ে ফেলে লিপি।নিসাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিলো তৎক্ষনাৎ।নিসা ব্যথা পেয়ে গোঙাচ্ছে একনাগাড়ে।লিপি নিসার সামনে বসে নিসার থুতনি শক্ত করে ধরে হিসহিসিয়ে বললো,

-‘খবরদার নিসা!ভুলেও আমার কথার অবাধ্য হস না যেন।নয়তো মেরে গুম করে দিবো,কেউ একটু টেরও পাবে না।আমার কথাটা মনে থাকে যেন।’

নিসা ভয় পেয়েছে এমন ভঙ্গি করে দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালো।ত্রস্ত কন্ঠে জবাব দিলো,

-‘কাউকে বলবো না আপু।তুমি আমাকে আর মেরো না।’

-‘গুড গার্ল।তোর ভাইকে নিয়ে সমস্যা নেই,সে মরে গেলেও এই লজ্জার কথা কাউকে বলতে যাবে না।এখন শুধু তুই মুখটা বন্ধ রাখলেই হবে।বুঝলি?ভুলেও যেন এসব লিক না হয়!’

-‘হবে না আপু।বলবো না কাউকে।তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।’

-‘হুম।তুই হাতের কনুইতে একটু মলম লাগিয়ে নিস।ছুলে গেছে মনে হচ্ছে।বেশি ব্যথা পাস নি তো আবার?’

নিসা মনে মনে মুখ বাঁকিয়ে বললো,”হারামজাদি,জুতা মেরে গরু দান করতে আসিস!আজকে যে এই বাসায় তোর শেষ দিন তা নিয়ে তুই শিওর থাক।একবার মাহা আপু আসুক।তারপর তোর হচ্ছে!”

-‘কী রে কী ভাবিস এত?’ লিপির ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে তার।শান্ত কন্ঠে বললো,’নাহ ব্যথা লাগে নি তেমন।চিন্তা করো না।তুমি যাও এখন।কেউ দেখলে সন্দেহ করবে।’

-‘হ্যা যাচ্ছি।আর আমি যা বললাম মনে থাকবে তো!’
-‘হুম থাকবে!’
-‘গুড,আমি যাই এবার।’

লিপি উড়তে উড়তে চলে গেল তার রুমে।লিপি যাওয়ার পর নিসা দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে বসে বললো,’বেশি উড়িস না।আজ তোর কপালে মারাত্মক দুঃখ আছে।আমার গায়ে হাত তোলার ফল হারে হারে টের পাইয়ে দিবো।আব্বু আর ভাইয়া আজ আসুক।আব্বুর আদরের মেয়ের গায়ে হাত তোলার সাহস ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে নে।’
__________

মাহার নার্সারি থেকে চারাগাছ,বীজ এসব কিনতে বেশি সময় লাগে নি।বাসার একদম কাছেই নার্সারি।পায়ে হেঁটে যেতে মাত্র ৭ মিনিট লাগে।পছন্দসই চারাগাছ,বীজের প্যাকেট কিনে একটা রিকশা ভাড়া করে তাতে সব চারাগাছ আর বীজের পলিথিন ব্যাগ তুলে দিয়ে রিকশাকে বললো সামনে যেতে।লিসা আর সে রিকশার পিছনে পিছনে হেঁটে আসছে।

বাসার সামনে এসে রিকশা থামলে লিসা আর মাহা দ্রুত চারার টবগুলো নামাতে লাগে।বাসার সামনের সিকিউরিটি গার্ডকে ইশারা দিয়ে বললো সে ওগুলো নিয়ে গাড়িবারান্দায় রাখতে।গার্ড এসে একে একে সব নিয়ে যেতে লাগে,মাহা রিকশা ভাড়া মিটিয়ে গেটের ভেতর প্রবেশ করলো।লিসা তার পাশেপাশি হাঁটছে।দুজনেই বেশ ফুরফুরে মুডে আছে।হাসিখুশি ভীষণ।

বাসার সদরদরজার সামনে এসে কলিং বেল পুশ করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো মাহা আর লিসা।কারও রেসপন্স না পেয়ে আরও কয়েকবার বেল চাপলো সে।প্রায় আরও কয়েক মুহূর্ত পর জেনি এসে দরজা খুলে দিলো।জেনি প্রায় আধভেজা অবস্থায় এসে দরজা খুলেছে।হাতে ডিটারজেন্টের ফেনা,দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কাপড় ধোয়া ছেড়ে ওঠে এসেছে।

মাহা ভেতরে ঢুকে জেনিকে জিজ্ঞেস করলো,’কীরে বাকিরা কই?কাউকে দেখা যাচ্ছে না কেন?’

