#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_০৪
মিসেস মুমতাহিনা এখনও ঘুমে বিভোর।কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধের প্রভাব এখনও বিদ্যমান ওনার মধ্যে।পাশেই লিসা বসে অঝোর ধারায় অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে।মাহার আম্মু মিসেস মিনারা লিসাকে বারবার সান্ত্বনা দিচ্ছেন,কিন্তু ওসব কোনো কাজে আসছে না।সে কান্না করেই যাচ্ছে একাধারে।ভাইকে রক্তাক্ত ও জখম অবস্থায় খুব কাছ থেকে দেখেছে সে।এই দৃশ্য কোনোমতে ভুলতে পারছে না বেচারি।তার মনে মস্তিষ্কে এ দৃশ্যটি খুবই গভীর প্রভাব ফেলেছে।
সে শক্ত মনের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ভাইয়ের এ অবস্থা দেখে পাগল প্রায় হয়ে গেছে।আজ ওর বদলে যদি ওর টুইন বোন নিসা থাকতো তবে সে পদে পদে সেন্সলেস হয়ে যেত।কারণ নিসা খুবই নরম মনের আর ভীতু টাইপের মেয়ে।সে এমন দৃশ্য জীবনেও সহ্য করতে পারতো না।এজন্যই তাকে হসপিটালে আসতে দেয় নি সাইফ।
আরাফাতের অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না।সেন্স ফিরে নি এখনো।ডক্টররা সব ওর চিকিৎসা নিয়ে কেবিনে বসে আলোচনা করছেন।নার্স ৪ জন আইসিইউতে আরাফাতকে পর্যবেক্ষণরত অবস্থায় আছে।ওরা সর্বক্ষণ পাহারা দিতে ব্যস্ত।আরাফাতের কেবিনের বাইরে নির্ঘুম অবস্থায় উদ্ভ্রান্তের মতো বসে আছেন বাকিরা।
মিসেস মুমতাহিনা একবার সজাগ হয়ে কান্নাকাটি করে আবারও ঘুমিয়ে গেছেন।ঔষধের প্রভাব তার এখনও কাটে নি।খাবার নিয়ে আসলেও কারও গলা দিয়ে এতটুকু খাবারও নামে নি।কেউ খেতে পারে নি কিছু।সবার একই অবস্থা।মনে মনে শুধু একটাই দোয়া,আল্লাহ যেন আরাফাতকে খুব দ্রুত ভালো করে দেন।রাতে আর রিয়াজ বাসায় যায় নি।নওশিনকে ফোন দিয়ে বলে দিয়েছে যে রাতে আসতে পারবে না।সারাটা রাত সবার এভাবেই নির্ঘুমতায় কেটে গেল।
বাসায় সাইফের স্ত্রী ইশানী ও নিসা টেনশনে মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাবে।নিসা তো কান্না করতে করতে দুবার সেন্সলেস হয়েছে।ইশানী নিজেকে সামলাবে না নিসাকে সামলাবে না নিজের ৫ বছর বয়সী ছেলে রিহাদকে সামলাবে!সে নিজেই বুঝতে পারছে না।বহুত কষ্টে নিসাকে জোর জবরদস্তি করে হাতেগোনা দু নলা ভাত ও একটা ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে নিজের রুমে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে সে।সবাই জানে নিসা অতিরিক্ত ইমোশনাল।এজন্যই তো তাকে বাসা থেকে বেরও হতে দেয় নি কেউ।
ইশানী বুঝতে পারছে আরাফাতের টানে নিসা নিজেই ভীষণ রকম অসুস্থ হয়ে যাবে।তাই নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে লাগলো সে অনবরত।কারণ সেও যদি এখন কান্নাকাটি করে নিজেকে দূর্বল করে ফেলে তবে ননদ,ছেলেকে ও সারা বাসা দেখে রাখার মতো কেউ থাকবে না।এবং নিজের মতো করে কাজের লোকেরা কখনোই ট্রিট করবে না।তারা তাদের নির্দিষ্ট কাজের বাইরে আর কীই-বা করবে!
