#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_০৫
বিপদাপদে পড়ার দোয়া;
“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন,আল্লাহুম্মা আজুরনি ফি মুসিবাতি ওয়াখলিফ লী খাইরাম মিনহা।”
অর্থ:-হে আল্লাহ!আমরা তো আপনারই,এবং আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী।হে আল্লাহ!আমাকে আমার বিপদে সওয়াব দিন এবং আমার জন্য এর থেকে উত্তম কিছু স্থলাভিষিক্ত করে দিন।
মাহা:-এই দোয়াটা বেশি বেশি পাঠ করতে থাকো সবাই।সাথে দোয়ায় ইউনুসও পড়তে পারো।দেখবে আল্লাহ আমাদেরকে ফিরিয়ে দিবেন না।এই দুঃখ কষ্ট আমরা খুব দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারবো।
মাহার বলা কথা মনযোগ দিয়ে শুনলো ওরা।মিসেস মুমতাহিনা তো পড়া শুরু করে দিয়েছেন অলরেডি।
মাহা জোরজবরদস্তি করে মি.এরশাদকেও হালকা পাতলা রুটি ভাজি খাওয়াতে পারলো কোনোমতে।সাইফের খিদে নেই।তারপরও অনিচ্ছা সত্ত্বে অর্ধেক রুটি খেলো চা কিনে নিয়ে এসে।
রাহাত এখনো জানে না যে মাহা এসেছে।সে প্রচুর ব্যস্ত।কিছু খাওয়ার মতোও সময় পাচ্ছে না।আরাফাতের রক্ত লাগবে কয়েক ব্যাগ।সেগুলো জোগাড় করতেই ব্যস্ত সে।রাফি দুজন ডোনার জোগাড় করে এনেছিলো অবশ্য।ওরা রক্ত দিয়েছে ঠিকই কিন্তু আরও রক্ত লাগবে তার ইমারজেন্সি।
মি.আতিক কেবিনে এসে মাহাকে দেখে অবাক হয়ে গেছেন।তিনি ভাবেন নি যে মাহা এত সাহস দেখিয়ে এখানে চলে আসবে!মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই সাংঘাতিক দুঃসাহসি।যেখানে বেশিরভাগ মেয়েরাই থাকে ননীর পুতুলের মতো নরম মনের,সেখানে সে ইস্পাতের মতো শক্ত মনমস্তিষ্কের অধিকারী।ভুতপ্রেত,পোকামাকড় কিছুতেই ভয় পায় না।বড় কোনো ব্যথা পেলেও অনায়াসে লুকিয়ে নিতে পারে সে।তার বুক ফাটে তবু মুখ ফুটে না।যেখানে মেয়েরা টিকটিকি,তেলাপোকা,মাকড়শা দেখলেই চিৎকার চেঁচামেচি করে বাসা মাথায় উঠিয়ে দেয়,সেখানে মাহা লাটি দিয়ে টিকটিকির লেজ কেটে দেয় নয়তো ওগুলো মেরে ফেলে।ভয়ডর বলতে কিছু নেই তার মনে।অদম্য সাহসী একজন তরুণী সে।
মি.আতিক মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন;
মি.আতিক:-একা আসতে গেলে কেন আম্মা?আমাকে বলতে,আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম তোমায়।এত সাহস দেখিয়ো না মা।দুনিয়া এখন রসাতলে গেছে।কখন কোন বিপদ ওত পেতে থাকে বলা যায় না।আর কখনো এমন সাহস দেখাতে যেও না।যাবার সময় আমি নিয়ে যাবো তোমায়।একা যাবে না।
মাহা আর কী করবে,বাবার কথার অবাধ্য তো হওয়া যায় না।অগত্যা নিমরাজি হলো সে।মাথা নেড়ে সায় জানালো।