জেনি হাত নেড়ে জবাব দিলো,’খালাম্মা মনে হয় হের রুমে আছে।আর বাকিরা কই হেইডা কইতে ফারমু না।আই কলিং বেলের আওয়াজ হুনি বাথরুম থই বারইয়া আইছি।’

-‘আচ্ছা যা, তুই তোর কাজে যা।’
-‘আইচ্ছা আফামনি।’

জেনি চলে গেল।মাহা চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিজের রুমে গেল।তার চোখ জোড়া শুধু আরাফাতকে খুঁজছে।লিসাও চলে গেল তার নিজের রুমে।

মাহা হিজাব খুলে কাপড় পাল্টে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এলো।এতক্ষণে তো নিসার আরাফাতকে নিয়ে রুমে চলে আসার কথা।কই গেল ওরা দুজন।ভাবীকেও দেখা যাচ্ছে না আজ।মাহা বাইরে দুবার উঁকি দিয়ে সোজা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।মাহা হেঁটে হেঁটে করিডরের দিকে গেল।চারিদিকে চোখ বোলাচ্ছে সে একমাত্র আরাফাতকে দেখার আশায়।হঠাৎ একটা রুমের সামনে এসে মৃদু গোঙানির আওয়াজ পেল মাহা।কান খাঁড়া হয়ে গেল তার।খুবই মৃদু একটা আওয়াজ কিন্তু মাহার কান এড়িয়ে যায় নি।সে কৌতুহল বশত দরজা খুলে রুমের ভেতর চোখ বোলালো।নিসাকে পা ধরে মাটিতে বসে থাকতে দেখে দ্রুত পায়ে হেঁটে নিসার সামনে এসে বসে সে।ব্যগ্র কন্ঠে ওর গালে হাত বুলিয়ে জানতে চায়,

-‘নিসা,কী হয়েছে তোর বোন?তোর এই অবস্থা হলো কী করে?ব্যথা কীভাবে পেলি?দেখি আমায় দেখতে দে!’ মাহা ব্যাকুল হয়ে গেছে নিসাকে ব্যথায় কাতরাতে দেখে।মাহাকে দেখতে পেয়ে নিসার এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা কান্না যেন ভলকে ভলকে বেরিয়ে এলো।’আপু’ বলে হেঁচকি তুলে কাঁদতে শুরু করে সে।মাহা নিসাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে কন্ঠে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,’কাঁদিস না সোনাবনু আমার?কী হয়েছে আপুকে বল?পায়ে চোট লাগলো কীভাবে?আর তুই এই রুমেই বা কী করছিস একা?’

নিসা কেঁদে কেঁদে একে একে সমস্ত কিছু মাহাকে খুলে বলতে লাগে।সবকিছু শুনে মাহার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে।রাগের স্ফুলিঙ্গ তড়িৎ বেগে মস্তিষ্কের শিরায় শিরায় পৌঁছে গেলো তৎক্ষনাৎ।আজকে এই লিপির একদিন কী তার যতদিন লাগে।নিসা ফুপিয়ে কেঁদে বললো,

-‘আপু,ডাইনীটা আমার মুখ বন্ধ করার জন্য আমার গায়েও হাত তুলেছে।জোরসে থাপ্পড় মেরে এখানে ধাক্কা দিয়ে ফেলে রেখে গেছে।আর বলেছে কাউকে যেন এসব না বলি।জানো আপু,পায়ে না বড্ড ব্যথা পেয়েছি,হাতের কনুই ফ্লোরের সাথে ঘষা খেয়ে ছুঁলে গেছে।জ্বলছে খুব।’

মাহা কিছু না বলে নিরবে নিসাকে তুলে দাঁড় করালো।শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,’হাঁটতে পারবি সোনা?’

