#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_২১
পুরোটা সপ্তাহ অনেক ভালোই কেটেছে সবার এই বাগানবাড়িটাতে।এই ক’টাদিন সিরাজগঞ্জের আশেপাশের দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঘুরে বেরিয়েছে ওরা।এরকম সুন্দরতম আনন্দের দিনগুলো খুব জলদি জলদিই কেটে যায়,দুই পরিবারের সবাই এই একটা সপ্তাহ প্রচুর আনন্দের মধ্যে কাটিয়েছে।তবে মাহার প্রত্যেকটা মুহূর্ত কেটেছে আরাফাতকে ঘিরে।এমন একটা ঘন্টা কাটে নি যেই ঘন্টায় আরাফাতকে চোখে চোখে রাখে নি সে!আরাফাতের জ্বর ২ দিনেই সেড়ে গেছে।বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় নি।মাহা যেই সেবা করেছে তার,তাতে সুস্থ হতে বাধ্য আরাফাত।সবকিছুর উর্ধ্বে আরাফাতের গুরুত্ব মাহার কাছে অনেক বেশি।ভালোবাসার আসল সংজ্ঞা জানা নেই তবে এটাকেই হয়তো সত্যিকারের ভালোবাসা বলে।
রাহাতের ছুটি শেষ হয়ে গেছে।সাথে সমাপ্ত হলো বাকিদের ছুটিও।আজকে রাতেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে ওরা।লিসা নিসার মন কিছুটা ভারাক্রান্ত।ওদের ইচ্ছে করছে না বাসায় যেতে।বাসায় গেলেই তো চিল মুডের বারোটা বাজবে।পড়া পড়া করে জীবনটা ত্যানাত্যানা।আর ভালো লাগে না দুবোনের।এই একটা সপ্তাহ কতই না মজা করে কাটিয়েছে ওরা।প্রচুর মাস্তি হয়েছে।
আর এ ক’দিন লিপিও তেমন একটা জ্বালাতন করতে পারে নি তাদেরকে।আসলে মাহার ভাই রাহাতকে লিপি প্রচুর ভয় পায়,রাহাতের হালকা একটা চোখ রাঙানিই যথেষ্ট কারও কলিজার পানি শুকিয়ে দেয়ার জন্য,মূলত এই রাহাতের জন্যই লিপি তাদেরকে ডিস্টার্ব করতে চেয়েও পারে নি।রাহাতের রাগ উঠলে ছেলেমেয়ে বৈষম্য করবে না,ঠাস করে থাপ্পড় মেরে দাঁত ভেঙে একদম গুঁড়িয়ে দেবে।আরাফাতদের আত্মীয়তার সুবাদে লিপি মাহার পরিবারের সবাইকে চেনে।আর রাহাতের রাগ সম্পর্কেও ভালো মতোন জানা আছে তার।তাই বেচারি আর মাহার সাথে লাগতে যায় নি।নয়তো শয়তানদের কাজই তো শয়তানী করা!