পরিস্থিতি আগের মতোই আছে।তবে মিসেস মুমতাহিনা কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছেন আগের থেকে।লিসাও নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছে।সাইফ বাসায় গিয়ে একবার গোসল সেড়ে আরাফাতের সাথে লামিয়ার সম্পর্কের কিছু ডকুমেন্টস নিয়ে এসেছে।এসব নিয়ে থানায় যেতে হবে।লামিয়ার পার্মানেন্ট একটা ব্যবস্থা করে তবেই ক্ষান্ত দিবে সাইফ,এর আগে নয়।রাফি ও রিয়াজকে নিয়ে থানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় সে।মাহার যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু তাতে তার বাবা বাঁধ সাধলেন।তাই আর যাওয়া হলো না।
🧩
পুলিশ লামিয়ার ফুপুকে নিয়ে এসেছে।সমাজের কাছে ওনার নাক কাটা গেছে ভাতিজির কুকীর্তির কারণে।লামিয়ার গালে গুনে গুনে ৫ টা থাপ্পড় মেরেছেন তিনি।ঘৃণায় একদলা থুতু ফেললেন ওর সামনে।এত লজ্জা তিনি জীবনেও পান নি।এই একটা মেয়ের কারণে তিনি তার শ্বশুর বাড়িতেও অনেক অপদস্ত হয়েছেন।লামিয়া গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।সাথে আলভীও আছে।ভদ্রমহিলা যা নয় তাই বলে গালাগালি করলেন দুই শয়তানের চ্যালাকে।
কিছুক্ষণ পর আলভীর গার্লফ্রেন্ড আশফা নামক মেয়েটা হাজির হলো।ততক্ষণে সাইফও তার গ্যাং নিয়ে হাজির হয়ে গেছে।আশফা কোনো কথা ছাড়াই আলভীর গালে মুখে চড় লাগালো।তা যেইসেই চড় নয়,একদম এলোপাতাড়ি কুপানোর স্টাইলে চড়।আলভী আশফাকে সরাতে পারছে না,তার হাত হ্যান্ডকাফ দিয়ে বাঁধা তাই।আলভীকে ছেড়ে লামিয়াকে উরাধুরা কয়টা কেলানি দিলো সে।একজন মহিলা পুলিশ মেয়েটাকে বহুত কষ্টে ওদের থেকে সরিয়ে নিয়ে আসলো।আশফা চেঁচাচ্ছে গলা ফাটিয়ে।
আশফা:-ছাড়ুন আমাকে,ওই কুত্তার বাচ্চাদেরকে মেরেই ফেলবো আমি।সাহস কতবড়,আমার সাথে প্রতারণা,এই আশফা মালেকের সাথে।আমাকে এখনও চিনিস না তো তুই,ব্রিগেডিয়ার আবুল মালেকের মেয়ে আমি!তোকে যদি ফাঁসির কাষ্ঠে না ঝুলিয়েছি,তো আমার নামও আশফা নয়।
আশফা নিজেকে কন্ট্রোল করে ফোন বের করে তার বাপকে কল দিয়ে এখানে আসতে বললো।আলভী সেই ফাঁসা ফেঁসেছে।বড়লোকের মেয়ের সাথে প্রেম করতে গিয়ে বাঁশ খেয়েছে সে,আহারে বেচারা!আলভী ভয়ের চোটে ঘামতে ঘামতে শেষ।লামিয়া তো মরাকান্না জুড়ে দিয়েছে।এসবের শেষটা যে এমন পরিনতি হবে কোনোদিনও ভাবে নি সে।ও তো তাও ভালো ছিলো।পুরোপুরি খারাপ তো আলভীর পাল্লায় পড়ে হয়েছে।নয়তো এভাবে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে ঠকিয়ে টাকা আদায়ের চিন্তা তার মাথায়ও কোনোদিন আসে নি।কথায় আছে না,সঙ্গ দোষে লোহা জলে ভাসে,লামিয়ার ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই।
সাইফ সবচাইতে নামকরা যে উকিল তাকে হায়ার করে এনেছে।লামিয়া যাতে কোনোমতেই জেল থেকে বেরোতে না পারে এই ব্যবস্থা করতেই এতকিছুর আয়োজন।সাইফ খুবই শান্তশিষ্ট একটা ছেলে।সে সহসা কোনো ঝামেলাতে জড়ায় না।কিন্তু এখনের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।তাদের কলিজাতে হাত দিয়েছে ওই বদমাশ মেয়েটা।ওর জন্য আজ তাদের বাড়ির ছেলেটা মৃত্যুর সাথে লড়ছে।এসব বদমাশদের কঠোর শাস্তি না হলে পরে আরাফাত ও আশফার মতো আরও অনেক ছেলেমেয়ে ভালোবেসে খুব বাজে ভাবে ঠকে যাবে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আশফার বাবা এসে পৌঁছালেন থানায়।লোকটা দীর্ঘকায় ও দশাসই টাইপের ব্যক্তি।চেহারা দেখেই বোঝা যায় লোকটা ভীষণ কঠিন,তবে মেয়ের জন্য অন্যরকম।লোকটি মেরে ফেলমু লুক নিয়ে আলভী ও লামিয়ার দিকে তাকালো।ব্যাটার চাউনি দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেছে ওরা দুজন।
যেহেতু সাইফ ও আশফার বাবা ওরা দুজনেই ক্ষমতাধর ব্যক্তি তাই পুলিশরা নিজ দায়িত্বে লামিয়া আর আলভীর যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা নিবে বলে কথা দিলো।লামিয়া কাঁদতে কাঁদতে পায়ে পড়ে গেছে ওদের।সাইফ পাত্তাই দিলো না তাকে।এমন জঘন্য অপরাধ করার আগে একশবার ভাবা উচিৎ ছিলো।আগুন নিয়ে খেলেছে দুজন,এই শাস্তি তো পেতেই হবে।
আশফা আলভীর দিকে তাকিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে।মেয়েটা সত্যি সত্যিই ভীষণ ভালোবাসতো তাকে।নিজের সর্বস্ব খুঁইয়ে তাকে দিয়ে দিয়েছে।তাদের দুজনের বিয়ে হবার কথা ছিলো।গতকাল সকাল পর্যন্তও তো আলভীকে নিয়ে কত স্বপ্ন বুনেছে নিজের মনে।ভাবে নি এমন একটা শক পাবে সে।মি.মালেক মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।কাল পর্যন্ত যে ছেলেটাকে আদর্শ ও ভালো ছেলে হিসেবে জানতেন তিনি আজ সেই ছেলেটাই কেমন প্রতারক হিসেবে বের হলো।বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না ওনার।কিন্তু বিশ্বাস তো করতে হবে।
উপরমহলের নির্দেশ পেয়ে লামিয়া ও আলভী দুজনকেই কারাগারে চালান করে দিলো পুলিশ।ওদের কান্না আর আর্তনাদে কারও মন গললো না।যা করেছে ওরা এতে তাদের শাস্তি প্রাপ্য।সাইফ মনে মনে হাজারবার ধন্যবাদ দিলো মাহাকে।মাহা না বললে তো সে কিছুই জানতে পারতো না।লামিয়ার ফুপি সাইফ ও মি.মালেকের সামনে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে হনহন করে থানা থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আশফার কান্না দেখে সাইফের খুব খারাপ লাগলো।মেয়েটাও আরাফাতের মতোই অতিরিক্ত ইমোশনাল।সাইফ আশফাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো;
সাইফ:-তুমি আমার ছোটবোনের মতো।একটা কথা বলি মনে রেখো।হুট করে কাউকে মনে জায়গা দিয়ে দিয়ো না বোন।এ দুনিয়ায় বেশিরভাগ মানুষই নিজের স্বার্থের পাগল।আজ দেখো যাদেরকে তুমি এবং আমার ভাই ভালোবেসেছো তারা কিন্তু তোমাদেরকে নিজের স্বার্থের ক্ষেত্রে ইউজ করেছে।ওরা তোমাদেরকে কখনোই চায় নি,যতোটা তোমরা ওদেরকে চেয়েছো।আমার ভাই আজ এমন একটা অবস্থায় যে ডক্টর না বললেও যতোটুকু বুঝতে পেরেছি যে ওর বাঁচার চান্স খুবই কম।ভালোবাসার মানুষের দেয়া ধোঁকাটা ও সহজে মেনে নিতে পারে নি।তাই আজ ওর এই অবস্থা।যাইহোক,এই প্রতারকের কথা মনে করে নিজেকে কষ্ট দিও না।নতুন করে লাইফে মুভ অন করো।ইনশাআল্লাহ বেস্ট কাউকে লাইফ পার্টনার হিসেবে পাবে তুমি।
মি.মালেক:-দোয়া করি বাবা,তোমার ভাই যেন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়।আমার মেয়ের জন্যও দোয়া করিও।আল্লাহ তাদেরকে এই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসার তৌফিক দিন এটাই চাই।
সাইফ:-জ্বী আঙ্কেল।আজ তাহলে আমরা আসি।ভালো থাকবেন।
বিদায় নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এলো সাইফরা।সাইফের নিজেকে এবার হালকা মনে হচ্ছে।ওর ভাইকে ঠকানোর ফল মেয়েটাকে দিতে পেরেছে এতেই ওর শান্তি।
রাফির লামিয়ার জন্য একটু খারাপ লাগছে।কারণ মেয়েটার দিক থেকে ভাবলে দেখা যায় যে সে পরিস্থিতির চাপে পড়ে এমন খারাপ হয়েছে।আমরা মূলত আমাদের পরিবার থেকেই সকল প্রাথমিক শিক্ষা দীক্ষা সব পেয়ে থাকি।কিন্তু সে এধরনের কোনো সুযোগ পায় নি।তার মা সন্তানের কথা চিন্তা না করে অন্য একটা লোকের সাথে পালিয়ে গেছে,বাবা ঘরে সৎ মা এনেছে।এমন অবস্থায় থাকলে কোন শিশুটা ভালো শিক্ষা পেয়ে বড় হয়ে উঠবে?কোনো মানুষই নিজে থেকে খারাপ হয় না,বরং পরিস্থিতির চাপেই মানুষ খারাপ হতে বাধ্য হয়।
☁️
মাহা হসপিটালে আজ থেকে গেছে।মিসেস মিনারাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে সে ড্রাইভার আঙ্কেলের সাথে।ওনি যাতে পরদিন রান্না বান্না করে খাবার নিয়ে আসেন এজন্য।আজকে আরাফাতের ফুফু অর্থাৎ রাফির মা এসেছেন হসপিটালে আরাফাতের এক্সিডেন্ট হয়েছে শুনে।ওনি কিছুই জানতেন না।রাফি ওনাকে শুনায় নি কিছু,যদি এমন একটা দুঃসংবাদ শুনে তিনি অসুস্থ হয়ে যান এজন্য।আসার সময় কেঁদেকুটে খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছেন তিনি।
মাহার বদৌলতে মিসেস মুমতাহিনা নিজেকে যথেষ্ট সামলে নিয়েছেন।সারাদিনে আর তেমন একটা কান্নাকাটি করেন নি তিনি।সারাটাক্ষন জায়নামাজে পড়ে রয়েছেন।উদ্দেশ্য একটাই,আল্লাহর কাছে ছেলের সুস্থতা কামনা।মাহার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে লিসা।মাহা একধ্যানে তাকিয়ে আছে কেবিনের বিছানার পাশের জানালাটার দিকে।
আগের কেবিন ছেড়ে নতুন একটা কেবিন নিয়েছেন মি.আতিক।এটা আগের তুলনায় বড় ও প্রশস্ত।টাকার জোরই বড় জোর।আজ টাকা থাকায় আরাফাতের চিকিৎসা বাহিরের দেশ থেকে আনা ডক্টরদের দ্বারা করা হচ্ছে,টাকা না থাকলে কী সেটা সম্ভব হতো?উহুম,মোটেই না।টাকা থাকায় আজ বড় একটা কেবিন নিয়ে ওনারা থাকতে পারছেন,টাকা না থাকলে একটা খুপরির মতো কেবিনও পেতেন না।দ্য মোরাল অফ স্টোরি ইজ,অনলি মানি!টাকা থাকলে বাঘের চোখ কেনাও সম্ভব।
মনে মনে এসবই ভাবছিলো মাহা।কারণ আজ দেখেছে হসপিটালে বড়লোক ও গরীবদের মধ্যে কেমন বৈষম্য করা হয়!বড়লোকদের গেটাপ ও হম্বিতম্বি দেখলেই বোঝা যায় যে ওরা বড়লোক,তাদের জন্য রয়েছে আলাদা কেয়ার।অথচ গরীব ও দরিদ্র যারা,তারা ডক্টরদের পায়ে ধরে কান্নাকাটি করছে নিজের আপনজনকে বাঁচানোর জন্য।অথচ ওরা কেউ তা পাত্তাই দিচ্ছে না।কী আজব দুনিয়া!
মাহার এত পরিমাণ খারাপ লেগেছে যে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।তার ভাই রাহাতও তো একজন ডাক্তার।কই সে দেখি এভাবে কাউকে অবহেলা করে না।রাহাত সবসময়ই গরীব ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের সাহায্য করে,তা টাকা দিয়েও হোক বা চিকিৎসা দিয়েও হোক।মাহা নিজেই এর সাক্ষী।অথচ রাহাতের মতো বাকিরা ডাক্তার হলেও ওদের মনমানসিকতা পশুর থেকেও নিম্নস্তরের।টাকার পিছনে দৌড়ে নিজেদের বিবেক খুইয়ে ফেলেছে তারা।
মাহা নিজের পকেট থেকে ৫ হাজার টাকা বের করে সেই মহিলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এসেছে,যে তার ছেলেকে বুকে নিয়ে মাটিতে বসে কান্না করছিলো।এই ৫ হাজার টাকাই ছিলো মাহার কাছে তখন।বাসা থেকে আর নিয়ে আসে নি।ছোট থেকে বড় হয়েছে জীবনে টাকার অভাব কী কখনো বুঝতে পারে নি সে।অথচ এই টাকার অভাবে কত মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যায়,কত মানুষ অনাহারে থাকে,কতজন থাকে বস্ত্রহীন হয়ে।মানুষের দুঃখ কষ্টের কোনো সীমাধারা নেই।
মহিলাটির চোখে জল,মুখে ছিলো একচিলতে হাসি।যা দেখে মাহা খুবই তৃপ্তি পেল।কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বিরবির করে মহিলাটি মাহাকে মন ভরে দোয়া করলো।মাহা নিজে ডক্টরকে ডেকে এনে বললো ছেলেটির চিকিৎসা করতে।সাথে কিছু মিথ্যা বললো,যেমন এই মহিলাটি তাদের অর্থাৎ ডক্টর রাহাতের দূরসম্পর্কের আত্মীয় হয়।রাহাতের আত্মীয় শুনে কাজ হলো দ্রুত।ওনারা খুবই সম্মানের সহিত মহিলার ছেলেটিকে নিয়ে গেলেন।ছেলেটার বয়স বেশি নয়,মাত্র ১৩ কী ১৪ বছর বয়স।মহিলাটি মন থেকে দোয়া করলেন মাহাকে।মাহা শুধু একটা মুচকি হাসি দিয়ে জায়গা থেকে প্রস্থান করেছিলো।মনে মনে তখন আল্লাহকে বললো;
মাহা:-হে আল্লাহ,আমার প্রতিপালক!আমি জীবনে যা যা ভালো কাজ করেছি তোমার সন্তুষ্টির জন্য,তার উছিলায় হলেও তুমি আমার আরাফাত ভাইয়াকে সুস্থ করে দাও।বেশিকিছু চাই নি,শুধু ওনাকে সুস্থ করে দাও।আমার ভালোবাসার মানুষটাকে আমি হালাল ভাবে পেতে চাই।এভাবে তুমি আমার কাছ থেকে তাকে কেঁড়ে নিও না।দয়া করো।
মাহা নিরবে লুকিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে জানালার দিকে মুখ করে তাকিয়ে।সারাটাদিন নিজেকে শক্ত করে রেখেছিলো।আর যে পারছে না।বাধভাঙ্গা কান্নায় ভেঙে পড়তে মন চাইছে তার।এতটা শক্ত হওয়া যে তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।কী করে নিজেকে সামলাবে সে?আরাফাতকে একটিবার দেখার তৃষ্ণা বেড়েই চলেছে একটানা তার মনে।খুব ইচ্ছা করছে একটিবার দেখতে,খুব!
মায়ের এত করুন আর্তনাদ,বুকভাঙা কান্না,বাবার হাহাকার,বোনেদের চোখের জল,ভাইয়ের সারারাত নির্ঘুম অবস্থায় থাকা,ভাবীর করা মোনাজাত,এবং মাহার এত আকুতি মিনতি যেন আল্লাহ ফেলতে পারলেন না।একরাশ আনন্দের বন্যা বইয়ে রাফি এসে তাদেরকে খবর দিলো যে আরাফাতের জ্ঞান ফিরে এসেছে।তবে এখন কাউকে দেখা করতে দেয়া যাবে না।রাহাত ও বাকি ডক্টররা তার ট্রিটমেন্ট করছেন।
মিসেস মুমতাহিনা আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর দরবারে সিজদাহ্ দিতে লাগলেন।মাহার চোখ থেকেও টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়লো।মনে মনে হাজার শুকরিয়া আদায় করলো সে।
আরাফাতের সেন্স ফিরে এসেছে ঠিকই কিন্তু ডক্টররা যতটুকু আশংকা করছেন তা হলো আরাফাত মানসিক ভাবে প্রচন্ড রকমের চাপ পেয়েছে।কন্ঠনালি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বেশ কিছুদিন কথা বলতে পারবে না।সেটা হতে পারে কয়েকমাস অথবা কয়েকবছর।শিওর না।হাত পায়ের অবস্থাও তেমন একটা ভালো না।পুরোপুরি সুস্থ হতে বছর গড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তাও ভালো বলা যায়,ডক্টররা তো সেন্স ফিরবে বলেও আশা করেন নি।তার অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিলো।সেখানে এত জলদি সেন্স ফিরে এসেছে এটাই তাদের কাছে অনেক কিছু।সে যে কোমাতে যায় নি সেটাই বেশি।আল্লাহ শেষ রক্ষা করেছেন।তবে রক্তের ঘাটতি রয়েছে ওর শরীরে।একব্যাগ বাদে আরেক ব্যাগ দেয়া হচ্ছে সিরিয়ালি।সারা শরীর সাদা ব্যান্ডেজ দ্বারা মোড়ানো মমির মতো।ভয় লাগছে তাকে দেখতে।প্রচুর যত্নের সহিত তার চিকিৎসা করা হচ্ছে।এতটুকুও ত্রুটি রাখছেন না ডক্টররা।ওনাদের বেস্টটা দিয়ে ট্রাই করছেন তাকে সুস্থ করতে।
সারাটারাত মাহা সজাগ রইলো।দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি সে।আরাফাতের চিন্তায় কোনোদিকে মন যাচ্ছে না।ঘুমও আসছে না চোখে।আরাফাতকে কবে দেখতে পাবে জানে না সে।তবে মাহা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবে ওর ভালোবাসার মানুষটির জন্য।অধীর আগ্রহে!অপেক্ষার ফল যে সুমিষ্ট হয়।তার অপেক্ষাও নিশ্চয়ই বিফলে যাবে না!
চলবে…