নিসা আলতো মাথা নেড়ে সায় জানালো।মাহা শক্ত করে নিসাকে ধরে তাকে নিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো।নিসাকে নিসার রুমে পৌঁছে দিয়ে লিসাকে বললো ওর খেয়াল রাখতে।লিসা কৌতুহলে ফেটে যাচ্ছে কিন্তু মাহাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না।কারণ মাহা যখন অতিরিক্ত রেগে যায় তখন সে পুরোপুরি শান্ত হয়ে যায়,ঝড়ের পূর্বে যেমন চারিদিক নিরবতা গ্রাস করে অনেকটা সেরকম।সাথে তার চোখ জোড়া রক্তবর্ণ ধারণ করে।লিসা নিসা খুব ভালো করেই তা জানে।

মাহা রুম থেকে বেরিয়ে আরাফাতের কাছে চলে গেছে।লিসা নিসাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে জিজ্ঞেস করল,’আসল ঘটনাটা কী নিসা?যার কারণে মাহা আপু এতটা ফায়ার হয়ে আছে!’

নিসা লিসাকে আরেকদফা সবকিছু খুলে বললো।সবশুনে লিসার চোখ রসগোল্লা হয়ে গেল।নিসার দিকে তাকিয়ে মেকি হেসে বলে সে,

-‘আজকে মারাত্মক দুঃখ অপেক্ষা করছে লিপি আপুর জন্য।মাহা আপু যা রেগেছে না!আমার তো এখন ভয় করছে রে।আজকে সেই কেলানি খাবে সে মাহা আপুর হাতে।’

-‘বেশি করে কেলানি খাক খবিশটা দোয়া করি।আমার বাসায় থেকে আমাকেই মারে সাহস কতো!জাহান্নামে গিয়ে মরুক কুত্তিটা।’

রাগে দাঁত কিড়মিড় করলো নিসা।মনে মনে হাজারটা গাল দিচ্ছে লিপিকে।
__________

আরাফাতকে নিসা যে রুমে রেখে এসেছে ঐ রুমে গিয়ে প্রবেশ করলো মাহা।রুমের দরজা জানালা সব বন্ধ করা,বাতিও নেভানো।যার ফলে রুমটাকে পুরো অন্ধকারে গ্রাস করে নিয়েছে।মাহা একপা দু পা করে এগিয়ে এসে রুমের বাতি জ্বালালো।আরাফাত মাটিতে বসে বিছানার ওপর মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে বিধ্বস্ত অবস্থায়।মাহা আরাফাতের কাছে গিয়ে বসে তাকে ডাকলো।

-‘শুনছো তুমি?এই যে?’

মাহার ডাকে আরাফাত চোখ পিটপিটিয়ে তাকালো।মাহাকে দেখতে পেয়ে তার চেহারা করুন হয়ে গেল।আরাফাতের দৃষ্টিতে অপরাধ বোধ স্পষ্ট।মাহা আলতো হেসে আরাফাতকে নিজের দিকে টেনে জড়িয়ে ধরলো।আরাফাতও একটা বিশ্বস্ত সঙ্গী পেয়ে যতটুকু সম্ভব ততটুকু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো।মাহা আরাফাতের ঘাড়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে কানের লতিতে চুমু খেয়ে বললো,

-‘তুমি জানো না?পুরুষ মানুষের এত সহজে ভেঙে পড়লে চলে না!এত ইমোশনাল কেন তুমি?ছেলেদেরকে সবসময় শক্ত মন মস্তিষ্কের অধিকারী হতে হয়,যাতে সমস্ত প্রতিকূল মুহূর্তেও তারা কখনো ভেঙে না পড়ে।তোমাকে একটা মেয়ে জোর করে চুমু খেয়ে চলে গেল আর তুমি তার প্রতিবাদ না করে রুমের এককোণে বসে মেয়েদের মতো লজ্জায় অপরাধ বোধে লাল হয়ে কাঁদছো!এটা কী ঠিক বলো?’