রিহাদ বারবার তার বাবাইর কথা জিজ্ঞেস করছে!আরাফাতকে সে বাবাই বলে ডাকে।আরাফাতের বেশি আদরের ভাতিজা হলো রিহাদ।একমাত্র ভাতিজা বলে কথা!আদরেরই তো হবে।সে বারবার জানতে চাচ্ছে তার বাবাইয়ের কী হয়েছে?ইশানী কোনোরকম ভুংভাং বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছেলেকে খাইয়ে তারপর ঘুমাতে নিয়ে গেল।কিছুক্ষণ পর পর সাইফকে ফোন দিয়ে আরাফাতের খোঁজ খবর রাখছে সে।এবং মনে মনে আল্লাহর কাছে বারবার নিজের ভাই সমতুল্য দেবরের প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছে।এখন একমাত্র বেশি বেশি দোয়াই পারে আরাফাতকে তাদের মাঝে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে!
🎭
পরদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙলো মাহার।খেয়াল করে দেখে সে বারান্দায়ই ঘুমিয়ে গেছে।আড়মোড়া ভেঙে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো।নিজেকে একদম কন্ট্রোলে এনে স্বাভাবিক হয়ে রুমে চলে আসে সে।ভালোমতন ফ্রেশ হয়ে রুমের বাহিরে যায়।দেখে ফুলমতি ওঠে গেছে ততক্ষণে ঘুম থেকে।
ফুলমতিকে তার বাগানে পানি দেয়ার ও মুরগির খাবার দেয়ার দায়িত্ব গছিয়ে দিয়ে রুমে ফেরত আসে মাহা।হসপিটালে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে লাগে।পরণে জিন্স,হাটুপর্যন্ত লং টিশার্ট,ডেনিম জ্যাকেট,পায়ে কেডস শু,হাতে ঘড়ি,চুলগুলো চূড়ো করে খোঁপা বেঁধে একটা টুপি পড়ে নিলো।এরকম গেটআপেরও কারণ আছে।বাইক তো আর সেলোয়ার-কামিজ পড়ে চালানো যাবে না তাই এই সুব্যবস্থা।এমন গেটআপে তার শরীরের গঠন আকৃতি ঠাহর করা দুষ্কর।
ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আনিশা অনেকগুলো কল দিয়েছে রাতে।এখন বেশি সকাল,হয়তো ও এখনও মরার মতো ঘুমাচ্ছে।তাই মাহা হোয়াটসঅ্যাপে একটা ম্যাসেজ দিয়ে ফোন রেখে দিলো।
পুরোপুরি রূপে তৈরী হয়ে রান্নাঘরে এলো মাহা।দ্রুত হাতে ডিম দিয়ে ভাত ভাজলো।নিজে কিছুটা খেয়ে তারপর বড় একটা হটপটে ভরে নিলো বাকি ভাত।রাতের রান্না করা মুরগির মাংস ও সবজি ওভেনে গরম করে আরেকটা বাটিতে ভরে নিলো।সাথে ফ্রোজেন পরোটা কতগুলো বের করে ভেজে নিলো।সব রেডি করে তারপর গেলো ভাই ভাবীর রুমে বাইকের চাবি আনতে।ইরা তখন ঘুম ঘুম চোখে মেয়েকে খাওয়াচ্ছিলো।মাহাকে এমন রূপে দেখে অনেক অবাক হলো সে।চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে গেছে ওর।জিজ্ঞেস করলো;
ইরা:-এত সকাল কোথায় যাচ্ছো মাহা?