__________
সবকিছু দুপুরের পর পরই গোছানো হয়ে গেছে।মাহা আর আরাফাত বাহিরে কাঁঠাল গাছের ছায়ার নিচে একটা বেঞ্চে বসে গল্প করছে।গল্পের টপিক হলো ফুল নিয়ে।
-‘আচ্ছা,তোমার কোন ফুল ভালো লাগে হানি বলো তো?’ মাহাকে সরলমনে জিজ্ঞেস করল আরাফাত।মাহা আরাফাতের দিকে তাকিয়ে কষ্টমিশ্রিত একটা হাসি দিয়ে বললো,
-‘আমার প্রিয় ফুল জেনে আর কী করবে বলো?ছোট থেকে আমায় দেখে আসছো ঠিকই,কিন্তু তুমি আজ পর্যন্ত বলতে পারবে না আমি কোন জিনিসটা পছন্দ করি অথবা কোনটা আমার অপছন্দের তালিকায় আছে।আমি তোমার ব্যাপারে সব খবর রাখলেও তুমি আমার ব্যাপারে সবসময় উদাসীন।যাকগে,আমার পছন্দ অপছন্দ জেনে আর কোনো লাভ নেই।কারণ আমি একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমার স্ত্রী,এরপর আর আমাদের মধ্যে আত্মীয়তা ব্যতিত আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না।সো,বাদ দাও এসব।’
মাহার কথা শুনে আরাফাতের মনে কষ্ট লাগলো, সাথে জেদও হলো।এই মেয়েটা কথায় কথায় এসব বলে কেন,বিরক্তিকর!আরাফাত চুপচাপ বসা থেকে ওঠে ক্রাচে ভর দিয়ে ল্যাংচিয়ে ধীরগতিতে হেঁটে ফুলের বাগানের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো,তারপর ভাঙা হাতটাতে যাতে চাপ না লাগে সেরকমভাবে খুবই সাবধানে হাত বাড়িয়ে গাছ থেকে গাঢ় গোলাপি রঙের একটি ডালিয়া ফুল ছিঁড়ে নিলো।মাহা কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আরাফাতের কর্মকাণ্ড দেখে যাচ্ছে।
আরাফাত ফের অন্য গাছ থেকে একটা সাদা জবাফুল ছিঁড়ে নিয়ে ক্রাচে ভর করে হেঁটে মাহার সামনে এসে দাঁড়ায়।মাহা আরাফাতের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।আরাফাত ডালিয়া ফুলটা মাহার কানের পিছে গুঁজে দিলো।খোলা এলোচুলে কানে গুঁজা ফুল,তাতে এক অন্যরকম মায়া এসে ভর করেছে মাহার চেহারায়।আরাফাত মুগ্ধ হয়ে গেছে মাহাকে দেখে।বিমোহিত নয়নে মাহার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে জবাফুলটা মাহার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
-‘তোমার পছন্দ এখন না জানলে কী হয়েছে?পরে একটা সময় জেনে নেব সমস্যা নেই।তবে এখন নাহয় আমার পছন্দের ফুল দিয়েই তোমাকে সাজাই!জানো হানি?তোমাকে না অনেক সুন্দর লাগছে আজ!চোখ ফেরানো দায় মনে হচ্ছে!’ ঘোর লাগা চোখে চেয়ে আছে আরাফাত।
আরাফাত নিজের অজান্তেই অকপটে মাহার সৌন্দর্য্যের প্রশংসা করছে।মাহা ফুলে হাত বুলিয়ে মুচকি হাসলো।বেশ লজ্জা পেয়েছে সে, সেটা তার নতদৃষ্টি দেখেই বোঝা যায়।আরাফাত আনমনে মাহার গালে আঙ্গুল বোলালো।মাহা হালকা শিউরে ওঠে এমন স্পর্শে।ঝট করে ধরে ফেলে আরাফাতের আঙ্গুল,ধ্যান ভাঙতেই সে বাস্তবে ফিরে আসে।থতমত খেয়ে কোনোমতে নিজেকে কন্ট্রোল করে চুপচাপ মাহার একপাশে এসে বসে পড়ে।
মাহা জবাফুলটাকে খুঁটে খুঁটে দেখছে একমনে,আর আরাফাত দেখছে তাকে!ভাবছে,সামান্যতেই মেয়েটা কত খুশি!অথচ লামিয়ার সাথে রিলেশনে থাকাকালীন শুধু টাকাই টাকা খরচ হয়েছে!ফুল দিয়ে প্রপোজ করা নাকি ব্যাকডেটেড,তাই ডায়মন্ড রিং দিয়ে তাকে প্রপোজ করেছিলো আরাফাত।শুধুমাত্র লামিয়ার রূপের মোহে ডুবে গিয়ে নিজের কতবড় সর্বনাশ করলো!ভাবতেও এখন নিজের ওপর ঘৃণা হয় আরাফাতের।এরচেয়ে মাহাকে যদি নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসতো,তবে এতো খারাপ ভাবে ঠকতো না!ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসাই পেতো!