আরাফাত মাহার কথা শুনে অবাকের শীর্ষে।সে বুঝতে পারছে না যে মাহা এসব জানলো কীভাবে? সে মাহাকে ছেড়ে দিয়ে বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করল,’তুমি কীভাবে জানলে হানি?কে বলেছে তোমায়?নিসা বলেছে?’

-‘যেই বলুক তা আসল কথা নয়।আসল কথা হলো,তোমার প্রতি আমার নজরদারি দিনেরাতে চব্বিশ ঘণ্টা অর্থাৎ সবসময়ই থাকে।সো কীভাবে জানলাম তা নাহয় অজানা থাক।শুধু এটা বলো,লিপি যখন তোমার সাথে এমন অসভ্যতামো করেছে তখন তুমি তাকে কষে একটা থাপ্পড় মারতে পারলে না?’

আরাফাত মাথা নিচু করে জবাব দিলো,’ভালো হাত (বাম) যেটা সেটা দিয়ে ধাক্কা মেরেও সরাতে পারি নি অসুর টাকে।ভাঙা হাত দিয়ে কিছু করার জন্য কোনো বলই পাই না।নয়তো ওকে ওখানেই মেরে গাল ফাটিয়ে দিতাম!নিসার সামনে অমন অসভ্যতামো করেছে আর আমি কিছুই করতে পারি নি।লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে হানি।খুব খারাপ লাগছে আমার।দুই বছরের রিলেশনে লামিয়ার হাত ধরা ছাড়া অন্য কিছু আমাদের মধ্যে ছিলো না।ইভেন লামিয়া টাকার প্রতি লোভী হলেও কখনো আমাকে সামান্য একটা ফোরহেড কিস করার জন্যও বলে নি।তুমিই সেই মেয়ে যাকে আমি গভীর ভাবে স্পর্শ করেছি।আর আজ,,,নিজেকে খুব অপবিত্র মনে হচ্ছে আমার।’

মাহা আরাফাতের দুই গাল আঁকড়ে ধরে আদুরে কন্ঠে বললো,’নিজেকে অপবিত্র মনে করবে না কখনো।তুমি পবিত্র আছো,সব ঠিক আছে।মনে করো কিছুই হয় নি।বি স্ট্রং ম্যান!এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো দরকারই নেই।এখন আসো,তোমায় মজার একটা লাইভ টেলিকাস্ট দেখাই।তুমি শুধু মজা নেবে।কোনো কথা বলবে না।অকে?

আরাফাত বাধ্য ছেলের মতো সায় জানালো।মাহা গুড বলে আরাফাতকে ধরে মাটি থেকে তুললো।তারপর ধীরে ধীরে তাকে নিয়ে নিজেদের রুমে চলে এলো সে।আরাফাতকে নিজেদের রুমের বিছানার ওপর আরামসে বসিয়ে রেখে মৃদু হেসে বললো,’তুমি একটু থাকো,আমি জরুরি জিনিসটা নিয়ে আসি!’

আরাফাত ঠিক আছে বলে ঠিকমতো নড়েচড়ে বসলো।মাহা ঝড়ের বেগে রুম থেকে প্রস্থান করলো।মাহার সান্নিধ্য পেয়ে আরাফাতের মনখারাপের ভার অনেকটাই কমে গেছে।এখন মনটা ভালো লাগছে তার কিছুটা।

মাহা রান্নাঘরে ঢুকে ফ্রিজ খুলে কয়েকটা বোম্বে মরিচ থেকে বেছে বেছে কালো দেখে একটা মরিচ হাতে নিলো।এইটাকে কালো নাগা বলে।মারাত্মক তেজ আর ঝাল হবে এটা।মরিচটা হাতের মুঠোয় পুরে ঠোঁটের কোণে ডেবিল স্মাইল ফুটিয়ে তুললো সে।আব আয়েগা মাজা!আগে আগে দেখো হতা হ্যায় কিয়া!