মাহা:-হসপিটালে যাচ্ছি ভাবী।ভাইয়ার বাইকের চাবিটা আমায় দাও।বাইক দিয়ে যাবো।
ইরা:-তোমার ভাইয়া বকবে তোমায় এভাবে একা একা বাইক নিয়ে গেলে।তার থেকে ভালো হসপিটাল থেকে কেউ আসুক,তখন নাহয় তার সাথে যেও।
মাহা:-ওফফো,ভাবী!ভাইয়া কিছু বলবে না,তুমি জলদি দাও।আমি এখনও সেই ছোট্ট খুকিটি রই নি।বড় হয়েছি।একা একা চলাফেরা করতে পারি আমি।তুমি চিন্তা করো না।পৌঁছে আগে তোমায় ফোন দেবো।এখন দ্রুত চাবি দাও সময় নেই।
ইরা:-আচ্ছা,দিচ্ছি ওয়েট।
ইরা বাইকের চাবিটা ড্রয়ার থেকে বের করে মাহার হাতে ধরিয়ে দিলো।সাবধান করে বললো;
ইরা:-বেশি স্পিডে চালাবে না।আস্তে ধীরে চারপাশ দেখে তারপর চালাবে।গিয়ে ফোন দিয়ো প্লিজ।নয়তো তোমার সাথে আমিও বকা খাবো।তোমার ভাই আস্ত রাখবে না আমাকে।
মাহা:-ডোন্ট ওয়ারি।আমি দেখে শুনে যাবো।আপ্পি যদি আমার কথা জিজ্ঞেস করে তাহলে বলো যে আমি হসপিটালে গেছি।ফিরতে দেরি হবে।আর আমার পুচকু দুটোকে দেখে রেখো।আসি আমি।
ইরা:-আচ্ছা।আর হ্যা শুনো,***হসপিটালের ৫ তলা কেবিন নং ***।ডানপাশের করিডর দিয়ে বামে গেলেই কেবিনটা পেয়ে যাবে।তারপরও যদি না পাও তবে কাউকে ফোন দিয়ে তোমাকে এসে নিয়ে যেতে বলবা।কেমন?
মাহা:-আচ্ছা ভাবী আচ্ছা।তোমার সকল কথা শুনবো।এখন আমি যাই।
মাহা চাবি হাতে নিয়ে বাসার বাহিরে দ্রুত বেরিয়ে এলো।তারপর গ্যারেজ থেকে বাইক বের করে তাতে ওঠে বসলো।ফুলমতি হটপটদুটো ও থালাবাটি চামচ সব একটা ব্যাগে ভরে এনে মাহার হাতে দিলো।মাহা ব্যাগটা বাইকের নিচে ঝুলিয়ে রাখলো।
ইন্টারে আরাফাতের কাছ থেকে বাইক চালানো আয়ত্ত করেছিলো সে।আরাফাত খুবই যত্নসহকারে তাকে বাইক চালানো শিখিয়েছে।বলেছে,সময় বের করে তাকে কার ড্রাইভ করাও শিখাবে।আরাফাতের সাথে কাটানো সেই দুষ্টু মিষ্টি মুহূর্তগুলো চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে মাহার।মুহূর্তেই চোখ জোড়া ছলছল করে ওঠে।দ্রুত টিস্যু দিয়ে চোখ দুটো ভালো করে মুছে মাথায় হেলমেট গলিয়ে দিলো সে।এখন এভাবে কান্না করা তার শোভা পায় না।নিজেকে স্ট্রং রাখতে হবে।এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না।
দক্ষ হাতে ইগনিশনে চাবি ঢুকিয়ে বাইক স্টার্ট করে ফুলমতিকে সবদিক খেয়াল রাখতে বলে রওনা দিলো মাহা।সে নিশ্চিত কেউ এখনও একটা দানাও মুখে তুলে নি।এখন সে যদি গিয়ে তাদের জোর না করে,তবে ওরা কেউই সারাদিনে কিছু খাবে না।এমন অবস্থায় কিছু খেতেও মন চাইবে না কারও।কিন্তু খেতে তো হবেই!নয়তো এমন সিচুয়েশনে কীভাবে টিকে থাকবে ওরা?
বাইক হাইয়েস্ট যতোটা স্পিডে চালালে কোনো অসুবিধা হবে না ঠিক ততোটাই স্পিডে চালাচ্ছে মাহা।ওর কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই,এজন্য রাহাত ওকে বাইক ধরতেও দেয় না।মাহার একটা বাইসাইকেল আছে অবশ্য।কিন্তু বাইক চালানো আয়ত্তে থাকলে তখন আর সাইকেল চালাতে কারও ইচ্ছে করে না,বিষয়টা মাহার ক্ষেত্রেও ঘটেছে।মাহার এখন বাইক চালাতেই বেশ ভালো লাগে।
প্রায় পঁচিশ মিনিটের মাথায় হসপিটালে পৌঁছে গেলো মাহা নিরাপদেই।মাঝ রাস্তায় একবার ট্রাফিক পুলিশ দেখেছিলো,এই সময়টায় একবারও থামে নি সে।স্পিড বাড়িয়ে ক্রস করে গেছে।পুলিশ একবার থামাতে পারলে তার আর রক্ষে ছিলো না।লাইসেন্স ছাড়া বাইক চালানোতে তার জরিমানা অথবা জেল হতে পারতো।
পার্কিং লটে বাইক পার্ক করে পকেটে চাবি ঢুকিয়ে হসপিটালের ভেতর প্রবেশ করলো সে।শুধু মানুষ আর মানুষের ভীড় হসপিটালে।এত মানুষ জন দেখে মাহা ভেবে পায় না যে সবাই কী একযোগে অসুস্থ হয়ে গেছে?রোগী একজন হলে রোগীর আত্মীয় স্বজন মিলে প্রচুর।হসপিটালে মানুষের এত গাদাগাদি মেনে নেয়া যায় না।
মাহা ফোন বের করে প্রথমে ইরাকে কল করে নিশ্চিত করলো যে সে ঠিকঠাক মতো হসপিটালে এসে পৌঁছেছে।মাহা ঠিকভাবে গেছে শুনে ইরাও স্বস্তি পেল মনে।মাহার মতো ইরাও রাহাতকে ভয় পায় ভীষণ।এজন্যই এত চিন্তায় ছিলো।
মাহা ইরার বলা কথা অনুযায়ী লিফটে চড়লো।কিছুক্ষণ পর পঞ্চম তলায় এসে পৌঁছাতেই নির্দেশনা মতো একটু খুঁজতেই প্রথমে রিয়াজের দেখা পেল।রিয়াজ মাহাকে দেখে হা করে তাকিয়ে আছে।এই মুহূর্তে মাহাকে সে এখানে আশা করে নি।মাহা এগিয়ে এলো রিয়াজের কাছে।রিয়াজের চোখ লাল হয়ে আছে।দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে সারারাত ঘুমায় নি।রিয়াজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো;
রিয়াজ:-মাহা,তুমি এখানে?একা এসেছো নাকি?
মাহা:-হ্যা ভাইয়া,আমি একাই এসেছি।
রিয়াজ:-ওমা একা আসতে গেলে কেন বোন?রাহাত ভাই শুনলে বকবে তো তোমায়!
মাহা:-বকলে বকুক।না এসে মন মানছিলো না তাই এভাবেই একা একা চলে এসেছি।
রিয়াজ:-ওহ,,নুশু কী করে?ও কী ঠিকঠাক মতো খাওয়া দাওয়া করেছে?তোমার বোন তো আবার আমার কথা শুনে না।রাতে আমি তাদেরকে এ অবস্থায় ফেলে যেতে পারি নি।
মাহা:-না ভাইয়া টেনশন নিয়েন না।আপ্পি রাতে খেয়েছে ঠিক মতো।আর এখনও ঘুমাচ্ছে মনে হয়। আসার সময় জাগাই নি।ভাবীকে বলে এসেছি।
রিয়াজ:-হাতে কীসের ব্যাগ?
মাহা:-নাশতা নিয়ে এসেছিলাম।জানি আপনারা কেউ এখনও খান নি।আর মামণি বা বাবাই নিশ্চিত কিচ্ছুটি মুখে তুলেন নি।তাই নিয়ে এলাম জোর করে খাওয়াবো বলে।
রিয়াজ:-ভালো করেছো।তুমি বরং আইসিইউর ওখানে না গিয়ে মা ও আন্টির কাছে যাও।
মাহা:-আরাফাত ভাইয়ার কোনো আপডেট পেলেন?
রিয়াজ হতাশা মিশ্রিত সুরে বললো;
রিয়াজ:-নাহ,কোনো উন্নতি হয় নি।যেমন ছিলো তেমনই আছে।ডক্টররা তাদের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করছেন।বাকিটা আল্লাহ ভরসা।
কথাটা শুনে মাহার কলিজা মোচড় দিয়ে ওঠলো।নিজেকে সামলানো যে বেশ কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে মাহার জন্য।ভালোবাসার মানুষের আজ এই হাল,সে যে নিজেকে এখনও যথেষ্ট স্ট্রং রেখেছে তা-ই তো ঢের!ক’জনই বা পারে এভাবে নিজেকে শক্ত করে রাখতে।মাহার মনের ভেতর সিডর আইলা ফণী সব তুমুল ঝড় চলছে।বাইরে তা প্রকাশ করছে না সে।নিজের আবেগ,দুঃখ-কষ্ট লুকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে মাহাকে নোবেল দেয়া যাবে।খুবই সুনিপুণ ভাবে নিজের ইমোশন লুকাতে পারে সে।মাহা ছোটবেলা থেকেই এরকম।
মাহা:-লামিয়ার কী কোনো ব্যবস্থা হয়েছে ভাইয়া?আলভীর বাসায় কী পেয়েছিলে ওকে?
মাহার প্রশ্ন শুনে রিয়াজ জবাব দিলো;
রিয়াজ:-ওহ হ্যা,বলতে ভুলে গেছিলাম তোমাকে।ওর ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে।
এই বলে রিয়াজ গতকালকের সমস্ত ঘটনা খুলে বললো মাহাকে।চুপচাপ সব শুনে মাহার ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম একটা হাসি ফুটে ওঠে নিমিষেই মিলিয়ে যায়।
মাহা:-খুবভালো হয়েছে।এখন সে বুঝতে পারবে কত ধানে কত চাল!
মাহা আর এক্সট্রা কোনো কথা না বলে ছোটখাটো একটা টিফিন বাটি বের করে রিয়াজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো;
মাহা:-যাকগে,এখানে রুটি ভাজি ও মাংস আছে।আলাদা করে নিয়েছিলাম আপনার জন্য।খেয়ে নিবেন।এবং খেয়ে সাইফ ভাইয়াকে জানিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বাসায় চলে যান।তারপর গোসল সেড়ে খেয়ে দেয়ে আবার আসবেন পরে।
রিয়াজ মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো মাহার কথার।টিফিন বক্সটা হাতে নিয়ে চলে গেল ক্যান্টিনে খাওয়ার জন্য।মাহা আইসিইউর ওখানে না গিয়ে কেবিনে চলে গেল,যেটাতে মিসেস মুমতাহিনাকে রাখা হয়েছে।
মিসেস মুমতাহিনা বিলাপ করে কান্না করছিলেন,মাহাকে দেখতে পেয়ে তিনি এবার একটু জোরেশোরেই কেঁদে ফেললেন।মাহা দ্রুত এগিয়ে এলো ওনার কাছে।মিসেস মিনারা মেয়েকে দেখে অবাক হলেন প্রচুর কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার স্কোপ পেলেন না।মিসেস মুমতাহিনা হাউমাউ করে কান্না করে উঠলেন মাহাকে জড়িয়ে ধরে।
মিসেস মুমতাহিনা:-মাহা রে!আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে রে মাহা!আমার ছেলেটার এ কী অবস্থা হলো রে!আমি সহ্য করতে পারছি না রে মাহা!আমার ছেলেটার কাছে আমারে নিয়ে যা না রে মা!আমার ছেলেটাকে না দেখে আমি আর থাকতে পারছি না।এ দিনটা দেখার আগে আল্লাহ আমাকে তুলে নিলেন না কেন?আল্লাহ আমার ছেলেরে তুমি আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।নইলে আমিও যে মরে যাবো!
একজন মা জানে তাঁর সন্তানের একটুখানি আঘাত লাগলেও মায়ের মনে কেমন কষ্ট হয়!সেখানে আজ আরাফাতের এই অবস্থা,একজন মা হয়ে তিনি কীভাবে বিষয়টা সহ্য করবেন?মাহা জানে আরাফাত তার মায়ের ঠিক কতোটা আদরের!আরাফাত যখন পরিবারে লামিয়ার কথা বলেছিলো তখন কোনো কিছু চিন্তা না করেই মিসেস মুমতাহিনা মত দিয়ে ফেলেছিলেন।কারণ তিনি তার ছেলের সুখকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন সর্বপ্রথমে।মি.এরশাদ প্রথমে রাজি ছিলেন না কিন্তু বউয়ের চোখ রাঙানি দেখে আমতা আমতা করে রাজি হয়েছিলেন।আরাফাত এতটাই আদরের তার মায়ের।
মিসেস মুমতাহিনার এমনতর কান্না দেখে যে কারোরই কান্না চলে আসবে।লিসা তো আগে থেকেই কান্না করছে।ওদের কান্না দেখে মিসেস মিনারাও কাঁদছেন।মাহা সান্ত্বনা দেয়ার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।তার নিজেরই বড্ড সান্ত্বনার দরকার।এই দুঃস্বপ্ন কবে কাটবে জানা নেই কারও।মাহার চোখ জোড়া থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই সাথে সাথে মুছে ফেললো সে।নিজেকে স্বাভাবিক করে মিসেস মুমতাহিনার চোখের জল দুহাত দিয়ে ভালো করে মুছে দিলো সে।কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বললো;
মাহা:-মামণি!ভরসা করো তো আল্লাহকে?হুম?
মিসেস মুমতাহিনা মাহার প্রশ্ন শুনে কান্না থামিয়ে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন মাহার দিকে।কান্না কোনোমতে থামলেও হেঁচকি ওঠছে বারবার।মাহা আবারও জিজ্ঞেস করলো;
মাহা:-কী হলো মামণি?বলো?বিশ্বাস আছে তো আল্লাহ তায়া’লার ওপর?
মিসেস মুমতাহিনা ধীরে ধীরে মাথা ঝাকালেন।মাহা এবার স্মিত হেসে বললো;
মাহা:-জানো তো,আমিও কিন্তু তোমাদের মতো আরাফাত ভাইয়াকে প্রচুর ভালোবাসি।কিন্তু দেখাে আমি কী বারবার এমন কান্না করছি তোমাদের মতো?না কাঁদছি না!কারণ আমার বিশ্বাস আছে আল্লাহর ওপর।আমি ভরসা করি ওনাকে।এবং এই ভরসাও আছে যে ওনি খুব জলদি আমার আরাফাত ভাইয়াকে সুস্থ করে দেবেন।মানুষ কিন্তু আল্লাহকে ভরসা করে বাঁচে।তো আমাদেরও তো উচিৎ ওনার ওপর আস্থা রাখা?কী বলো?এখন তোমরা যদি আরাফাত ভাইয়ার জন্য দোয়া না করে শুধু কান্নাই করতে থাকো,তাহলে কী ভাইয়া সুস্থ হয়ে যাবে?কাঁদলেই কী সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে মামণি?তুমি জানো তোমার এই কান্নাকাটির ফলে ভাইয়ারও কষ্ট হচ্ছে!ভাইয়া স্বস্তি পাচ্ছে না মামণি।একটু বোঝার চেষ্টা করো!
মিসেস মুমতাহিনা ছেলের কষ্টের কথা মনে করে এবার নিরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।হেঁচকি তুলে তুলে বললেন;
মিসেস মুমতাহিনা:-মা রে,আমার ছেলেটা কালই আমার সাথে হাসিমুখে কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছিলো,তারপর এসব কী থেকে কী হয়ে গেলো রে মা!কীভাবে সহ্য করি আমি?আমার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!বারবার আমার বাচ্চাটার কথা মনে পড়ছে আমি কীভাবে নিজেকে বুঝ দিবো?
মাহা তার মামণির মাথা নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বললো;
মাহা:-মামণি জানো তো একজন মায়ের দোয়া তার সন্তানের জন্য কখনো বিফলে যায় না।তুমি মনেপ্রাণে শুধু আল্লাহর কাছে তোমার ছেলের সুস্থতা চাও!দেখবে খুব দ্রুতই আরাফাত ভাইয়া রিকোভার করবে।নিজেকে এভাবে ভেঙে পড়তে দিও না মামণি।ভাইয়ার কথা মনে করে এটলিস্ট নিজেকে সামলে নাও।কাঁদতে কাঁদতে যদি তুমিই অসুস্থ হয়ে যাও তবে আল্লাহর কাছে আরাফাত ভাইয়ার সুস্থতা চাইবে কে?হুম?মায়ের দোয়া সবার আগে কবুল হয় তুমিই তো বলতে সবসময়!তাহলে এখনই নিজেকে কন্ট্রোল করে নাও।মোনাজাতে নিরবে চোখের পানি ফেলো তাহলে কাজে দেবে।এভাবে কান্না করলে মোটেও লাভ হবে না।
মিসেস মুমতাহিনা মাহার বলা কথা গুলো শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠলেন যেন।ওনার চোখের তারায় জ্বলে উঠে আশার প্রদীপ।মাহার দিকে তাকিয়ে বললেন;
মিসেস মুমতাহিনা:-কিন্তু আমি তো গোসল করি নি,জায়নামাজ আনি নি,কিছুই তো আনি নি।এখানে নামাজ পড়ারও তো জায়গা নেই।তাহলে কীভাবে পড়বো?
মাহা:-চিন্তা করো না,আমি ব্যবস্থা করে দেবো সব।এখন সবার প্রথমে যে কাজ করতে হবে তা হল তোমাদের কিছু খেতে হবে।আমি খাবার নিয়ে এসেছি,কোনো অজুহাত ছাড়া খেয়ে নিবে।কারণ এখন যদি তোমরা না খেয়ে দুর্বল হয়ে যাও তবে ভাইয়ার সেন্স ফিরে আসার পর তোমরা কেউই ওনার কাছে যেতে পারবে না অসুস্থ শরীর নিয়ে।তাই বলছিলাম এক্ষুনি খেয়ে নাও।
মিসেস মুমতাহিনা:-খেতে ভালো লাগছে না মা।জোর করে খেতে পারবো না।
মাহা দৃঢ় কন্ঠে বললো;
মাহা:-তোমার কোনো কথা শুনছি না মামণি।খেতে তো হবেই।তুমি না খেলে বাবাই ও খাবে না,সাইফ ভাইয়াও খাবে না,লিসাও খাবে না।তো,তুমি কী চাও তোমার জন্য এতগুলো মানুষ না খেয়ে থাকুক?
মিসেস মুমতাহিনা আর কিছু বললেন না।মাহা হটপট সহ একটা ব্যাগ নিজের মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বললো;
মাহা:-আম্মু,প্লেট,চামচ,বাটি,যাবতীয় সব আছে এখানে।কষ্ট করে একটু বের করবে?
মিসেস মিনারা বোদ্ধার মতো মাথা ঝাঁকিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে সব বের করতে লাগলেন একে একে।লিসার মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে কাঁদতে কাঁদতে দুর্বল হয়ে পড়েছে সে।মাহা লিসার গালে হাত রেখে আদুরে কন্ঠে বললো;
মাহা:-বুদ্ধু একটা,দেখতো কেঁদেকেটে নিজের কী হাল করেছিস?এত কাঁদতে হয় বল?কোথায় তুই মামণিকে সামলে রাখবি এখন দেখা যাচ্ছে তোকে সামলাতেও একজনের দরকার পড়বে।পাগল একটা যা গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আয়,নাশতা করবি।
লিসা ভাঙা নিরস কন্ঠে জবাব দিলো;
লিসা:-আপু আমি কিছু খেতে পারবো না এখন।আমি খাওয়ার মতো শক্তি পাচ্ছি না।
মাহা:-তোর কিচ্ছু করতে হবে না।তুই গিয়ে বরং হাতমুখ ধুয়ে আয় আমি তোকে এবং মামণিকে নিজের হাতে খাইয়ে দিবো।যা বোন।দেরী করিস না।
লিসা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওঠে গেল ওয়াশরুমে।ছোটখাটো একটা কেবিন নিয়েছে সাইফ।শুধু মিসেস মুমতাহিনা সেন্সলেস হয়ে গেছেন দেখে।নয়তো নিতে হতো না।ওদেরকে আসতে বারণ করেছিলো সে,কিন্তু ওরা তার কথা শুনলে তো!মিসেস মিনারা মিসেস মুমতাহিনাকে ধরে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলেন লিসা বের হওয়ার পর।
মাহা ডিম দিয়ে ভাজা ভাতে মুরগির মাংস নিয়ে মাখাচ্ছে।লিসা ওড়না দিয়ে মুখ মুছে এসে পাশে বসতেই মাহা ওর মুখে একনলা ভাত তুলে দিলো।
মিসেস মুমতাহিনা ফ্রেশ হয়ে আসতেই মাহা ওনাকেও নিজের হাতে খাইয়ে দিতে লাগে।মিসেস মিনারা শুধু অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছেন মেয়ের কাজকর্ম।যেটা তিনি নিজেই করতে পারেন নি সেটা এখন তার মেয়ে অনায়াসে করে দেখাচ্ছে।গতকাল থেকে জোর করেও ওদেরকে একটু পানিও খাওয়াতে পারেন নি ওনি।আর মাহা কিনা কয়েকটা সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে ওদেরকে পুরো বশ করে ফেলেছে।গর্বে বুক ফুলে ওঠে ওনার।
ওদেরকে খাওয়ানোর সময়টাতে সাইফ মি.এরশাদকে নিয়ে কেবিনে আসে।মি.এরশাদের চেহারার দিকে প্রায় তাকানোই যাচ্ছে না।অতিরিক্ত টেনশন করার ফলে ওনার বয়স যেন এই একদিনে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।সাইফ অবাক হলো মাহাকে এখানে দেখে।খুশিও হলো মাকে ও বোনকে খেতে দেখে।
সাইফ:-তুমি এখানে একা এসেছো নাকি মাহা?
মাহা নম্র কন্ঠে জবাব দিলো;
মাহা:-জ্বি ভাইয়া একাই এসেছি।
সাইফ:-ওহহ,একা এসে এভাবে ঠিক করো নি।আঙ্কেল ও রাহাত জানতে পারলে খুব বকবে তোমায়।
মাহা:-বকলে বকুক,কেয়ার করি না।আসার প্রয়োজন মনে হয়েছে তাই এসেছি।কারণ আমি জানতাম ওরা একফোঁটা পানিও খায় নি।ওদেরকে খাওয়াতেই আমার আসা।
মি.এরশাদ দুর্বল কন্ঠে বললেন;
মি.এরশাদ:-মা,তুই আমার ছেলের জন্য বেশি বেশি দোয়া করিস মা।আমার বাচ্চাটা যেন জলদি সুস্থ হয়ে যায়।আমার বাচ্চা যেন আমাদের কাছে ফিরে আসে।
মি.এরশাদের অবস্থা খুবই করুন।ছেলের শোকে ওনার মৃতপ্রায় অবস্থা।ততক্ষণে মাহারও ওদেরকে খাওয়ানো শেষ।হাত ধুতে ধুতে জবাব দিলো;
মাহা:-ইনশাআল্লাহ,আল্লাহ আমাদেরকে নিরাশ করবেন না।খুব দ্রুতই তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন।রিকোভার করতে তো একটু টাইম লাগে তাই না!সেই সময়টুকু আমাদের ধৈর্য্য ধরতে হবে বাবাই।দেখাে,আজকেই আল্লাহর রহমতে আরাফাত ভাইয়ার জ্ঞান ফিরে আসবে।আমি তোমাদের সবাইকে ছোট একটা দোয়া শিখিয়ে দিবো।সেই দোয়া হাঁটতে বসতে পড়তে থাকবে।দেখবে বালা মুসিবত সব কেটে গেছে।কালকে এই ঘটনার কথা শোনার পর থেকে আমিও পড়তেছি।তোমরাও ধুমসে পড়বে।অবশ্যই এই দোয়ার ফজিলতে আরাফাত ভাইয়া সুস্থ হয়ে যাবে।
__
চলবে …