আরাফাত তার সুদূর চিন্তাভাবনার লাগাম টেনে ধরলো।এখন আর ওসব ভেবে লাভ নেই।ভবিষ্যতে যা হবার তাই হবে।এখন মুহূর্তটাকে উপভোগ করা যাক!আরাফাত আবারও হারিয়ে গেল মাহার মধ্যে।
-‘একটা কথা জানো তো,আমরা যাকে চাই তাকে আমরা পাই না।আবার আমাদেরকে যারা চায়,তাদেরকে আমরা পাত্তাই দিই না।দুনিয়াটা এখন এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে।বেশিরভাগ মানুষই কাউকে না কাউকে একতরফা ভাবে ভালোবেসে ভুক্তভোগী।এই ভুক্তভোগীরা কাউকে নিজের মনের অবস্থাটা বোঝাতে সক্ষম হয় না।তারা তাদের এই কষ্টের কথাটা মনের মধ্যেই চেপে রাখে।প্রকাশ করে না।তবে মনেপ্রাণে এটাই চায়,যাকে সে ভালোবাসে সেই মানুষটা তার ভালোবাসার মানুষের সাথে খুশি থাকুক,সুখে থাকুক।ভালো থাকুক তার ভালোবাসার মানুষটা!যাকে চাও তাকে পাওয়ার মধ্যে তৃপ্তি নয়,তাকে সুখে দেখার মধ্যে যেই তৃপ্তি পাবে সেই সেই তৃপ্তি অন্য কোথাও হাজার খুঁজলেও পাবে না।হ্যা এটাই খাঁটি ভালোবাসা!’
মাহা জবাফুলের গাছটার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো।আরাফাত মনযোগ সহকারে মাহার প্রত্যেকটি কথা শুনে গেছে।মাহা যা বলেছে তা দুর্বোধ্য হলেও সত্যি!তবে মাহা হঠাৎ এসব বললো কেন বুঝতে পারলো না আরাফাত।আর ঘাটতেও চাইলো না তা।থাকুক না কিছু কথা এমন ধোঁয়াশার মতো।যার গভীরে প্রবেশ না করাটাই বরং ভালো!
____________
সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছয়টা বাজে,
তাদের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে,ব্যাগ-ট্যাগ সব গাড়ির পেছনের ডিকিতে তুলে রাখছে সাইফ আর রাফি।মাহা আরাফাতকে নিয়ে বাইরে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।রাহাত জাওয়াদকে কোলে নিয়ে এককোনায় দাঁড়িয়ে ফোনে জরুরি কথা বলছে।লিপি লিসা নিসার সাথে সেলফি তুলতে ব্যস্ত।রবি এবার মাহার দিক থেকে পল্টি মেরে আনিশার পেছনে লেগেছে।আনিশাকে ফ্লার্টিং করতে করতে বেচারা শেষ,কিন্তু আনিশা তো গলে যাওয়ার পাত্রি নয়।শুধু সৌজন্যতার খাতিরে কথার জবাব দেয়,নয়তো পাত্তাই দিতো না এই হ্যাংলা পাতলা লুচুটাকে।
এখানে থাকার সময় ফুরিয়ে এসেছে।সকলে যার যার সুবিধামতো গাড়িতে উঠে বসলো।মাহার হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসেছে আরাফাত।রাহাতের আদেশে তাদের গাড়িটা আগে আগে চলতে শুরু করলো।জনাব এরশাদদের গাড়িটা পড়ে আসবে।তারা এখনও রওনা দেন নি।কেয়ারটেকারের সাথে দরকারী কীসব কথা বলছেন ওরা।সেসব নিয়ে মাথা না ঘামালেই চলবে তাদের।
আরাফাত মাহার সাথে একদম গা ঘেঁষে বসে গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে।মাহা আনিশার সাথে কথা বলছে।দুই বান্ধবী এক হলে দুনিয়ার আর কোনো কিছু মনে থাকে না।
জারা জারা গানটা বাজছে গাড়িতে।সবাই চুপ করে বসে আছে।শুধু গাড়িঘোড়ার ইঞ্জিনের আওয়াজ কানে ভেসে আসছে।আরাফাত মাহার কাঁধে মুখ গুঁজে একহাত তার পেটের পাশে নিয়ে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।মাহা চুপটি করে কোনো প্রকারের নড়চড় ব্যতিত আরাফাতকে নিয়ে নিজের কল্পনার জগৎ সাজাচ্ছে।আগে যেমন আরাফাতকে নিয়ে তার কল্পনার কোনো শেষ ছিলো না,এখনও ঠিক তাই।এই লাগামহীন কল্পনার নিয়ন্ত্রণের রাশ যে তার হাতে নেই!কল্পনার রাজ্যে আরাফাত আর তার দুটি ছোট ছোট বেবিও আছে।তবে সে জানে না এই কল্পনা কখনো বাস্তব হবে কী না!
রাত ১১ টার বেশি বাজে,
রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম থেকে কোনোমতে রক্ষা পেয়ে বাসায় মাত্র এসে পৌঁছেছে ওরা।তবে রাহাতরা এখানে থাকে নি।তারা তাদের বাসায় চলে গেছে।কালকে রাহাত,রিয়াজ দুজনেরই কাজ আছে।এখানে থাকলে কাজের কিছুই হবে না।তাদেরকে বিদায় দিয়ে মাহা নিজেদের রুমে চলে এলো আরাফাতকে নিয়ে।আনিশা চলে যাওয়ায় মন কিছুটা খারাপ তার।আর কোনদিন দেখা হবে কে জানে!
বাগান বাড়ি থেকে অনেক বড়ই,পেঁপে,পেয়ারা,নারিকেল,সুপারি এসব নিয়ে আসা হয়েছে।সেসব মিসেস মুমতাহিনা জেনিকে দিয়ে ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে রাখছেন।রাত সাড়ে নয়টার সময় একটা রেস্তোরাঁর সামনে গাড়ি থামিয়ে রাতের খাবার সেড়ে ফেলায় এখন আর সেসবের ঝামেলা নেই।
আরাফাতের পরনের কাপড় পাল্টে দিতে হবে।মাহা প্রথমে নিজে কাপড় চোপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে এলো।আরাফাতের শরীরে ক্লান্তি জেঁকে বসেছে,সাথে আছে ঘুম।সে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বিছানার ওপর।মাহা খোঁপা প্যাঁচিয়ে বাঁধতে বাঁধতে আরাফাতের পাশে এসে বসলো পাতলা একটা গেঞ্জি নিয়ে।আরাফাত চোখ মেলে তাকালো মাহার দিকে।মাহা আরাফাতের ওপর উবু হয়ে সযত্নে পরনের গেঞ্জিটা খুলে দিলো।আরাফাতের ঘন লোমশ বুকটা স্পষ্ট মাহার চোখের সামনে ফুটে ওঠেছে।আরাফাত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে মাহার দিকে,যা বুঝতে পেরে মাহার লজ্জার শেষ নেই।লজ্জার ঠ্যালায় গলা শুকিয়ে গেছে বেচারির।আরাফাতকে অনেক কিউট লাগছে দেখতে।গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ওঠেছে,চুলও আগের ন্যায় লম্বা হয়েছে।সে ভারী সুদর্শন একজন যুবক ছেলে,যে প্রতিটা মেয়ের হৃদয়হরণ করতে বাধ্য!
মাহা অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু বেশিই লজ্জা পাচ্ছে।কষ্টেসৃষ্টে আরাফাতের পরনের কাপড় পাল্টে দিয়ে তাকে ঠিক হয়ে শু’তে সাহায্য করে সে সরে এলো।আরাফাত বেশিক্ষণ চোখ খোলা রাখতে পারলো না।ঘুমিয়ে গেল।এতে মাহা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন।সিরাজগঞ্জ যাওয়ার সময় রুম ভালো মতোন গুছিয়ে রেখে গেছিলো তাই এখন আবার নতুন করে গুছানোর ঝামেলায় যেতে হলো না।এতদূর ভ্রমণ করার ফলে শরীর ভেঙে আসতে চাইছে।তাই রুমের লাইট নিভিয়ে বিছানায় চলে গেল সে ঘুমাতে।বিছানার ওপর শোয়ে স্থির হতেই আরাফাত হাতড়ে হাতড়ে মাহাকে খুঁজে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো।মাহাও আরাফাতের মাথায় ও গালে আদুরেভাবে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেলো।ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়ার ভীষণ তৃপ্তিতে ও আরামে চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে এলো তার।অতঃপর হারিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে।
__________
পরদিন,
দুপুরের পর রবি নিজেদের বাসায় চলে গেল।তার ভার্সিটিতে ক্লাস আছে,তাই যেতেই হবে।লিপিরও তার সাথে যাওয়ার কথা ছিলো,কিন্তু লিপি গেল না।মিসেস মুমতাহিনাও খুশিমনে মেনে নিলেন।বাকিরা লিপির থেকে যাওয়াতে মোটেও খুশি না।আপদটা বিদায় হয়েও হলো না।শয়তানী ছেড়ে যদি ভালোমানুষের মতন থাকতো, তবে কেই-বা তার থাকাতে বিরক্ত হতো?মাহা মুখ বাঁকিয়ে তৈরি হতে গেল।আজকে একটু নার্সারিতে যাবে সে।গিয়ে শাক-সবজির বীজ ও ফুলের চারা কিনে নিয়ে আসবে।তার আর এমন নিরস প্রকৃতি দেখতে ভালো লাগছে না।নিজের হাতে লাগানো ফুল গাছ না থাকলে মনই ভালো হবে না।
মাহা হিজাব বেঁধে তৈরী হয়ে গেছে।তার সাহায্যকারী হিসেবে লিসাকে সাথে নেবে সে।আর নিসা তার ভাইয়ের দায়িত্বে বাসায় থাকবে।আরাফাতের কোনো কিছু প্রয়োজন পড়লো কী না সেসব নিসাই খেয়াল রাখবে।সাথে লিপিকেও চোখে চোখে রাখবে সে।
মাহা নিজের রুম লক করে চাবি নিজের কাছে রাখলো।বলা যায় না লিপি কোনো ক্ষতি করে রাখতে পারে।তাই আগাম সতর্কতা অবলম্বন করলো।আরাফাতকে লিভিং রুমে নিসার পাশে বসিয়ে টিভি অন করে রেখে মিসেস মুমতাহিনাকে ও আরাফাতকে বললো,’আমি আসছি।চিন্তা করো না খুব দ্রুতই বাসায় ফিরে আসবো।মামণি ওনার খেয়াল রেখো একটু,প্লিজ!’
-‘আচ্ছা মা,তুই জলদি বাসায় আসিস।আর আরাফাতের চিন্তা করিস না, আমি খেয়াল রাখবো আমার ছেলের।’
-‘আচ্ছা ঠিক আছে!আমি যাই!’
এই বলে বেরিয়ে আসে মাহা।তার সাথে সাথে লিসাও।আরাফাত মাহার যাওয়ার পানে পলকহীনভাবে নির্বাক তাকিয়ে আছে,মুখ ফুটে কিছু বললো না।তবে তার মনে উথাল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।না জানি কতক্ষণ মেয়েটাকে না দেখে থাকতে হবে।মাহাহীন সে বিরসতায় ভরা বিষন্ন ভগ্নহৃদয়ের অধিকারী।এই জীবনটায় প্রাণ নেই,বরং নিষ্প্রাণ।মনটা অকস্মাৎ বলে উঠে,’জলদি ফিরে আসো হানি,তোমাকে না দেখলে হৃদয়টা তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ে ভীষণ,ব্যাকুল মন শুধু তোমাকে চোখের সামনে দেখতে চায়।আর কিছুই চায় না!’