মরিচটা হাতে নিয়ে মাহা সোজা গেল লিপির রুমে।লিপির রুমের দরজা খোলা থাকায় অনায়াসে ভেতরে ঢুকে পড়লো সে।লিপি কানের মধ্যে ইয়ারফোন গুঁজে মনের সুখে গান শুনছে।গানের তালে তালে তার হাত আর মাথা নাচছে।মাহা মনে মনে বললো,”এইবার তোর সাথে যা হতে যাচ্ছে,তার জন্য তুই নিজেই দায়ী।গান শোনে চিল মুডে থাকার শখ একদিনেই মিটিয়ে দিবো।কার স্বামীর দিকে নজর দিছো এখনও টের পাও নাই বাছা।পাবা,পাবা,খুব শীঘ্রই পাপের ফল পেয়ে যাবা।খাঁড়াও,মুই আইতাছি।”

মাহা কোনপ্রকার কোনো বাক্যব্যয় ছাড়াই এগিয়ে এসে কিছু বুঝে ওঠার আগেই চট করে লিপির হাত ধরে হিড়হিড় করে বিছানা থেকে টেনে নামালো।লিপি হকচকিয়ে গেছে পুরো।মাহাকে দেখে চেঁচিয়ে বলে উঠে,’হোয়াট দ্যা হেল!এসবের মানে কী?আমার হাত ধরে টানাহেঁচড়া করছো কেন আজব?

-‘আজব না,আজব না!তোমায় একটা জিনিস দেখানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছি।জলদি আসো,নয়তো মজাটা মিস করবা।’ মাহা দাঁত কেলিয়ে হেসে লিপিকে টানতে টানতে রুম থেকে বের করলো।লিপি মাহার শক্তির সাথে পেড়ে ওঠছে না।ভয়ও লাগছে,কৌতুহলও জাগছে!তাকে কী দেখাতে চায় মাহা?বুঝতে পারছে না সে।

লিপির রুম বেশি দূরে নয় মাহার রুম থেকে।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লিপিকে নিজের রুমে নিয়ে আসলো মাহা।লিপি বারবার মাহাকে বলছে,’হাত ছাড়ো!আমার লাগছে।এখন কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে মাহা।ছাড়ো আমার হাত।’

মাহা লিপিকে ধাক্কা দিয়ে রুমে ঢুকিয়ে দরজা লক করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো।আরাফাত বিস্মিত নয়নে তাদের কান্ডকারখানা দেখছে।মাহা ফুল ভোল্টেজে ফ্যান অন করে স্পিকারে সুন্দর একটা গান ছেড়ে লিপির দিকে এক পা দুপা করে এগিয়ে গিয়ে বললো,’বাড়াবাড়ির কী দেখেছো সোনা!এখনও তো আসল ভেলকিটাই দেখানো হলো না।’

-‘মা,মানে?’ ভয়ের চোটে তোতলানো শব্দ বেরোচ্ছে লিপির মুখ দিয়ে।কপালে সুক্ষ্ম ঘামের রেখা দেখা দিয়েছে ইতিমধ্যে।

মাহা নাগা মরিচটাকে ভেঙে লিপির আরও কাছে গিয়ে লিপির চুলের মুঠি শক্ত করে চেপে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে জবাব দিলো,’বিবাহিত পরপুরুষের ঠোঁটে চুমাচুমি করতে ভীষণ মজা লাগে তাই না রে?তাও আর মানুষ খুঁজে পেলি না,আমার বরের পিছনে লেগেছিস।তাহলে এত সহজে কীভাবে ছেড়ে দিই তোকে বল!মাহা কী চিজ তা আজকেই বুঝে যাবি খুব ভালো করে।আজ এমন শিক্ষা দিবো যে নেক্সট টাইম আমার বরের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও ভয় পাবি তুই!’