নিজের মনের কথায় নিজেই বিস্মিত আরাফাত।তারমানে কী আবারও মনটা প্রেমে পড়লো?তাও প্রথমবারের ন্যায় খুব বাজেভাবে?জানা নেই তার!
লিপি মাহার যাওয়ার অপেক্ষাতেই ছিলো।মাহা চলে যেতেই নিচে নেমে আসার প্রস্তুতি নেয় সে।এতক্ষণ নিজের রুমে শাড়ি পড়ে বসে সাজুগুজু করছিলো।মাহা চলে যাওয়ার শব্দ পেতেই নিজেকে আরও একবার আয়নায় দেখে যাচাই করে মুখে সফলতার হাসি ফুটিয়ে তুলে দাম্ভিক একটা ভাব নিয়ে নিচে চলে আসে।মিসেস মুমতাহিনার জরুরি ফোন আসায় নিজের রুমে চলে গেছেন।তাই লিভিং রুমে এখন শুধু নিসা আর আরাফাত বসে আছে।জেনি কাজে,ইশানী নিজের রুমে।
লিপিকে অনেক সুন্দরী লাগছে শাড়ি পড়ায়।পৃথিবীতে হয়তো এমন কোনো নারী নেই যাকে শাড়ি পড়লে মানাবে না।লিপি এমনিতেই সুন্দরী রমণী,শাড়ি পড়ে গর্জিয়াস মেকওভার করায় তাকে অপরূপা লাগছে দেখতে।লিপি খুবই স্টাইলিশভাবে হেঁটে হেঁটে আরাফাতের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো।আরাফাত মনযোগ দিয়ে দেশের গরম গরম সংবাদ শুনছিলো,হঠাৎ চোখের সামনে এভাবে এসে কারও দাঁড়ানোতে কিঞ্চিত বিরক্তি ফুটে ওঠে কপালের ভাঁজে।লিপিকে দেখে বিরক্তি বাড়লো বই কমলো না।লিপি মূলত আরাফাতকে গলানোর জন্যই শাড়ি পড়েছে,কিন্তু আরাফাত সেসবের ধারেকাছেও যায় নি।মাহাকে যেমন মোহিনীময় লাগে শাড়ি পড়লে,তেমন লিপিকে মোটেও লাগছে না।আরাফাত তাই সাথে সাথে চোখ সরিয়ে ফেললো।নিসা হাসিমুখে বলে উঠে,
-‘ওয়াও লিপি আপু!তোমাকে তো দারুণ লাগছে!ক্রাশ খেয়ে গেলাম পুরো।’ নিসার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনে লিপির তো পা যেন আর মাটিতে পড়ছে না।কিন্তু যার জন্য এতকিছু সে তো মনের ভুলেও তাকাচ্ছে না।আরাফাত পাশ থেকে নিজের ফোন হাতে নিয়ে এফবিতে লগইন করলো।আজ অনেকদিন পর এফবিতে ঢুকলো সে।নিজের টাইমলাইনে ঢুকে লামিয়ার সাথে তোলা ছবিগুলো সাথে ইন এ রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস চোখে পড়লো।দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেল পুরো।সাথে সাথেই ছবিগুলো ডিলিট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।অথচ তার চোখের সামনে সুন্দরী রমণী এসে ফ্যাশন শো করছে তাতে তার ধ্যানই যাচ্ছে না।
লিপি আরাফাতের খুব কাছে এসে বসলো।আরাফাত ফোন থেকে মুখ তোলে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়েছে লিপির দিকে।যেন না চিবিয়েই গিলে ফেলবে এনাকোন্ডার মতো।শান্ত অথচ কঠোর গলায় বললো,’এসকল বেয়াদবি আমি মোটেও পছন্দ করি না লিপি।দূরত্ব বজায় রেখে বসো।ভুলে যেও না আমি একজন বিবাহিত পুরুষ।’
লিপি ডোন্ট কেয়ার ভাবে জবাব দিলো,’সো হোয়াট?বিবাহিত হয়েছো তো কী হয়েছে?এজন্য কী নিজের খালার মেয়ের দিকেও তাকাতে পারবে না?দেখো,আমি আজ শাড়ি পড়েছি।বলো তো আমাকে কেমন লাগছে?নিশ্চয়ই তোমার বউয়ের থেকে বেশি সুন্দর লাগছে আমায়?’
লিপি যেমন বললো,আরাফাতও তেমনই ত্যাড়া উত্তর দিয়ে বললো,’আমার বউকে যেমনটা সুন্দর লাগে,তোমায় তেমনটা মোটেও লাগছে না।সো আমাকে এসব ফালতু কথা জিজ্ঞেস করা থেকে বিরত থাকো।তোমার বিএফ থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করো গিয়ে যাও!’
লিপি এবার নিসার দিকে তাকিয়ে বললো,’নিসা,তুই একটু এখান থেকে যা তো!তোর ভাইয়ের সাথে আমার কথা আছে।’
-‘সরি আপু।আমি তোমার কথাটা রাখতে পারবো না।মাহা আপু আমাকে বলে গেছে সে না আসা অবধি আমি যাতে এই জায়গা থেকে না নড়ি।তাই আমি আমার কথার খেলাপ করতে পারবো না আপু।তুমি হাজার বললেও পারবো না।’
নিসা একদম সোজাসাপটা বলে দিলো কথাগুলো।লিপি দাঁত কিড়মিড় করে বললো,’এখন আমার থেকে মাহা তোর কাছে বড় হয়ে গেল তাই না?আর কখনো আসিস আমার কাছে মেক-আপ করার জন্য,থাপড়ে দাঁত ফেলে দেবো।’
আরাফাত এতক্ষণ ধরে দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করছিলো।আর পারলো না।মেজাজ তিরিক্ষি করে কাঠখোট্টা কন্ঠে বললো,’তুমি এখান থেকে যাবে লিপি?আমার মেজাজ গরম করো না কিন্তু।ফল ভালো হবে না।তুমি শাড়ি পড়েছো ভালো কথা,সেটা আমাকে কেন দেখাতে আসছো?আমি একবার বলেছি না,আমার এসব ভালো লাগে না।তারপরও কেন বেহায়ার মতো পেছনে পড়ে আছো?’
লিপি এবার একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেললো।সে আরাফাতের গেঞ্জির কলার দুহাত দিয়ে চেপে ধরে আরাফাতের খুব ক্লোজ হয়ে বললো,’মাহা তোমাকে কোনো সুখ দিতে পারবে না,যতোটা আমি তোমায় দিতে পারবো।কী আছে ঐ কালো মেয়েটার মধ্যে?যা আমার মাঝে নেই!ওকে ছেড়ে দিয়ে আমায় বিয়ে করো,সর্বসুখে মুড়িয়ে দিবো তোমায়!’
কথাগুলো বলে লিপি নিসার সামনেই আরাফাতের ঠোঁটের ওপর জোরজবরদস্তি করে ঠাস করে গাঢ় একটা চুমু বসিয়ে দিলো।আরাফাত চাইলেও আটকাতে পারলো না তাকে।লিপি চুমু দিয়েই হাসতে হাসতে চলে গেল।স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো আরাফাত।এটা কী করে গেল লিপি।ছি, এত অধ্বপতন হয়েছে এই মেয়েটার।ছি ছি।ঘৃণায় ভেতর গুলিয়ে এলো আরাফাতের।নিসা মুখে হাত দিয়ে ফেলেছে।এত জঘন্যতম কাজ করতে কী একবারও বাঁধলো না লিপির।ছোটবোনের সামনে ভাইকে এভাবে অপদস্ত করতে একটুও লজ্জা লাগলো না?ভয়ে সাথে ভাইয়ের অসহায়তা দেখে নিসার চোখ জলে টলমল করে উঠলো।আরাফাত দুই হাত দিয়ে জোরে জোরে ঘষছে নিজের ঠোঁট।নিজেকে ভীষণ অপবিত্র মনে হচ্ছে তার।ছি এটা কী হলো তার সাথে!
আরাফাত দ্রুত বসা থেকে দাঁড়ালো।আজকে ক্রাচ ছাড়াই ল্যাংচিয়ে ল্যাংচিয়ে বহু কষ্টে এখান থেকে চলে যেতে চাইলো।নিসা দ্রুত বসা থেকে ওঠে আরাফাতকে ধরে কেঁদে দিয়ে বললো,’ভাইয়া এমন করছো কেন?’
-‘আমাকে একটা রুমে নিয়ে যা নিসা।আমার বমি পাচ্ছে ভীষণ।’
নিসা মাথা ঝাকিয়ে আরাফাতকে ধরে ধরে একটা খালি রুমে নিয়ে গেল।আরাফাত ওয়াশরুমে ঢুকে বেসিনের সামনে গিয়ে মুখের ভেতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে একপ্রকার জোর করে বমি করলো।নিসা তাকে ধরে রেখেছে।মাকে বলবে কী না এই নিয়ে চিন্তায় আছে সে।এই কথাটা কাউকে জানাতে গেলেই তো বাসায় বড়সড় একটা ঝামেলা বাঁধবে।নিসা পড়েছে মহা ফ্যাসাদে।আরাফাত সাবান ডলে নিজের ঠোঁট ঘষতে লাগলো।ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসছে বারবার।মাহা ছাড়া এই ঠোঁটে আর কোনো মেয়ের ছোঁয়া লাগে নি।এমনকি লামিয়ার হাত ধরা ছাড়া কখনো একটা চুমু খায় নি সে এই দুই বছরের রিলেশনশিপে।সেখানে আজ এই খবিশ মেয়েটা জোর করে তার সাথে,,ছি!আর ভাবতে পারছে না সে।
নিসা আরাফাতকে ধরে ধরে রুমে নিয়ে আসলো আবার।আরাফাত নিসার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা স্বরে বললো,’তুই এখন যা নিসা।আমি একটু একা থাকতে চাই।’
-‘কিন্তু ভাইয়া,,’
-‘প্লিজ যা!’
আরাফাতের করুন কন্ঠ শুনে তার কথা আর অমান্য করতে পারলো না নিসা।বিনাবাক্যব্যয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে।আরাফাত মাটিতে বসে পড়েছে।তার ভেতর থেকে ফুঁপানোর মতো একটা শব্দ বেরিয়ে এলো।আহাজারি করে বলে উঠে,’আল্লাহ, আমি কী আর সুস্থ হবো না?আজ হাত পা ভাঙা বলে একটা মেয়ে আমার এমন অসহায়ত্বের সুযোগ নিলো।অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিলো না।নিজের কাছে নিজেরই ভীষণ ঘৃণা লাগছে আমার।আমি কী করবো!আমার সবকিছু বিস্বাদ ঠেকছে কেন?কিচ্ছু ভালো লাগছে না।আমি হানিকে কী জবাব দিবো!’
আরাফাত নিজের চুল টেনে ধরলো।অপরাধবোধের কারণে চোখের কোণ গড়িয়ে দুফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো।মনে মনে সহস্রাধিক গালি দিচ্ছে লিপিকে।এই মেয়েটিকে সে ছাড়বে না।
চলবে…