মাহা যেন বর্তমানে জ্বলন্ত এক আগ্নেয়গিরি।লেলিহান আগুনের শিখা তার চোখের তারায় স্পষ্ট।লিপির ভয়ে গা ছমছম করে উঠে।জোরে চেঁচিয়ে উঠলো সে,’ছাড়ো আমায়!আহ,ছাড়ো লাগছে।হেল্প!আরাফাত তোমার বউকে বাঁধা দাও প্লিজ।’

আরাফাত নির্বিকার ভঙ্গিতে দেখে যাচ্ছে সব।মাহা লিপিকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে নাগা মরিচটা লিপির ঠোঁটে জোরসে ডলে দিচ্ছে।লিপি গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।ফ্যানের শব্দে আর গানের ছন্দে ভেতরের চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ বাহিরে যাচ্ছে না।মাহা নিষ্ঠুরভাবে নাগামরিচ লিপির ঠোঁটের ওপর জোরে জোরে ঘষা দিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বললো,’আর কোনোদিন আমার স্বামীর দিকে চোখ তুলে তাকালেও চোখ গেলে নেব তোর কুলাঙ্গারের বাচ্চা।তোর চুমু খাওয়ার স্বাদ জন্মের তরে ঘুচিয়ে দিবো আমি।হারামজাদি তোর সাহস কত,আমার স্বামীর সাথে অসভ্যতামো করে আবার আমার ননদের গায়ে হাত তুলিস।আজকেই তোর এই বাসায় শেষ দিন।ঘাড় ধাক্কা দিয়ে যদি তোকে আজ এই বাড়ি থেকে না তাড়িয়ে দিয়েছি তো আমার নামও মাহা নয়!’

-‘আল্লাহ গো,জ্বলে গেল গো!মরে গেলাম!আল্লাহ আমি শেষ।আহ,উহ,উহু!’ লিপির যন্ত্রণাকাতর চিৎকার শুনে মাহা পৈশাচিক এক হাসি দিলো।আরাফাত লিপির দিকে তাকিয়ে বললো,’এবারের মতো ওকে ছেড়ে দাও হানি।আম্মুকে বলে ওকে বাসা থেকে বের করে দিবো নে।’

আরাফাতের কথা শুনে মাহা ধাক্কা মেরে তাকে ফেলে দিলো মাটিতে।লিপি গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করছে।তার ঠোঁটে আর জিভে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে মনে হচ্ছে।জ্বলা কাকে বলে আর কতপ্রকার এবং কী কী তা আজ খুব ভালো মতোন বুঝতে পারছে লিপি।পড়িমরি করে মাটি থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে কোনোমতে দরজার লক ও ছিটকিনি খুলে ভোঁ দৌড় দিলো নিজের রুমের দিকে।রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে সে।মাহা শয়তানী এক হাসি দিয়ে ময়লা ফেলার ঝুড়িতে হাতে থাকা অবশিষ্ট মরিচটি ফেলে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল হাত ভালো করে ধুতে।

হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে কয়েকদফা হাত ভালো করে ঘষে ধুয়ে তারপর বেরিয়ে এলো সে।আরাফাত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহার দিকে।মাহা পরিত্যক্ত একটা তোয়ালে বের করে তাতে হাত মুছে আরাফাতের দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে বললো,’কেমন লাগলো লাইভ টেলিকাস্ট?’

আরাফাত আমতা আমতা করে বললো,’ভালো ছিলো!কিন্তু একটু বেশি হয়ে গেল না?’

মাহা কঠিন কন্ঠে বললো,’কেন?তোমার আবার দরদ উতলে ওঠছে নাকি ওর জন্য?’

আরাফাত ভয় পেল মাহার তাকানোর ভঙ্গি দেখে।ত্রস্ত কন্ঠে জবাব দিলো,’না না,দরদ টরদ কিছু না।এমনি আরকি বললাম।’

মাহা আর কিছু বললো না এর পরিবর্তে।চুপ করে গেল।
_________

লিপি পাগলের মতো ওয়াশরুমের ভেতর ঢুকে বেসিনের ট্যাপ ছেড়ে পানি দিতে লাগলো ঠোঁটে।হাঁপাচ্ছে ভীষণ।জ্বলে যাচ্ছে তার ঠোঁট জোড়া।এত কষ্ট জীবনেও পায় নি সে।আজকে যেমনটা পেল।ফুপিয়ে কেঁদে ফেললো সে ব্যথার চোটে।এত জ্বালা যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না।এক মুহূর্তের জন্য ভাবলো সে আজকেই নিজের বাসায় চলে যাবে,আর এদিকটা মাড়াবে না কখনো প্রাণ থাকতে।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে